আঞ্চলিক সংবাদ

সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্মের বেদখলকৃত ভূমি ফেরত ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবিতে জনসমাবেশ ও আলোচনা সভা

সাহেবগঞ্জ বাগদাফার্মের নিরীহ আদিবাসী-বাঙ্গালীদের উপর সংঘটিত হামলার ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করে সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত এবং আখ চাষের নামে অধিগ্রহণকৃত ১৮৪২.৩০ একর বাপ-দাদার জমিতে আদিবাসী ও প্রান্তিক বাঙালি কৃষকদের আইনগতভাবে রেস্টোরেশনের মাধ্যমে জমি ফেরত দেয়ার দাবিসহ সাত দফা দাবিতে আজ সকালে মাদারপুর আদিবাসী গ্রাম, গোবিন্দঞ্জ, গাইবান্ধায় জন সমাবেশ ও আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে।

সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটি, জাতীয় আদিবাসী পরিষদ ও জনসংগঠন ঐক্য পরিষদ দিনাজপুরের যৌথ উদ্যোগে এবং উন্নয়ন সংগঠন কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট এসোসিয়েশন (সিডিএ), এএলআরডি, আরবান, কাপেং ফাউন্ডেশন, নাগরিক উদ্যোগ, প্লানেট এবং ল্যান্ড কোয়ালিশনের সহায়তায় এই জনসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে।

জনসমাবেশের শুরুতে গত ৬ নভেম্বর ২০১৬ তারিখে বাগদা ফার্মে পুলিশের হামলায় গুলিতে নিহত শ্যামল-রমেশ-মঙ্গলসহ বাগদা ফার্মের ভূমি আন্দোলনের সাথে জড়িত প্রয়াতদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।

সমাবেশে জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন বলেন, আদিবাসীরাও মুক্তিযুদ্ধে জীবন দিয়েছে কিন্তু তারপরেও আজ এই স্বাধীন দেশে কেন আমাদের জমি-জলা-জঙ্গল হারাতে হচ্ছে। আমরা শুনতে পেরেছি যারা সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্মে হত্যাযজ্ঞের নেপথ্যের নায়ক ছিল আগামী নির্বাচনে তারা নাকি আবারো নির্বাচন করতে চায়। আমি আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডকে জানাতে চাই আপনারা যদি আবারো আবুল কালাম আজাদকে নমিনেশন দেন তাহলে বাগদা ফার্মের আদিবাসী-বাঙ্গালিরা রাজপথ অবরোধ করবে ও তাকে ভোট দেবেনা। তিনি আরো বলেন, আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক আমাদের সাথে ঢাকায় আলোচনা করে প্রতিশ্রতি দিয়েছিলেন বাগদা ফার্মের সমস্যার সমাধানে দ্রত ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু তার কোন সুফল আমরা পায়নি। অনতিবিলম্বে আমরা এই সমস্যার সুন্দর সমাধান এবং আদিবাসীদের উপর হামলার ঘটনায় যারা হত্যার শিকার হয়েছেন তাদের যথেষ্ট ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।

সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সভাপতি ডা. ফিলিমন বাস্কে বলেন, সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্মের ১৮৪২.৩০ একর সম্পত্তি উদ্ধারের জন্য আমরা গত কয়েক বছর ধরে লড়াই সংগ্রাম করে যাচ্ছি। কিন্তু চিনিকলের নামে আমাদের সম্পত্তি এখনো অবৈধভাবে দখল করে রাখা হয়েছে। চিনিকল কর্তৃপক্ষের যেখানে আখ চাষ করার কথা সেখানে ধান, বেগুন, আলু এমনকি তামাক চাষ করা হচ্ছে লীজ প্রদানে মাধ্যমে। উল্টো নিজেদের পৈত্রিক সম্পত্তিতে আদিবাসী-বাঙ্গালিদের শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে হচ্ছে। অনতিবিলম্বে উক্ত জমি ফিরিয়ে দিয়ে মানবতার দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য সরকারের নিকট তিনি জোর আহ্বান জানান।

উন্নয়ন সংগঠন কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট এসোসিয়েশন-সিডিএ’র নির্বাহী পরিচালক শাহ-ই-মবিন জিন্নাহ্ বলেন, আজকে একটি ন্যায্য দাবিতে বাগদা ফার্মে আন্দোলন চলছে। আজ এই আন্দোলন শুধু বাগদা ফার্মের নেই। এটা গোটা উত্তরা লের আদিবাসী-বাঙ্গালিদের আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। তিনি আরো বলেন, সংবিধানের ৭ (১) ধারাতে বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ’ কিন্তু বাগদা ফার্মের উদাহরণ বলে এদেশের মালিকদেরকেই শোষণ করা হচ্ছে। আমি আবারো বাগদা ফার্মের আদিবাসীদের মৌলিক মানবাধিকার ফিরিয়ে দিতে সরকারের কাছে জোর দাবি জানাই।

সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম ভুমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সাধারণ সম্পাদক জাফরুল ইসলাম বলেন, বাগদা ফার্মে গত ৬ নভেম্বর ২০১৬ তারিখে যে হামলা হয়েছে সেটি একাত্তরের মানবতা বিরোধী অপরাধকেও হার মানিয়েছে। কারণ স্বাধীন দেশে দিনে দুপুরে মানুষের উপর অন্যায়ভাবে হামলা করে সাঁওতালদের হত্যা, নির্যাতন, বাড়ি-ঘরে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। আমরা ধারাবাহিক আন্দোলন করে যাচ্ছি। অনেকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু আমরা কোন বাধা বিপত্তি মেনে নেবনা। আমাদের জমিতে আমরা চাষবাস করবো, কেউ বাধা দিলে আমরা সেটি প্রতিহত করবো।

শহীদ শ্যামল হেমব্রমের ছেলে সাগর হেমব্রম, আমার বাবাকে যারা মেরেছে তাদের আমি বিচার চাই, আমার বাবার পৈত্রিক সম্পত্তি ফেরত চাই এবং বাবার হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে চাই।

সমাবেশে বক্তারা আরো বলেন, উত্তরাঞ্চলের আদিবাসী-বাঙ্গালিদের উপর নির্যাতন-নিপীড়ণের পেছনে ভূমি দখলই প্রধান কারণ। কারণ এখন পর্যন্ত যত ঘটনা ঘটেছে তার সবটাই ভূমিকে কেন্দ্র করে ঘটছে। সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্মের আদিবাসী-বাঙ্গালিদের ১৮৪২.৩০ একর সম্পত্তি, বিরলের কড়াদের ৪৮ একর জমি দখলের ঘটনার মতো অসংখ্য ঘটনা বিভিন্ন জেলায় অব্যাহত রয়েছে। এসব ঘটনায় প্রশাসন ও রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় প্রভাবশালী ভূমিদস্যুরা আদিবাসী ও প্রান্তিক বাঙ্গালিদের ভূমি জবরদখল করেই চলেছে। বক্তারা আরো বলেন, গত ৬ নভেম্বর ২০১৬ তারিখে বাগদাফার্মে হামলার পরে এখনো সেখানে আদিবাসী-বাঙ্গালিরা খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছে। পুলিশ ও চিনিকল কর্তৃপক্ষের দায়েরকৃত মিথ্যা মামলায় এখনো ক্ষতিগ্রস্থরা আতঙ্কিত জীবনযাপন করছে। বক্তারা অবিলম্বে সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্মের উদ্বাস্তু মানুষদের যথাযথ পুনর্বাসনসহ তাদের বাপ দাদার জমি ফেরতের দাবি জানান।

রবীন্দ্রনাথ সরেনের সভাপতিত্বে আয়োজিত এই সমাবেশে আরো বক্তব্য রাখেন, আফজাল হোসেন, খয়রাত হুসাইন; খন্দকার জিল্লুর রহমান; তাজুল ইসলাম, গোলাম মোস্তফা তারা, জয়নাল আবেদন মুকুল, রমজান আলী, লরেন্স বেগ, লালমোহন বর্মন, গণেশ মুর্মু, সুফল হ্রেমব্রম, থমাস হেমব্রম, জাফরুল ইসলাম, বার্নাবাস টুডু, রেজাউল করিম, স্বপন শেখ, যোসেফ হেমব্রম, লুৎফর রহমান, জোহন মুরমু প্রমুখ।
সমাবেশে উত্থাপিত সাত দফার অন্যান্য দাবিগুলো হচ্ছে: উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় আদিবাসী ও ভূমিহীন দরিদ্র ক্ষমতাহীনদের মানবাধিকার লংঘনের ঘটনার সাথে জড়িতদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক বিচার; ক্ষতিগ্রস্থ আদিবাসী-বাঙ্গালিদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করা এবং আদিবাসী-বাঙ্গালি নারী-পুরুষের উপর স্থানীয় সন্ত্রাসীদের জুলুম ও পুলিশী হয়রানি বন্ধ করা; আদিবাসীদের সম্পত্তি কোন সরকার/কর্তৃপক্ষ কর্তৃক রিক্যুইজিশন (Requisition) করা এখতিয়ার কহিভর্‚ত হওয়ায় এ ধরণের কার্য বাতিল ও সমতলের আদিবাসীদের ভূমি সংকট নিরসনে পৃথক ও স্বাধীন ভূমি কমিশন গঠন করা; ১৯৪৮ সালের The East Bengal (Emergency) Requisition of Property Act 1948 (No. VIII of 1948) মোতাবেক যে কার্যের জন্য (ইক্ষুচাষ) গ্রহণ হয় তা না করা হলে খেসারতসহ পূর্বমালিক আদিবাসীদের ফেরতের বিধান বাস্তবায়ন করা; আদিবাসী সাঁওতালদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগকারী চিহ্ণিত পুলিশ কর্মকর্তাসহ জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি করা; ২০০৪ সালে সুগার মিল বন্ধের পর প্রভাবশালীদের মাঝে লিজের নামে যে অর্থ আত্মসাৎ ও দূর্নীতি হয়েছে সেই দূর্নীতিবাজদের চিহ্ণিত করে আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

Back to top button