
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং এর সভাপতিত্বে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন সংগঠনের সাংগঠনিক সম্পাদক এন্ড্রু সলমার।
তিনি বলেন, আদিবাসীদের লড়াই সংগ্রামের জন্য আমাদের সবাইকে কাজ করে যেতে হবে, বিশেষ করে এক্ষেত্রে বর্তমান তরুণ প্রজন্মকে আরো বেশি অধিকতর সক্রিয় হয়ে আদিবাসী ফোরামের আন্দোলকে বেগমান করার লক্ষ্যে ভূমিকা রাখতে সচেষ্ট হতে হবে।
এএলআরডির প্রোগ্রাম অফিসার এ্যাড. একে এম বুল বুল আহমেদ বলেন, আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুযায়ী আদিবাসীদের অনেক স্বীকৃতি রয়েছে, কিন্তু রাষ্ট্র আদিবাসীদের এ অধিকারগুলো স্বীকৃতি দিতে চায় না। অথচ রাষ্ট্র আদিবাসীদের এ অধিকারগুলো প্রতিপালনে আন্তর্জাতিক আইনে বাধ্যবাধকতা না থাকলেও আদিবাসী অধিকারের প্রতি সম্মান রেখে তাদের অধিকারটুকু মেনে নেয়া উচিত। আমাদের এ দেশের সরকার আদিবাসীদের অহংকার মনে করেন। অথচ এদেশে ৫০টির অধিক আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী তারা তাদের কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ভাষা, ইতিহাস, ও প্রথাগত রীতি নীতি ও পদ্ধতি নিয়ে ঐতিহাসিককাল থেকে বসবাস করে আসছে। কিন্তু সরকার ভাবে না যে, আদিবাসীরা এ দেশের অহংকার নয়ম, বরং তারাও এদেশের নাগরিক, তাদেরও নাগিরেক সুবিধা ভোগ করার অধিকার রয়েছে।
তিনি আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রথাগত রীতি নীতি ও পদ্ধতি ও বিভিন্ন আইন থাকাতে সেখানকার আদিবাসীদের ভূমির উপর আংশিকভাবে স্বীকৃতি রয়েছে। কিন্তু সমতলের ক্ষেত্রে সেটাও নেই। এ কারণে সমতল আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠন অত্যন্ত জরুরী। একইসাথে আইনের ৯৭ ধারা অনুযায়ী আদিবাসীদের অনেক জমি বেহাত হয়ে গিয়েছে। সেসব জমি উদ্ধারের লক্ষে সবাইকে কাজ করে যাওয়ার যেতে হবে এবং আদিবাসীদের চলমান লড়াই আরো বেশি বেগবান করার আহব্বান জানান।
সম্মানিত অতিথির বক্তব্যে অধ্যাপক সৌরভ শিকদার বলেন, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্মে আদিবাসীদের যে সমস্যা ছিল, সেটা বিগত সরকারের আমলেও সমাধান হয়নি এবং বর্তমানে এ সমস্যাটা আরো বেশি প্রকট আকার ধারণ করেছে। সেখানে নতুন করে ইপিজেড করার পরিকল্পনা চলছে, এ নিয়ে আদিবাসীরা উচ্ছেদ আতঙ্গে রয়েছে। তিনি তার বক্তব্যে এক পর্যায়ে বলেন, তিনি স্বপ্ন দেখতে ভয় পান, কোথায় এবং কি বাস্তবতায় স্বপ্ন দেখাবো। কারণ আদিবাসীদের জমি দখল হচ্ছে, আদিবাসী নারী ধর্ষিত হচ্ছে। যে স্বপ্ন ও আশা নিয়ে আমরা এ দেশ স্বাধীন করেছি আর বর্তমানে কি দেখতে পাচ্ছি।
কমিউনিটি টুরিজ্যম নিয়ে তিনি আরো বলেন, এটা করলে একদিকে যেমন সুবিধা রয়েছে তেমনি এর কিছু ক্ষতির দিক ও রয়েছে। কারণ কিছু কিছু ক্ষেত্রে আদিবাসীরা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, যেসব এলাকায় কমিউনিটি টুরিজ্যম রয়েছে সেখানে বহিরাগতদের যাওয়ার কারণে আদিবাসীদের সংস্কৃতি বিকৃতি করা হচ্ছে। আদিবাসীদের ভূমির সাথে রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক তারা ভূমিকে সম্পদ মনে করে, এর সাথে রয়েছে আদিবাসীদের সাংস্কৃতিক ও বৈচিত্রের সম্পর্ক। কিন্তু অ আদিবাসীরা এটাকে সম্পত্তি বা প্রপার্টি মনে করে। তিনি আরো বলেন, দিন দিন আদিবাসীদের জমি দখল হয়ে যাচ্ছে এ থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য সবাইকে সম্মিলিতভাবে একযোগে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহ্বান জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম মৌলভীবাজার জেলার সাধারণ সম্পাদক জনক দেববর্মা বলেন, এ অঞ্চলে ৪টি পুঞ্জি খাসিয়াদের এবং ৫টি গ্রাম ত্রিপুরাদের দখলে বর্তমানে রয়েছে। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে এটি অ-আদিবাসীদের হাতে চলে যাওয়ার পায়তারা চলেছে। আন্দোলন ছাড়া আদিবাসীদের সমস্যা সমাধান হবে না। কাজেই তিনি সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার আহবান জানান।
জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি ও আদিবাসী ফোরামের কার্যকরী সদস্য ইউজিন নকরেক বলেন, গত ২৫ শে ২০২৫ মধুপুরে শালবন উদ্ধারের জন্য বন, পরিবেশ ও জলবায়ু উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্রতিশ্রতি দিয়েছেন। কিন্তু এটি কতটুকু সফল হবে তার উপর নির্ভর করবে। মধুপুরে বনবিভাগ কর্তৃক আকাশি চারা রোপনের জন্য শালবন কেটে ফেলা হচ্ছে। সেখানে সামাজিক বনায়নের নামে আদিবাসীদের জমি দখলের কার্যক্রম বর্তমানে বন্ধ থাকলেও পরবর্তীতে এ কাজ বন বিভাগ যে করবে না তার কি নিশ্চয়তা রয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
আদিবাসী ফোরামের সহ সভাপতি অজয় এ মৃ সমতল আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠন অত্যন্ত জরুরী বলে মনে করেন তিনি। পাশাপাশি নিজ নিজ এলাকায় জমি রক্ষার্থে ডিমারকেশন করার পরামর্শ দিয়েছেন। এক্ষেত্রে কিছুটা হলেও নিজের ভূমি রক্ষার্থে সহায়ক হবে বলে মনে করেন। আদিবাসীদের অধিকার আদায়ে সবাইকে একয়োগে কাজ করে যেতে হবে, সোচ্ছার থাকতে হবে এবং বিশেষে করে তরুণ প্রজন্মকে এগিয়ে আসার আহবান জানান আদিবাসী ফোরামের এই সিনিয়র নেতা।
সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাাাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের শিক্ষা, সংষ্কৃতি ও ক্রীড়া সম্পাদক উজ্জ্বল আজিম ও সংগঠনের কার্যকরী সদস্য সোহেল চন্দ্র হাজং। পরে তিনি সমতল আদিবাসীদের জন্য মূল দাবিনামা ছাড়াও অন্যান্য কয়েকটি দাবীনামাসমূহ উপস্থাপন করেন। মূল দাবিনামাসমূহ:-
[১]. সংবিধান ও সার্বিক আইনঃ বাংলাদেশের সংবিধানে আদিবাসীদেরকে আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে।
সংবিধানের আলোকে নীতি ও আইন প্রণয়নে ’বাংলাদেশ আদিবাসী অধিকার আইন’ (ইওচজঅ)- এর খসড়াটি চূড়ান্ত আইনে রূপদান করতে হবে।
[২]. সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠাঃ সমতলের আদিবাসীদের জীবনমান উন্নয়ন এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় অর্ন্তভূক্ত করার লক্ষ্যে একটি পৃথক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে। মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে সমতলের আদিবাসিদের মধ্য থেকে একজন পূর্ণ মন্ত্রী নিযুক্ত করতে হবে। [৩]. সমতলের আদিবাসীদের জন্য ভূমি কমিশন গঠনঃ সমতলের আদিবাসীদের দীর্ঘদিনের ভুমি সমস্যা সমাধানের লক্ষে একটি পৃথক ভূমি কমিশন গঠন করতে হবে। আদিবাসীদের ভূমি বিশেষ করে আদিবাসীদের প্রথাগত ও সমষ্টিগত ভূমি অধিকারের স্বীকৃতি, সুরক্ষা ও পৃনরুদ্ধার করাই হবে কমিশনের অন্যতম কাজ। [৪]. অন্যান্য দাবীনামাসমূহঃক. জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় সরকারের সকল পর্যায়ে আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলসমূহে আদিবাসী নারীসহ সমতলের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সংরক্ষিত আসন বরাদ্ধ করতে হবে।
খ. সকল সরকারি ও স্বায়িত্বশাসিত প্রতিষ্ঠাসমূহে আদিবাসীদের জন্য ৫% কোটা পূনর্বহাল রাখতে হবে।
গ. সমতলের প্রথাগত ব্যবস্থাপনা ও প্রতিষ্ঠানসমূহের স্বীকৃতি, ক্ষমতায়ন ও পর্যান্ত বাজেট বরাদ্ধ করতে হবে।
ঘ. আদিবাসীদের ঐতিহ্যগত সংস্কৃতির সংরক্ষন, উন্নয়ন, চর্চা ও গবেষানার লক্ষ্যে ঢাকায় কেন্দ্রীয়ভাবে এবং আদিবাসী অধ্যুষিত জেলা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা ও বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানসমূহে আদিবাসী পরিচালক, লোকবল নিয়োগ ও পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্ধ রাখতে হবে।
ঙ. অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারে সমতল অঞ্চলের একজন আদিবাসী প্রতিনিধি নিশ্চিত করতে হবে।
চ. সমতল অঞ্চলের আদিবাসীদের জন্য ঢাকায় সমতল আদিবাসী কমপ্লেক্স নির্মান করতে হবে।
ছ. আদিবাসীদের সাথে অর্থপূর্ন আলোচনার মাধ্যমে ১৯২৭ সালের বন আইন সংশোধন, আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে তথাকথিত উন্নয়ন প্রকল্প বাতিলসহ আদিবাসীদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত সকল মিথ্যা বন মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।
জ. গাইবান্দার গোবিন্দগঞ্জের সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্মের ভূমি প্রকৃত মালিকদের নিকট হস্তান্তরসহ আন্দোলনে আদিবাসী হত্যাকান্ডের বিচার, ক্ষতিপূরন নিশ্চিতকরণ ও আদিবাসীদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।
ঝ. অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারে আদিবাসী অধিকার বিষয়ক সংস্কার কমিশন গঠন করতে এবং বিভিন্ন সংস্কার কমিশনে আদিবাসী প্রতিনিধি নিশ্চিত করতে হবে।
ঞ. জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এর আলোকে সকল আদিবাসীদের মাতৃভাষায় প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ, আদিবাসী শিক্ষক নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ, গুনগত মান নিশ্চিতকরণ, নীতিমালা প্রণয়নসহ পাঠ্য পুস্তকে আদিবাসীদেরকে ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করতে হবে।
ত. আদিবাসী ভাষায় চলচিত্র নির্মানে সরকারী অনুদান এবং আদিবাসীদের নিজস্ব গণমাধ্যমের স্বীকৃতি, বিকাশ ও মান উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।