জাতীয়

আদিবাসী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর সকল হামলা-নির্যাতনের মূলে ভূমিদখল: মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যান

ভূমি সমস্যা দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা। ভূমি থেকে উচ্ছেদ করতে পারলেই দখল করা যায়। তাই সকল হামলা নির্যাতনের মূলে ভূমি থাকে। আজ ২৮ ডিসেম্বর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘‘বিশ্ব মানবাধিকার বনাম বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং আদিবাসীদের ভূমি অধিকার ও নিরাপত্তা’’ শীর্ষক গোলটেবিল সংলাপে প্রধান অতিথির বক্তব্যে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক এ কথা বলেন। তিনি বলেন, নারীদের উপর যে ধরনের নির্যাতন হচ্ছে সে বিষয়গুলো দেখলে মানবাধিকারের ক্ষেত্রে কোন অগ্রগতি চোখে পড়ে না। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার বিচার একদিন না এক দিন হবেই উল্লেখ করে তিনি পরিবর্তনের জন্য আমাদের সবাইকে এক যোগে কাজ করার আহ্বান জানান। অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন বাস্তবায়ন জাতীয় নাগরিক সমন্বয় সেল, এএলআরডি, আরবান, সিডিএ ও কাপেং ফাউন্ডেশন যৌথভাবে এ সংলাপের আয়োজন করে।
গোলটেবিল সংলাপে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রাণা দাশগুপ্ত। মূল প্রবন্ধে তিনি উল্লেখ করেন, আমাদের সংবিধানে বাংলাদেশ আছে পাকিস্তানও আছে, বঙ্গবন্ধু আছেন জিন্নাহ সাহেবও হারিয়ে যান নি। ধর্মের অপব্যবহার বা ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে বা তাদের সাথে মেলবন্ধনে তৃণমূলে সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধতাকে ছড়িয়ে দিয়ে রাষ্ট্র ও রাজনীতি লুন্ঠন ও জবরদখল প্রক্রিয়াকে অব্যাহত রেখেছে। এ থেকে উত্তরণে মুক্তিযুদ্ধ, গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের পক্ষে সকল শক্তিকে আজ ঐক্যবদ্ধভাবে ভাববার সময় এসেছে বলে তিনি তার প্রবন্ধে উল্লেখ করেন। অপর একটি উপস্থাপনায় এএলআরডি-র পক্ষ থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘটে যাওয়া হামলা, নির্যাতন ও উচ্ছেদের তথ্যানুসন্ধানী পর্যবেক্ষণের সারসংক্ষেপ তুলে ধরা হয়।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে আদিবাসী বিষয়ক সংসদীয় ককাসের আহ্বায়ক ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, ২২ পরিবারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে করতে বঙ্গবন্ধু দেশকে স্বাধীন করেছিলেন। সেই দেশে একটি গোষ্ঠী দেশের সম্পদ লুট করে বাজেটের সমপরিমান অর্থ বিদেশে পাচার করছে। সংবিধান রক্ষা করতে না পারলে দেশ প্রতিক্রিয়াশীলতার কানাগলিতে হারিয়ে যাবে।
আরেক বিশেষ অতিথি উষাতন তালুকদার বলেন, পাহাড়ে যেভাবে নির্যাতন হচ্ছে সেটার প্রতিকার না করতে পারলে সমস্যা বাড়বে বৈ কমবে না। বিচারহীনতার সংস্কৃতি যেটা চলছে তা বন্ধ করতে না পারলে সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্প্রদায়িক হামলা আরো ভয়াবহ রূপ নিবে। তিনি সম্পত্তিতে আদিবাসীদের প্রথাগত অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়া দাবি জানান।
ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত বলেন, সংবিধানে জনগণের অভিপ্রায়ে দেশ পরিচালিত হবার কথা থাকলেও এদেশে বিরাট জনগোষ্ঠী বৈষম্য, বঞ্চনা ও নানারকম নিপীড়নের শিকার। যারা অপেক্ষাকৃত দুর্বল তারা বৈষম্য, বঞ্চনা ও নিপীড়নের শিকার বেশি হয়। সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে দিন দিন দুর্বলতর অবস্থানে ঠেলে দেয়া হচ্ছে।
গবেষক ও অর্থনীতিবিদ স্বপন আদনান সকল দলের মধ্যে ভূমি গ্রাসীরা আছে উল্লেখ করে বলেন, জাতিগত বৈষম্য এবং সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রত্যেকটি ঘটনা ভূমি দখলকে কেন্দ্র করে হয়ে থাকে। । ধর্মনিরোপেক্ষ দেশ বলা হলেও প্রতিনিয়িত এই ধরনের ঘটনাই বলে দিচ্ছে সম্প্রদায়িকতা আমাদের দেশের চলমান বাস্তবতা।
হামলা নির্যাতনের ঘটনায় নারীরা সবচেয়ে বেশি ঝুকিপূর্ণ অবস্থায় থাকে উল্লেখ করে এ ধরণের আলোচনায় নারী প্রসঙ্গটিকে গুরুত্ব দেয়ার অনুরোধ করে এএলআরডি-র চেয়ারপার্সন ও নিজেরা করি-র সমন্বয়কারী খুশী কবির বলেন, এ দেশে শতশত বছর ধরে আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাস আছে। সেই সংগ্রামী মানুষের প্রতি আস্থা আমাদের রাখা প্রয়োজন, কোনো অবস্থাতেই আমরা এদেশকে সাম্প্রদায়িক শক্তির কাছে হারিয়ে যেতে দেবো না সেই অঙ্গিকার আমাদের করতে হবে।
মানবাধিকার কর্মী ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সুলতানা কামাল বলেন, যে দেশে মানবাধিকার বিরাজ করে সে দেশে শান্তি বিচাজ করে, শান্তিতে থাকতে পারে কিন্ত বর্তমান যে চিত্র দেখা যাচ্ছে তাতে দেশের মানবাধিকার বিরাজ করছে না। মানুষ ন্যায় বিচার পাচ্ছে না সকল সময় ভয়ে ভয়ে থাকে। বাংলাদেশ এখন ‘কেউ’ আর ‘কেউ না’ এই দুই দলে বিভক্ত। ৭২ সালের সংবিধানে যে ঘাটতি ছিল না তা নয়, কিন্তু সেখানে মৌলিক অঙ্গিকার ছিল ধর্ম, গোষ্ঠী ইত্যাদি পরিচয় ভেদে কেউ বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার হবে না। সেখান থেকে আমাদের বিচ্যুতি ঘটৈছে।
অনুষ্ঠানে দেশের কয়েকটি স্থানে হামলা ও নির্যাতনে শিকার ভুক্তভোগীদের কয়েকজন তাদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সুপ্রীম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী সুব্রত চৌধুরী, আরবান-এর নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ কামালউদ্দিন প্রমুখ।
এর আগে স্বাগত বক্তব্যে এএলআরডি-র নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা প্রান্তিক মানুষের মানবাধিকার সুরক্ষায় সরকারের পাশাপাশি দেশের বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিক পরিম-লের ব্যক্তিবর্গ, নাগরিক সমাজসহ সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।

Back to top button