পার্বত্য চুক্তির দুই দশক ও বাস্তবায়নের বর্তমান অবস্থাঃ বাচ্চু চাকমা
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২০ বছর পূর্ণ হতে চলেছে। যেখানে চুক্তির বর্ষপূর্তি পালনের কথা সাফল্য আর অর্জনের মধ্য দিয়ে; আনন্দ-উল্লাস, উৎসাহ আর উদ্দীপনার কোন প্রকার কমতি থাকার কথা ছিল না। একটি নিপীড়িত জাতির জন্য ২০ বছর জাতীয় জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া অনেক ক্ষতির ব্যাপার। চুক্তি স্বাক্ষরের দিনক্ষণে জন্ম নেওয়া একটি শিশু বর্তমানে টগবগে যুবক। সেই যুবক আজ নিজেই বুঝেছে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা একটি রাজনৈতিক সমস্যা। এই সমস্যা যথাযথ সমাধানের লক্ষে ১৯৯৭ সালে ২রা ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যেকার ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সুদীর্ঘ আড়াই দশক ধরে রক্ত-পিচ্ছিল পথ পাড়ি দিয়েছে এই জাতি; সেই সাথে যোগ হতে চলেছে ২০টি বছরের চুক্তি বাস্তবায়নের লড়াই সংগ্রাম; পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি ও রুঢ় বাস্তবতা প্রমাণ করে নিঃসন্দেহে জুম্ম জনগনের জাতীয় অস্তিত্ব বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। চুক্তি স্বাক্ষরের পর পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের মনে কিছুটা হলেও আশার আলো সঞ্চারিত হয়। পার্বত্যাঞ্চলের বঞ্চনা-সংঘাত অবসানের পর স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন জেগেছে মানুষের মনে। পার্বত্যবাসী মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেছিল; আশায় বুক বেঁধেছিল এই বুঝি চুক্তি বাস্তবায়িত হবে। দীর্ঘ ২০ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো এখনও যথাযথ বাস্তবায়িত হতে পারেনি। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের অন্তরে পুঞ্জিভুত ক্ষোভ দিন দিন ঘনীভুত হতে চলেছে।
বাংলাদেশ সরকারের সাথে যে আস্থা-বিশ্বাস নিয়ে জুম্ম জনগণ চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল সেটা আজ প্রতারণার উদাহরণে পরিণত হয়েছে। ইতিমধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণ হিসাব-নিকাশ শুরু করে দিয়েছে। অতীতের সংগ্রাম, সাফল্য, অর্জন, জুম্ম জনগণের উপর বারে বারে আঘাত, হত্যা, রক্তপাত, জ্বালাও-পোড়াও এসবের হিসাব-নিকাশ করে চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য চলমান আন্দোলনের চেয়ে আরো অধিকতর আন্দোলনে যাওয়ার কথা ভাবছে পার্বত্যাঞ্চলের জুম্ম জনগণ।
জুম্ম জনগণ জনসংহতি সমিতিরি নেতৃত্বে অতীতে যেমনি লড়াই-সংগ্রাম চালিয়েছে; তেমনি আগামীতেও সে লড়াই থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথ বাস্তবায়নের স্বার্থে চুক্তি-পরিপন্থী ও জুম্ম স্বার্থ বিরোধী যে কোন ষড়যন্ত্র প্রতিরোধ করতে জুম্ম জনগণ আজ দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২০তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে গত ২৯ নভেম্বর ঢাকায় আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি সন্তু লারমা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ২০১৬ সালে ঘোষিত দশদফা কর্মসূচির ভিত্তিতে অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাওয়া; পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী সকল কার্যক্রম প্রতিরোধ করা; এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে বৃহত্তর আন্দোলন সংগঠিত করার-তিন দফা ঘোষণা দিয়েছেন। পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা দেশের বৃহত্তর স্বার্থে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে কার্যকর ভূমিকা রাখার জন্য দেশের গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের প্রতিও তিনি আহ্বান জানিয়েছেন।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির দুই দশক অতিক্রান্ত হলেও পার্বত্যাঞ্চলের মানুষ দেখছে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি জুম্ম জনগণের বেঁচে থাকার ভিত্তি এখনও অনিশ্চিত অবস্থায় পড়ে আছে। এহেন পরিস্থিতি ও বাস্তবতায় চুক্তির বর্ষপূর্তি উৎযাপিত হচ্ছে তীব্র ক্ষোভ আর হতাশার মধ্য দিয়ে। কারণ ২০ বছর অতিক্রান্ত হলেও আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের কার্যাবলী হস্তান্তর ও কার্যকরকরণ এবং স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে ভোটার তালিক প্রণয়ন পূর্বক পার্বত্যবাসীর প্রত্যক্ষ ভোটাধিকারের ভিত্তিতে এসব পরিষদসমূহের নির্বাচন; পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ; অপারেশন উত্তরণসহ সকল অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার; ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি পূর্বক জুম্মদের বেহাত হওয়া জায়াগ-জমি ফেরত পাওয়া; প্রত্যাগত শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু পুনর্বাসন; পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন ও আঞ্চলিক পরিষদ আইন তথা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির সাথে সঙ্গতি বিধানকল্পে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রযোজ্য অন্যান্য আইন সংশোধন; পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল চাকরীতে জুম্মদের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়োগ; সেটেলার বাঙালিদের পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে যথাযথ ও সম্মানজনক পুনর্বাসন ইত্যাদি চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহ এখনও অবাস্তবায়িত অবস্থায় রয়েছে।
সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০০১-এর বিরোধাত্মক ধারাসমূহের সংশোধনের কাজ গত বছর যথাযথভাবে সম্পূর্ণ করলেও ভূমি কমিশনের বিধিমালা, জনবল নিয়োগ, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান জেলায় শাখা অফিস স্থাপন- এসকল কাজগুলো এখনও ঝুলে রয়েছে। তাছাড়া বর্তমান সরকার তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে কতিপয় বিষয় হস্তান্তর, ৩৫টি অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার, পার্বত্য চট্টগ্রাম কমপ্লেক্সে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন, চুক্তি মোতাবেক বিভিন্ন কমিটি গঠন ও এসব কমিটিতে চেয়ারম্যান-সদস্য নিয়োগ, সর্বশেষ পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন সংশোধন ইত্যাদি চুক্তির কিছু বিষয় বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা ধারাবাহিকতাহীন লক্ষ্য করা যায়। এছাড়াও জেলা আইন-শৃঙ্খলা, ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, পুলিশ (স্থানীয়), বন ও পরিবেশ ও অন্যান্য স্থানীয় শাসন সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানসহ গুরুত্বপূর্ণ ১৬টি বিষয় তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের নিকট হস্তান্তরের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। জনসংহতি সমিতি ও আঞ্চলিক পরিষদের পক্ষ থেকে চুক্তি বাস্তবায়নে সময়সূচি-ভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা (রোডম্যাপ) ঘোষণার জন্য বারে বারে সরকারের নিকট দাবী করা হলেও বস্তুত সরকার আন্তরিকতাপূর্ণ রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকার কারণে এই ন্যায়সঙ্গত দাবী চরমভাবে উপেক্ষিত হয়ে আসছে।
আমরা ইতিমধ্যে অবগত হয়েছি যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন না করে উন্নয়নের দোহাই দিয়ে রাঙ্গামাটি জেলায় ঠেগামুখে স্থল বন্দর স্থাপন, ঠেগামুখ-চট্টগ্রাম বন্দর সংযোগ সড়ক ও সীমান্ত সড়ক নির্মাণ, বিলাসবহুল পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন, রিজার্ভ ফরেস্ট ঘোষণা, অস্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি ও কোম্পানীকে ভূমি ইজারা প্রদান, এলোপাতাড়ী পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন ইত্যাদি কার্যক্রমের মাধ্যমে জুম্মদের চিরায়ত ভিটেমাটি থেকে চিরতরে উচ্ছেদের প্রক্রিয়া জোরদারভাবে এগিয়ে চলছে। জুম্ম জনগণের বিরোধিতা সত্ত্বেও রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজসহ তথাকথিত উন্নয়নের নামে সরকার রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে জোরপূর্বক বাস্তবায়ন করে চলেছে যার লক্ষ্য চুক্তি বিরোধী ও জুম্মস্বার্থ পরিপন্থী রাজনৈতিক ক্ষেত্র তৈরী করার কারখানা বলে পার্বত্যবাসী মনে করে।
পার্বত্য চুক্তির ‘ক’ খন্ডের ১নং ধারায় পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে বিবেচনা করে এই অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ এবং এই অঞ্চলের সার্বিক উন্নয়ন অর্জন করার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করা হয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সরকারের পক্ষ থেকে এই অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের জন্য যথাযথ কোন আইনী ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। পক্ষান্তরে, উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য’কে ক্ষুন্ন করার লক্ষ্যে বহিরাগত অনুপ্রবেশকারীদের পুনর্বাসন; জুম্মদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা; বহিরাগতদের পার্বত্য চট্টগ্রামের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তকরণ; ডেপুটি কমিশনার কর্তৃক স্থায়ী বাসিন্দার সনদপত্র প্রদান; ভূমি বেদখল; বহিরাগতদের নিকট ভূমি বন্দোবস্তী ও ইজারা প্রদান; জুম্ম জনগণকে সংখ্যালঘু করার লক্ষ্যে নতুন করে বহিরাগতদের অনুপ্রবেশ ঘটানো ইত্যাদি চুক্তির লংগনের কার্যক্রম অব্যাহতভাবে চলছে।
দীর্ঘ ২০ বছরের মধ্যে চারটি রাজনৈতিক সরকার ও দুটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার- মোট ছয়টি সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলেও কোন সরকারই চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহ বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়ে এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি। এমনকি চুক্তি স্বাক্ষরকারী অন্যতম রাজনৈতিক দল আওয়ামীলীগ ১৯৯৭ সালে ২রা ডিসেম্বর হতে ৩ বছর ৮ মাস সময় পার করেছিল; ২০০৯ সাল থেকে দীর্ঘ ৯ বছর ধরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকলেও চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহ বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে লক্ষ্য করা যায়নি। বস্তুত: দীর্ঘ আড়াই দশক ধরে রক্ত-পিচ্ছিল সংগ্রাম পথ পাড়ি দিয়ে পার্বত্যবাসীর অধিকার সনদ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি অর্জিত হয়েছে। চুক্তি বাস্তবায়নের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে ফ্যাসীবাদী কায়দায় দমন-পীড়নের যেকোন চক্রান্ত দেশের জাতীয় স্বার্থে কখনও শুভ ফল বয়ে আনতে পারেনা তথা পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের ক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের কোন বিকল্প পথও থাকতে পারেনা। সুতরাং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথভাবে বাস্তবায়নে সরকারের পক্ষ থেকে আন্তরিকতাপূর্ণ ও সদিচ্ছা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে; চুক্তির ২০ বছর পূর্তিতে প্রত্যাশা করি তাই হোক।