জাতীয়

ঢাকায় জননেতা রবীন্দ্রনাথ সরেনের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী পালন

আইপিনিউজ ডেস্ক (ঢাকা): ঢাকায় জননেতা রবীন্দ্রনাথ সরেনের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে এক জাতীয় স্মরণসভার আয়োজন করা হয়েছে।

আজ ১৩ জানুয়ারী, ২০২৫, সোমবার রবীন্দ্রনাথ সরেনের সহযোদ্ধা ও সুহৃদ সকলের আয়োজনে ঢাকার সেগুনবাগিচায়, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির নসরুল হামিদ মিলনায়তনে এ স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়। স্মরণসভা সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরামের সহ-সভাপতি টনি ম্যাথিউ চিরান এবং সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সহ সাধারণ সম্পাদক ডা. গজেন্দ্রনাথ মাহাতো।

স্মরণসভার শুরুতে জননেতা রবীন্দ্রনাথ সরেনের প্রতিকৃতিতে ফুলেল শ্রদ্ধা জানিয়ে ও তাঁর স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে ১ মিনিট নিরবতা পালন করা হয়।

আয়োজিত এ জাতীয় স্মরণসভায় অতি সম্প্রতি জাতীয় পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক পাঠ্যবইয়ের প্রচ্ছদ থেকে আদিবাসী শব্দ বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্তের প্রতি কঠোর প্রতিবাদ জানিয়ে প্রয়াত রবীন্দ্রনাথ সরেনের উপর প্রাথমিক উপস্থাপন করেন লেখক ও গবেষক পাভেল পার্থ।

স্মরণসভায় নিজেরা করি’র নির্বাহী পরিচালক ও অধিকার কর্মী খুশি কবীর  রবীন্দ্রনাথ সরেনের স্মৃতিচারণ করে বলেন, তিনি চিরকালই, দেশ, দেশের মানুষ, দেশের আদিবাসী সমাজের অধিকার আদায়ে নিরলসভাবে কাজ করে গিয়েছেন। আদিবাসীদের মধ্যেও বিভিন্ন জাতি আছে, বিভিন্ন সংস্কৃতি-ভাষা আছে যাদের সবাইকে নিয়েই বৈষম্য দূরীকরনে কাজ করে যেতে হবে। অনেকসময় বিভিন্ন বক্তব্যে বলা হয় সংখ্যালঘু কিন্তু আমরা যে সংখ্যালঘুকরণের মাধ্যমে যে বৈষম্য করছি তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে হবে। বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ যে নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে সেজন্য আমরা এই বাংলাদেশে যেন দীর্ঘস্থায়ী বৈষম্য নিরসন হয়ে আদিবাসীসহ সকলের অধিকার নিশ্চিতে আমরা যেন কাজ করতে পারি। তিনি আরো তার বক্তব্যে  সমতলের আদিবাসীদের জন্য কার্যকর ও পৃথক ভূমি কমিশন প্রতিষ্ঠা ও পার্বত্য ভূমি কমিশনকে কার্যকর করার দাবি জানান। যারা আজকে পাঠ্যপুস্তকে গ্রাফিতির প্রচ্ছদের বদলের কথা বলছে তারা জুলাই আন্দোলনে ছিল না বলে তিনি আরো যোগ করেন, যারা জুলাই মাসের আন্দোলনে ছিল তারা বই থেকে আদিবাসী শব্দ বাদ দেয়ার পক্ষে ছিল না কারন তারা যদি বাদ দেয়ার পক্ষে থাকতো তাহলে রাস্তায় গ্রাফিতিতে আদিবাসী শব্দ থাকতো না। তাহলে আমরা কেন একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর কথায় কোন কিছু চিন্তা না করেই সাথে সাথেই বাদ দেয়ার চিন্তা করছি।

এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা তার বক্তব্যে রবীন্দ্রনাথ সরেনের সংগ্রামী জীবনের সাথে সম্প্রতি এনসিটিবির বাতিলকৃত বইয়ের প্রচ্ছদের প্রসঙ্গ টেনে বলেন,  গ্রাফিতি কারো ব্যক্তিসম্পত্তি না। এটি গণঅভ্যূত্থানের একটি অংশ। এটির পরিবর্তন করা বা বাদ দেয়া এটিকে অসম্মান করা এবং এটির অসম্মান আমরা মেনে নিবো না। যদি কোন গোষ্ঠী এটির বিরুদ্ধে কথা বলে সেই গোষ্ঠীর মুখোশ উন্মোচন করা দরকার। আমাদের বাংলাদেশ যে বৈচিত্র্য, বহুত্ববাদ, বহুধর্ম, বহুভাষা, বহুমতের দেশ এটির একটি বার্তা কিন্তু ঐ প্রচ্ছদে ছিল। এই গ্রাফিতির বার্তাই ছিলো অভ্যুত্থানের একটি অর্জন। এই অর্জনকে আমরা বৃথা হতে দিতে পারি না। বাংলাদেশ কোন দল, পরিবার বা কারো বাপ-দাদার সম্পদ নয় বলে এই হীন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন তিনি।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ও সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স তার বক্তব্যে রবীন্দ্রনাথ সরেনের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, রবীন্দ্রনাথ সরেনের সাথে আমার পরিচয় আন্দোলনের মধ্য দিয়ে, সাতষট্টি বছরের জীবনে তিনি সবসময়ই সমাজ, দেশ সভ্যতার অগ্রগতির জন্য কাজ করেছেন। পাঠ্যবইয়ে প্রচ্ছদের পরিবর্তন নিয়ে তিনি বলেন  কেউ একজন এসে কিছু একটা বলে গেল, আর সাথেসাথেই পাঠ্যবই পরিবর্তন হয়ে গেল, আদিবাসীদের নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা নিয়ে একধরনের অজানা ভয়-আতঙ্ক যে আছে সেটা আরো বৃদ্ধি করেছে অন্তবর্তীকালীন সরকারের এই সময়ে।

বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)-এর সহ-সাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন তার বক্তব্যে বলেন এই দেশটা সবার হওয়ার কথা ছিল, কেন সবার হল না, এই দেশটা শুধুমাত্র কেন বাঙালিদের করে রাখা হলো ? অন্তবর্তীকালীন সরকারের অন্তরে আদিবাসীদের জায়গা আছে কিনা? মানবাধিকার নিয়ে যারা কাজ করে তারা যদি আদিবাসীদের অধিকার নিয়ে কাজ করতে ভয় পায় তাহলে তারা কিসের মানবাধিকারকর্মী এই প্রশ্ন রাখেন তিনি। বাংলাদেশের যারা গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বিশ্বাস করে, বাংলাদেশকে যারা অন্তর্ভুক্তিমূলক দেশ হিসেবে দেখতে চাই তাদের জন্য রবীন্দ্রনাথ সরেন ঐক্যের প্রতীক হিসেবে পাথেয় হয়ে থাকবে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় সদস্য দীপায়ন খীসা তার বক্তব্যে রবীন্দ্রনাথ সরেনকে স্মরণ করে বলেন, আমার জন্মস্থান পাহাড়ের পরে সবথেকে পায়ে হেঁটে যাতায়াত করেছি উত্তরবঙ্গে এবং সেটি তাঁর সাথেই। জ্বর গায়ে নিয়েই তিনি সারাদিন মিছিল করছেন, লড়াই সংগ্রামে দমে না যাওয়ার প্রবনতা রাখতে রবীন্দ্রনাথ অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবেন। তিনি আরো বলেন, রবীন্দ্রনাথ সরেনের স্মরণসভায় এসে আমাদের কেন বলতে হচ্ছে এই বাংলাদেশ এখনও সবার হতে পারেনি, অভ্যুত্থান চলাকালীন সময়ে আন্দোলনে কল্পনা চাকমার কথা ছিল, একটি গাছের পাতায় হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রীস্টানের সাথে আদিবাসীরাও ছিল, আন্দোলন শেষ হওয়ার সাথে সাথেই আবার আদিবাসীদের অস্বীকার করা হচ্ছে বলে এই অভিযোগ রাখেন তিনি।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মাহমুদুল সুমন বলেন রবীন্দ্রনাথ সরেনকে আমি চিনিই একজন সংগঠন হিসেবে। তাঁকে দেখেই আমি আমার গবেষনার বিষয় ঠিক করি যে কিভাবে উত্তরবঙ্গ থেকে শুরু করে পুরো বাংলাদেশে আদিবাসী অধিকার আন্দোলন কিভাবে চলছে। জাতীয় আদিবাসী পরিষদের মাধ্যমে উত্তরবঙ্গের আদিবাসীদের সংগঠিত করতে রবীন্দ্রনাথ সরেনের যে অবদান, যে নিরলস কার্যক্রম পরিচালনা করে গিয়েছেন সেগুলো আর্কাইভ করার উপরে গুরুত্বারোপ করেন। সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন করার স্বপ্ন যে তিনি দেখেছেন সেই স্বপ্ন এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এ অধ্যাপক।

বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক তার বক্তব্যে নব্বইয়ের দশক থেকে গত তিন দশক ধরে সমতলের আদিবাসীদের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ের সংগ্রামে রবীন্দ্রনাথ সরেনের ভূমিকার স্মৃতিচারণ করেন। বক্তব্যে তিনি বৈষম্য নিরসনে ও অর্ন্তভুক্তিমূলক সমাজ বির্নিমাণে বাংলাদেশের আপামর জনতা, শ্রমিক, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, আদিবাসীসহ সকলকে নিয়ে আলোচনা শুরু করার জন্য অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রতি আহ্বান জানান সেই সাথে পাঠ্যবইয়ের প্রচ্ছদ পরিবর্তনেরও জোর প্রতিবাদ করেন।

নাগরিক উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন তার বক্তব্যে বলেন, রবীন্দ্রনাথ সরেন যেমন আদিবাসীদের কথা বলেছেন ঠিক তেমন দেশের কথাও বলেছেন, তিনি যেমন আদিবাসীদের নেতা তেমনি বাংলাদেশেরও সবার নেতা। আমরা শুধুমাত্র বৃহৎ-ক্ষুদ্র বিবেচনায় তাঁকে একটি নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ রাখতে পারি না। আমরা দেখেছি যে কিছু সময় বিভিন্ন মহল থেকে রবীন্দ্রনাথ সরেনের কার্যাদি নিয়ন্ত্রন করে রাখার প্রবনতার মধ্যেও তিনি আজীবন এই সকল নিয়ন্ত্রন ও কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত লড়াই করেছেন।

জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি বিচিত্রা তির্কি তার বক্তব্যে পাহাড়-সমতল মধুপুর অঞ্চলে আদিবাসীদের প্রতিনিয়ত লড়াই-সংগ্রামের কথা এবং রবীন্দ্রনাথ সরেনের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তার লড়াই-সংগ্রামের-আদর্শের স্মৃতিচারণ  করেন। তিনি তার বক্তব্যে আদিবাসীদের ভূমি অধিকার এবং প্রাথমিক শিক্ষায় আদিবাসীরা যেন নিজ নিজ মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে এ দাবিও রাখেন।

Back to top button