জাতীয়

ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও আদিবাসীদের ওপর হামলার ঘটনাগুলো নিয়ে সুষ্ঠু তদন্ত হচ্ছে না

অন্তর্বর্তী সরকারও অতীতের সরকারের মতো ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন-আক্রমণের ঘটনাগুলো অস্বীকার করছে। ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও আদিবাসীদের ওপর হামলার ঘটনাগুলো নিয়ে সুষ্ঠু তদন্ত হচ্ছে না। সরকার এসব ঘটনাকে রাজনৈতিক হামলা অভিহিত করে দায় সারছে।

গতকাল মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে নাগরিক সমাজ, ভূমি ও মানবাধিকার সংগঠনের প্রতিনিধিরা এসব কথা বলেন।

৩ জানুয়ারি জমি নিয়ে বিরোধের জেরে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে এক সাঁওতাল নারীকে মারধর ও বাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। ওই নারীর স্বজনদের অভিযোগ, রাজাহার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও তাঁর লোকজন এ ঘটনা ঘটিয়েছেন। গত সপ্তাহে নাগরিক সমাজ, জাতীয় পর্যায়ের ভূমি ও মানবাধিকার সংগঠনের প্রতিনিধিরা ঘটনার তথ্য অনুসন্ধানে সেখানে যান। সংবাদ সম্মেলনে ওই প্রতিনিধিদলের প্রতিবেদন তুলে ধরে অপরাধীদের গ্রেপ্তার ও কঠোর শাস্তির দাবি জানানো হয়।

সংবাদ সম্মেলনে অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (এএলআরডি) ব্যবস্থাপক রফিক আহমেদ সিরাজী লিখিত প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। এতে বলা হয়, আদিবাসীদের ভোগদখলীয় জমিতে রাজাহার ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম ও তাঁর লোকেরা মাটি ভরাট করতে শুরু করলে কয়েকজন যুবক তাতে বাধা দেন। তখন চেয়ারম্যান ও তাঁর লোকজন নিকোলাস মুর্মু নামের এক যুবককে মারধর করেন। খবর পেয়ে ব্রিটিশ সরেন নামের এক যুবক প্রতিবাদ করতে গেলে চেয়ারম্যান তাঁকেও লাঠি দিয়ে মারধরের হুমকি দেন। এ সময় ব্রিটিশের মা ফিলোমিনা হাঁসদা চেয়ারম্যানের লাঠি ঠেকাতে গেলে চেয়ারম্যান তাঁকেও মারধর করেন। বর্তমানে ফিলোমিনা বগুড়ার জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ওই দিন রাতে ব্রিটিশ সরেনের বাড়িতে চেয়ারম্যানের লোকজন আগুন দেন। পরে ফায়ার সার্ভিসের লোকজন এসে আগুন নিয়ন্ত্রণ করেন।

এ ঘটনায় বিভিন্ন দাবি তুলে ধরে প্রতিনিধিদল। দাবিগুলো হলো পুলিশ দিয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্বসহকারে ঘটনাটি তদন্ত, সাঁওতাল নারীকে মারধর ও শ্লীলতাহানির ঘটনায় গ্রেপ্তারকৃত চেয়ারম্যান ও জড়িত অপরাধীদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত, এবং আগুন দেওয়ার ঘটনা তদন্ত ও দোষীদের শাস্তি, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের আর্থিক সহায়তা দেওয়া, রফিকুল ইসলামকে চেয়ারম্যান পদ থেকে স্থায়ীভাবে অপসারণ, সাঁওতালদের জমি চেয়ারম্যানের কাছ থেকে উদ্ধার করে ফিরিয়ে দেওয়া, চেয়ারম্যানের অবৈধ দখলে থাকা খাসপুকুর উদ্ধার করে সাঁওতাল আদিবাসীদের লিজ দেওয়া, সাঁওতালদের কবরস্থান উদ্ধার করে ফিরিয়ে দেওয়া এবং সাঁওতালদের প্রতি বিদ্বেষমূলক আচরণ, ক্ষমতার দম্ভ প্রদর্শন এবং রাষ্ট্রীয় নীতির তোয়াক্কা না করে চার ফসলি জমিতে ইপিজেড করার চক্রান্তে লিপ্ত হওয়ায় জেলা প্রশাসককে অপসারণের দাবি জানানো হয়।

সংবাদ সম্মেলনে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সুব্রত চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশে যখনই এসব ঘটনা (সংখ্যালঘুদের নির্যাতন-আক্রমণ) ঘটে, তখন অস্বীকার করা হয়। প্রতিটি সরকারের আমলেই দেখেছি, সব ঘটনা তারা অস্বীকার করত। যখন চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো হয়, তখন ইনিয়েবিনিয়ে নানান কথা বলত। এই সরকারও অতীত সরকারের মতো কিছু বয়ান তৈরি করে ঘটনাগুলো রাজনৈতিক হামলা বলছে। এ সরকার গত ছয় মাসে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর একটিরও সুষ্ঠু তদন্ত করেনি, ব্যবস্থাও নেয়নি বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মনীন্দ্র কুমার নাথ বলেন, এই সরকারের যে আচার-আচরণ, সত্য ঘটনাকে যে অস্বীকার করার প্রবণতা, আমরা ধিক্কার দিই। মানবিক মূল্যবোধের ওপর প্রতিশ্রুত এ সরকারের সত্য ঘটনাকে রাজনৈতিক তকমা লাগানোর প্রবণতা ভাবতেই পারি না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, বাংলাদেশের আদিবাসীরা যেখানেই আছেন, তাঁরা জমি, বাগান ও বনগুলোকে এত সুন্দর করে রাখেন যে ভূমিদস্যুদের ওখানেই চোখ পড়ে।

লেখক-গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, শুধু গোবিন্দগঞ্জে নয়, পাঠ্যপুস্তকে জুলাই বিপ্লবের একটি গ্রাফিতি ব্যবহার নিয়ে মতিঝিলেও একটি জাতিগত বিদ্বেষ ও সহিংসতা ছড়ানো হয়েছে, হামলা-রক্তপাত করা হয়েছে। এত রক্তপাতের ভেতর দিয়ে হওয়া এই গণ-অভ্যুত্থান কোনো বার্তা দিতে পারছে না।

এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদার সভাপতিত্বে সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে ব্লাস্টের আইন উপদেষ্টা এস এম রেজাউল করিম, কাপেং ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপক হিরন মিত্র চাকমা বক্তব্য দেন।

সংবাদ সম্মেলন যৌথভাবে আয়োজন করে এএলআরডি, ব্লাস্ট, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, কাপেং ফাউন্ডেশন, জাতীয় আদিবাসী পরিষদ, নিজেরা করি, মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন, বাগদাফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটি, আদিবাসী-বাঙালি ঐক্য পরিষদসহ বেশ কয়েকটি সংগঠন।

Back to top button