জাতীয়

গাইবান্ধার গোবিন্দেগঞ্জে পালিত হলো ঐতিহাসিক সাঁওতাল বিদ্রোহ দিবস; অবিলম্বে ইপিজেড বন্ধের দাবি

আইপিনিউজ ডেস্ক (গাইবান্ধা): গত ৩০ জুন ২০২৫, সোমবার—গোবিন্দগঞ্জের কাটামোড় ও বাগদা বাজারে পালিত হলো ইতিহাসগর্বিত সাঁওতাল বিদ্রোহ দিবস। সাঁওতাল জাতির গৌরবময় সংগ্রামের দিনটিকে স্মরণ করতে আজ হাজারো কণ্ঠ একত্রিত হয়েছিল একটি চেতনাবোধে—ভূমির মালিকানা, ন্যায্য অধিকার ও সম্মানের দাবি নিয়ে।

সাঁওতাল বিদ্রোহ দিবসটির সূচনা হয় ১৮৫৫ সালের সাঁওতাল বিদ্রোহের অগ্নিশিখার প্রতীক, বীরসেনানী সিধু-কানু-র প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের মাধ্যমে। এই শ্রদ্ধা নিবেদনে অংশ নেয় সাহেবগঞ্জ বাগদাফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম পরিষদ, আদিবাসী-বাঙালি সংহতি পরিষদ, সামাজিক সংগ্রাম পরিষদ সহ বিভিন্ন আদিবাসী ও সাঁওতালী সংগঠন।

পদযাত্রার একাংশ

পুষ্পার্ঘ অর্পনের পর শুরু হয় দীর্ঘ পদযাত্রা। তীর ধনুক হাতে কিংবা স্লোগানে স্লোগানে শত শত সাঁওতাল ও বাঙালি, যুবক ও বৃদ্ধ, নারী ও পুরুষ কাটামোড় থেকে বাগদা বাজার পর্যন্ত প্রায় চার কিলোমিটার পদযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। নিজেদের বাপ দাদার জমি ফেরত, তিন সাঁওতাল হত্যার বিচার ও ইপিজেড ষড়যন্ত্র বন্ধ করার দাবিতে বিভিন্ন স্লোগান সম্বলিত প্ল্যাকার্ড হাতে হাজারো মানুষের পদযাত্রা যেন সাঁওতাল বিদ্রোহ দিবসের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকেই স্মরণ করিয়েছে।

পদযাত্রা শেষে বাগদা বাজারে অনুষ্ঠিত সমাবেশে বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরামের সহ সভাপতি টনি চিরান বলেন – “এই অঞ্চলের যারা ভূমিপুত্র, যাঁরা এই অঞ্চলকে বাসযোগ্য করে তুলেছে, যাঁরা ব্রিটিশদের নিপীড়ন-শোষণের বিরুদ্ধে প্রথম লড়াই করেছে, সেই সাঁওতাল আদিবাসীরাই নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে নিঃস্ব, উদ্বাস্তু। যে ভূমিতে তাঁদের পূর্বপুরুষের রক্ত ঝরেছে, সেই ভূমিই আজ কেড়ে নেওয়া হচ্ছে নানান অজুহাতে। ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর, পূর্বপুরুষদের ভূমি রক্ষার আন্দোলন করতে গিয়ে সাহেবগঞ্জ বাগদাফার্মের তিন সাঁওতাল – শ্যামল-মঙ্গল-রমেশ টুডুকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও ভূমিদস্যুরা নির্মমভাবে হত্যার করলেও এখনো বিচার হয়নি উপরন্তু মিথ্যে উন্নয়নের নামে আদিবাসী ও স্থানীয়দের তাদের পূর্বপুরুষদের ভূমি থেকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ করে ইপিজেড প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্র চলছে। সাঁওতালদের যৌক্তিক ও ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনে এদেশের সকল আদিবাসী, মেহনতি ও প্রগতিশীল মানুষ সাথে আছে।”

সমাবেশ

সমাবেশে নারী নেত্রী তৃষ্ণা মুরমু বলেন, “সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম এলাকায় ইপিজেড প্রকল্পের আড়ালে আদিবাসী ও স্থানীয়দের উচ্ছেদ করার ষড়যন্ত্র চলছে। আমরা আদিবাসীরা উন্নয়নবিরোধী নয়, কিন্তু সেই উন্নয়ন যদি সাঁওতাল ও স্থানীয়দের তাদের পূর্বপুরুষদের ভূমি থেকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ করে হয় তাহলে আমরা সেই উন্নয়ন চাইনা। গাইবান্ধায় আরো অনেক সরকারি খাস ও পতিত জমি রয়েছে যেমন – মহিমাগঞ্জে সরকারের পতিত জমি রয়েছে সেখানে ইপিজেড করতে পারে। সরকার যদি তারপরও আমাদের বাপ দাদার ভূমিতে ইপিজেড করতে চাই তাহলে আমাদের লাশ ও রক্তের উপর দিয়ে ইপিজেড করতে হবে। আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের তিন ফসলি জমিতে কোন ইপিজেড করতে দিবোনা।

আদিবাসী বাঙালী সংহতি পরিষদের আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলাম বাবু বলেন, “সরকারকে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে হবে। রিকুইজিশন চুক্তি অনুযায়ী সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্মের সাঁওতালদের জমি প্রকৃত মালিকদের কাছে ফেরত দিতে হবে। রাষ্ট্র যদি সংবিধানে সকল নাগরিকের সমান অধিকার নিশ্চিত করতে চায়, তবে আদিবাসীদের প্রতি এই বৈষম্য অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। আদিবাসীদের জমিতে ইপিজেড ষড়যন্ত্র বন্ধ করতে হবে।”

সামাজিক সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক জাহাঙ্গীর কবির তনু বলেন, “সাঁওতাল বিদ্রোহ শুধু ইতিহাস নয়, এটা আজকের লড়াইয়ের অনুপ্রেরণা। সেই বিদ্রোহের চেতনা থেকেই উঠে এসেছে আজকের পদযাত্রা। আজকের প্রতিবাদ সেই উত্তরাধিকার বহন করে। আমরা আপনাদের ন্যায়সঙ্গত ও শোষণ মুক্তির লড়াইয়ের সাথে আছি। আপনাদের পূর্বপুরুষদের ভূমি ফেরত ও ইপিজেড ষড়যন্ত্র বন্ধ করার জোর দাবি জানাই।”

সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন সাহেবগঞ্জ বাগদাফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সভাপতি ডা. ফিলিমন বাসকে। এছাড়াও সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন বার্নাবাস টুডু, স্বপন শেখ, আতাউর রহমান সাবু, আনিসুর রহমান ময়নুল, রিপন বেসরা, মনির হোসেন সুইট, অজিত মুন্ডা, খিলন রবিদাস, যোসেফ সরেন, প্রিসিলা মুরমু, তৃষ্ণা মুরমু, বিটিশ সরেন, র‍াফায়েল মুরমু, দিপন সহ শত শত আদিবাসী ও বাঙালি।

সভাপতির বক্তব্যে ডা. ফিলিমন বাসকে বলেন, “৩০ জুন, সাঁওতাল বিদ্রোহ দিবসে আজকের পদযাত্রা ও সমাবেশ শুধু একটি কর্মসূচী নয়—এটি দঢ় প্রত্যয় ও ন্যায্য আন্দোলনের ধারাবাহিকতার অংশ। আগামী দিনে অধিকার প্রতিষ্ঠার শপথে সাঁওতাল আদিবাসী -বাঙালি সকলকেই ঐক্যবদ্ধ হয়ে সকল ষড়যন্ত্র রুখে দিতে হবে।

আগামী ১০ জুলাই ২০২৫ পর্যন্ত বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশসহ নানান কর্মসূচি পালন করে ইপিজেড উদ্বোধন প্রতিহত ও রাজপথে লড়াই জারি রাখার ঘোষণা দেন ডা. ফিলিমন বাসকে

Back to top button