পার্বত্য চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন না করে রাষ্ট্র পার্বত্যবাসীর সাথে বেঈমানী করেছে
আইপিনিউজ ডেস্ক (ঢাকা): আজ ২৫ অক্টোবর, শুক্রবার ঢাকার পরিবাগে সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্রের পথচলার ৩৩ বছর পালিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এ আয়োজনটি উদ্বোধন করেন বরেণ্য নাট্য ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আমিরুল হক চৌধুরী। আয়োজনে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনে দেশবাসীর সম্পৃক্ততা বিষয়ে সেমিনারে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের সদস্য দীপায়ন খীসার সঞ্চালনায় সভাপ্রধান হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস। মূল আলোচনা উপস্থাপন করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের যুগ্ম সমন্বয়কারী জাকির হোসেন। আলোচক হিসেবে অংশ নেন পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের যুগ্ম সমন্বয়কারী অধ্যাপক ড. খায়রুল ইসলাম চৌধুরী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জোবাইদা নাসরীন ।
সেমিনারের সভাপ্রধান অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস তার বক্তব্যে বলেন, সর্বশেষ যে সংবিধান সংস্কার কমিটি হয়েছে, আমার সরাসরি শিক্ষক প্রফেসর আলী রীয়াজ স্যারকে আমি প্রশ্ন করেছিলাম, এই যে সংস্কার কমিশন করলেন সংবিধান সংস্কার সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ, এখানে একজন জাতিগত সংখ্যালঘু কেন নাই? ধর্মীয় একজন সংখ্যালঘু কেন নাই? তিনি একদম নিশ্চুপ, আমার প্রশ্নের একটা সরাসরি উত্তর দিতে পারেন নাই । তিনি বলেন, এ সংস্কার কমিটি অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়নি। এই সংবিধান সংস্কার কমিটিকে আমি লাল কার্ড দেখাচ্ছি । এই সংস্কার কমিশনকে বাতিল ঘোষনা করে নতুন করে অর্ন্তভুক্তিমূলক কমিশন পুনর্গঠন করতে হবে।
তিনি তার বক্তব্যে বাহাত্তরের সংবিধানে বাঙালি ভিন্ন অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের জাতিগত পরিচয়কে অস্বীকার করে সবাইকে জাতি হিসেবে বাঙালি পরিচয় চাপিয়ে দেয়াকে ঐতিহাসিক ভুল ও এর চেয়ে মিথ্যা অবৈজ্ঞানিক অসত্য বলে কোন কিছু নাই বলেও মন্তব্য করেন। এসময় তিনি আরো যোগ করে বলেন, বাংলাদেশ কেবলমাত্র বাঙালির না, বাংলাদেশ কেবলমাত্র মুসলমানের না, বাংলাদেশে বাঙালি ছাড়াও ৫০ এর অধিক জাতি বাস করে, এই প্রত্যেকটি জাতির নাম সংবিধানে উল্লেখ থাকতে হবে। বাংলাদেশে বাংলা ছাড়াও আরও ৩৫টি মাতৃভাষায় মানুষ কথা বলে। বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান, মুসলিম, বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী, বহুজাতি, বহুভাষা, বহুলিঙ্গের, বহুধর্মের বৈচিত্র্যর্পূর্ণ একটি রাষ্ট্র সুতরাং রাষ্ট্র পরিচালনায় বহুত্ববাদী নীতিই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য ।
আমিরুল হক চৌধুরী তার উদ্বোধনী বক্তব্যে বলেন, সংস্কৃতিটা ভেতরের দিকে লুপ্তির পথে প্রায়, কোথায় যেন চারিদিকে সামাজিক যে উপাদনগুলো চলছে, যেগুলো আমাদের চারিপাশে বিরাজ করছে সেগুলো যেন আমাদের ছোট করে দিচ্ছে। সংস্কৃতিটাকে বাঁচাতে হবে তা না হলে জাতি বাচঁবে না। সংস্কৃতিকে স্পর্শ করতে পারার জন্যই মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে যেখানে বিভিন্ন পেশাজীবীর মানুষজন এক হয়ে স্বতস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। সংস্কৃতিকে যখন স্পর্শ করা যায় তখন আত্মসম্মানের বিষয়টিও দাঁড়িয়ে যায় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের যুগ্ম সমন্বয়ক জাকির হোসেন তার মূল আলোচনায় বৈচিত্র্যকে সম্মান ও স্বীকার না করার কারনেই পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্ত্র আন্দোলনের সূচনা হয়েছে বলে বক্তব্য প্রদান করেন। সশস্ত্র সংঘাত থেকে উত্তরণের জন্যই ২৬ বছর আগে রাষ্ট্র চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু আমরা ভুলে যেতে বসছি যে, চুক্তির পূর্ণাঙ্গ ও মৌলিক বিষয়গুলোই বাস্তবায়িত হয় নি। চুক্তি করে বাস্তবায়ন না করে রাষ্ট্র পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের সাথে বেইমানী করেছে বলে বক্তব্যে যোগ করেন তিনি। তাই বাংলাদেশের সচেতন নাগরিক হিসেবে নিজের দেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার অবদান রাখার জন্যই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দেলনের মূল উদ্দেশ্য হিসেবে বক্তব্য প্রদান করেন তিনি।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের যুগ্ম সমন্বয়কারী অধ্যাপক ড. খায়রুল ইসলাম চৌধুরী তার আলোচনায়, “পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘাত কেন শুরু হয়েছিল ও পটভূমি কি? ৯৭ এ কেন চুক্তি হয়েছিল? তিনি এ দুইটি সম্পূরক প্রশ্ন নিয়ে ও পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস নিয়ে বিষদ আলোচনা করেন এবং তার আলোচনায় পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাটি সভ্যতার দ্বন্দ্ব বলে মতামত প্রকাশ করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জোবাইদা নাসরীন তার আলোচনার প্রথমেই নবগঠিত সংবিধান সংস্কার কমিটি নিয়ে প্রতিবাদ ব্যক্ত করেন। তিনি আরো বলেন, আমাদের দেশে ইনক্লুসিভিটির মানে আমরা যদি শুধুমাত্র ধর্মকে বুঝি তাহলে কিন্তু আমরা ভুল ফাঁদে পা দিচ্ছি। তার বক্তব্যে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত আগ্রাসনের বিষয় টেনে বলেন ”খাগড়াপুরের নাম কেন ইসলামপুর হবে? কেন ভে-বোন ছড়ার নাম হবে ভাইবোন ছড়া? হবংপুজ্যের নাম কেন হবে খবংপড়িয়া? সাজেকে গেলে পর্যটকরা লুসাই পোশাকে ছবি তুলে কিন্তু সাজেকের লুসাইরা কোথায় গেল? এ সব জিজ্ঞাসার উত্তর তিনি তার আলোচনায় শ্রোতাদের খুঁজতে বলেন।
ডা. অজয় প্রকাশ চাকমা তার আলোচনায় পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ায় ক্ষোভ ও হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংবিধানের আওতায় বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি অবিচল আস্থা রেখেই চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছিল। এ চুক্তিতে আদিবাসী অধিকারকামীদের যেমন রক্ত ঝরেছে তেমনি রক্ত ঝড়েছে বাঙালি ও নিরাপত্তা বাহিনীর। তাই অন্তর্ভূক্তিমূলক বাংলাদেশ গঠনে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের সম্পৃক্ত করতে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন অতীব জরুরী বলে আলোচনায় যোগ করেন তিনি।
এছাড়া আয়োজনে আন্দ্রেজ ওয়াজদার পরিচালনায় ড্যান্টন চলচ্চিত্র প্রদর্শনী ও আলোচনা এবং তারার মেলা, হর বোলা, সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠী, সংযোগাগার এবং অন্যান্য অতিথি শিল্পীবৃন্দদের সাথে নিয়ে সাংস্কৃতিক আয়োজন এবং সন্ধ্যায় শাস্ত্রীয় সংগীত পরিবেশন করা হয়।