জাতীয়

অর্ন্তবর্তী সরকারের সময়ে পাহাড়ে সাম্প্রদায়িক হামলা: হত্যাকান্ডের বিচার হয়নি ১ বছরেও

গত ১৯ ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখে খাগড়াছড়ি রাঙ্গামাটিতে আদিবাসী জুম্ম জনগণের উপর সংঘটিত ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক হামলা, হত্যাকাণ্ড, অগ্নিসংযোগ লুটপাটের এক বছর পূর্ণ হলো। কিন্তু এক বছর পার হলেও এসব হত্যাকাণ্ড ধ্বংসযজ্ঞের বিচার হয়নি, অপরাধীরা এখনো শাস্তির বাইরে রয়ে গেছে।

২০২৪ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার দীঘিনালা উপজেলা খাগড়াছড়ি সদরে পরপর রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সহায়তায় সেটলার বাঙালি কর্তৃক আদিবাসী জুম্মদের উপর ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক হামলার হয়। উক্ত হামলায় সেটলার বাঙালি কর্তৃক দীঘিনালায় জুম্ম নিহত, জুম্ম আহত, অর্ধশতাধিক দোকান, ২৪টি মোটরবাইক অটোরিক্সা ভস্মীভূত হয় এবং খাগড়াছড়ি সদরে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে আরও জুম্ম নিহত, অনেকেই আহত হন।

এই হামলা শুধু খাগড়াছড়িতে সীমাবদ্ধ থাকেনি। দীঘিনালা খাগড়াছড়িতে জুম্মদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলার প্রতিবাদে পরের দিন রাঙ্গামাটি শহরে ছাত্রযুব সমাজ শান্তিপূর্ণ মিছিল প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করলে, সেখানেও সেটলার বাঙালি কর্তৃক জুম্মদের উপর কয়েক দফায় সাম্প্রদায়িক হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট হয়। এতে এক জুম্ম ছাত্রকে নৃশংসভাবে হত্যা, আঞ্চলিক পরিষদ কার্যালয়ে গাড়িতে অগ্নিসংযোগ, বৌদ্ধ বিহারে ভাঙচুর লুটপাট করা হয়।

ছবি: বৌদ্ধ বিহারে হামলা পরবর্তী (সংগৃহীত)

উক্ত সাম্প্রদায়িক হামলার পর পার্বত্য চট্টগ্রাম সহ দেশে বিদেশে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা, ব্যক্তিত্ব এবং রাজনৈতিক, নাগরিক ছাত্র সংগঠনের পক্ষ থেকে ব্যাপক প্রতিবাদের ঝড় ওঠে।

ব্যাপক প্রতিবাদের মুখে, অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ চট্টগ্রাম বিভাগের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন)-কে আহ্বায়ক এবং রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, বান্দরবান পার্বত্য জেলার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বান্দরবান পার্বত্য জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে সদস্য করে সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।

উক্ত কমিটিকেসংঘটিত সহিংস ঘটনার প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান, ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিতকরণ ভবিষ্যতে একই জাতীয় ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে যথাযথ সুপারিশ প্রণয়ন করা দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং তৎসময় হতে আগামী সপ্তাহের মধ্যে চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনারের নিকট প্রতিবেদন দাখিল করার নির্দেশ দেওয়া হয়।

কিন্তু বিগত এক বছরেও উক্ত তদন্ত কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন জনসম্মুখে প্রকাশ করার কথা জানা যায়নি। অপরদিকে বিগত এক বছরেও দীঘিনালা খাগড়াছড়ি সদরে সংঘটিত উক্ত সাম্প্রদায়িক হামলায় জড়িত অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি এবং কোনো মামলা দায়ের করা হয়নি বলে জানা গেছে।

উল্লেখ্য, গত ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ তারিখে মোঃ মামুন (৪০) নামে এক সেটলার বাঙালি খাগড়াছড়ি সদরের মধুপুর থেকে একটি মোটর বাইক চুরি করে নিয়ে যাওয়ার সময় জনতার ধাওয়া খেয়ে বাইক থেকে পড়ে গিয়ে, পরে জনতার পিটুনিতে গুরুতর আহত হওয়ার পর মারা যায়। জানা গেছে, এই সময়ে ওই মামুনের বিরুদ্ধে চুরি মাদক সংক্রান্ত অন্তত ১৭টি মামলা চলমান ছিল। পরে দিনই সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর নেতৃত্বে সেটলার বাঙালিদের একটি দল মধুপুর সহ খাগড়াছড়ি সদরের একাধিক এলাকায় জুম্মদের উপর হামলার চেষ্টা করে। এক পর্যায়ে জুম্মরা প্রতিরোধে এগিয়ে আসলে সেটলাররা পিছু হটে।

ছবি: রাঙামাটিতে সেটলারের হামলায় আহত একজন আদিবাসী তরুণ (সংগৃহীত)

কিন্তু এর পরের দিন (১৯ সেপ্টেম্বর) বিকাল ৪টার দিকে বাঙালি ছাত্র পরিষদের ব্যানানের সেটলার বাঙালিরা দীঘিনালা উপজেলা সদরে উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়ে সমাবেশ মিছিল করে এবং এক পর্যায়ে দফায় দফায় আশেপাশের এলাকায় দীঘিনালা সদরের লারমা স্কোয়ার স্টেশন বাজারে নিরাপত্তা বাহিনীর সামনেই জুম্মদের উপর হামলা দোকানে অগ্নিসংযোগ করে। রাত প্রায় ৯টা পর্যন্ত হামলা অগ্নিসংযোগ চলে। এতে ধন রঞ্জন চাকমা (৫২) নামে এক জুম্ম গুরুতর আহত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। এছাড়া জন গুরুতর আহত হন। দোকানে বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগের ফলে কমপক্ষে কোটি টাকার সম্পত্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে জানা যায়।

একই দিন (১৯ সেপ্টেম্বর) রাতে উক্ত হামলার প্রতিবাদে খাগড়াছড়ি সদরে বিক্ষুব্ধ ছাত্রযুব সমাজের একটি অংশ সড়কে নেমে আসলে, এক পর্যায়ে সেখানে সেনাবাহিনীর একটি দল উপস্থিত হয়। এতে উভয়পক্ষের বাকবিতন্ডা উত্তেজনার এক পর্যায়ে সেনা সদস্যরা গুলি করলে, এতে জুনান চাকমা (২০) রুবেল ত্রিপুরা (৩০) নামে দুই যুবক গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। এসময় আরও অন্তত ২০ জন ছাত্রযুবক আহত হয় বলে জানা যায়।

পরেরদিন ২০ সেপ্টেম্বর, রাঙ্গামাটি জেলা শহর এলাকায় দীঘিনালা খাগড়াছড়িতে জুম্মদের উপর ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক হামলা হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে মিছিলকারী জুম্ম ছাত্রযুবকদের উপর সেটলার বাঙালি কর্তৃক সাম্প্রদায়িক হামলা করা হয়। উক্ত হামলার ঘটনায় অনিক চাকমাকে হত্যা ছাড়াও অন্তত শতাধিক জুম্ম আহত হন এবং জুম্মদের ২৪টি বাড়ি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ লুটপাট, একটি ঐতিহ্যবাহী বৌদ্ধ বিহারে লুটপাট ভাঙচুর করা হয়। এতে অন্তত কোটি টাকার সম্পত্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অপরদিকে, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ কার্যালয় বিশ্রামাগারে হামলা চালিয়ে সেটেলার বাঙালিরা আঞ্চলিক পরিষদের ১টি পিকআপ, ৫টি পাজেরো, ব্যক্তিগত ২টি গাড়ি, ৫টি মোটর সাইকেল এবং উন্নয়ন বোর্ডের ১টি পাজেরো ১টি পিকআপে অগ্নিসংযোগ করে। এতে অন্তত কোটি টাকার সম্পত্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

সেদিন সেটলার বাঙালিরা নিউমার্কেট সংলগ্ন কালিন্দীপুর সড়কে ইট লাঠিসোটা দিয়ে মাথা শরীরে আঘাত করতে করতে কাপ্তাইয়ের কর্নফুলী সরকারি ডিগ্রি কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক ১ম বর্ষের ছাত্র অনিক চাকমাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। উক্ত হত্যার ঘটনাটির ভিডিও চিত্র তৎকালীন সময়ে সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হতে দেখা যায়। হামলাকারী অনেককে স্পষ্টভাবে দেখতে পাওয়া যায়।

উক্ত হামলার ঘটনায় অন্তত ৩টি মামলা দায়ের করার কথা জানা যায়। এর মধ্যে ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখে প্রথম মামলাটি করেন হত্যার শিকার অনিক চাকমার পিতা আদর সেন চাকমা, যেটি রাঙ্গামাটির কোতয়ালী থানার মামলা নং; পুলিশ কর্তৃক দ্বিতীয় মামলাটি দায়ের করা হয় ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখে, যেটি কোতয়ালী থানায় মামলা নং এবং আঞ্চলিক পরিষদের পক্ষে তৃতীয় মামলা করেন মুজিবুর রহমান অক্টোবর ২০২৪ তারিখে, যেটি রাঙ্গামাটির কোতয়ালী থানার মামলা নং১। এছাড়া অনিক চাকমার মা তারা সুন্দরী চাকমাও একটি মামলা করেছিলেন বলে জানা যায়।

ছবি: অগ্নিসংযোগের সময় সেটলার কর্তৃক দিঘীনালা বাজার লুটপাত, নিরপত্তা বাহিনীর নিরব ভূমিকা পালন। (সংগৃহীত)

উক্ত ঘটনার পর দৈনিক সমকাল পত্রিকার তথ্য অনুযায়ী দুই দফায় জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে কোনো আলামত না পাওয়ায় এদের মধ্যে অনেক আগে দুইজন জামিন পেয়ে মুক্ত হন বলে জানা যায়।

সর্বশেষ জনকে গ্রেপ্তার করার কথা জানা যায়। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেনঅনিক চাকমা হত্যা মামলার আসামী মোঃ রুবেল (২৩), মোঃ জালাল (২৭) আরবার (১৭) এবং অগ্নিসংযোগ ভাঙচুরের মামলার আসামী রাকিব (২৭) আরিফুল (১৭) অনিক চাকমা হত্যা মামলার তিন আসামীর মধ্যে একজন মোঃ রুবেল ইতোমধ্যে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে।

গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে হত্যা মামলার আসামী আবরার (১৭) এবং অগ্নিসংযোগ ভাঙচুরের মামলার আসামী রাকিব (১৭) দুইজনকে নাবালক হিসেবে অনেক আগে কারাগার থেকে স্থানান্তর করে জাতীয় কিশোর উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানে পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে।

সম্প্রতি রাঙ্গামাটি কোতয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ শাহেদ উদ্দিন একাধিক গণমাধ্যমে উল্লেখ করেছেন যে, পর্যন্ত জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তদন্ত কাজ চলমান রয়েছে।

তবে বিশেষ একটি সূত্রমতে, একজন ব্যতীত বাকীরা সবাই জামিনে ছাড়া পেয়েছে।

মামলাসমূহে হামলাকারী অপরাধী হিসেবে ২০০০ হতে ৩০০০ জনের নাম উল্লেখ থাকলেও পর্যন্ত মাত্র জনকে গ্রেপ্তারের কথা জানা গেছে। তাছাড়া প্রকৃত অপরাধীদের অধিকাংশই শাস্তির আওতার বাইরে রয়ে গেছে। পুলিশ তাদেরকে চিহ্নিত করে গ্রেপ্তারের কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না বলে জানা গেছে।

Back to top button