সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবি করেছে সিপিবি-বাসদ
নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা:‘নির্বাচনকালীন সরকারের ক্ষমতা ও কর্তৃত্বকে সংকুচিত, অন্তর্বতীকালীন ও তত্ত্বাবধায়নমূলক কিছু কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে- এ বিষয়টি উল্লেখ করে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। কোন ধরনের সরকারের অধীনে নয়, নির্বাচন হতে হবে ‘নির্বাচন কমিশনের’ অধীনে। নির্বাচনের আগে পার্লামেন্ট ভাঙতে হবে।’
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) জোট আয়োজিত ‘নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার’ বিষয়ক মতবিনিময় সভায় উত্থাপিত ধারণাপত্রে একথা বলা হয়।
আজ ১৮ এপ্রিল সকাল ১১টায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট-এর সেমিনার কক্ষে বাসদ সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান-এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় ধারণাপত্র উত্থাপন করেন সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। বক্তব্য রাখেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান, বিশিষ্ট কলামিস্ট, সাংবাদিক সৈয়দ আবুল মকসুদ, ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পংকজ ভট্টাচার্য, বিশিষ্ট গবেষক ড. বদিউল আলম মজুমদার, বিশিষ্ট আইনজীবী অ্যাড. রানা দাশগুপ্ত, নাগরিক ঐক্যের যুগ্ম আহ্বায়ক এস এম আকরাম, গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি এ্যাড. সুব্রত চৌধুরী, গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার সমন্বয়ক শুভ্রাংশু চক্রবর্তী, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীষ্টান ঐক্য পরিষদের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজল দেবনাথ প্রমুখ। মতবিনিময় সভা সঞ্চালনা করেন সিপিবি’র সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স।
ধারণাপত্রে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম জাতীয় সংসদে ‘এলাকাভিত্তিক একক প্রতিনিধিত্বে’র বদলে ‘জাতীয়ভিত্তিক সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব’ ব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবি জানান।
তিনি ভোটে দাঁড়ানো ও ভোট দেওয়ার সমঅধিকারের জন্য নির্বাচন ব্যবস্থায় মৌলিক সংস্কারের দাবি জানান। এ জন্য নির্বাচনী টাকার খেলা বন্ধ, প্রচারের সম-সুযোগ, সন্ত্রাস, পেশী শক্তির প্রভাব ও দুর্বৃত্তমুক্ত, নির্বাচনে ধর্ম-সাম্প্রদায়িকতা ও আঞ্চলিকতা অপব্যবহার বন্ধ, রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক চর্চা নিশ্চিত করার কথা উল্লেখ করেন। তিনি সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি নির্বাচন, ‘না’ ভোট, প্রতিনিধি প্রত্যাহারের ব্যবস্থা ও কঠোরভাবে নির্বাচনী আচরণ বিধি অনুসরণেরও দাবি জানান। তিনি এসব দাবি আদায়ের আগামী ২৮, ২৯ ও ৩০ এপ্রিল উপজেলায় পদযাত্রা-সমাবেশ, এরপর জেলায় জেলায় মতবিনিময় সভা ও ঢাকায় কনভেনশন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেন।
এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, গণতন্ত্রের শুরু অবাধ নির্বাচন। পার্লামেন্ট বহাল রেখে জাতীয় নির্বাচন হলে তা সুষ্ঠু হবে বলে আমি বিশ্বাস করি না। একদলের নেত্রী ইতিমধ্যে নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছেন অপরদিকে অন্যদল ঘর থেকে বের হতে পারছেন না। এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন বলছে তফসিল ঘোষণা ছাড়া আমরা কোন পদক্ষেপ নিতে পারছি না। নির্বাচনের আগে সরকারের মসজিদ কমপ্লেক্স, মন্দির নির্মাণসহ নানা প্রতিশ্রæতি দেওয়া বন্ধ করতে হবে। নির্বাচনকে প্রভাবিত করার জন্য এগুলো করা হচ্ছে। নির্বাচনে খরচ করা অর্থের উৎস খতিয়ে দেখা উচিত। তিনি সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবি সমর্থন করেন।
সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনবিহীন গণতন্ত্র ইমিটেশন অলংকারের মতো। আসল অলংকার ও ইমিটেশন অলংকারের মধ্যে যে তফাৎ রয়েছে, কারচুপির নির্বাচনের মাধ্যমে যে সরকার- পার্লামেন্ট হয় তাও মূল্যহীন ইমিটেশন অলংকারের মতো। তিনি বলেন, ভালো নির্বাচন করতে হলে ইসিকে গণতন্ত্রমনা ও শক্তিশালী হতে হবে এবং মেরুদণ্ড শক্ত করে দাঁড়াতে হবে। তিনি বলেন, শুধু নির্বাচন কমিশন নয় সকল দলকেও গণতন্ত্রমনা হতে হবে।
পংকজ ভট্টাচার্য বলেন, বর্তমান বাস্তবতায় সাধারণ মানুষের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে কোন আগ্রহ দেখছি না। নির্বাচন, গণতন্ত্র, সংসদ, রাজনীতি নিয়ে বিচ্ছিন্নতা লক্ষ্য করছি মানুষের মধ্যে। তিনি বলেন, নির্বাচনের আগে, মাঝে এবং পরে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার শুরু হয়। রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়ে যদি নির্বাচনী আইন সংস্কার করা না হয় তাহলে তা কোন কাজে আসবে না।
এ্যাড. রানা দাশগুপ্ত বলেন, ১ ব্যক্তি ১ ভোট এ দাবিতে পাকিস্তান আমলের ২৫টি বছর আমাদের আন্দোলন করতে হয়েছে। স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর এখনও আমরা চিন্তিত যে, এ ভোট আমি প্রয়োগ করতে পারব কি, না। স্বাধীনতার পর জাতীয় সঙ্গীত, পতাকা পাল্টালেও রাজনীতির কোন পরিবর্তন হয় নি।
ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, অতীতের মতো আবারো বিতর্কিত নির্বাচন হলে ভয়াবহ সংকট রোধ করা যাবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, এর মাসুল শুধু ক্ষমতাসীনদের নয় সকল দেশবাসীকেই দিতে হবে। তিনি বলেন, রাজনৈতিক সমঝোতা ও ঐক্যমত্য ছাড়া শুধুমাত্র শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।
এস এম আকরাম বলেন, নির্বাচনের পূর্বে জনগণের মধ্যে ভীতি তৈরী হচ্ছে। সরকার চায় ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করতে অপরদিকে বিরোধীদল চায় যেকোনভাবে ক্ষমতায় আসতে। আজ রাজনীতিতে দেশপ্রেমিকদের বড় অভাব উল্লেখ করে তিনি বলেন, আন্দোলনের মাধ্যমেই দাবি আদায় করতে হবে।
এ্যাড. সুব্রত চৌধুরী বলেন, সংস্কার শব্দটিতে সরকার প্রধানের আপত্তি। আগে শ্লোগান দিতাম, ‘আমার ভোট আমি দেব যাকে খুশি তাকে দেব’, তারপর ‘আমার ভোট আমি দেব, দেখে শুনে বুঝে দেব’। আর বর্তমানে দেখছি ‘আমার ভোট আমি দেব, তোমারটাও আমি দেব’।
শুভ্রাংশু চক্রবর্তী বলেন, বতর্মান সরকারের কাছে নিরপেক্ষ নির্বাচন প্রত্যাশা করা যৌক্তিক না। তিনি বলেন, কৃষক, শ্রমিকসহ নির্যাতিত জনগণকে সাথে নিয়ে আন্দোলনের মাধ্যমেই জনগণের আকাক্সক্ষার বাস্তবায়ন ঘটাতে হবে।
কাজল দেবনাথ বলেন, স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরেও আমরা ধর্মীয় সংখ্যালঘুই রয়ে গেলাম। আজ যখন নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অর্থবহ হওয়ার কথা উঠে তখনই বুঝা যায় নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িকতা নির্বাসিত হয়ে সাম্প্রদায়িকতা যেন একটি নিয়ামক বিষয় হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সামাজিক, রাজনৈতিক, সংবিধানে সাম্প্রদায়িক বিষয়গুলো নিষিদ্ধ করতে হবে। তিনি বলেন, এখন নির্বাচন মানে সংখ্যালঘুদের কাছে নির্যাতন, আতঙ্কের নাম।
সভাপতি বক্তব্যে বাসদ সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান বলেন, একটা সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পরিবেশ এখনও হয়নি। সাধারণ মানুষকে জিজ্ঞেস করলে এটা বুঝা যায়। তিনি বলেন, ব্যাংকসহ গোটা আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যবস্থাপনা লুটেরা গোষ্ঠীর দখলে। দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দুর্বৃত্তদের হাতে রাজনীতিক ক্ষমতা কুক্ষিত, মানবাধিকার লংঘনের চরম পরিস্থিতি বিদ্যমান, আইন-আদালত, প্রশাসনসহ সকল প্রতিষ্ঠান নির্বাহী কর্তৃত্বের অধীন এবং দলীয়করণের শিকার। গণতন্ত্রকে ভোটতন্ত্রে সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদীরা আজ সারা দুনিয়ায় দাঁড় করিয়েছে। ভোটতন্ত্রের সেই ভোট করতেও আমাদের শাষকশ্রেণি অপরাগতার পরিচয় দিয়েছে।
মতবিনিময় সভায় সিপিবি-বাসদ প্রস্তাবিত নির্বাচন সংস্কারের দাবিসমূহের সাথে ঐক্যমত্য পোষণ করে কিছু সংযোজনী প্রস্তাব করেন।