ছবিতে আগামীর স্বপ্ন নিকসেং ঘাগ্রার
তারুণ্য; ফটোগ্রাফি
শ্যাম সাগর মানকিনঃ শীতকাল, ময়মনসিংহ শহরে ভোর হয়ে আসছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো নিকসেং, ভোর ৫ টার মতন বাজে তখন। মোবাইল ফটোগ্রাফির নেশা তাকে জাগিয়ে রেখেছে। বন্ধুকে নিয়ে ছবি তুলতে যাবে বলে সারারাত ঘুমায়নি সে। নিজের ফোন নেই তাই বন্ধুর ফোন দিয়ে ছবি তুলবে বলে এমন ভোরে বন্ধুকে জাগিয়ে তুললো ঘুম থেকে। কিছুটা বিরক্তি নিয়ে তাকে সঙ্গ দিতে উঠতেই হলো বন্ধুকে। ময়মনসিংহ শহর থেকে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবার পথে কেওটখালী নামক এক জায়গায় নদীর উপর দিয়ে ট্রেনের যাওয়ার জন্য একটা পুল রয়েছে। সেখানে ছবি তুলবে বলে বন্ধুকে নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলো। মনে মনে কল্পনা করেছিলো কুয়াশাচ্ছন্ন সেই ট্রেনের পুল ধরে কেউ হেটে আসবে বা যাবে এমন একটা ছবি তুলবে। অপেক্ষা করতে করতে অনেকক্ষণ পেরিয়ে গেলো, ইতিমধ্যে সাথে থাকা বন্ধু বিরক্ত হয়ে গেছে। বার বার তাগাদা দিচ্ছে ফিরে যাবার। কিন্তু নাছোড়বান্দা ছেলেটি বেরিয়েছে যখন তখন ছবি না নিয়ে ফিরবেনা বলেই হয়তো পণ করে এসেছিলো। এক-দেড় ঘন্টা পর তার চাওয়া মতনই এক লোক চাদর গায়ে কুয়াশাচ্ছন্ন পুলের উপর দিয়ে অন্য পার থেকে হেটে আসছেন। সাথে সাথেই ক্লিক করা শুরু করলো নিকসেং। প্রায় ৩০-৩৫ টার মতন ছবি তুলেছিলো সেই একই দৃশ্যের। ছবি তোলার পর হোস্টেলে এসেই ঘুমিয়ে পড়লো সেদিন। উঠতে উঠতে একদম বিকেল। রাতে এডিট করা হয় ফোনে তোলা ছবিটা।
কয়েকদিন পর ফেসবুকের নিউজফিডে চোখ রাখতে গিয়ে খোঁজ পেলো ডেইলি স্টারের মোবাইল ফটোগ্রাফি ও সিনেমাটোগ্রাফি বিষয়ক ‘স্ন্যাপ এন্ড শ্যুট’ কন্টেস্ট চলছে। কিছুটা কৌতুহল বশত নিজের তোলা সেই ছবিটা জমা করে দেয় কন্টেস্টের ওয়েবসাইটে। তারপর চমকের পালা। একদিন ফোন পেলেন ডেইলি স্টার পত্রিকার স্ন্যাপ এন্ড শ্যুট আয়োজকদের কাছ থেকে। সেরা বিশ জনের মধ্যে রয়েছে নিকসেং ঘাগ্রার নাম। ঢাকায় ডাক পেলেন একদিনের ওয়ার্কশপে। সেখানে এসে আরো এক চমক অপেক্ষা করছিলো তার জন্য। প্রতিযোগীদের মধ্যে তার ছবি নির্বাচিত ও পুরস্কৃত হয়েছিলো সেরা ছবি হিসেবে। এই একই ছবি দিয়ে সে জিতে নিয়েছিলো আরো একটি প্রতিযোগিতার পুরস্কার।
ছবি তোলা নিয়ে এমন হাজারো গল্প রয়েছে নিকসেংর। ছবি তুলতে গিয়ে নিজের সাধের মোবাইল ফোন যে কতবার নষ্ট হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। তাছাড়া ছবি তোলার নেশায় প্রায় সময় বন্ধুদের উত্যক্ত করা যেনো নিয়মের মতন একটা ব্যাপার হয়ে গেছিলো তার কাছে। সব কিছুর পরেও কখনো ছবি তোলার জন্য তাকে দমিয়ে রাখা যায়নি। প্রকৃতির সাথে তার সখ্যতা ক্যামেরার ভাষায় যেনো আরো জীবন্ত হয়ে উঠতো।
ছবি তোলার প্রতি প্রচণ্ড ভালোলাগা নিকসেং ঘাগ্রার। ছবি তোলার নেশা স্কুলে থাকতেই শুরু হয়েছিলো তার। ফেসবুকে শখের মোবাইল ফটোগ্রাফি নামে এক গ্রুপে মোবাইল ফোনে তোলা ছবি দেখতে দেখতে ছবি তোলার প্রতি ভালবাসা জন্ম নেয়া। প্রথম দিকে নিজের ভিজিএ ক্যামেরা যুক্ত মোবাইল ফোনে টুকটাক ছবি তুলে সেই গ্রুপে পোস্ট করতো। সাথে সাথে প্রতিদিন ফটোগ্রাফি বিষয়ে বিভিন্ন নিবন্ধ পড়াশুনা চলতো অনলাইনে। ইউটিউবে দেখে দেখে শিখে নেওয়ার চেষ্টা চলতো ছবি তোলার নানান কায়দা কানুন। শুরুতে যা দেখে ভালো লাগতো তাই তুলে ফেলতো ফোনের ক্যামেরায়। কখনো নিজের কম মেগাপিক্সেলের ক্যামেরায় আবার কখনো বন্ধুদের একটু দামী ফোনের ক্যামেরায়। কখনো একা আবার কখনো বন্ধুদের নিয়ে বেড়িয়ে পড়তো ছবি তোলার জন্য। যে ফেসবুক গ্রুপে ছবি দেখে নিজে ছবি তোলার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছিলো সেই গ্রুপেই একদিন এডমিন হয়ে ঊঠেছিলো নিকসেং ঘাগ্রা।
ছবি তোলার নেশাকে ভালোবাসায় রুপান্তরিত করে ফেলেছে এই আদিবাসী তরুন। ছবি তোলা বা ফটোগ্রাফি নিয়ে আগামীর স্বপ্ন দেখে সে। ডেইলি স্টারের কন্টেস্টে জেতা ফোন দিয়ে হরদম চলে ছবি তোলার কাজ। এখনো নিজের ক্যামেরা হয়ে উঠেনি তার, তাই দূরে কোথাও বের হলে কাছের বন্ধু, ভাইদের কাছ থেকে ক্যামেরা নিয়ে ছবি তোলার কাজ সারে। বিশেষত ল্যান্ডস্কেপ ও লাইফস্টাইল ফটোগ্রাফির প্রতি ভাললাগা কাজ করে একটু বেশি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক প্রোফাইল ঘেটে দেখা গেলো বিভিন্ন সময় তোলা অসংখ্য ছবি ভরে আছে তার ওয়ালজুড়ে।
ফটোগ্রাফি নিয়ে বহুদূর যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর এ তরুন। মিউজিকের সাথেও তার সখ্যতা রয়েছে। গারো ব্যান্ড ‘আইয়াও’ এ ড্রাম বাজায় নিকসেং। ছোটখাট গড়নের এ গারো তরুনের মুখে সর্বক্ষণ এক চিলতে হাসি লেগে থাকে। নিজের নানান সীমাবদ্ধতাকে পাশ কাটিয়ে একদিন সফল হবেন এমন দৃঢ় সংকল্প তার চোখেমুখে বিচ্ছুরিত হয়।
ময়মনসিংহ পলিটেকনিকে ৩য় সেমিস্টারে পড়াশুনা করে নিকসেং ঘাগ্রা। পাশাপাশি অনলাইন ভিত্তিক YTVNEWS.TV তে কাজ করছে ফটোগ্রাফার হিসেবে। নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দা থানার বড়ুয়াকোনায় আদিবাসী গারো পরিবারে জন্ম তার। বাবা নিপন রিছিল ও মা পপি ঘাগ্রার সবার বড় ছেলে নিকসেং এর দুই ছোট ভাই রয়েছেবাবা মা দুজনই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরি করেন। তাদের কাছে প্রতিনিয়ত ইতিবাচক অনুপ্রেরণা নিকসেংর চলার পাথেয়।
আপনাদের জন্য নিকসেংর তোলা কিছু ছবি দেয়া থাকলো।