জাতীয়
খাগড়াছড়িতে সেটলার বাঙালি কর্তৃক আদিবাসী কিশোরী ধর্ষণ: চবি’তে প্রতিবাদ সমাবেশ

আইপিনিউজ ডেস্ক: আজ ১৭ জুলাই, ২০২৫, বৃহস্পতিবার খাগড়াছড়ির ভাইবোনছড়ায় আদিবাসী কিশোরীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের প্রতিবাদে এবং ধর্ষণকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে আদিবাসী শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে সকাল ১১ ঘটিকায় এক বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
ত্রিপুরা স্টুডেন্টস ফোরাম-বাংলাদেশ, চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সভাপতি ধনরঞ্জন ত্রিপুরার সভাপতিত্বে এবং রঁদেভূ শিল্পীগোষ্ঠী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক জাল্লাং এনরিকো কুবি’র সঞ্চালনায় সমাবেশে বক্তব্য রাখেন পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি অন্বেষ চাকমা, বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্টস কাউন্সিল, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক সাথুঅং মারমা, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সংগঠক আহমেদ মুগ্ধ, বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা স্টুডেন্টস ওয়েলফেয়ার ফোরাম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অঞ্চলের সহ-প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক নয়ন তঞ্চঙ্গ্যা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সিংয়ইপ্রু মারমা প্রমুখ। সমাবেশে স্বাগত বক্তব্য রাখেন বিপুল চাকমা।
পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি অন্বেষ চাকমা বলেন, আমরা এমন এক বাস্তবতার মধ্যে যাচ্ছি যেখানে নিজ বাড়িতেও নিজ মা-বোনের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা নেই। কিছুদিন আগে আদিবাসী এক কিশোরীর ওপর যে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটে তার পরবর্তীতে ভূক্তভোগী তার নিজের পরিবারকেও জানানোর মত সাহস করেনি। আজকে এই ভয়ের সংস্কৃতি আমাদের মগজের মধ্যে ঢুকে গেছে তার দায় এখানকার আইন ও বিচার ব্যবস্থা এবং এমন ঘটনায় প্রশাসনের নির্লিপ্ততা। পাহাড়ে আদিবাসী জুম্ম নারী ও শিশুর ওপর ক্রমাগত সহিংসতা আমাদের ওপর জাতিগত নির্মূলীকরণের অংশ। ছাত্র সমাজকে এমন কঠিন বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে নিজের কর্তব্যকে বুঝে নিতে হবে। পাহাড়ে জুম্ম নারী ও শিশুর নিরাপত্তার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার স্থায়ী সমাধান চায়। এজন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন অতীব জরুরি।

বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্টস কাউন্সিল, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক সাথুঅং মারমা বলেন, ধর্ষণ-গুম-খুন-হত্যা ও ধর্ষণের মত ঘটনা পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসীদের ওপর দীর্ঘসময় ধরে চলছে। এসব ঘটনার পরে প্রশাসন নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। ধর্ষণের মতো ঘটনায়ও বিচারের ব্যবস্থা না করে প্রশাসন এসব ঘটনার বৈধতা দিচ্ছে। আমরা মনে করি এগুলো আদিবাসীদের তাদের ভূমি থেকে বিতারণ করে তাদের অস্তিত্ব মুছে দেওয়ার রাষ্ট্রের একটি নীল নকশার অংশ। খেয়াল করলে দেখা যাবে, এসব মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় নিরাপত্তা বাহিনীও বড় অংশীদার। পাহাড়ে তাদের অবস্থানকে জায়েজ করার জন্য তারা একের পর এক মানবাধিকার লঙ্ঘন করে যাচ্ছে। পাহাড়বাসীরা আজকের স্বাধীন দেশেও ভালো নেই কারণ রাষ্ট্র-সরকার তাদেরকে আগলিয়ে রাখতে পারছে না।
বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সংগঠক আহমেদ মুগ্ধ বলেন, আদিবাসী নারীর ওপর নিপীড়ন আমাদের কাছে নতুন বিষয় নয়, কিছুদিন আগেও এক খেয়াং নারীর হত্যার বিচার চাইতে হয়েছিল আমাদের। আমরা আইন ও বিচারের আশায় থাকলেও বাস্তবতা হচ্ছে এই রাষ্ট্র আইন-বিচারের ধার ধারেনা। ফলশ্রুতিতে আমরা পাহাড় থেকে সমতলে ক্রমাগত মব ও নারী নিপীড়ন দেখতে পাচ্ছি। জুলাই অভ্যুত্থানে আদিবাসীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকলেও আদিবাসীদের ভাগ্যের পরিবর্তন আমরা দেখিনা। সরকার পরিবর্তন হয় কিন্তু আদিবাসীরা তাদের নায্য অধিকার থেকে চিরকাল বঞ্চিত থেকে গেছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সিংয়ইপ্রু মারমা বলেন, আদিবাসী নারীদের জীবনের নিরাপত্তা দিনদিন সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামেও আজকের দিনে একজন আদিবাসী নারীর তার নিজ ভূমিতে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার অধিকার নেই। পাহাড়ে এযাবৎ বিভিন্ন সময়ে নারী ও শিশুর ওপর নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে আসলেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে বেশির ভাগের ক্ষেত্রে আমরা সেগুলোর বিচার পাইনি। এমন বাস্তবতা চলতে থাকে আদিবাসীদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়তে বেশি সময় লাগবে না। রাষ্ট্রের বিচারহীনতার সংস্কৃতিই পাহাড় ও সমতলে আড়ালে ধর্ষকদের সায় দিয়ে যাচ্ছে। আমরা এর থেকে মুক্তি চাই।
বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা স্টুডেন্টস ওয়েলফেয়ার ফোরাম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অঞ্চলের সহ-প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক নয়ন তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সমগ্র বাংলাদেশে আজকে ধর্ষণ ও ধর্ষণ পরবর্তী হত্যার মতো ঘটনা আমরা প্রায় সময় দেখতে পাচ্ছি। এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সরকারের পক্ষ থেকেও যথাযথ কোন পদক্ষেপ নেই। শাসকগোষ্ঠীর মদদে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেটেলার বাঙালিরা জুম্ম আদিবাসীদের ওপর দীর্ঘকাল ধরে নিপীড়ন-নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। যার অধিকাংশই বিচারের বাইরে রয়ে গেছে। এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সরকারকে যথাযথভাবে এগিয়ে আসতে হবে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার স্থায়ী সমাধান করতে হবে।
স্বাগত বক্তব্যে বিপুল চাকমা বলেন, আশির দশকে জুম্মদের জাতীয় অস্তিত্ব ধ্বংস করে দেওয়ার উদ্দ্যেশ্যে সমতল থেকে যে চার লক্ষাধিক বাঙালিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে পূনর্বাসন করা হয় সেই সেটেলাররা আজকে জুম্মদের ভূমি দখল করে বসে আছে, জুম্ম নারী ও শিশুদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালাচ্ছে। অথচ প্রশাসন তার স্থায়ী সমাধানের জন্য এপর্যন্ত কোন উদ্যোগ নেওয়ার বদলে অবস্থাভেদে এমন কাজের পিছনেও ইন্ধন দিয়ে যাচ্ছে। কিছুদিন আগেও অন্য একজন আদিবাসী নারীর হত্যার বিচারের দাবিতে এ জায়গায় দাঁড়িয়েছি কিন্তু ২ মাস পেরিয়ে গেলেও তার বিচার আমরা পাইনি। এই বাস্তবতায় আমরা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় যেকোন পরিস্থিতিতে যাওয়ার প্রস্তুতি রাখতে হবে।
সভাপতির বক্তব্যে ধনরঞ্জন ত্রিপুরা বলেন, পাহাড়ে আদিবাসীদের ওপর সংঘটিত অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে বারবার প্রতিবাদের সত্ত্বেও এমন ঘটনা প্রতিনিয়ত আমাদের চোখের সামনে ঘটছে। প্রশাসনের কাছে আমরা প্রতিবার দাবি জানাই এগুলোর সুষ্ঠু বিচার যেন হয়, কিন্তু আমরা খুব কম সময়ই সঠিক বিচার পেয়ে থাকি। পুরো বাংলাদেশে একটার পর একটা ধর্ষণ, হত্যা ও মব ঘটে যাচ্ছে কিন্তু এর সমাধানের জন্য সরকারের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেই। এমতাবস্থায় আদিবাসীদের জাতীয় জীবনও খুব হুমকির মুখে। আইনের শাসন ও বিচার ব্যবস্থার দৃঢ়তা থাকলে এসব সুরাহার একটা সুযোগ থাকত কিন্তু আমরা তাও দেখিনা। ভাইবোনছড়ায় সংঘটিত ঘটনার অপরাধীরের সুষ্ঠু বিচারের মাধ্যমে কঠোর শাস্তির দাবি জানাই।
সভাপতির বক্তব্যের শেষে এক বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। মিছিলটি শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ থেকে শুরু হয়ে প্রশাসনিক ভবন হয়ে আবার শহীদ মিনারে এসে শেষ হয়।