বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগে খেলছেন পাহাড়ের চার প্রতিভাবান আদিবাসী ফুটবলার

আইপিনিউজ ডেস্ক: বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগে খেলছেন পাহাড়ের চার প্রতিভাবান আদিবাসী ফুটবলার।
বিস্তারিত: বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগ ফুটবল ২০২৫-২৬ মৌসুমে খেলার সুযোগ পেয়েছের পাহাড়ের চার প্রতিভাবান আদিবাসী ফুটবলার। এদের মধ্যে বসুন্ধরা কিংস-এ উসিং মারমা, আরামবাগ ক্রিড়া সংঘে সমর জয় ও নিক্সন এবং ফর্টিস এফসি তে খেলছেন আইক্য মারমা। এছাড়াও পাহাড় থেকে ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের গোলবার সামলাচ্ছেন মিঠুল মারমা। পাহাড়ের এ চারজন আদিবাসী খেলোয়াড় ছাড়াও খেলছেন সমতল থেকে অনেক প্রতিভাবান ফুটবলার। এদের মধ্যে রাফায়েল টুডু, শান্ত টুডু, সুশান্ত ত্রিপুরা, স্যামুয়েল রাকসাম, ডালিম বর্মন ও প্রণয় মারান্ডি অন্যতম। উল্লেখ্য যে, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫ থেকে শুরু হওয়া এ লীগ চলবে ২৪ এপ্রিল ২০২৬ সাল পর্যন্ত।
প্রতিভাবান এ ফুটবলারদের নিয়ে প্রতিবেদন তৈরী করেছেন রাঙ্গামাটির বরগাঙ স্পোর্টিং ক্লাব-এর আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সচিব অতুল বরন চাকমা (পিজোর)।
উসিং মারমা: পাহাড়ের দুর্গম পথ পেরিয়ে জাতীয় দলের স্বপ্নে উড়তে থাকা এক উদীয়মান প্রতিভা

বাংলাদেশ ফুটবলের উঠতি তারকাদের তালিকায় নতুন যে নামটি সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হচ্ছে, সে হলো উসিংথোয়াই মারমা উসিং। বান্দরবানের প্রত্যন্ত পাহাড়ি অঞ্চল থেকে উঠে আসা এই প্রতিভাবান ফুটবলার যেন নিজের শৈশব, সংগ্রাম আর স্বপ্নকে একসূত্রে গেঁথে দিচ্ছেন বর্ণিল সাফল্যের গল্পে।
বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলার দূরবর্তী সানাক্র পাড়া গ্রামে জন্ম উসিংয়ের। বাবা ক্যসাচিং মার্মা একজন জুমচাষী। জীবনের কঠোর পরিশ্রম আর পাহাড়ি প্রকৃতির সঙ্গে যাঁর নিত্য লড়াই। ঠিক সেই প্রকৃতি, সেই পরিশ্রম, সেই মাটির গন্ধেই বড় হয়ে উঠেছে উসিং। শৈশবটা ছিল একেবারে সহজ-সরল-কখনো জুমের কাজে বাবাকে সাহায্য করা, কখনো গ্রামের বন্ধুদের সঙ্গে ফুটবল নিয়ে দৌড়ঝাঁপ। বল নিয়ন্ত্রণ, ড্রিবলিং আর গতির চমৎকার সমন্বয়ে ছোটবেলা থেকেই নজর কাড়তে শুরু করেন তিনি।
রুমা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই ফুটবল তাকে নিয়ে যায় ভিন্ন এক দুনিয়ায়। মাঠে তার গতি, টেকনিক আর দৃঢ়তা দেখে স্থানীয়রা বুঝে গিয়েছিলেন- ছেলেটি দীর্ঘ যাত্রার জন্যই তৈরি হচ্ছে। এসএসসি পাস করার পর বর্তমানে তিনি রুমা সরকারি সাঙ্গু কলেজে ইন্টার প্রথম বর্ষের ছাত্র। পড়াশোনা আর ফুটবল, দুইই সমানতালে এগিয়ে নিচ্ছেন এক অনন্য শৃঙ্খলা নিয়ে। স্থানীয় টুর্নামেন্টে সুনাম অর্জনের পর ঢাকায় এসে বিসিএলের মাঠে উসিং নিজেকে চেনান নতুনভাবে। ড্রিবলিং, বলের দাপট আর মাঠে তীক্ষ্ণ উপস্থিতি তাকে দ্রুতই আলোচনায় এনে দেয়। সেখান থেকেই শুরু হয় বড় স্বপ্নের পথচলা।
অনূর্ধ্ব-১৮ দলের হয়ে দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের পর বিপিএলে বসুন্ধরা কিংসের জুনিয়র স্কোয়াডে যোগ দেন উসিং। বয়সভিত্তিক দলে ধারাবাহিক পারফরম্যান্সে ক্লাব ম্যানেজমেন্টের আস্থা কুড়ান তিনি। এবং অবশেষে ২০২৫–২৬ মৌসুমে বসুন্ধরা কিংস তাকে সিনিয়র দলে অন্তর্ভুক্ত করে- যা তার ক্যারিয়ারের এক যুগান্তকারী অর্জন। অনেকের মতে, উসিং মারমা জাতীয় দলের জন্য এক অনন্য সম্পদ হয়ে উঠতে পারে। বয়স কম হলেও তার শৃঙ্খলা, পরিশ্রম, আর মাঠের পরিণত খেলা ভবিষ্যতের বড় সাফল্যের বার্তা দিচ্ছে।
পাহাড়ি দুর্গম গ্রামের ছোট্ট উসিং থেকে ঢাকার বড় ক্লাবের সদস্য-এই পথচলা শুধু তার একার নয়; এটি হাজারো পাহাড়ি তরুণের স্বপ্নকে ডানা মেলানোর গল্প।উসিং মারমা শুধু একজন ফুটবলার নন, তিনি পাহাড়ের স্বপ্ন, সংগ্রাম এবং সম্ভাবনার প্রতীক। তার যাত্রা প্রমাণ করেমেধা, পরিশ্রম আর বিশ্বাস থাকলে পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথও সাফল্যের মহাসড়কে পরিণত হয়। বাংলাদেশ ফুটবল তার পা ছোঁয়া এই উঠতি প্রতিভার কাছে আজ বড় কিছু প্রত্যাশা করে- আর উসিং মারমা নিজেও যেন সেই প্রত্যাশা পূরণের জন্যই লড়ে যাচ্ছেন নিরলসভাবে।
নিক্সন চাকমা: পাহাড়ি মাঠ থেকে দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছেন ঢাকার সবুজ ঘাসে

রাঙামাটির বিলাইছড়ি উপজেলার দিঘোলছড়ি মাঠ থেকেই ফুটবল যাত্রা শুরু করেছিলেন নিক্সন চাকমা। ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলার প্রতি প্রবল আকর্ষণ তাকে অন্য সবার থেকে আলাদা করে তুলেছিল।
দ্বিতীয় বিভাগ ফুটবল লীগে ব্রাদার্স ইউনিয়নের হয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়ে প্রথম আলোচনায় আসেন তিনি। এরপর বয়সভিত্তিক প্রতিযোগিতা ও জেলা পর্যায়ে একে একে নিজের প্রতিভার প্রমাণ দেন।
২০১৭ সালে বিজি প্রেস ক্লাবের হয়ে দ্বিতীয় বিভাগ ফুটবলে ঢাকার মাঠে তার অভিষেক ঘটে। পরে খেলেছেন চট্টগ্রাম প্রথম ডিভিশন, আর সর্বশেষ ২০২৪-২৫ মৌসুমের ঢাকা চ্যাম্পিয়ন্স লীগে আরামবাগ ক্রীড়া সংঘের অধিনায়ক হিসেবে দলকে রানার্সআপ করেন।
তার গতি, শারীরিক সক্ষমতা, নিখুঁত কাভারিং এবং মাঠে নেতৃত্বদানের ক্ষমতা কোচদের চোখে তাকে এক নির্ভরযোগ্য খেলোয়াড়ে পরিণত করেছে। এবারের মৌসুমে আরামবাগ ক্রীড়া সংঘের রক্ষণভাগের দায়িত্বে থাকবেন তিনি।
সমরজয় তঞ্চঁঙ্গ্যা: খালি পায়ে শুরু করে প্রিমিয়ার লিগে সুযোগ পাওয়ার সংগ্রামের গল্প

নিক্সনের যাত্রা ছিল সুসংগঠিত, কিন্তু সমরজয়ের গল্প অনেক বেশি সংগ্রামের। বিলাইছড়ির দোজরী পাড়ার এক জুমচাষী পরিবারে জন্ম তার। আর্থিক কষ্টে শৈশবে ফুটবলের বুট জোগাড় করাও ছিল স্বপ্নের মতো। তবু খালি পায়ে খেলেই দিঘোলছড়ি মাঠে নিজের স্বপ্ন বুনতে থাকেন তিনি।
পরে স্থানীয় ক্রীড়ানুরাগীদের সহযোগিতায় সাবেক জাতীয় দলের ফুটবলার অরুণ বিকাশ দেওয়ানের মাসব্যাপী ফুটবল প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে যোগ দেন। সেখানেই বাংলাদেশ জাতীয় দলের গোলকিপার মিতুল মারমাসহ আরও প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের সঙ্গে প্রশিক্ষণ নেন। কোচদের চোখে পড়েন সমরজয়, ডাক পান রাঙামাটি অনূর্ধ্ব-১৮ দলে। এরপর সুযোগ পান নোয়াখালীর পাইওনিয়ার ফুটবল একাডেমীতে। অনূর্ধ্ব-১৮ বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগে ঢাকা আবাহনীর হয়ে ঢাকার মাঠে অভিষেক ঘটে তার।
পরবর্তীতে খেলেছেন যাত্রাবাড়ী, বাংলাদেশ বয়েজ ক্লাব, ফকিরাপুল ইয়াংমেনস (২০২২-২৩) এবং আরামবাগ ক্রীড়া সংঘে (২০২৪-২৫), যেখানে দলের রানার্সআপ সাফল্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। পরবর্তীতে তার বাবা স্ট্রোক করার পর পরিবারের মূখ্য হয়ে ওঠেন সমর। পড়াশোনা ও পারিবারিক টানাপোড়নের মাঝেও ফুটবলের প্রতি একাগ্রতা, নিয়মিত অনুশীলন এবং অদম্য ইচ্ছাশক্তিই তাকে আজ প্রিমিয়ার লিগের দুয়ারে দাঁড় করিয়েছে। এবারের মৌসুমে আরামবাগ ক্রীড়া সংঘের মাঝমাঠ দখল রাখবেন সমরজয় তঞ্চঁঙ্গ্যা।
আইক্য মারমা: নাইক্ষ্যংছড়ির দুর্গম পাহাড় থেকে দেশের ফুটবলে আলো ছড়াচ্ছেন আইক্য

পাহাড়ি জনপদে ফুটবল মানেই আবেগ, আর সেই আবেগের এক তাজা মুখ আইক্য মারমা। বান্দরবানের সীমান্তবর্তী নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ধুংড়ী হেডম্যান পাড়া থেকে উঠে আসা এ তরুণ আজ পাহাড়ের গণ্ডি পেরিয়ে দেশের ফুটবলমঞ্চে নিজের আলো ছড়াচ্ছেন। যার প্রতিটি অগ্রযাত্রা পাহাড়ি তরুণদের জন্য এক নতুন প্রেরণা।
আইক্যের ফুটবল যাত্রা শুরু সাবেক জাতীয় দলের খেলোয়াড় উসাই মং মারমা (ছোটন)–এর হাত ধরে। ২০১৮ সালে ছোটনের সহযোগিতায় তিনি প্রথম জাতীয় দলের অনূর্ধ্ব–১৫ ট্রায়ালে অংশ নেন। সে বছর নীলফামারী ক্যাম্পে বর্তমান জাতীয় দলের গোলরক্ষক মিতুল মার্মার সঙ্গে সময় কাটানো ছিল তার জন্য বড় অভিজ্ঞতা। তবে সেবার দলে সুযোগ পাননি। এই ব্যর্থতাই তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি।
২০১৯ সালে নতুন উদ্যমে আবারও পথচলা শুরু। ছোটন মার্মার সহায়তায় সাইফ স্পোর্টিং ক্লাব একাডেমিতে সুযোগ পান। সেখানে ২ বছর পরিশ্রম, ঘাম আর স্বপ্নের সঙ্গে লড়ে গেছেন। কিন্তু ক্লাব একাডেমি বন্ধ হয়ে গেলে অনেকেই ভেঙে পড়লেও আইক্য মারমা ছিলেন ব্যতিক্রমী। তার বিশ্বাস ছিল একটাই—
“যার শৈশবের নেশা ফুটবল, সে কি করে সহজে স্বপ্নকে বিদায় জানায়! অদম্য সেই বিশ্বাসই তাকে এগিয়ে দেয়। ২০২২ সালে ফর্টিস এফসির হয়ে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে খেলার সুযোগ পান তিনি। সেখানে নিজের রক্ষণভাগের দৃঢ়তা, গতি ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরিপক্বতায় নজর কাড়েন কোচদের। সেই ধারাবাহিকতার ফল মিলল ২০২৪ সালে- বাংলাদেশ জাতীয় (অনূর্ধ্ব-২০) সাফ চ্যাম্পিয়ন দলে নিজের জায়গা পাকা করেন আইক্য মারমা।
বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ জাতীয় অনূর্ধ্ব-২৩ দলের নিয়মিত সদস্য। দেশের নানা প্রান্তে তার খেলার দৃঢ়তা, আগ্রাসীতা ও আত্মবিশ্বাসের কথা এখন আলোচিত। আর সেই পারফরম্যান্সের সুবাদে ফর্টিস এফসি ২০২৫-২৬ মৌসুমে তাকে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল) মূল দলে অন্তর্ভুক্ত করে।
রক্ষণভাগে তার উপস্থিতি যেন এক প্রাচীর-গতি, শক্তি, এবং বল দখলের অসাধারণ দক্ষতা তাকে আলাদা পরিচয় দিয়েছে। প্রতিপক্ষের আক্রমণ ভেঙে দেওয়া, দলকে স্বস্তি এনে দেওয়া এবং নিজের পজিশনে আধিপত্য বিস্তার-সব মিলিয়ে তিনি ফুটবলে পাহাড়ি জনপদের নতুন ভরসা।
আজ আইক্য মারমা শুধু একজন ফুটবলার নন, তিনি পাহাড়ি তরুণদের স্বপ্নের প্রতীক। বারবার রিজেকশন, বারবার বাধা-কিছুই তাকে থামাতে পারেনি। বরং প্রতিটি ব্যর্থতা তার পথচলার ইন্ধন হয়েছে। পাহাড়ের সন্তান আইক্য মারমা প্রমাণ করেছেন, যে স্বপ্ন দেখে, সে-ই পারে। আর যে বিশ্বাস ধরে রেখে পরিশ্রম করে, তারই প্রাপ্য সাফল্য।
বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগ ২০২৫-২৬ এ বিভিন্ন দলে জায়গা করে নেওয়া পাহাড়ের এ প্রতিভাগুলো প্রমাণ করছে প্রতিভা কখনো জায়গার সীমাবদ্ধতায় আটকে থাকে না। পাহাড়ের ছোট্ট মাঠ থেকে দেশের সর্বোচ্চ আসরে পৌঁছানো এই চার ফুটবলারের সাফল্য নিঃসন্দেহে পার্বত্য চট্টগ্রামের তরুণদের জন্য নতুন অনুপ্রেরণা।
স্থানীয় ক্রীড়ানুরাগীরা বলছেন, “আজ পাহাড়ের ছেলেরা দেশের সর্বোচ্চ আসরে খেলছে—এটা শুধু গর্ব নয়, বরং ভবিষ্যতের জন্য আশার আলো।” উসিং মারমা, নিক্সন চাকমা, সমরজয় তঞ্চঙ্গ্যা ও আইক্য মারমা’র সাফল্য শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামে নয়, বরং পুরো বাংলাদেশের ফুটবলেরই সম্পদ। তাদের অর্জন দেখিয়ে দিল, সীমিত সুযোগ ও কঠিন বাস্তবতা পেরিয়েও যদি মনের জোর আর পরিশ্রম থাকে তবে দেশসেরা মঞ্চে জায়গা করে নেওয়া সম্ভব। এখন পার্বত্য চট্টগ্রামের নতুন প্রজন্মের চোখে স্বপ্ন আরও বড়, একদিন জাতীয় দলের জার্সি গায়ে মাঠ কাঁপাবেন তাদের নায়করা।


