জাতীয়

মানবাধিকার পরিস্থিতিতে নাজুক অবস্থায় আদিবাসী নারী ও কন্যাশিশুরা : কাপেং ফাউন্ডেশন

বাংলাদেশে আদিবাসীদের মানবাধিকার পরিস্থিতিতে আদিবাসী নারী ও কন্যাশিশুরা খুবই নাজুক অবস্থায় রয়েছে। বিগত ছয় মাসে ২৩ জন আদিবাসী নারী ও কন্যাশিশু হত্যা, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, ধর্ষণের চেষ্টা, যৌন হয়রানি শিকার হয়েছে। ১ জুলাই, ২০১৮ প্রকাশিত বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কাপেং ফাউন্ডেশনের আধা বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বান্দরবান, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, ময়মনসিংহ, রাঙ্গামাটি ও ঢাকায় ২ জন আদিবাসী কিশোরীকে ধর্ষণের হত্যা ও অপর আরো ৪ নারীকে খুন, ২ জনকে দলগতভাবে ধর্ষণ, ৭ জনকে ধর্ষণ, ৫ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা এবং ৩ জনকে যৌন হয়রানি ও শারীরিক হামলা করা হয়। মে মাসে চট্টগ্রাম জেলার সীতাকু-ে দুই আদিবাসী ত্রিপুরা কিশোরীকে ধর্ষণের পর নৃশংসভাবে হত্যার লোমহর্ষক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। এছাড়া এপ্রিল ও জুন মাসে যথাক্রমে বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতে পৃথক দুটি ঘটনায় দুই জন ত্রিপুরা কিশোরী গণধর্ষণের শিকার হয়। সবচেয়ে হৃদয় বিদারক ঘটনার অভিযোগ উঠেছে গত জানুয়ারি মাসে রাঙ্গামাটি জেলার বিলাইছড়িতে দুই আদিবাসী মারমা বোনের মধ্যে একবোনকে ধর্ষণ ও আরেক বোনকে যৌন হয়রানির ঘটনা। জানুয়ারিতে ঘটনার পর আজ অবধি পিতামাতাসহ তাদেরকে রাঙ্গামাটি পৌরসভার ভেদভেদী এলাকার একটি ঘরে পুলিশ প্রহরায় অনেকটা অন্তরীণ করে রাখা হয়েছে। অপরদিকে দীর্ঘ ২২ বছর পরও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাংগঠনিক সম্পাদক কল্পনা চাকমার অপহরণের কোন হদিশ মেলেনি। তাকে নিরাপত্তা বাহিনী সদস্য কর্তৃক রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ির নিজ বাড়ি থেকে অপহরণ করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সমতল অঞ্চলের আদিবাসীদের উপর কমপক্ষে ৭০টি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা সংগঠিত হয়েছে । ৭০টি ঘটনায় ১২ জন আদিবাসী শিশু ও ২৩ আদিবাসী নারী ও কন্যাশিশুসহ ২০৯ জন আদিবাসী ব্যক্তি এবং ৭৪টি বাড়ি/পরিবার তল্লাসীসহ ১২৫টি আদিবাসী পরিবার মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছে। বিগত ছয় মাসে হত্যা, গণধর্ষণ, ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, শারীরিক নির্যাতন, অবৈধ গ্রেফতার ও আটক, সম্পত্তির ক্ষতিসাধন ও অবৈধভাবে ঘরবাড়ি তল্লাসী ইত্যাদি ঘটনার প্রত্যক্ষ করা গেছে।
বিগত ছয় মাসে আদিবাসীদের অবৈধভাবে গ্রেফতার, আটক ও ঘরবাড়ি তল্লাসী ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। চাঁদাবাজি, অবৈধ অস্ত্র ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের অভিযোগে আদিবাসী অধিকার কর্মীদের বিরুদ্ধে সাজানো মামলায় অবৈধ গ্রেফতার, জেলে প্রেরণ, ক্যাম্পে সাময়িক আটক ও নির্যাতন, ঘরবাড়ি তল্লাসী ইত্যাদি সংঘটিত হচ্ছে। বিগত ছয় মাসে ৯৬ ব্যক্তির বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ৩২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তল্লাসীর কোন আইনী দলিল বা কোন অভিযোগ ছাড়াই মধ্যরাতে ঘুম থেকে জাগিয়ে ৭৪টি ঘরবাড়ি তল্লাসী করা হয়েছে বলেও প্রতিবেদনে জানানো হয়।

প্রতিবেদনে আরো দেখা যায়, আদিবাসীদের ভূমি বেদখল, উচ্ছেদ ও জাতিগত সংঘাত ইত্যাদি হরহামেশাই ঘটে চলেছে, যা আদিবাসীদের জীবন ও জীবিকার উপর চরম দুর্গতি সৃষ্টি করে চলেছে। রাজশাহী জেলার পবা উপজেলার নয়াহাটা মহানানাখাল আদিবাসী গ্রামের ৪০ উরাও পরিবার চরম উচ্ছেদ আতঙ্কের মধ্যে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে। থানায় মামলা করতে গেলে পুলিশ মামলা নেয়নি। অন্যদিকে গ্রাম ছেড়ে চলে যাবার জন্য বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার সাতগজ্যাই চাক পাড়ার চাক গ্রামবাসীর উপর অবৈধ ভূমিদস্যু ও সশস্ত্র বাঙালি দুর্বত্তরা হুমকি দিয়ে চলেছে। ফলে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ চাক গ্রামবাসীরা গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। গত বছর জুন মাসে রাঙ্গামাটি জেলার লংগদুতে অগ্নিসংযোগ ও সাম্প্রদায়িক হামলার শিকার আদিবাসী পরিবারসমূহকে এখনো পুনর্বাসন প্রদান করা হয়নি। ক্ষতিগ্রস্ত তিন গ্রামের অধিবাসীরা ঝুঁপড়ি টাঙিয়ে কোন রকমে দিনাতিপাত করছে।

প্রতিবেদন নিয়ে আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সন্জীব দ্রং বলেন, ‘বিগত ছয় মাসে আদিবাসীদের উপর হওয়া মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা খুব উদ্বেগজনক। এমনিতেই বাংলাদেশের আদিবাসী অস্তিত্ব হুমকির মধ্যে রয়েছে, এমন করে চলতে থাকলে এদেশে আদিবাসীদের অস্তিত্বই থাকবেনা।’
তিনি আদিবাসীদের উপর ঘটে চলা মানবাধিকার লংঘনের ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় এনে বিচারের দাবী জানান।

কাপেং ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপক হিরন মিত্র চাকমা প্রতিবেদন নিয়ে বলেন, ‘বিগত সময়ে যে ধরনের মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা ঘটতো, তা কমেনি বরং বেড়ে চলেছে। আদিবাসী ও আদিবাসী নারীর উপর সহিংসতার ঘটনা প্রতিনিয়ত পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। ঘটনা পুনরাবৃত্তি হওয়ার কারন হলো বিচারহীনতার সংস্কৃতি। বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে পারলে আদিবাসীদের উপর মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা কমে যেতো।’

Back to top button