ঢাকায় এম এন লারমার ৮৬তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন

আইপিনিউজ ডেস্ক (ঢাকা): ঢাকায় বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ৮৬তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন করা হয়েছে।
আজ ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫ বিকাল ০৩.০০ ঘটিকায় বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ৮৬ম জন্মবার্ষিকী উদযাপন কমিটির উদ্যোগে ঢাকার বাংলামটর এলাকার বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ৮৬তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়।
পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক শান্তিময় চাকমার সঞ্চালনায় ও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের যুগ্ম সমন্বয়কারী জাকির হোসেনের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন লেখক ও গবেষক পাভেল পার্থ, সাংবাদিক এহসান মাহমুদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় সদস্য দীপায়ন খীসা, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের অর্থ সম্পাদক মেইনথিন প্রমীলা, বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্টস কাউন্সিল এর কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক অং শোয়ে সিং মারমা প্রমুখ।
অনুষ্ঠানটির শুরুতে মহান নেতা এম এন লারমাকে সম্মান জানিয়ে কবিতা পাঠ করা হয়। এই সময় কবিতা পাঠ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রেই চাকমা ও লাল নিকিম বম। কবিতা পাঠের পরে এম এন লারমার জীবন বৃত্তান্ত পাঠ করেন হিল উইমেন্স ফেডারেশন, ঢাকা মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক রিয়া চাকমা।
আলোচনা সভায় লেখক ও গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, এম এন লারমা ছোটকাল থেকে কঠিন বাস্তবতার মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছিলেন। ১৯৫৫-১৯৬৫ সালের মধ্যে তৈরি হওয়া বাইনারি বিভাজন পরবর্তীতে বাংলাদেশে সরকার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাইনারি মনস্তত্ত্বকে এখনো এই দেশে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। এম এন লারমাই প্রথম আত্মপরিচয়ের রাজনীতিকে বৈজ্ঞানিকভাবে চিহ্নিত করেছিলেন। তিনি প্রথম বাংলাদেশে কাঠামোগতভাবে আত্মপরিচয়ের রাজনীতিকে স্পষ্ট করেছেন। একটি বহুত্ববাদী রাষ্ট্রের ধারণা দিয়েছিলেন তিনি। বাঙালি হেজিমনির বিরুদ্ধে তিনি আইডেন্টিটির ন্যারেটিভটা বাঁচিয়ে রাখার জন্য তৎকালীন সময়ে জোড়ালো প্রতিবাদ করেছিলেন। তিনি আরও বলেন, সম্প্রতি সময়ে কোক স্টুডিওর ’বাজি’ নামক গানে বম, মনিপুরী, মারমাদের সংস্কৃতিকে যথাযথভাবে উপস্থাপন করা হয়নি। যেই গানে আমরা বাইনারি বিভাজনের ইঙ্গিত পাই।
দীপায়ন খীসা বলেন, কাপ্তাই বাঁধ না করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়েই ছাত্র এম এন লারমার প্রতিবাদী জীবন শুরু হয়। ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের পর যে বৈষম্যহীন, অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশের কথা বলা হচ্ছে, এম এন লারমা ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কালেই এই বিষয়গুলো নিয়ে জোরালো বক্তব্য দিয়েছিলেন। তিনি প্রতিবাদীদের মধ্যে একজন হলেও এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি সেই সময়ে তিনিই সঠিক ছিলেন। সংবিধান সংস্কারের বিষয়ে সংবিধান সংস্কার কমিশন বা জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশন কখনো আদিবাসীদের সাথে সংলাপ করেনি। আমরাও এই দেশের অংশ। তাহলে আদিবাসীদেরকে কেন কোনো সংলাপে অংশগ্রহণ করার জন্য আহ্বান করা হলো না? ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানে আদিবাসীদেরও অংশীদারিত্ব আছে। কিন্তু অভ্যুত্থান পরবর্তীতে আদিবাসীদেরকেই ভুলে গেলো এই সরকার। শুধু আদিবাসীদেরকেই না, শ্রমজীবী-মেহনতি মানুষের অবদানকে এই সরকার স্বীকৃতি দেয়নি। এই সরকারের মধ্যে ডানপন্থার ভূত আছে। যার কারণে পুরো দেশজুড়ে মব সৃষ্টি হচ্ছে। এই রাষ্ট্রকে যদি সকল জনগণের জন্য গড়ে তুলতে হয়, তাহলে এম এন লারমার জীবন ও সংগ্রামকেও আত্মস্থ করতে হবে।
মেইনথিন প্রমীলা বলেন, এম এন লারমারা তাদের সময়কালে শিক্ষাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তিনি নানা গুণে গুণান্বিত ছিলেন। তিনি সবসময় উপেক্ষিত ও অবহেলিতদের কথা বলে গেছেন। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষই তাকে অবহেলিত ও উপেক্ষিত করে রেখেছে। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর তিনিই অন্তর্ভুক্তিমূলক ও শোষণমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণের কথা বলেছিলেন। বাংলাদেশের ইতিহাস এইটাই বলে, যারা একসময় নিপীড়িত ছিলেন, তারা পরবর্তীতে নিপীড়কের ভূমিকা পালন করেন। এম এন লারমার জন্মবার্ষিকীতে তাঁকে আমরা গভীরভাবে শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। আমাদের সকলের দায়িত্ব তাঁর দেখিয়ে যাওয়া আদর্শকে ধারণ করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।
এহসান মাহমুদ বলেন, এম এন লারমাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী তকমা দেওয়া ও বাঙালির হেজিমনির বয়ানটা এখানে প্রতিফলিত হচ্ছে। কেননা, এই অনুষ্ঠানটি শুধু আদিবাসীদের নয়, এটি বাংলাদেশের সকল নাগরিকের হওয়া উচিত। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে মিডিয়ারা সেটিকে শান্তিচু্ক্তি হিসেবে আখ্যায়িত করছে। কিন্তু সেই আকাঙ্ক্ষিত শান্তি পার্বত্য জনগণ পায়নি। একগোষ্ঠীর মত আরেক গোষ্ঠীর উপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ স্বাধীন ও ২৪ এর গণঅভ্যুত্থান হয়নি। তিনি আরও বলেন, এম এন লারমা তৎকালীন সময়ে ঠিক ছিলেন যে, একজন বাঙালি যেভাবে একজন বম, চাকমা হতে পারবে না, ঠিক একইভাবে এজন বম, চাকমা কখনো বাঙালি হতে পারবে না। আপনারা আদিবাসীরা সংখ্যায় কম হলেও আপনাদের জয় হবে। কারণ আপনারা ঠিক পথে হাঁটছেন।
সভাপতির বক্তব্যে জাকির হোসেন বলেন, এম এন লারমা একজন জাতীয় নেতা। কিন্তু যারা আদিবাসীদের বাইরে আছেন তারা তাঁকে জাতীয় হিসেবে মেনে নিতে পারেন না। ”বাঙালি হয়ে যাও”- কথাটার পিছনে বাঙালি মুসলমানদের জাত্যভিমানের ব্যাপারটি রয়েছে। এম এন লারমা বাংলাদেশের মধ্যে থেকে নিজেদের অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য আন্দোলন শুরু করেছিলেন। সেই আন্দোলনের প্রেক্ষিতে পরবর্তীতে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি নামে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের সরকার সেই চু্ক্তিকে যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়ন না করে আদিবাসীদের সাথে বেইমানী করেছে।
এছাড়া এই আলোচনা সভায় সংহতি প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন আদিবাসী ছাত্র ও যুব সংগঠনসমূহ।