অন্যান্য

জল পাথরের মেঘলা কাব্য; মেঘালয় ভ্রমনের বৃত্তান্ত (পর্ব-১)

শ্যাম সাগর মানকিনঃ এ এক জল পাথরের মেঘলা কাব্য যেনোবা। এখনো কানে নদী ঝর্ণার জল পাথরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার শব্দ লেগে আছে। অনুভূতিতে দোল খাচ্ছে মেঘের ভেতর ঢুকে গিয়ে মেঘ খোঁজার বিস্ময়। আহা জল! আহা পাথর! দুটোর যৌথটা মানুষকে কেমন মুগ্ধ করে দিতে পারে। মানবিক শরীর মস্তিস্ককে স্বর্গের মতন কাল্পনিক অসীম সৌন্দর্য্যের ভাবনায় ডুবিয়ে দিতে পারে। প্রকৃতির অংশ হয়েও প্রকৃতি বিযুক্ত মানুষ আমরা। অথচ প্রকৃতি আমাদের কখনোই মুগ্ধ করতে, প্রশান্তি দিতে কৃপণতা করেনি। এই জল পাথরের মেঘলা কাব্য আমার শিলং ভ্রমনের একান্ত অনুভূতিমালা।

ভারতের মেঘালয় রাজ্যের শিলং আর সহরা(চেরাপুঞ্জী) ঘুরতে গিয়েছিলাম এ বছরের অগাস্ট মাসে। যোয়েল চাকমা আর মনিরা ত্রিপুরার সাথে খানিকটা কাবাব মে হাড্ডি হয়ে সফরসঙ্গী হয়েছিলাম। কাবাব মে হাড্ডি বলার কারন, বিয়ের পর দুজনের বাইরে বেড়াতে যাওয়া আমার কাছে মধুচন্দ্রিমা বলেই মনে হচ্ছিলো। তাতে অবশ্য বেড়ানোর আনন্দে কমতি পড়েনি কারো, কেবল এ যুগলের একান্তে সময় কাটানো হলোনা! যাক গে সে সব কথা। বরং কি দেখে এলাম তাই বলি। তবে এও বলে রাখা প্রয়োজন সেখানকার বিভিন্ন জায়গা ঘুরে একটা ব্যাপার খুব করে মনে হল, ভাষা কিংবা চিত্রে মেঘালয়ের অপার সৌন্দর্য্য বুঝা মুস্কিলি নেহি, না মুমকিন হে। সে জন্য সময় ও সুযোগ হলে স্বশরীরে একবার হলেও বেড়াতে গিয়ে নিজের চোখে দেখা ও অনুভব করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

.মাওলিনং গ্রামে যোয়েল মনি
ঢাকা থেকে সিলেটের পথে বাসে রওনা দিয়েছিলাম ১৮ আগস্ট রাতে। ১৯ তারিখ ভোরে সিলেট শহর থেকে সিএনজিতে করে সকাল সকাল তামাবিল স্থল বন্দরে পৌছে গেলাম। ইমিগ্রেশনের কাজ সেরেটেরে ভারতের মাটিতে পা দিতে দিতে দশটা সাড়ে দশটার মতন বেজে গেলো। তখনো অবশ্য ভিনদেশে গেছি তেমন মনে হচ্ছিলোনা। ইদের আগে আগে বলে লোকজনের ভীড় খুব একটা ছিলোনা। ওপাশে গিয়ে ইমিগ্রেশনের কাজ সাড়তে খুব বেশিক্ষন লাগলো না। ভারতের পাশটার বন্দরের নাম ডাউকি। সেখানে থেকে হেটে ২০ মিনিটের মত লাগলো ডাউকি বাজারে পৌছাতে। দিনটা ছিলো রবিবার। শুক্রবার ছুটিতে অভ্যস্ত মানুষ আমরা, রবিবার বাজারের প্রায় সবকটা দোকান বন্ধ দেখে কিছুটাতো খটকা লাগবেই। রবিবারে ভারত ভ্রমনের মজাটা টের পেলাম যখন গাড়ি ভাড়া করতে যাবো তখন। ছুটির দিনে গাড়ি কম থাকায় স্বাভাবিকের থেকে প্রায় দুগুন বাড়িয়ে ভাড়া চেয়ে বসছে গাড়িচালকেরা। আমাদের পরিকল্পনায় ছিলো ডাউকির আশেপাশে যতগুলো দর্শনীয় স্থান রয়েছে সব দেখে নিয়ে ফিরবো স্নোংপেডাং গ্রামে। এখানেই আমাদের প্রথম রাত্রিযাপন হবে। স্বাভাবিক দিনগুলোতে কাছাকাছি সব জায়গা ঘুরে ফিরতে ১৫০০ থেকে ২০০০ রুপির মধ্যে হয়ে যায়। রবিবার বলে আমাদের গুনতে হলো ২৮০০ রুপি। সে জন্যই বলে রাখি চার-পাঁচ দিনের ভারতে ভ্রমনের ক্ষেত্রে রবিবারকে এড়িয়ে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
রিওয়াই লিভিং রুট ব্রিজ
বারোটা সাড়ে বারোটা নাগাদ রওনা হলাম রিওয়াই(riwai) এর লিভিং রুট ব্রিজ দেখতে। যেতে যেতে রাস্তায় কথা হচ্ছিলো আমাদের গাড়িচালক ডেভিডের সাথে। হিন্দি ভাষাটা বুঝতে খুব বেশি সমস্যা হয়না, তবে বলতে গেলেই অনভ্যস্ততার কারনে বিপত্তি বাঁধিয়ে ফেলি। আধো আধো করে জেনে নিচ্ছিলাম তাদের জীবনধারা। এদিকের লোকজন পর্যটনের উপর তাদের জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। ডেভিড আমাদের জানাচ্ছিলেন এদিকে কৃষি খুব একটা হয়না। তাদের দিকে গ্রামের ছেলে মেয়েরা অল্প বয়সেই বিয়ে করে ফেলে সে কথা জানাচ্ছিলো সে বিয়ে করেছে কিনা এমন প্রশ্ন করাতে। কমাস আগেই বিয়ে করেছে সেও। নতুন বিয়ে হয়েছে তা টের পেলাম ফোনে তার বউয়ের সাথে কথা বলার ধরণ শুনেই(হা হা হা)। যাক গে সে সব। রিওয়াই পৌছাতে ১ টার মতন বাজলো। নেমে খেয়ে নিলাম খানিকটা, পার্কিং এর কাছেই একটা খাবার দোকানে। তিনজন মিলে ৩০০ রুপিতেই সেরে ফেলা গেলা দুপুরের খাবার। অবশ্য যাদের খাবারের প্রতি বেশি ভালবাসা রয়েছে তাদের হয়তো এটুকুতে পোষাবেনা।

পার্কিং এর জায়গা থেকে ১৫-২০ মিনিট ধরে নিচে নামলেই জীবন্ত গাছের শেকড়ের সেই ব্রীজটা। মাথাপিছু দশ রুপি টিকেট কেটে যেতে হয় ব্রীজের কাছে। তবে ব্রীজের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকতে মানা রয়েছে। তার নিচ দিয়ে কলকল করে বয়ে গেছে একটা জলধারা। সেখানে নামা যায়, চাইলে গোসল সেরে ফেলা যাবে ঠান্ডা জলে। আমরা অবশ্য গোসলের প্রস্তুতি নিয়ে যাইনি বলে কিছুটা আক্ষেপ নিয়ে সেখান থেকে ফিরতে হয়েছে। সবুজে ঘেরা ছায়ামায়া দিয়ে জড়ানো জলের কলকল শব্দ ভেতরটাকে কেমন ছুঁয়ে দেয়, শান্তি লাগে। ব্রীজ পেরিয়ে ওপাড়ে আরো অনেকটা সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলে আরেকটা গ্রাম নহওয়েট। সেখানে দর্শনার্থীদের জন্য রয়েছে পাহাড়ের ধারে গাছের উপরে বাঁশের তৈরি ভিউ পয়েন্ট আর বাড়ি। সেখানে ঢুকতে জনপ্রতি ৩০ টাকা টিকেট কাটতে হয়। ভিউ পয়েন্ট থেকে বাংলাদেশ দেখা যায়। পাহাড়ের ধারে গাছের মাথায় বাঁশের তৈরি ভিউ পয়েন্ট থেকে পাহাড় দেখা বেশ রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছি বলে আমাদের কারোরই সময়ের দিকে খুব একটা খেয়াল ছিলোনা। এদিকে আমাদের খুঁজতে খুঁজতে নহওয়েট গিয়ে হাজির আমাদের গাড়ি চালক ডেভিড। ফেরার তাড়া দিলেন তিনি,অগত্যা………

মাওলিনং গ্রামের বাগান
আমাদের পরের যাত্রাস্থল এশিয়ার সবথেকে পরিচ্ছন্ন গ্রাম মাওলিনং। সেখানে পৌছালাম সোয়া তিনটা নাগাদ। গ্রামের প্রবেশমুখে গ্রামের ব্যবস্থাপনা কমিটিকে দিতে হলো ৫০ রুপি। এ গ্রামে কোন একদিন বেড়াতে আসবো তা ভেবেই রেখেছিলাম। সেটা সত্য হল, কিছুটা অবিশ্বাস্য লাগছিলো। গ্রামের এদিক ওদিক ঘুরতে লাগলাম। সত্যিই পরিচ্ছন একটা গ্রাম মাওলিনং। পুরো গ্রামে বাড়িতে বাড়িতে রাস্তায় এতো এতো ফুল-গাছপালা-অর্কিডের সমারোহ যে, গ্রামটাকে নির্দ্বিধায় একটা ফুল বাগানও বলা যেতে পারে। পরিচ্ছন্নতা রক্ষা করার জন্য সর্বত্র বাঁশের তৈরি ময়লা ফেলার ঝুড়ি রাখা আছে। ঝকঝকে দিনের আলোয় কেমন এক মোহনীয় হয়ে উঠেছিলো গ্রামটা। মুগ্ধতা নিয়ে গ্রামের চারপাশ ঘুরে বেড়ালাম।
বরহিল ঝর্ণা (পান্থুমাই)
উমক্রেম ঝর্ণার পানি বাংলাদেশে যাচ্ছে
উমক্রেম ঝর্ণা আর প্রাকৃতিক সুইমিংপুল
সেখান থেকে আমারা যাত্রা করলাম বরহিল ঝর্ণার দিকে। বাংলাদেশের থেকেও এই ঝর্ণা দেখা যায় যা পান্থুমাই নামে পরিচিত। বরহিল পৌছাতে পৌছাতে সাড়ে চারটার মতন বাজে। অনেক বড় একটা পাহাড় থেকে জলধারা আছড়ে পরছে নিচে প্রকান্ড প্রকান্ড সব পাথরে। এই ঝর্ণার জল বেয়ে চলে গেছে আমাদের বাংলাদেশে দিকে। ঝর্ণার সামনেই স্টিলের ব্রিজ থেকে মন ভরে দেখা যায় বরহিল ঝর্ণা। বরহিল ঝর্ণায় নামা যায়না।
আমরা বাংলাদেশ আর ভারতের সীমানা ঘেষেই ঘুরছিলাম। পরের যাত্রা উমক্রেম ঝর্ণা। আমরা যে সময়টাতে গিয়েছিলাম সে সময়টাতে ঝর্ণাগুলোর প্রবাহ কিছুটা কম ছিলো কোথাও কোথাও। উমক্রেম ঝর্ণা দেখে সে রকমই মনে হলো প্রবাহ কিছুটা কম হলেও, স্বচ্ছ পানি জমে সুইমিংপুলের মতন হয়ে আছে। চোখে মুখে জল ছিটালাম সেই প্রাকৃতিক সুইমিংপুলে। মন শীতল করে দেবার মতন ঠান্ডা জল গায়ে লাগতেই ভ্রমনের ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। সেখানে স্থানীয়রা গোসল করছে। এদিকে আমাদের গাড়িচালক ডেভিড তাগাদা দিচ্ছেন ফিরে যাবার। বেশিক্ষন থাকা হলোনা সেখানে। ফিরে চললাম আমাদের রাত্রি যাপনের জায়গা স্নোংপেডাং গ্রামে।

Back to top button