মতামত ও বিশ্লেষণ

আদিবাসীদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ এবং ভূমি সুশাসনের নিশ্চয়তা: রোবায়েত ফেরদৌস

“The LAND is the only thing in the world worth working for, worth fighting for, worth dying for, because it’s the only thing that lasts”
–Margaret Mitchell (Gone With The Wind)

“ অখণ্ড ভূমির এই পৃথিবী, স্বত্বাধিকারের স্বার্থে খণ্ডিত হয় ভূমি, সেই সাথে খণ্ডিত হয় মানুষের ভালোবাসা”
–নাট্যকার মামুনুর রশীদ (নাটক: সময়-অসময়)

মহামতি লেনিন বলেছিলেন, মানুষ তার পিতৃশোক ভুলতে পারে কিন্তু ভূমি হারানোর শোক কখনই ভুলতে পারে না। অস্ট্রেলিয়ার নর্দান টেরিটরির এক প্রবীণ আদিবাসী নেতার উক্তি: ‘ভূমিই আদিবাসীদের অস্তিত্বের কেন্দ্র বিন্দু। ভূমি আমাদের ঠিকানা, অস্তিত্ব। ভূমি আছে বলে জীবন এত গতিময়। ভূমি জীবনের প্রতীক। এ ভূমি আমাদের, আমরাও ভূমির। ভূমিতে আমরা বিশ্রাম নেই। আমরা ভূমি থেকে আসি, আবার ভূমিতে ফিরে যাই।’
বিশ্বের ৫ টি মহাদেশের ৯০টি দেশে কমপক্ষে ৫ হাজার আদিবাসী জাতির মানুষ বাস করছেন। তাদের জনসংখ্যা বিশ্বের মোট মানুষের প্রায় ৬% – সংখ্যার হিসেবে ৪০ কোটিরও বেশি আদিবাসী পৃথীবিতে বসবাস করেন- যারা কথা বলেন ৪ হাজারেরও বেশি ভাষায়। আদিবাসীরা সবাই মিলে পৃথিবীর ২০% এরও বেশি ভূখণ্ড জুড়ে বাস করছেন এবং বিশ্বের সাংস্কৃতিক ও জীববৈচিত্র্য প্রতিপালন ও রক্ষা করে চলেছেন। (তথ্যপত্র: পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটি, ২০১১) ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক যুগ থেকে বিশ্বের ৯০টিরও বেশি দেশে বসবাসকারী আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর ওপর যে শতাব্দী ব্যাপী বৈষম্য ও জাতিগত আগ্রাসন চলছে – জাতিসংঘ তা স্বীকার করেছে। (আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক জাতিসংঘ ঘোষণাপত্র, ২০১১)
বাংলাদেশে বৃহত্তর বাঙালি জনগোষ্ঠী ছাড়াও প্রায় ৩০ লক্ষ জনসংখ্যার ৫০টিরও অধিক আদিবাসী মানুষ স্মরণাতীতকাল থেকে বসবাস করে আসছে। বাংলাদেশের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে তাদের জীবন, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও আশা-আকাঙক্ষা। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধসহ দেশের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে আদিবাসী জনগণের রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। (ঘোষণাপত্র, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, ২০১২) এ জনগোষ্ঠীর প্রায় ৩০ লাখ মানুষ দেশের ৩৫টিরও অধিক জেলায় বাস করেন। এর মধ্যে তিন পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে ১৪ জাতির মানুষ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক স্বকীয় বৈশিষ্ট্য নিয়ে বসবাস করছেন। আয়তনে এ তিন জেলা দেশের প্রায় এক দশমাংশ এলাকা জুড়ে বিস্তৃত; এর বাইরে সমতলের ৩০টিরও বেশি জেলায় আদিবাসী জাতির মানুষ বসবাস করেন। বাংলাদেশ একটি বহুত্ববাদী রাষ্ট্র, যদিও রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে একে ঠিক স্পষ্ট করে গ্রহণ করা হয়নি। বাংলাদেশের সংবিধানেও রাষ্ট্রের এই বহুত্ববাদী চরিত্র অনুপস্থিত। সংবিধানে বিসমিল্ল্লাহির রাহমানির রাহিম, আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা, ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করা, বসবাসরত সকলকে বাঙালি বলে চিহ্নিত করে রাষ্ট্রীয় চরিত্রে ‘বাঙালি মুসলমান’র আধিপত্যকে জোরদার করা হয়েছে; একক জাতীয়তাবাদের প্রাবল্যকে স্বাগত জানানো হয়েছে; রাষ্ট্রের সামপ্রদায়িক চরিত্র তৈরি করা হয়েছে এবং রাষ্ট্রের অপরাপর বৈচিত্র্য ও ভিন্নতাকে অস্বীকার করা হয়েছে; শাসকবর্গের এহেন উগ্র জাতীয়তাবাদী ও সামপ্রদায়িকচেতনাজাত মানসিকতা জারি থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে বসবাসরত আদিবাসী জাতিসমূহের অস্তিত্বকে অস্বীকার করার যে কোনো জো নেই, তা শাসকবর্গও জানেন। বাংলাদেশে আদিবাসী ইস্যুটির প্রকৃতি তাই খুবই জটিল রূপ নিয়েছে; এর সঙ্গে রাজনৈতিক আদর্শ, ধর্মীয় মতাদর্শ ও আঞ্চলিক রাজনীতির বিভিন্ন দিকমাত্রা জড়িত। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যে রাজনৈতিক আদর্শ থেকে আদিবাসী ইস্যুটিকে বিবেচনা করে, বিএনপি ঠিক সেভাবে দেখে না; আবার আদিবাসীদের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক কিংবা সাংবিধানিক অধিকার ও মানবাধিকারের বিষয়টিকে ইসলামী মতাদর্শের রাজনৈতিক দলগুলো যে দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিচার করে বাম মতাদর্শের রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান তার বিপরীতে। আদিবাসী ইস্যুর সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর ‘ভারতমুখীনতা’ ও ‘ভারতবিরোধী’ রাজনৈতিক মনোভাবেরও সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। ( রোবায়েত ফেরদৌস, ২০১৩)
১.১ জাতিসংঘ সনদে আদিবাসী ভূমি অধিকার:
আদিবাসী অধিকার বিষয়ে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সনদ ও ঘোষণাপত্র যা আছে তাহলো জাতিসংঘ আদিবাসী অধিকার ঘোষণাপত্র, ২০০৭; নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সনদ এবং অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার সনদ, ১৯৬৬; আইএলও কনভেনশন নং ১০৭ ও ১৬৯; শিশু অধিকার সনদ, ১৯৮৯; জাতিগত, নৃতাত্ত্বিক, ধর্মীয় ও ভাষাগত সংখ্যালঘুদের অধিকার ঘোষণাপত্র, ১৯৯২। এসব ছাড়াও সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্র, ইউনেস্কোর বিভিন্ন সনদ ও ঘোষণা, ভিয়েনা বিশ্ব সম্মেলন, জীববৈচিত্র সনদ এবং আঞ্চলিক বিভিন্ন দলিলে আদিবাসীদের অধিকার স্বীকৃত হয়েছে। বিশ্ব ব্যাংক, ইউএনডিপি, এডিবি, ইফাড, ডানিডা, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নসহ অনেকের আদিবাসী বিষয়ে পলিসি আছে। আদিবাসীদের অধিকার বিষয়ক জাতিসংঘের ঘোষণাপত্রে আদিবাসীদের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের কথা বলা আছে। এ ঘোষণাপত্রের ৩নং ধারায় বলা হয়েছে, ‘আদিবাসীদের আত্ন-নিয়ন্ত্রণ অধিকার রয়েছে। এই অধিকারের বলে তারা স্বাধীনভাবে তাদের রাজনৈতিক অবস্থান ও মর্যাদা নির্ণয় করে এবং স্বাধীনভাবে তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক উন্নয়ন সাধন করে।’ এছাড়াও আদিবাসীদের ভূমির অধিকার, বন ও প্রাকৃতিক সম্পদের উপর আদিবাসীদের অধিকার, ভাষা ও সংস্কৃতি এবং আদিবাসী জ্ঞানের উপর অধিকারের বিষয় ঘোষণাপত্রে যুক্ত আছে। আদিবাসী ঘোষণাপত্রের ৪৬টি ধারার ১০ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, আদিবাসীদের জোর করে তাদের এলাকা বা ভূমি থেকে উচ্ছেদ করা যাবে না। ঘোষণাপত্রের ২৬ ধারায় বলা হয়েছে যে সব ভূমি, এলাকা ও প্রাকৃতিক সম্পদ আদিবাসীরা বংশপরম্পরায় ঐতিহ্যগতভাবে ভোগদখল করে আসছে বা ব্যবহার করে আসছে, তার উপর আদিবাসীদের অধিকার রয়েছে। আবার বলা হয়েছে, রাষ্ট্র এ সব ভূমি, অঞ্চল ও সম্পদের আইনগত স্বীকৃতি প্রদান করবে এবং এ ধরনের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান করতে হবে আদিবাসীদের রীতিনীতি, ঐতিহ্য ও ভূমি মালিকানা প্রথাকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করে। এছাড়াও আদিবাসীদের নাগরিকত্ব, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য, অধিকারের সমতা, মর্যাদা, আদিবাসী নারী, তরুণ, শিশু ও প্রবীণদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ ইত্যাদি আদিবাসী অধিকার ঘোষণাপত্রে স্থান পেয়েছে। সদস্যরাষ্ট্রের ১৪৩টি দেশ এ ঘোষণাপত্রের পক্ষে ভোট দিয়েছে। ভোটদানে বিরত ছিল ১১টি দেশ যার মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে। এশিয়ারও প্রায় সকল দেশ ঘোষণার পক্ষে ভোট দিয়েছে। পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ফিলিপাইন থেকে শুরু করে ভারত, শ্রীলংকা, নেপাল, মালদ্বীপ, এমনকি পাকিস্তান পর্যন্ত আদিবাসী ঘোষণাপত্রের পক্ষে ভোট দিয়েছে। প্রত্যাশা ছিল শাসকগোষ্ঠী এই সত্য মেনে নেবে যে, বাংলাদেশ একটি বহু ভাষা, বহু জাতি ও বহু সংস্কৃতির এক বৈচিত্রপূর্ণ দেশ এবং এর মধ্য দিয়ে সকল জাতির পরিচয়, অধিকার ও সংস্কৃতিকে স্থান দেবে; এভাবেই রাষ্ট্র হয়ে উঠবে সবার; কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্র পরিচালনার যে বহুত্ববাদী নীতি বা বৈচিত্র্যের ভেতরে যে সংহতি তাকে নির্লজ্জভাবে পরিহার করে সংবিধানে ৯ অনুচ্ছেদে যুক্ত করা হয়েছে, “ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত একক সত্তাবিশিষ্ট বাঙালী জাতি”র মতো অসত্য বাক্য। বাংলাদেশ কোনো একক ভাষা বা একক জাতির রাষ্ট্র নয়। বাংলাদেশে বাঙালি ছাড়াও আরো জাতির মানুষ বাস করে এবং তারা বাংলায় নয়, তাদের নিজ নিজ মাতৃভাষায় কথা বলেন। সংশোধিত সংবিধান এদেশে বসবাসরত অন্য ভাষাভাষীর মানুষের মাতৃভাষাকেও পরিত্যাজ্য ঘোষণা করেছে। সংবিধানে রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম হলেও অন্য ধর্মগুলোর অস্তিত্ব স্বীকার করেছে কিন্তু দেশের অন্য জাতিসমূহের ভাষার অস্তিত্বের ব্যাপারে সংবিধান ভয়ঙ্কর শব্দহীন এবং নিশ্চুপ। (রোবায়েত ফেরদৌস, ২০১১)। একুশ আজ বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি পেয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে। বাংলাদেশে বসবাসরত ৫০ টিরও বেশি জাতিগোষ্ঠীর নাগরিকগণ প্রায় ৩০টির মতো ভাষায় কথা বলেন; সংবিধানে এর স্বীকৃতি নেই। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী ইশতেহার ২০১৪-এর ধারা ২২.১ ও ২২.২ ধারায় আদিবাসীদের ভূমি সুরক্ষা, পার্বত্য চুক্তির অবশিষ্টাংশ বাস্তবায়নসহ তাদের জীবন ও জীবিকার উন্নয়নে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। কিন’ আদতে এ সব প্রতিশ্রুতি কর্পুরের মতো উবে যায় সিংহাসনের হাতলে হাত রাখলেই।
২. ভূমি: দখল-উচ্ছেদ-সুশাসন:
শিরোনামে ভূমি সুশাসনের নিশ্চয়তার কথা বলা হয়েছে কিন’ বর্তমান বাংলাদেশে ভূমি নিয়ে ভয়ংকর সব অপশাসন আর কুশাসন চলছে; ভয়ংকর সব রক্তাক্ত কাণ্ড চলছে ভূমি নিয়ে; স্বত্বাধিকারের স্বার্থে চলছে দখল-পাল্টা দখল, নির্যাতন-জবরদস্তি, মামলা-হামলা, খুন-হত্যা-ধর্ষণ; কেবল আদিবাসীদের ভূমি নিয়ে নয়; সংকট চলছে সব ধরনের ভূমি নিয়ে; রাজনৈতিক সমস্যা বাদ দিলে বাংলাদেশের বেশিরভাগ সমস্যার কেন্দ্রে এই ভূমি; আইন, বিধি, মানবাধিকার ও জনস্বার্থকে উপেক্ষা করে কৃষিজমি, বনভূমি দখল, অধিগ্রহণ ও বরাদ্দ প্রদান চলছে; ফি বছর বাংলাদেশ এক শতাংশেরও বেশি হারে কৃষি জমি হারাচ্ছে; নির্বিচারে কৃষি জমিতে বসত-বাড়ি, শিল্প-কারখানা হচ্ছে; ভূমি খেকো আর ভূমি দস্যুরা খাল-বিল-নদী-জলাভূমি দখল করে নিচ্ছে; মহোৎসব চলছে হাউজিং আর রিয়েল এস্টেট প্রকল্পের; গরিব-প্রান্তিক মানুষরা বাধ্য হচ্ছে স্বল্পমূল্যে/বিনামূল্যে তাদের জমির অধিকার হস্তান্তরে; চরাঞ্চলের জায়গা, পতিত ভূমি আর সরকারি খাস জমি স্থানীয় প্রভাবশালী আর লাঠিয়ালরা করায়ত্ত করছে; বাড়ছে ভূমিহীন মানুষের সংখ্যা; আবাসন প্রকল্পের নামে ভূমি দখলের প্রক্রিয়ায় সামরিক-আধাসামরিক-পুলিশবাহিনী – কেউই পিছিয়ে নেই; নতুন নতুন সেনানিবাস, বিজিবির সেক্টর সদর দপ্তর, সেনাছাউনি কিংবা প্রতিরক্ষা স্থাপনা সম্প্রসারণের কারণে প্রতি বছর হাজার হাজার একর জমি অনুৎপাদনশীল খাতে চলে যাচ্ছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন আদালতে যতো মামলা-মোকাদ্দমা আছে তার ৭০ ভাগেরও বেশি মামলা ভূমিকেন্দ্রিক। আপনারা কি জানেন, ঢাকা শহরের বেশিরভাগ বিত্তবানের গাজীপুর-আশুলিয়ায় বিশাল জায়গা ঘিরে বাগানবাড়ি/প্রমোদ উদ্যান আছে? টাকা থাকলেই কি আবাদি/কৃষি জমিতে এভাবে বাড়ি করা যায? ভূমি নীতি/আইন, পরিবেশ নীতি/আইন, নদী/জলাভূমি ব্যবহার সংক্রান্ত নীতিমালা – এদেশে কোনো কিছুর তোয়াক্কা কেউ করছে না। হাতিরঝিলে ‘স্বাভাবিক পানি প্রবাহ রুদ্ধ করে নির্মিত’ এবং ‘আদালতের রায়ে অবৈধ’ বিজিএমই ভবন এখনও বহাল তবিয়তে টিকে আছে; আদালত থেকে তারা স্টে-অর্ডার পেয়েছেন; মাননীয় বিচারকরা কীভাবে এতোটা বিবেকবন্দী হন? একটি অবৈধ ভবন কী করে দিনের পর দিন স্টে-অর্ডার পায়? পরিবেশ দূষণকারী ও অবৈধভাবে নির্মিত এই ভবনটিকে ‘মন্যুমেন্ট অব করাপশন’ বলা যায় কারণ এই ভবনের ভেতরে বর্তমান ও সাবেক দুই প্রধানমন্ত্রীর ভিত্তিপ্রস্তর/উদ্বোধন ফলক রয়েছে; ভূমি অপশাসনের বিস্তৃতি কতো দূর পৌঁছেছে তা বোঝা যাবে যদি আমরা বিভিন্ন ক্ষমতাধর ব্যক্তি/সংস্থা কর্তৃক খেলার মাঠ, বিদ্যালয়ের জমি, পার্ক, উদ্যান, খোলা জায়গা ক্রমশ দখলি প্রক্রিয়া খেয়াল করি। কলাবাগান খেলার মাঠ দখল এর সর্বশেষ উদাহরণ। গেলো বছর ৮টি মানবাধিকার ও উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার শৈলাট গ্রাম, কক্সবাজার জেলার রামু উপজেলার রাজারকুল ইউনিয়ন, বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলা, পাবনার চাটমোহর উপজেলার ছাইকোলা, নিমাইচড়া ও হান্ডিয়াল ইউনিয়ন ও নোয়াখালী জেলার সুবর্ণচর ও হাতিয়া উপজেলায় সরেজমিন অনুসন্ধান চালায়। এতে দেখা যায়, গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার শৈলাট ও এর পাশ্ববর্তী গ্রামের কৃষিজমিসহ প্রায় ১,২০০ একর জমি একই ব্যক্তির মালিকানাধীন চারটি কোম্পানি অবৈধ পন্থায় দখলের পাঁয়তারা করছে। কক্সবাজারের রামু উপজেলার রাজারকুল ইউনিয়নের তিনটি মৌজায় অবস্থিত বনবিভাগের ১,৭৮৮ একর জমি সেনানিবাস স্থাপনের জন্য বরাদ্দ প্রদানের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বান্দরবান জেলার রুমাতে সেনানিবাস স্থাপনের জন্য ৯৯৭ একর পাহাড়ি আদিবাসীদের জমি বরাদ্দের কাজ সম্পন্ন হয়ে গেছে। সেনাবাহিনীর স্থাপনা নির্মাণের জন্য পাবনা জেলার চাটমোহর উপজেলার তিনটি ইউনিয়নের ১,৪০৮ একর কৃষিজমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব সংক্রান্ত প্রাথমিক তথ্য পাওয়া গেছে। এ জমিগুলো চলনবিলের পানির উৎসমুখে অবসি’ত নিম্নভূমির অংশ। সর্বশেষে নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার চর ক্যারিং মৌজার প্রায় ১০ হাজার একর কৃষিজমি সেনাবাহিনীকে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে এবং হাতিয়া, সুবর্ণচর ও চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলার অন্তর্গত প্রায় ৩৫ হাজার একর আয়তনের কৃষিজমি বিশিষ্ট জাহাজ্জার চর পুরোটাই সেনাবাহিনীকে বরাদ্দ দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। (সংবাদ সম্মেলন, ৮টি মানবাধিকার ও উন্নয়ন সহযোগী সংস’া, ১৩ নভেম্বর ২০১৪, ঢাকা রিপোটার্স ইউনিটি) অন্যদিকে ধর্মীয় সংখ্যালঘু যেমন হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, আহমাদিয়া জামাত কিংবা জাতিগত সংখ্যালঘু যেমন চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো, সাঁওতাল, হাজংসহ বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায়ের জমি-জমা প্রতিদিন দখল হয়ে যাচ্ছে; সংখ্যালঘুদের জমি দখলের জন্য প্রথমত: ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে ভাংচুর দ্বিতীয়ত: বসতবাড়িতে লুটতরাজ-অগ্নিসংযোগ তৃতীয়ত: উপাসনালয় আক্রমণ এবং চতুর্থত: সংখ্যালঘুদের হুমকি-ধামকি-মামলা দেওয়া হয়; এসবে কাজ না হলে তাদের মেয়েদের ধর্ষণ করা হয়, যাতে সংখ্যালঘু মানুষদের পক্ষে এলাকায় সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকা আর সম্ভব না হয়; এর ফলে হয় তারা হয় অন্যত্র নয়তো অন্য দেশে চলে যেতে বাধ্য হন। সব মিলিয়ে পুরো বাংলাদেশে ভূমি নিয়ে যারপরনাই এক অমানবিক, নিষ্ঠুর আর রক্তাক্ত অধ্যায় প্রতিনিয়ত রচিত হয়ে চলেছে। এর প্রতিকারের জন্য কেউ নেই, নেই কোনো প্রতিবিধান।

৩. ভূমি উচ্ছেদ ও আদিবাসীর মানবাধিকার:
বিশ্বজুড়ে ভূমি আদিবাসীদের কাছে পবিত্র। নদী, পাহাড়-পর্বত, ভূমি ও প্রকৃতির সাথে রয়েছে আদিবাসীদের নিবিড় ও আধ্যাত্মিক সমপর্ক। তাদের সংস্কৃতিতে ভূমি হলো জননী – মাদার আর্থ; আদিবাসীরা প্রকৃতিকে অনুভব করতে পারে – তাই তারা বন ও সমপদকে কোনোদিন বেচাকেনার বিষয় হিসেবে দেখেনি, জীবনের অংশ হিসেবে দেখেছে। কিন’ আধুনিক সভ্যতা বন, প্রকৃতি সবকিছুকেই বাণিজ্যিক দৃষ্টিতে দেখে। এখানেই আদিবাসীদের সঙ্গে বর্তমান উন্নয়ন ধারার দ্বান্দ্বিকতা। টাঙ্গাইলের মধুপুর বনে ষাটের দশকে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার জাতীয় উদ্যান গড়ে তুলেছিল আদিবাসী গারোদের ভূমিতে, তাদের উচ্ছেদ করে। কাগজে কলমে এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যও ছিল বন সংরক্ষণ ও উন্নয়ন। ভেতরে উদ্দেশ্য ছিল আদিবাসী উচ্ছেদ। আজ এ জাতীয় উদ্যান নির্মানের ষাট বছর পর দেখা যাচ্ছে, মধুপুর বনের প্রাকৃতিক বৃক্ষ উজাড় হয়ে গেছে, জীববৈচিত্র্য ধ্বংসপ্রায়, অরণ্য বিরানভূমিতে পরিণত। আর বনের আদি অধিবাসী গারো ও কোচদের জীবন মুমূর্ষু। বনবিভাগ হাজার হাজার মামলা দিয়ে বনের আদি বাসিন্দাদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে। সব কিছুই হয়েছে ‘উন্নয়ন’এর নামে। (সঞ্জীব দ্রং, ২০১২) এ সব প্রকল্পের ফলে স্থানীয় মানুষের উন্নয়ন হয়নি, দুঃখ-কষ্ট-বঞ্চনা বরং বেড়েছে। অন্যদিকে বাইরে থেকে শত শত মানুষ ঢুকে গেছে একদা আদিবাসী পাহাড়ি অধ্যুষিত এলাকায় ও বনে। আদিবাসীরা পরিণত হয়েছে সংখ্যালঘু, নিজভূমিতে। মধুপুর জাতীয় পার্ক এখন বাইরের আমোদপ্রিয় লোকদের বনভোজন ও আনন্দভ্রমনের যোগ্য জায়গা হয়ে উঠেছে আর আদিবাসীদের কাছে হয়ে উঠেছে বসবাস অযোগ্য। বনের পরিবেশ বিপন্ন, মানুষেরাও বিপন্ন। তাই তথাকথিত উন্নয়নকে আদিবাসীরা ভয় পায়। এভাবেই উন্নয়নের নামে রাষ্ট্র আদিবাসীদের নিপীড়ন ও ভূমি হারানোর প্রক্রিয়ার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। পুরো দেশ জুড়ে আদিবাসীদের ‘আনপিপলিং’ করা হচ্ছে (আবুল বারাকাত ২০১৫); এভাবে চললে বাংলাদেশে কোনো আদিবাসী মানুষ থাকবে না, সংখ্যালঘু থেকে আদিবাসীরা হয়ে যাবে সংখ্যাশূন্য, তাদেরকে তখন কেবল গবেষণা রিপোর্ট, আর্কাইভ বা প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘরে পাওয়া যাবে। আদিবাসীরা গরিব/প্রান্তিক কিন্তু যেখানে তারা বাস করেন সেটা প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর। আর সেটাই আদিবাসীদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। দখলবাজদের চোখ পড়ে এখানে, তারা তখন দখলের সব আয়োজন করে চলে। এ যেন আপনা মাসেঁ হরিণা বৈরি।

৩.১. আদিবাসীদের ভূমিকেন্দ্রিক সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা: আদিবাসীদের ভূমি দখলের প্রক্রিয়া চলছে দশকের পর দশক ধরে। নিচে কিছু ঘটনা তুলে ধরছি, যেখানে গেলো এক/দুই বছরে আদিবাসীদের ভূমি দখল, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ভূমিকেন্দ্রিক বিরোধ, হত্যা, ধর্ষণ, মামলা- মোকাদ্দমার বিবরণ পাওয়া যাবে। পুরো উচ্ছেদ ও দখলি প্রক্রিয়ার এ এক ক্ষুদ্র অংশ মাত্র।
ক. দিনাজপুর: জেলার পার্বতীপুর উপজেলার মোস্তফাপুর ইউনিয়নের হাবিবপুর গ্রামে, আদিবাসীদের কাছে যা চিড়াকূটা নামে পরিচিত, ২৪ জানুয়ারি ২০১৫ সকালে ভূমিদস্যুরা সেখানে হামলা চালিয়ে আদিবাসী গ্রামকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করে দিয়েছে। ভূমিদস্যুরা শুধু হামলা করেই ক্ষান্ত হয়নি, আদিবাসীদের সহায় সম্বল সবকিছু লুটপাট করে নিয়ে গেছে। এমনকি গ্রামের টিউবওয়েল পর্যন্ত খুলে নিয়ে গেছে এবং ঘটনাস্থল ত্যাগ করার আগে আদিবাসীদের বাড়ি-ঘরে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে ও গর্ভবতী একজন নারীসহ আদিবাসী নারীদের মারধর ও শ্লীলতাহানি করেছে। আদিবাসীরা সহায় সম্বলহীন হয়ে খোলা আকাশের নিচে খুবই মানবেতর জীবন যাপন করছে। এই ঘটনায় আমরা গভীরভাবে লক্ষ করেছি, আদিবাসীদের সাথে ভূমিদস্যুদের সংঘর্ষে একজন নিহত হওয়ার পরে ভূমিদস্যুরা খুবই চতুরতার সাথে সাম্প্রদায়িক উস্কানি দিয়ে আদিবাসীদের পুরো গ্রামটিকে ধূলিসাৎ করে দিয়েছে। নিহতের পরিবারের পক্ষে ২৮ জনের নামসহ ১৪ জনকে অজ্ঞাত করে আদিবাসীদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলাও দেওয়া হয়েছে।
খ. চাঁপাইনবাবগঞ্জ: ২০১৪ সালের আগস্টে আদিবাসী নারী নেত্রী বিচিত্রা তির্কি নিজের কৃষিজমি চাষ করার সময় ধর্ষণ ও শারীরিক আক্রমণের শিকার হন, তার বাড়িঘর ভাংচুর করা হয়; কিন্তু অপরাধীরা ক্ষমতাসীন দলের সদস্য হওয়ার কারণে আইনি প্রক্রিয়া দুর্বল হয়ে যায়। এর মূলেও ভূমি বিরোধ।
গ. রাজশাহী: ২০১৫ সালের ৯ জানুয়ারি রাজশাহী কলেজের ছাত্র বাবলু হেমব্রমকে নিজ বাসায় জবাই করা হয়; বাবলু আদিবাসী ছাত্র পরিষদের একজন নেতৃস্থানীয় সংগঠক। উত্তরবঙ্গের আদিবাসী আন্দোলনে ভয়ভীতি প্রদর্শন ও আতঙ্ক ছড়াতে পাশবিক এ হত্যাকাণ্ড চালানো হয়। আজ অবধি কেউ গ্রেপ্তার হয়নি।
ঘ.কাপ্তাই: ১৪ ডিসেম্বর ২০১৪-এ কাপ্তাইতে ছবি মার্মা নামের এক অষ্টম শ্রেণীর স্কুল ছাত্রীকে ধর্ষণের পর মেরে ফেলা হয়েছে।
ঙ. শ্রীমঙ্গল: মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে রাজহাট ইউনিয়নের নাহার চা বাগানের আসলম খাসিয়া পুঞ্জীতে ৩০ শে মে ২০১৪ ঘর উত্তোলন কেন্দ্র করে দুপক্ষের সংঘর্ষ ও একজনের মৃত্যু হয়। পরস্পর বিরোধী মামলা হয়। পুঞ্জীর খাসিয়া আদিবাসীরা প্রান্তিক এবং চা শ্রমিকরা আরও প্রান্তিক। পুঞ্জী দখল থেকে ঘটনার সূত্রপাত। মূলত চা বাগান কর্তৃপক্ষ প্রতিবছর আড়াই একর করে বাগান সম্প্রসারণের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে প্রতিনিয়ত এগুচ্ছে এবং এর আওতাধীন খাসিয়া পুঞ্জীর লোকজনকে পুঞ্জী ছাড়ার জন্য বলে আসছে। ১৯৬০ সালে প্রায় ৩৫০ হেক্টর জায়গা নিয়ে গড়ে ওঠে নাহার চা বাগান। নাহার চা বাগান থেকে ২০০ একর জায়গা নিয়ে ১৯৮২ সালে গড়ে ওঠে আসলম বা নাহার পুঞ্জি-১। পাশাপাশি কাইলিন পুঞ্জিটি গড়ে ওঠায় সেটিও নাহার পুঞ্জি-২ নামে পরিচিতি পায়। পুঞ্জির লোকজন বছরে ২৫ হাজার টাকা ইজারার জন্য খাজনা হিসেবে নাহার চা বাগানকে দেয়। নাহার পুঞ্জির বর্তমান কর্তৃপক্ষ আসলম পুঞ্জির খাসিদের প্রতি বছর ২০ একর করে জমি ছেড়ে দিয়ে পুঞ্জির জায়গাটি ছেড়ে দেয়ার কথা বলে। চা বাগানের আয়তন বাড়াতে প্রতি বছর খাসিয়াদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে। রাষ্ট্র খাসিয়া ও চা বাগানিদের ভূমির সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বাধ্য। কোনো এজেন্সি, বাহিনী বা করপোরেট সংস্থা যদি রাষ্ট্রের চেয়ে ক্ষমতাধর হয়ে যায় তাহলে কীভাবে এর সমাধান হবে? খাসিয়া জনগণের পুঞ্জী ও বসতের যাবতীয় সুরক্ষা নিশ্চিত করে কীভাবে চা বাগানের বিকাশ ঘটানো যায়, তা রাষ্ট্রকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কারণ জনগণের, খাসি ও চা বাগানিদের রক্ত জল করা পান ও চায়ের আয়ে রাষ্ট্রীয় বাজেট তৈরি হয়।
চ. বান্দরবান: বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলার ক্রাইক্ষ্যং-হাংসামাপাড়া এলাকায় আদিবাসীদের শ্মশান ভূমি ও জুম- জমিতে বিজিবির সেক্টর সদর দপ্তর নির্মাণের কাজ চলছে। জায়গাটা এখন কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে আটকানো; বিজিবি সেখানে টহল বসিয়েছে, অস্ত্রহাতে জওয়ানরা পাহারা দিচ্ছে। আদিবাসীদের তাদের নিজেদের জায়গায় আর ঢুকতে দেওযা হচ্ছে না। উচ্ছেদের ভয়ের মধ্যে আদিবাসীরা দিনাতিপাত করছে; জমি অধিগ্রহণে আগাম ঘোষণা দেওয়া হয়নি, আদিবাসীদের সঙ্গে কথা বলা হয়নি; এ প্রক্রিয়ায় সার্কেল চিফ/রাজা কিংবা হেডম্যানের কোনো সুপারিশও নেওয়া হয়নি। এটি স্পষ্টত শান্তিচুক্তির লংঘন। পার্বত্য শাসনবিধি ১৯০০ অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামে খাসজমি বলে কিছু নেই, জমির মালিকানা স্বত্ব হেডম্যান/সার্কেল চিফের হাতে ন্যস্ত থাকে; কিন্তু কোনো বিধি-রীতির তোয়াক্কা এখানে করা হচ্ছে না।
ছ. রাঙ্গামাটি: চাপিয়ে দেওয়া সেটেলমেন্ট প্রক্রিয়ায় গেলো ২৪/২৫ বছর ধরে জ্যামিতিক হারে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিদের বসতি স্থাপনের প্রকল্প চলছে; প্রধানত শিক্ষাবঞ্চিত প্রান্তিক বাঙালিদেরকেই পাহাড়ে পুনর্বাসন করা হতো; আর রাঙামাটিতে মেডিক্যাল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের মাধ্যমে এখন শিক্ষিত বাঙালিদের পুনর্বাসনের চেষ্টা চলছে বলে আদিবাসীরা মনে করেন। তাদের ভয়, এটা জুম্ম ও স্থানীয় অধিবাসীদের তাদের নিজস্ব জায়গা-জমি ও বসতবাটি হতে উচ্ছেদকরণ ত্বরান্বিত করবে। মেডিকেল কলেজের কার্যক্রম শুরুর প্রতিবাদে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের ১০ জানুয়ারি ২০১৫ সকাল-সন্ধ্যার অবরোধকে কেন্দ্র করে পাহাড়ের চিরপরিচিত জাতিগত সহিংসতার পুনরাবৃত্তিই জাতি লক্ষ করল। ২০১৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর বগাছড়িরর ধ্বংসযঞ্জের রেশ না কাটতেই রাঙ্গামাটি শহরের ঘটনাবলী দেশবাসীর জন্য নতুন কোনো শুভবার্তা নিয়ে আসেনি। দিনের পর দিন এসব অন্যায়-অবিচারের কোনো বিচার হয়নি, ফলে বিচারহীনতায় আদিবাসীদের নিরাপত্তাহীনতা বেড়ে চলেছে ক্রমাগত। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে খুন-ধর্ষণ-জমি দখল।
জ. রাজবাড়ী: রাজবাড়িতে বাগদা আদিবাসীদের বসবাস। সেখানে জানুয়ারি মাসে মা- মেয়ে যুগপৎ ধর্ষণের শিকার হন। বিচার কি হবে? সংশয় একশো ভাগ। সমস্যার মূলে ওই ভূমি আত্মসাৎ।
ঝ. পটুয়াখালি-বরগুনা: বছরের পর বছর ধরে রাখাইন আদিবাসীদের জমি, শ্মশান, উপসনালয় সব দখল হয়ে যাচ্ছে; স্বাধীনতার প্রারম্ভিক কালে লক্ষাধিক রাখাইন এ অঞ্চলে বাস করতেন; এখন তাদের সংখ্যা মাত্র আড়াই হাজারে নেমে এসেছে। ‘আনপিপলিং’-এর চূড়ান্ত উদাহরণ বাংলাদেশের এই রাখাইন জনগোষ্ঠী।

ঞ. নানিয়ার চর: বিজয় দিবস ২০১৪ সকালে রাঙ্গামাটির নানিয়ার চর উপজেলার বুড়িঘাট ইউনিয়নের বগাছড়ি-চৌদ্দমাইল এলাকায় তিনটি পাহাড়ি গ্রাম সুরিদাশ পাড়া, বগাছড়ি ও নবীন তালুকদার পাড়ায় আদিবাসীদের ৭টি দোকান ও ৫৪টি বসত বাড়ি জ্বালিয়ে, পুড়িয়ে, কুপিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ ও নিঃশেষ করা হয়েছে। আশ্চর্য হবেন যে, আক্রমণ থেকে বুদ্ধ ধর্মের পীঠস্থান কিয়াং পর্যন্ত রক্ষা পায়নি, ভিক্ষুকে পর্যন্ত মারধর করা হয়েছে। উবাসা ভিক্ষু ভয়ে পালায়নি, কিন্তু দেবতা বুদ্ধের মূর্তিকে অসম্মানের হাত থেকে রক্ষা করতে পারেন নি, মূর্তি চুরি হয়েছে, ভূলুন্ঠিত করা হয়েছে। আশি বছরের প্রিয়বালার যাবার জায়গা নেই, দেবরের ছেলে অরূপের আশ্রয়ে আছে। এখন তো আশ্রয়দাতারও আশ্রয় নেই। বাঙালি সেটলারদেরকে পাহাড়ী জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করানো হয়েছে। টিকে থাকার সংগ্রামে তারা জায়গা দখল করে, পুর্নদখল ও জবরদখল চালায়। পাহাড়ীরাও ভুমি উদ্ধার, জমি দখল ঠেকাতে চেষ্টা করে। কিন্তু কার জমি কোনটা এ সমস্যার সমাধান থানায় আর হয় না। প্রথাগত আইন অনুসারে, পাহাড়ের জমির মালিক আদিবাসী জনগণ। সেখানকার প্রথাগত আইনে ভূমি ক্রয়- বিক্রয় – এ মৌজা হেডম্যানের সুপারিশ বাধ্যতামূলক। কিন্তু পুনর্বাসিত বাঙালিরা দখল বা ক্রয়ের ক্ষেত্রে এই নিয়ম মেনে চলে না। জেলা প্রশাসন কিংবা সেনাপ্রশাসনও এই নিয়মনীতির তোয়াক্কা করে না। তাই ভূমি সমস্যার সৃষ্টি হয়, টিকে থাকে, জিইয়ে রাখা হয়।

এছাড়া ভূমি সমস্যা নিয়ে খবরের কাগজে ২০১৪ সালে প্রকাশিত আরো কিছু খবর যোগ করা যায়: দৃষ্টির বাইরে সমতলের আদিবাসীরা (প্রথম আলো, ০৯ আগস্ট’১৪); নীরবে বাস্তভিটা ছাড়ছে গারোরা: মধুপুরে অস্তিত্ব সংকটে কোচরা: সিলেটে ভূমি রক্ষার নিরন্তর লড়াই (সমকাল, ০৯ আগস্ট’১৪); ভূমি বিরোধে বান্দরবান, রংপুর, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও চুয়াডাঙ্গায় ৬ জন নিহত (ডেইলি স্টার, ০৬ ফেব্রুয়ারি’১৪); ভূমির জন্য আদিবাসীদের ওপর সহিংসতা বাড়ছে: আদিবাসীদের তিন হাজার ৮২৬ একর জমি দখল, ২৬ পরিবার উচ্ছেদ, ধর্ষণ, হত্যা, শারীরিক নিগ্রহ, ধর্ষণচেষ্টা ও অপহরণের ঘটনা ৬৭টি (প্রথম আলো, ২৪ ফেব্রুয়ারি’১৪); জামালপুরে জমিসংক্রান্ত বিরোধে আদিবাসী পরিবারে হামলা, বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, আহত ৭ (জনকণ্ঠ, ০৯ জানুয়ারি’১৪); পাহাড় থেকে পাহাড়ে অনিশ্চিত জীবন: যৌন নিপীড়নের শিকার আদিবাসী নেত্রীর পাশে সংসদীয় ককাসের সদস্যরা (প্রথম আলো, ০৯ আগস্ট’১৪) রাখাইনদের রক্ষার আহ্বান নাগরিক প্রতিনিধি দলের (সমকাল, ০৯ সেপ্টেম্বর’১৪); ভূমি কমিশন চেয়ে চাপাইনবাবগঞ্জে আজ লংমার্চে নামছে আদিবাসীরা (প্রথম আলো, ২৭ আগস্ট’১৪); ভূমি অধিকারের লড়াই বাধাগ্রস্ত করতে ধর্ষণ নির্যাতন চলছে (কালের কন্ঠ, ১৯ আগস্ট’১৪); চাপাইনবাবগঞ্জে আদিবাসী নেত্রীকে ধর্ষণের নেপথ্যে ভূমি বিরোধ: সংসদীয় ককাসের অভিযোগ (প্রথম আলো ১৯ সেপ্টেম্বর’১৪); পাহাড় ও সমতলে আদিবাসিদের জমি দখল করা হচ্ছে: সংবাদ সম্মেলনে সংসদীয় ককাস (সমকাল ১৯ সেপ্টেম্বর’১৪); জমি হারিয়ে দেশান্তরি হচ্ছে ক্ষুদ্রজাতি (কালের কন্ঠ, ০৭ নভেম্বর’১৪) ইত্যাদি।

বলা বাহুল্য এ তালিকা দীর্ঘতর, করুণ, দানবীয় আর অমানবিক।

৪. পার্বত্য চুক্তি ও পার্বত্য ভূমি অধিকার:
শান্তি চুক্তি অনুসারে এখনও ভূমি সমস্যার সমাধান হয়নি। পাহাড়ে তাই বাড়ছে দখল, বাড়ছে বিরোধপূর্ণ ভূমির পরিমাণ। হেডম্যানের পূর্বানুমতি ব্যতীত জমি হস্তান্তরের বিধান না থাকা সত্ত্বেও জমি বিকিকিনি হচ্ছে, বাঙালি ভূমির মালিকানা বাড়ছে। আদিবাসী তাদের নাম নিয়েই ঠিকমত দাঁড়াতে পারছে না। পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তিকরণ; আভ্যন্তরীণ জুম্ম উদ্বাস্তু ও প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থীদের জায়গা-জমি প্রত্যর্পণ ও পুনর্বাসন; সেনা শাসন ‘অপারেশন উত্তরণ’সহসকল অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার; অস্থানীয়দের নিকট প্রদত্ত ভূমি ইজারা বাতিলকরণ; সেটেলার বাঙালিদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সম্মানজনকভাবে পুনর্বাসন ইত্যাদি বিষয়গুলো বাস্তবায়িত না হওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি সমস্যার সমাধান কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে অগ্রগতি লাভ করেনি। অপারেশন উত্তরণের ছত্রছায়ায় ও সিভিল প্রশাসনের সহায়তায় উগ্র সামপ্রদায়িক গোষ্ঠী ও সেটেলার বাঙালিরা জুম্মদের জায়গা-জমি জবরদখল করার লক্ষ্যে সংঘবদ্ধ সামপ্রদায়িক হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। ক্যাম্প সমপ্রসারণ, অবৈধভাবে ইকো-পার্ক ও পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন, উন্নয়নের নামে অস্থানীয় প্রভাবশালী বাঙালিদের নিকট ভূমি ইজারা প্রদান, সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘোষণা ইত্যাদির নামে জুমভূমিসহ স্থায়ী অধিবাসীদের রেকর্ডীয় ও ভোগদখলীয় জায়গা-জমি অধিগ্রহণের মাধ্যমে উচ্ছেদ প্রক্রিয়া জোরদার হয়েছে। পাশাপাশি জুম্মদের ঘরবাড়ীতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট, নিরীহ গ্রামবাসীদের উপর হামলা ও হত্যা, জুম্ম নারীদের অপহরণ, ধর্ষণ ও ধষর্ণের পর হত্যা ইত্যাদি সন্ত্রাসী কার্যক্রমের মাধ্যমে জুম্মদের জাতিগতভাবে নির্মূলীকরণের কার্যক্রম বাস্তবায়িত হচ্ছে এবং অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। বিজিবি, সেনাবাহিনী, বন বিভাগ, বহিরাগত প্রভাবশালী ব্যক্তি, সেটেলার বাঙালি কর্তৃক পাবত্য চট্টগ্রামের তিন পার্বত্য জেলায় জুম্মদের আবাসভূমি ও ধর্মীয় স্থান এবং স্বভূমি থেকে তাদেরকে উচ্ছেদের প্রক্রিয়া ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। আদিবাসী জুম্মদের আবাসভূমি, জুমভূমি ও বিচরণভূমিতে অহরহ গড়ে তোলা হচ্ছে বিভিন্ন পর্যটন স্পট, রিসোর্ট, রেস্টুরেন্ট, বিলাসবহুল মোটেলসহ বিনোদন ও বাণিজ্য কেন্দ্র। এতে অনেক আদিবাসী জুম্ম পরিবার হয় ইতোমধ্যে নিজের বাস্তভিটা ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে, নয়তো উচ্ছেদের মুখে রয়েছে। ‘উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য’কে ক্ষুণ্ন করার লক্ষ্যে সেটেলার বাঙালিদের পুনর্বাসন; সেটেলারদের গুচ্ছগ্রাম সমপ্রসারণ; জুম্মদের উপর সামপ্রদায়িক হামলা; বহিরাগতদের পার্বত্য চট্টগ্রামের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তকরণ; ডেপুটি কমিশনার কর্তৃক স্থায়ী বাসিন্দার সনদপত্র প্রদান; চাকরি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রদান; ভূমি বেদখল; বহিরাগতদের নিকট ভূমি বন্দোবস্তী ও ইজারা প্রদান; জুম্ম জনগণকে সংখ্যালঘু করার লক্ষ্যে নতুন করে বহিরাগতদের অনুপ্রবেশ ঘটানো; তথাকথিত ‘সমঅধিকার আন্দোলন’ গঠনের মাধ্যমে সেটেলার বাঙালিদের সংগঠিত করে পার্বত্য চট্টগ্রামে সামপ্রদায়িক পরিবেশ সৃষ্টি করা, ভূমি জরিপের মাধ্যমে সেটেলার কর্তৃক জবরদখলকৃত ভূমি বৈধতা প্রদানের পাঁয়তারা ইত্যাদি কার্যক্রম অব্যাহতভাবে চলছে। পূর্ববর্তী সরকারের মতো আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান মহাজোট সরকারের আমলেও জুম্মদের উপর সামপ্রদায়িক হামলা অব্যাহত রয়েছে। এ সরকারের আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রায় এক ডজন সাম্প্রদায়িক হামলা সংঘটিত হয়েছে। ৩ আগস্ট ২০১৩ খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার মাটিরাঙ্গা উপজেলার তাইন্দং এলাকায় সেটেলার বাঙালিরা নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতিতে জুম্মদের ১১টি গ্রামে সংঘবদ্ধভাবে সাম্প্রদায়িক হামলা চালিয়ে ৩৬টি ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও ২৬১টি বাড়িতে লুটপাট ও ভাঙচুর করে। এর আগে ২২-২৩ সেপ্টেম্বর ২০১২ রাঙ্গামাটি শহরে সংঘটিত সামপ্রদায়িক হামলায় শতাধিক জুম্ম ও ৯ জন বাঙালি আহত এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের কার্যালয় ও বিশ্রামাগারে হামলাসহ জুম্মদের ঘরবাড়ি ও দোকানপাত ভাঙচুর করা হয়। ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০১১ খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার রামগড় ও মানিকছড়ি উপজেলায় সামপ্রদায়িক হামলা চালিয়ে জুম্মদের ১১০টি ঘরবাড়ি সম্পূর্ণভাবে ভস্মিভূত এবং ১৭ এপ্রিল ২০১১ রাঙ্গামাটি জেলার লংগদু উপজেলার বগাচদর এলাকায় হামলা চালিয়ে ২১টি ঘরবাড়ি ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয় এবং লুটপাট করা হয়। (সংবাদ সম্মেলন, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি, ১ ডিসেম্বর, ২০১৪) পার্বত্য আদিবাসী ও সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর উপর সাম্প্রদায়িক হামলা, তাদের জায়গা-জমি জবরদখল, নারীর উপর সহিংসতা ও উপাসনালয়ে আক্রমন ইত্যাদি মানবতা বিরোধী কার্যক্রম বৃদ্ধি পেয়েছে।
৫. সুপারিশ ও করণীয়:
প্রশ্ন হচ্ছে ঠিক কী কারণে আদিবাসীরা ভূমি হারায়? ১৯৪৭-এর দেশভাগের কারণে হিন্দুদের কী অবস্থা হয়েছে, এ নিয়ে যথেষ্ট লেখালেখি ও গবেষণা হয়েছে। কিন্তু আদিবাসীদের জীবনে দেশভাগের ফলে কী ভয়াবহ পরিণতি হয়েছিল, এ নিয়ে খুব একটা কাজ হয়নি। মূলত: ১৯৪৭ ছিল আদিবাসীদের জীবনের বড় টার্নিং পয়েন্ট। পরবর্তীকালে ১৯৬৪ সালের হামলা ও আক্রমণ। দু’পাক্ষিক দাঙ্গা নয়, কেবল একপাক্ষিক হামলা হয়েছিল, আদিবাসীরা শুধু পলায়ন করেছে, দেশান্তরিত হয়েছে। আর ১৯৬৫ সালের মাত্র ১৭ দিনের পাক-ভারত যুদ্ধে আদিবাসীদের অনেক জমি শত্রু সম্পত্তি হয়ে গেছে। মূলত যেসব কারণে আদিবাসীরা ভূমি হারায় তাহলো পপুলেশন ট্রান্সফার – বার বার বাধ্যতামূলক দেশান্তরকরণ প্রক্রিয়া; ১৯৪৭ সালের পর থেকে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো, হাজং, কোচ, ডালু, হদি, বানাই প্রভৃতি আদিবাসীদের কয়েকদফা প্রাণরক্ষার জন্য জন্মভূমি ছাড়তে হয়। ১৯৬০-৬২ সালে কাপ্তাই বাধের কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের লক্ষাধিক আদিবাসী বাড়ি-ঘর হারিয়ে উদ্বাস্তু হয়; তখন ৫০ হাজারেরও বেশি আদিবাসী ভারতে, ২০ হাজারের মতো চলে যায় বার্মাতে। ১৯৬৪ সালে পাক সরকার সামপ্রদায়িক আক্রমণ চালায়। তখন আদিবাসীরা দেশত্যাগে বাধ্য হয়। তাদের ফেলে যাওয়া জমিতে সরকার অ-আদিবাসীদের পুনর্বাসিত করে। যারা ফিরে আসে, তাদের মধ্যেও অনেকে জমি ফেরত পায়নি। ১৯৭১ সালেও পাহাড় ও সমতলের আদিবাসীদের সবকিছু ত্যাগ করে দেশান্তরিত হতে হয়। গারো অঞ্চলের সীমান্ত এলাকায় ১৯৭৫ সালেও গারোদের অনেকে দেশান্তর হয়। বার বার দেশান্তরের ফলে তাদের অর্থনীতি ভেঙে পড়ে। আরো কারণ হচ্ছে আদিবাসীদের কোনো মতামত বা সম্মতি ছাড়াই সেনানিবাস, সেনা ছাউনি, বিজিবি দপ্তর, সামরিক- বেসামরিক কর্মকর্তাদের নামে-বেনামে জমি কেনা বা দখল নেওয়া, আদিবাসীদের ভূমিতে ও এলাকায় জাতীয় উদ্যান, এনজিও প্রকল্প গ্রহণ, ইকো-পার্ক নির্মাণ, রাবার বাগান, বাঙালি পুনর্বাসন প্রকল্প গ্রহণ, অবকাশ কেন্দ্র, সামাজিক বনায়ন প্রকল্প গ্রহণ করা; আদিবাসীদের ঐতিহ্যগতভাবে অধিকৃত, ব্যবহৃত ভূমিকে আদিবাসীদের না জানিয়েই রিজার্ভ ফরেস্ট ঘোষণা বা খাস করে দেয়া; উচ্ছেদ নোটিশ এবং শত শত মিথ্যা মামলা দিয়ে আদিবাসীদের হয়রানি করা; শত্রু সম্পত্তি বা অর্পিত সম্পত্তি আইন কার্যত বজায় থাকা; ভূমিলোভী চক্রের জাল দলিল, জোরপূর্বক জমি দখল; জমি-জমা সংক্রান্ত আইন কানুন, খারিজ, খাজনা, কাগজপত্র তৈরি ও সংরক্ষণ ইত্যাদি বিষয়ে আদিবাসীদের সচেতনতার অভাব; প্রজাসত্ত্ব আইন বলবৎ থাকার পরও এর যথাযথ বাস্তবায়ন না হওয়া এবং জেলা প্রশাসনে কোনো আদিবাসী বিষয়ক অফিসার না থাকা; সরকারি ভূমি অফিসের চরম দুর্নীতি ও আদিবাসীদের প্রতি প্রতিপক্ষমূলক আচরণ; ভূমি জরিপের সময় দুর্নীতি ও ঘুষ দিতে বাধ্য করা; ঘুষ না দিলে জমি খাস করে দেয়া; আইনের আশ্রয় না পাওয়া, এমনকি মামলায় জয়ী হলেও জমির দখল বুঝে না পাওয়া; বছরের পর বছর, এমনকি যুগের পর যুগ মামলা চালাতে গিয়ে আরও জমিজমা হারানো, নিঃস্ব ও সর্বসান্ত হওয়া ইত্যাদি। (সঞ্জীব দ্রং, ২০১৪)
এ জন্য যা করণীয় তাহলো পার্বত্য-সমতল নির্বিশেষে সকল আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীকে তাদের ভাষা-শিল্প-সংস্কৃতি-জীবনধারার স্বাতন্ত্র সংরক্ষণসহ সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেয়া; আদিবাসী মানুষের জমি-জলা-বনভূমি অধিকার নিশ্চিতকরণে স্থানীয় সরকার, স্থানীয় শাসন ও ঐতিহ্যগত শাসন কাঠামোর সর্বোচ্চ সমন্বিত পদক্ষেপ নিশ্চিত করা; আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভূমি অধিকারসহ উন্নয়ন সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি নিয়ে জাতীয় সংসদে বিশেষ অধিবেশনে আলোচনাপূর্বক সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সময়-নির্দিষ্ট (টাইম-বাউন্ড গোলস) লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ ও তা বাস্তবায়নে দায়িত্ব বন্টন করা; আদিবাসীদের ভূমি জোরদখলকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া; বনের আদিবাসীদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ বন্ধ করা ও বনবিভাগের হয়রানি মামলা প্রত্যাহার করা; ইকো-পার্কের নামে বন উজাড় বন্ধ করা; সেই সাথে বিশ্বব্যাপী ক্লাইমেট চেঞ্জের ঋণাত্মক প্রভাব থেকে মুক্ত হবার লক্ষ্যে আদিবাসী মানুষ অধ্যুষিত বন-জঙ্গল-জলাভূমি সংরক্ষণে সহায়ক গবেষণা ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম জোরদার করা। আদিবাসীদের প্রথা ও ঐতিহ্যগত ভূমি অধিকারের আইনগত স্বীকৃতি দেয়া; শান্তি চুক্তি অনুযায়ী পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পটত্তি করা; আর সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠন করা। বাংলাদেশে হাজং, কোচ, বানাই, মারমা, চাকমা, গারো, সাঁওতাল, উঁরাও, মুন্ডা, খাসিয়া, মণিপুরী, খুমি, খিয়াং, লুসাই, বম, ম্রো ও রাজবংশীসহ বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক আদিবাসী জনগোষ্ঠী বসবাস করেন। তাঁরা তাঁদের স্বকীয়তা, বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি, সমৃদ্ধ মূল্যবোধ ও ঐতিহ্য দিয়ে আমাদের দেশকে সমৃদ্ধ করেছেন। ভুলে গেলে ভুল হবে যে, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে এ সকল আদিবাসীদের রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল অবদান। নিজেদের স্বতন্ত্র পরিচয় বজায় রেখে আদিবাসী জনগণ যাতে সকলের মত সমান মর্যাদা ভোগ করতে পারেন, সেটি নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের কর্তব্য। আমরা মনে করেছিলাম, চল্লিশ বছরে ভূ-রাজনীতির গতিপ্রকৃতি যেমন পাল্টেছে জাতির আশা-আকাঙক্ষা, মন-রুচিও অনেক অনেক পাল্টেছে, তাই এখন যে সংবিধান রচিত হবে তা কেবল ধর্ম নিরপেক্ষ হলেই চলবে না, একইসঙ্গে ভাষা নিরপেক্ষ, জাতি নিরপেক্ষ, যৌনতা নিরপেক্ষ ও লিঙ্গ নিরপেক্ষ হতে হবে। ভুলে গেলে ভুল হবে যে, বাঙালির একক জাতীয়তাবাদের দেমাগ ইতোপূর্বে রাষ্ট্রীয় শান্তির ক্ষেত্রে বহুবিধ সমস্যাই কেবল পয়দা করেছে, কোনো সমাধান বাতলাতে পারেনি। শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে এরকম ধারণা কাজ করে যে একটি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য মুছে ফেলতে না পারলে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা জোরদার হয় না। আমরা মনে করি একক জাতীয়তাবাদের প্রাবল্য একটি ভুল প্রেমিজ; বরং একটি দেশের জনবিন্যাস, ঐতিহ্য, ভাষা ও কৃষ্টির বহুমুখী বিচিত্র রূপই রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে; এটিই বৈচিত্রের ঐকতান বা বহুত্ববাদ – বিউটি অব ডেমোক্রেসি। একক জাতিসুলভ দাম্ভিকতা বাদ দিয়ে দ্রুত এই সত্য বুঝতে পারলে রাষ্ট্রের জন্য বরং ভালো যে, বাংলাদেশ কোনো এক জাতি এক ভাষা আর এক ধর্মের রাষ্ট্র নয়; এটি অবশ্যই একটি বহু জাতি, বহু ভাষা ও বহু ধর্মের রাষ্ট্র; সেই আশায় আমাদের দাবিসমূহ আবারো তুলে ধরছি:
#আইএলও-এর ১০৭ ও ১৬৯ নং কনভেনশন এবং ২০০৭ সালে গৃহীত জাতিসংঘ আদিবাসী জনগোষ্ঠী অধিকার বিষয়ক ঘোষণাপত্র মোতাবেক আদিবাসীদের ঐতিহ্যগত ভূমি অধিকারের আইনগত ও সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা হোক।
সংবিধান সংশোধন করে আদিবাসী অধিকারের স্বীকৃতি দিয়ে তাদের আত্ম-নিয়ন্ত্রণ অধিকারসহ ভূমি ও সম্পদের উপর অধিকার নিশ্চিত করা;
শান্তি চুক্তি অনুযায়ী পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করা;
সমতলের আদিবাসীদের জন্য স্বতন্ত্র ভূমি কমিশন গঠন ও সমতলের আদিবাসীদের জন্য আলাদা মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করা;
জাতীয় আদিবাসী কমিশন গঠন করা;
ইনডিজিনাস পিপলস্‌ রাইটস অ্যাক্ট বা আদিবাসী অধিকার আইন প্রণয়ন করা ।

আমারা এখনও মনে করি বাংলাদেশ একটি বহু জাতির সম্মানজনক অংশীদারিত্বের রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত হওয়ার স্বপ্নকে ধারণ করতে সক্ষম হবে। আমরা চাই দেশে বসবাসকারী সকল জাতির সমান মর্যাদার ভিত্তিতে নতুন করে রচিত হোক আগামীর সংবিধান।
তথ্যসূত্র:
সঞ্জীব দ্রং ২০১২, আদিবাসী দিবস উপলক্ষে সিরডাপ মিলনায়তনে পঠিত, ৭ আগস্ট ২০১২
তথ্যপত্র: পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটি, ২০১১
আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক জাতিসংঘ ঘোষণাপত্র, ২০১১
সঞ্জীব দ্রং ২০১৪, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ও আদিবাসী ফোরাম যৌথ আয়োজিত ন্যাশনাল সেমিনারে উপস্থাপিত, সিরডাপ, ২৭ মে ২০১৪
ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার্ক গ্রুপ ফর ইন্ডিজিনাস অ্যাফেয়ার্স-এর সূত্রে উদ্ধৃত, সংহতি ২০১১, পৃষ্ঠা ২৩
ঘোষণাপত্র, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, ২০১২
রোবায়েত ফেরদৌস ২০১১, ‘সংবিধানের পঞ্চদশ সংধোধনী: আদিবাসীদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া বাঙালি জাতিয়তাবাদ’, সংহতি, ২০১১, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, ঢাকা ০৯ আগস্ট ২০১১
আবুল বারাকাত, “পলিটক্যিাল ইকোনমি অব আনপিপলিং অব ইন্ডিজিনাস পিপলস: দ্য কেইস অব বাংলাদেশ”, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সম্মেলন, জানুয়ারি, ২০১৫
রোবায়েত ফেরদৌস ২০১৩, গণমাধ্যম ও আদিবাসী, গতিধারা, ঢাকা, আগস্ট ২০১৩
নির্বাচনী ইশতেহার, ২০১৪ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ
সংবাদ সম্মেলন, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি, ১ ডিসেম্বর ২০১৪
সংবাদ সম্মেলন, ৮টি মানবাধিকার ও উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা, ১৩ নভেম্বর ২০১৪, ঢাকা রিপোটার্স ইউনিটি
রোবায়েত ফেরদৌস: মানবাধিকার কর্মী; সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়[email protected]

Back to top button