৯ম শ্রেণির গারো কিশোরীকে ধর্ষণের বিচারের দাবিতে শাহবাগে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সমাবেশ

আইপিনিউজ: গত ২৯ সেপ্টেম্বরে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটের ২ নং জুগলী ইউনিয়নের নবম শ্রেণির এক গারো আদিবাসী শিক্ষার্থী ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত আসামীদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে আজ শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরের সামনে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে আদিবাসী ছাত্র ও যুব সংগঠনসমূহ। প্রতিবাদ সমাবেশে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক শান্তিময় চাকমার সঞ্চালনায় ও বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরামের সহ-সভাপতি টনি চিরানের সভাপতিত্বে স্বাগত বক্তব্য রাখেন গারো স্টুডেন্টস ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক জানকি চিসিম।

সমাবেশে বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অনন্ত তঞ্চঙ্গ্যা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমরা এই শাহবাগে এইসব ঘটনার বিচারের দাবিতে টানা প্রতিবাদ সমাবেশ করেও রাষ্ট্র গতকাল আমাদেরকে উপহার দিল ধর্ষনের একটি মিথ্যা রিপোর্ট। মুনিয়া ও তনু ধর্ষণের প্রসঙ্গ টেনে মি. তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, এই ধরনের ঘটনায়ও ধর্ষনের কোন আলামত পাওয়া যায় নি বলে আমাদের কাছে তুলে ধরা হয়। এছাড়া ধর্ষণের ইস্যুতে ঘটনার তদন্তে আদিবাসীদের সাথে রাষ্ট্র ও প্রশাসন দ্বিচারিতা করে অভিযোগ তুলে তিনি বলেন সমতলে বা পাহাড়ে আদিবাসী নারী ধর্ষিত হলে তদন্তের জন্য দ্বায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলো ধীরগতিতে বা গুরুত্ব না দেওয়ার মত করে কাজ করে থাকে।
সভাপতির বক্তব্যে বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরামের সহ-সভাপতি টনি চিরান বলেন, একের পর এক নিপীড়নের শিকার হতে হতে আমাদের পিঠ দেয়ালে থেকে গেছে। আপনাদের অস্ত্র থাকতে পারে, আপনাদের ক্ষমতা থাকতে পারে, আপনাদের জাত্যাভিমান থাকতে পারে, এই জাত্যাভিমানের চাপে পড়েই আমরা নিষ্পেষিত, আদিবাসীদেরকে হত্যা করে, ধর্ষণ করে, গ্রামে আগুন দিয়ে, গুম করে সুপরিকল্পিতভাবে এই দেশ থেকে বিতারনের জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে, ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। এই ষড়যন্ত্রের অংশই হচ্ছে এই বিচারহীনতা সংস্কৃতি। এই ষড়যন্ত্র ও নীলনকশার বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিরোধ করতে হবে। আগামী দিনে পাহাড় ও সমতলে ঐক্যবদ্ধ লড়াই সংগ্রামের ঘোষণাও দেন তিনি।

বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সদস্য অনন্যা দ্রং তার বক্তব্যে রাষ্ট্রকে তার ব্যর্থতা স্বীকার করতে আহ্বান জানান। তিনি বলেন, আপনি এই সংস্কার করছেন, সেই সংস্কার করছেন, আপনার সবার আগে সংস্কার করা উচিত ছিল মানুষের মনমানসিকতার সংস্কার করা। আপনারা আদিবাসী বিরোধী যে ন্যারেটিভ তৈরি করছেন, যে মনোভাব তৈরি করছেন সেটির সংস্কার আগে দরকার। আপনি মনে করছেন আদিবাসী নারীরা বিচারের দাবিতে রাস্তায় নামলেই বিচ্ছিন্নতাবাদী, আপনাকে কে বলেছে আমরা বিচ্ছিন্নতাবাদী? আমরা কি কখনো বলেছি আমরা বিচ্ছিন্ন হতে চাই? ধর্ষণের বিচারের দাবিতে রাস্তায় নামলেই তাকে আপনি গুলি করবেন, হত্যা করবেন, সাম্প্রদায়িক হামলা করবেন, বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দেবেন তাহলে সে জায়গা থেকে আপনি বলে দেন যে সেই সব এই রাষ্ট্রে জায়েজ, আমরা আর রাস্তায় নামবো না।

বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সাবেক সভাপতি অলীক মৃ বলেন, খাগড়াছড়িতে যে ঘটনা ঘটেছে সেটি একটি সাজানো নাটকের মত স্ক্রিপ্ট। তিনি অভিযোগ করে বলেন, পার্বত্যাঞ্চলের ঘটনাগুলোতে ঐ উত্তরপাড়া থেকে যেভাবে বলা হয় রিপোর্টগুলো এভাবে লিখবেন, ঐভাবে লিখবেন সেই রিপোর্টটাই আমরা গতকালকে দেখেছি। তিনি গণমাধ্যমকে ধর্ষণের শিকার কিশোরীর পরিচয়, ছবি প্রকাশ করার বিষয়টি প্রকাশ করার সমালোচনা করে বলেন, ‘তার মানে বুঝতে হবে এটি উত্তরপাড়ারই সাজানো নাটক ছিল। উত্তরপাড়া থেকে যা বলা হয় তাই এই রাষ্ট্রে ঘটে তাই এই নাটককে আমরা ধিক্কার জানাই । ঐ বিচ্ছিন্নতাবাদের নাটক-তকমা দিয়ে বাংলাদেশের আদিবাসী সমাজকে দমিয়ে রাখতে পারবেন না, আমরা এই দেশকে ভালোবাসি, মনে ধারন করি এসব বিচ্ছিন্নতাবাদের তকমা দিয়ে আমাদের দেশ থেকে বিতাড়িত করতে পারবেন না বলে বক্তব্য রাখেন তিনি।
বাংলাদেশ গারো ছাত্র সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক প্যাট্রিক চিসিম বলেন, বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি সেটি রাষ্ট্র বারবারই বজায় রাখার চেষ্টা করে থাকে। আমরা সবসময়ই রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর অসহযোগীতামূলক আচরন দেখে আসছি। পাহাড়ের ঘটনার পরপরই সমতলে গারো কিশোরী ধর্ষণের শিকার হতে হয়েছে। পুলিশ প্রশাসন আমাদের শান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করে এই বলে যে, ‘আমরা দেখছি, প্রয়োজনী ব্যবস্থা নিচ্ছি, গ্রেপ্তার করছি’ কিন্তু আমরা বারবারই দেখতে পাই গ্রেপ্তার হওয়ার পরেও কোন ধর্ষণকারীর পর্যাপ্ত শাস্তি তো দূরে থাক, জামিন নিয়ে চোখের সামরে ঘুরতে দেখি। পাহাড় থেকে সমতলে আদিবাসীদের নিরাপত্তা দিতে কোন সরকারই চেষ্টা করেনি, তাই তারা বারবারই সেই নিরাপত্তা ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ হয়েছে। বক্তব্যে তিনি এই ধরনের ঘটনার জন্য প্রশাসনের চরম ব্যর্থতাকে দায়ী করেন।

বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্টস কাউন্সিল ঢাকা মহানগর শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক উসাইন মারমা তার বক্তব্যে বলেন, খাগড়াছড়ির ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই আমরা ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটে এই ধরনের ন্যাক্কারজনক ঘটনার শিকার হচ্ছি। এই ধরনের ঘটনা জাতিগত নিপীড়নের একটা অংশ বলে আমরা মনে করি। আমরা প্রতিবারই এই ধরনের ঘটনার সুষ্ঠু বিচার ও তদন্তের দাবিতে শাহবাগে প্রতিবাদ সমাবেশে দাড়াচ্ছি কিন্তু রাষ্ট্র আমাদের কোন সুবিচারের আশা দেখাতে পারে নি। এই সময় খাগড়াছড়িতে আদিবাসীদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনায় মিডিয়া কর্তৃক সঠিক তথ্য তুলে না এনে একপাক্ষিক বক্তব্য প্রচারের জন্য নিন্দা জানান।
এছাড়া সংহতি বক্তব্য রাখেন, গারো স্টুডেন্টস ফেডারশন, ঢাকা মহানগর শাখার সভাপতি নিপুল ম্রং, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের নারী বিষয়ক সম্পাদক ফাল্গুনী ত্রিপুরা, সুপ্রীমকোর্টের আইনজীকি এডভোকেট নিকোলাস চাকমা।
আজকের বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে আদিবাসী ছাত্র ও যুব সংগঠনসমূহ, নিম্নলিখিত দাবিগুলো জানিয়েছে-
১️। ধর্ষণের ঘটনায় জড়িত অভিযুক্ত সব আসামিকে অবিলম্বে গ্রেপ্তার এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
২️। ভুক্তভোগী ও তাঁর পরিবারের ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে ধর্ষণের সকল আলামত যথাযথভাবে সংগ্রহ, নিরপেক্ষ তদন্ত এবং এ বিষয়ে পুলিশ-প্রশাসনকে দায়িত্বশীল ভূমিকা করতে হবে।
৩️। ভুক্তভোগী কিশোরীর নিরাপত্তা, চিকিৎসা ও মানসিক পুনর্বাসনের ব্যবস্থা রাষ্ট্রকেই দ্রুত নিশ্চিত করতে হবে।
৪। আদিবাসী নারী ও কন্যাশিশুসহ সকল নারীর নিরাপত্তা রাষ্ট্রীয়ভাবে নিশ্চিত করতে হবে।
৫️। বারবার সংঘটিত আদিবাসী নারীর উপর নির্যাতনের ঘটনায় সরকারি পর্যায়ে স্বতন্ত্র তদন্ত কমিশন গঠন করতে হবে।