সামরিকায়নের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত এশিয়ার আদিবাসী জনগোষ্ঠী
আইপিনিউজ ডেস্কঃ ১০ মে ২০১৬ শুরু হয় নিউয়র্ক শহরে শুরু হয় আদিবাসী বিষয়ক জাতিসংঘের স্থায়ী ফোরামের ১৫তম অধিবেশন। চলে ২০ মে পর্যন্ত। সংঘাত, শান্তি, এবং নিরসন এবং আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীসমূহের উপর এর প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করার লক্ষ্যে সারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত হতে হাজারের অধিক অংশগ্রহণকারী সমবেত হয় দু’সপ্তাহ ব্যাপি এই বার্ষিক অধিবেশনে।
অধিবেশনের প্রথম দিনে, একদল প্রতিনিধিবর্গ এশিয়ার আলোকে প্রতিপাদ্য বিষয় সম্পর্কে তাদের বক্তব্য তুলে ধরতে এবং সচেতনতা গড়ে তোলার লক্ষ্যে একটি পার্শ্ব অধিবেশনে সমবেত হয়। বিশ্বের মোট আদিবাসী জনগোষ্ঠীর আনুমানিক দুই-তৃতীয়াংশ আদিবাসী এশিয়া মহাদেশে বাস করে থাকে, যা সমগ্র এশিয়াকে সর্বাধিক সাংস্কৃতিকগতভাবে বৈচিত্রপূর্ণ অঞ্চলে পরিণত করে। সামরিকায়ন এবং আদিবাসীদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার এবং ভূমি অধিকারের প্রতি অস্বীকৃতিই হচ্ছে এ অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান বড় চ্যালেঞ্জসমূহের মধ্যে অন্যতম। এই আলোচনায় আদিবাসী বিষয়ক জাতিসংঘের স্থায়ী ফোরামের সদস্য ও এশীয় ইন্ডিজেনাস পিপলস প্যাক্ট-এর মহাসচিব জোয়ান কার্লিং বলেন, এশিয়া আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে সামরিকায়ন হচ্ছে সংঘাত বৃদ্ধি এবং মানবাধিকার লংঘনের অন্যতম কারণ।
আদিবাসী বিষয়ক আন্তর্জাতিক ওর্য়াক গ্রুপ এর হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট সেনাবাহিনীর এক-তৃতীয়াংশ পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত রয়েছে, যেখানে দেশের সর্বমোট জনসংখ্যার মাত্র একশতাংশ বসবাস এবং নয় শতাংশ ভূমি রয়েছে। বাংলাদেশের ১১টি আদিবাসী জাতিসত্তার আবাসস্থল পার্বত্য চট্টগ্রাম হচ্ছে বিশ্বে সর্বাধিক সামরিকায়িত অঞ্চল হিসেবে এখনো বিদ্যমান রয়েছে।
আদিবাসীদের অধিকার এবং আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের বিষয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি এবং বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে দু’শক ধরে সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু হলে গোড়ারদিকে সামরিক স্থাপনা গড়ে তোলা হয়। ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে সেনাবাহিনী সরিয়ে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি থাকলেও সামরিক বাহিনীর উপস্থিতি এবং কার্যত সামরিক শাসন অব্যাহত রয়েছে।
অধিবেশন চলাকালে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বিষয়ে তার মতামত ব্যক্ত করেন “ইতিমধ্যে ১৮ বছর অতিবাহিত হয়েছে এবং অধিকাংশ বিষয়সমূহ এখনো অবাস্তবায়িত অবস্থায় রয়েছে”, ।
এই বিষয়ে সঞ্জীব দ্রং জোরালো যুক্তি উপস্থাপন করে বলেন যে, আদিবাসী জাতিসমূহ সামরিক বাহিনীর বিরোধী নয়, তবে তারা সামরিক শাসন সমর্থন করেন না। তিনি উল্লেখ করেন “সেনাবাহিনী সেখানে থাকতে পারে, তবে বেসামরিক সরকার অঞ্চলটি শাসন করবে।” তিনি আরও বলেন যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে তা হয়নি যেহেতু আদিবাসীদের স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানসমূহ অকার্যকর অবস্থায় রয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারের ব্যর্থতা এবং উক্ত অঞ্চলে অব্যাহতভাবে সামরিক বাহিনীর নিয়োজিত রাখার জন্য ফোরামের নিয়োগকৃত স্পেশাল র্যাপোটিয়র লারস অ্যান্ডারস বায়ার উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি তার প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করেন, “কার্যকর অগ্রগতি অভাবের ফলে এ অঞ্চলে আদিবাসী জনসাধারণের মাঝে হতাশা ও অসন্তোষ সৃষ্টি হচ্ছে।” অ্যান্ডারস বায়ার আরও উল্লেখ করেন “চুক্তির স্পিরিটকে লঙ্ঘন করে বা চুক্তি পরিপন্থী অবস্থানের ফলে চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারের আন্তরিক সদিচ্ছা ও রাজনৈতিক সক্ষমতা বিষয়ে মানুষের আস্থা কমে আসছে” ।
পার্বত্য অঞ্চলে সেনা উপস্থিতি নিয়ে সম্পূরক প্রশ্নর উত্তরে স্ঞ্জীব দ্রং বলেন, সেনাবাহিনী কর্তৃক নির্যাতন এবং অবৈধ গ্রেফতার, বিরুদ্ধপক্ষের উপর দমন চালানো এবং ভূমি বেদখল এই সবই বড় ধরনের সমস্যা। স্থানীয় আদিবাসীদের জোরপূর্বক উচ্ছেদ এবং অস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের নিকট অবৈধভাবে ভূমি ইজারা প্রদান ছাড়াও, সেনাবহিনী কর্তৃক পর্যটন শিল্প উদ্যোগের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসীদের ভূমি বেদখল এবং নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ হওয়ার কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন।
সেনা কল্যাণ সংস্থা, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি বাণিজ্য শাখা হচ্ছে একটি আবাসন প্রকল্প উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনার একটি অন্যতম ভূমিকাপালনকারী সংগঠন। সরকারি আর্থিক সহায়তা প্রদানসহ এবং শান্তি রক্ষা কাজ থেকে উপার্জিত অর্থ দিয়ে, উক্ত সংস্থা পার্বত্য চট্টগ্রামে নীলগিরিসহ বিলাসবহুল বিনোদন কেন্দ্র পরিচালনা করে থাকে। এই কেন্দ্র নির্মাণের সময়, স্থানীয় সূত্রমতে সেনাবাহিনী আদিবাসীদের একটি বাগানসহ অনেক দোকান এবং পাশ্ববর্তী একটি স্কুল ধ্বংস করে দিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
অনুরূপভাবে আদিবাসীদের নেতা যোসেফাইন পগলন ফিলিপাইনের প্রাকৃতিক সম্পদের সম্ভার মিনদানাও দ্বীপে ভূমি বেদখলের বিষয়ে আলোচনা করেন। দ্বীপটি ইহার তামা এবং সোনাসহ প্রাকৃতিক খনিজ সম্পদের জন্য বিশেষভাবে সুপরিচিত। যার কারণে ফিলিপাইনের আধা-সামরিক বাহিনী বাদে সেনাবাহিনীর ষাট শতাংশ মিনদানাওতে নিয়োজিত থাকে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
দক্ষিণ ফিলিপাইনেও দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ আদিবাসীদের বসবাস যাদের সমষ্টিগতভাবে লুমাদস বলা হয়। দেশের সেনাবাহিনী জোরপূর্বকভাবে অসংখ্য লুমাদস অধিবাসীদের বাস্তুচ্যুত এবং উচ্ছেদ করে, যা খনিজ কোম্পানিসমূহের কার্যক্রম বৃদ্ধিতে এবং সুরক্ষার লক্ষ্যে পরিচালিত বলে অনেকে মনে করেন। আদিবাসী নেতৃবৃন্দকে নির্বিচারে হত্যাকাণ্ডের সাথে সেনাবাহিনী জড়িত রয়েছে।
পগলন যিনি ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করেছিলেন, আধা-সামরিক বাহিনী কর্তৃক আকস্মিক আক্রমণ/হামলার কথা স্মরণ করে বর্ণনা করলেন: গত ১লা সেপ্টেম্বর, দিবাগত রাত ৩.৩০ মিনিটে, আমাদের জোরপূর্বকভাবে ঘুম থেকে ওঠানো হয় এবং আমাদের সবাইকে ১৫০ জনকে বাড়ি-ঘর ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হয়। তার চোখের সামনে আদিবাসী নেতা দিওনেল কামপুস এবং তার ফুফাতো ভাই অরেলিও সিনজো সহ লুমাদের বিদ্যালয় এর কার্যনির্বাহী পরিচালক, ইমেরিকো সামারকাকে বহুবার ছুরিকাঘাত করা হয়।
“তাদের মৃত্যেুর পর, (আধা সামরিক বাহিনী সদস্যরা) বলল যে দু’দিনের মধ্যে আমাদের চলে যেতে হবে এবং যদি আমরা না যেতাম, আমাদের সবাইকে নির্বিচারে হত্যা করা হত।” তিনি উপস্থিত প্রতিনিধিবর্গের সম্মুখে বর্ণনা করেন। উক্ত ঘটনার ফলে প্রায় ৩,০০০ হাজার লুমাদ উচ্ছেদ হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
এই হামলা সংঘটিত হওয়ার একদম এক মাস পূর্বে, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ প্রতিবেদন প্রদান যে, ফিলিপাইন সরকারের সৈন্যরা ১৩ ও ১৭ বছরের শিশুসহ লুমাদ এর একটি পরিবারের পাঁচ জন সদস্যকে হত্যা করে যেটি গুরুতর ধারাবাহিক মানবাধিকারের লঙ্ঘন।
রাষ্ট্রপতি তৃতীয় বেনিগনো অ্যাকুইনু অপরাধ এক বাক্যে অস্বীকার করেন, উল্লেখ করেন যে “লুমাদ জনসাধারণের হত্যার জন্য কোন অভিযান পরিচালনা করা হয়নি, আমরা জনসাধারণকে সেবা প্রদান করছি।” চিরায়ত ভূমিতে পুনর্বাসনসহ পগলন ক্ষতিগ্রস্ত আদিবাসী জনসাধারণের জন্য সরকারের দায়বদ্ধতা হয়েছে এবং ন্যায় বিচারের জন্য তিনি আহ্বান জানান।
বাংলাদেশের রাজনীতিক এবং অধিকার কর্মী দেবাশীষ রায় স্থায়ী ফোরামে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে পার্বত্য চট্টগ্রামে ন্যায় বিচারের পক্ষে বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করেন। তিনি উল্লেখ করেন, আমাদের সত্যিকারভাবে শান্তির জন্য অন্বেষণ করা প্রয়োজন… কারণ ন্যায় বিচার হলো অপরিহার্য অংশ। আপনি বৈরিতার বিরতি হতে পারে কিন্তু এর মানে এই নয় যে তা প্রকৃতই সমাধান হয়েছে।
জোয়ান কার্লিং স্থায়ী ফোরামের নিকট আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, আদিবাসীদের অধিকার এবং সংঘর্ষ সমাধানের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে এবং কার্যকর করতে আদিবাসী স্থায়ী ফোরাম বিশেষভাবে সদস্য রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করবে। তিনি আরও বলেন, যতক্ষণ না পর্যন্ত রাষ্ট্রসমূহ কর্তৃক এ বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হবে না এবং সামরিকায়নের বিষয়টি রাজনৈতিক সদিচ্ছা সহিত বিহিত করা হবে না… পরিস্থিতি পরিবর্তনের আমরা তেমন প্রত্যাশা করতে পারি না।
জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন উদ্বোধনী অধিবেশনে এক ভিডিও বার্তায় আদিবাসী সমস্যাবলী সম্পর্কে ব্যাপকভাবে পদ্ধতিগত একযোগে সঙ্গতিপূর্ণ কর্ম-পরিকল্পনা পরিচালনার কথা ঘোষণা করেন। “আদিবাসীদের সাংস্কৃতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ন্যায় বিচার ব্যতীত স্থায়ী শান্তি অর্জন সম্ভব নয়। আদিবাসী জনসাধারণের পূর্ণ অধিকার বাস্তবায়ন করতে আমাদের একত্রে কাজ করা জরুরি” বলে তিনি উল্লেখ করেন।
আইপি নিউজ পাঠকদের জন্য পাপেল চাকমা কর্তৃক অনুদিত