মতামত ও বিশ্লেষণ

ভয়াবহ বন্যার কবলে গারো পাহাড়ের পাদদেশ-সোহেল হাজং

গারো পাহাড়ের পাদদেশের জনগণ এমন ভয়াবহ বন্যা দেখেনি বহুদিন। এবারের বন্যা ১৯৮৮ সালের বন্যার ভয়াবহতাকেও পেছনে ফেলেছে।  ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও ভারী বৃষ্টিতে বন্যার স্রোতে ভেসে গেছে ঘর, আসবাবপত্র, গবাদিপশু; পানির বাড়ার সঙ্গে তৈরি হয়েছিল  খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট।

দু’দিন ধরে ভারী বর্ষণ। গত ৪ অক্টোবর শুক্রবার দুপুরে শুনলাম নিজ জেলা শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার চেল্লাখালী ও ভোগাই নদীর বাঁধ ভেঙে গেছে, বাঁধ  উপচে পানি পার্শবর্তী গ্রামগুলোতে প্রবল বেগে ঢুকে পড়ছে। পানির প্রবল স্রোতে বিভিন্ন রাস্তার অনেক অংশ ভেঙে গিয়ে পানি চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে। জেলার পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বলেছে, সেদিন দুপুর পর্যন্ত এই নদী দু’টির পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।

বিকেলে খোঁজ নিয়ে জানা গেল ইতোমধ্যে নিজ ইউনিয়ন নয়াবিলসহ পোড়াগাঁও, রামচন্দ্রকুড়া ও বাঘ‌বেড় এই চারটি ইউনিয়ন এবং নালিতাবাড়ী পৌরসভার গড়কান্দা ও নিচপাড়া এলাকা প্লাবিত হয়েছে। দ্রুত বেগে পানি লোকজনের বাড়ি-ঘরে প্রবেশ করছে। এ সময় দেশের বাইরে অবস্থান করায় মোবাইল ও ইন্টারনেটের ওপর ভরসা করেই বাবা-মা আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছিল।

সন্ধ্যায় যখন খোঁজ নিলাম জানতে পারলাম নিজগ্রাম দাওয়াকুড়ার বিভিন্ন স্থানসহ পার্শবর্তী অনেক গ্রাম বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। আমাদের বাড়িসহ আরো কয়েকটি বাড়ি রাস্তার অপর পাশে কিছুটা উঁচু জায়গায় অবস্থিত হওয়ায় তখনও সেখানে বন্যার পানি প্রবেশ করতে পারেনি তবে বাড়ির দুইপাশে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। এই ভয়ানক অবস্থায় পার্শবর্তী বাদলাকুড়া গ্রামের ৯/১০টি  হাজং পরিবার-আত্মীয় স্বজন আমাদের গ্রামে অবস্থান নিয়েছে। তাদের সবার ঘরে ইতোমধ্যে পানি ওঠেছে এবং চারটি পরিবারের মাটির দালান ঘরগুলো সব ধসে পড়েছে। আকস্মিক এ বন্যায় অনেকেই বাড়ির আসবাব-পত্র রক্ষা করতে পারেনি। আশ্রয়ী সকলের থাকা ও খাবারের যেন কোনো অসুবিধা না হয় সে ব্যাপারে বাড়িতে কথা হল। এরপর রাতে এলাকার আর কারও সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হল না তাদের মোবাইলের চার্জ শেষ হওয়ার কারণে। গত দু’দিনের ভারী বৃষ্টিতেও এলাকায় বিদ্যুৎ নেই।

এভাবেই টানা বর্ষণ এবং উজানের পাহাড়ি ঢলে শেরপুরের নালিতাবাড়ি, ঝিনাইগাতী ও শ্রীবরদী উপজেলা, ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট, ধোবাউড়া উপজেলা এবং নেত্রকোণার দুর্গাপুর, কলমাকান্দা উপজেলার শত শত গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে এসব অঞ্চলের লাখো লাখো আদিবাসী ও বাঙালি পরিবার। এর মধ্যে শেরপুর জেলার বন্যার অবস্থা খুবই মারাত্মক আকার ধারণ করে। ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট, ধোবাউড়াতেও এর ভয়াবহতা ছড়িয়ে পড়ে। নেত্রকোণা ও অন্যান্য অঞ্চলেও এ দুর্ভোগ তৈরি হয়েছে।

এখন পর্যন্ত বন্যার পানিতে শেরপুর জেলার কমপক্ষে ৯ জন প্রাণ হারিয়েছেন যার মধ্যে নারী ও শিশুসহ ৬ জনই নালিতাবাড়ীতে এবং নকলায় ২ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। ঝিনাইগাতীতে বন্যার পানিতে ভেসে এসেছে এক অজ্ঞাত পরিচয় নারীর লাশ। নিখোঁজ রয়েছে আরো অনেকে। এছাড়া  শেরপুরের ৫টি উপজেলার ৩০টি ইউনিয়নের দুই শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছিলেন দেড় লাখেরও বেশি মানুষ। এই বন্যায় নালিতাবাড়ীর অভয়পুর গ্রামের একই পরিবারের দুই সহোদর ভাইয়ের মরদেহ উদ্ধার এবং বাঘবেড় এলাকায় এক নারীর মরদেহের সঙ্গে ভেসে আসা তার শিশু সন্তানের সংবাদ সবাইকে বিষাদময় করে তোলে।

পানির তোড়ে বন্যাকবলিত এসব অঞ্চলের অসংখ্য বসতবাড়ি ও অবকাঠামোর ক্ষতি হয়েছে। যোগাযোগের বিভিন্ন রাস্তাঘাট, স্থানীয় নদীর বাঁধ ভেঙে গেছে। রোপা আমনের ফসলী জমি, সবজি ক্ষেত পানিতে তলিয়ে গেছে। গবাদি-পশু, হাঁস-মুরগী ভেসে গেছে। হারিয়ে গেছে প্রায় ১১ হাজার পুকুর ও খামারের কোটি কোটি টাকার মাছ। নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে মানুষ হয়েছিল দিশেহারা। চুলা জ্বলেনি বানভাসি মানুষের ঘরে।

মূলত ভারতের মেঘালয় থেকে আসা পাহাড়ি ঢলের পাশাপাশি কয়েকদিনের ব্যাপক বৃষ্টির কারণেই এবার এসব এলাকায় ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির তৈরি হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। জনগণের কাছে ছিলনা বন্যার কোনো পূর্বাভাস ও আগাম সতর্কতা, নিতে পারেনি কেউ কোনো পূর্ব প্রস্তুতি। পর্যাপ্ত নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্র ও সুপেয় পানির অভাবে মানুষের দুর্ভোগ ছিল চরমে।

ময়মনসিংহ বিভাগের এসব অঞ্চলে বৃহত্তর বাঙালি জাতির লোকজন ছাড়াও গারো, হাজং, কোচ, বানাই, হদি, বর্মন, ডালু এ ৭টি আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর লোকেরা স্বরণাতীত কাল হতে বসবাস করে আসছে। সীমান্তবর্তী নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতী, হালুয়াঘাট, ধোবাউড়া, দুর্গাপুর, কলমাকান্দাসহ অন্যান্য উপজেলার হাজারো আদিবাসী পরিবার এ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে অনেকেরই পুরনো ও নতুন মাটির দালান ও আধা পাকা ঘর ছিল। এই বন্যার পানিতে তাদের অধিকাংশ ঘর-বাড়ির মাটির দেয়াল ও বেড়া ধসে পড়েছে। বাড়ি-ঘর হারিয়ে পথে বসেছেন অসংখ্য আদিবাসী পরিবার। বন্যায় পাকা মাটির দেয়াল ও আধা-পাকা ঘর ধসে পড়েছে

এ অঞ্চলের হিন্দু ধর্মাবলম্বী আদিবাসী হাজং, কোচ, ডালু, বানাই, হদি ও বর্মন জাতিগোষ্ঠীর আর একদিন পরেই প্রধান ধর্মীয় উৎসব দুর্গা পূজা শুরু হবে। কিন্তু পূজার ঠিক কয়েকদিন পূর্বে এরকম দুর্গত পরিস্থিতি তাদের সব আনন্দ মাটি করে দিল!

আমরা দেখেছি এই ব্যাপক বন্যার সংবাদ জাতীয়ভাবে তেমন সাড়া ফেলতে পারেনি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও এটা নিয়ে তেমন
হৈচৈ ছিল না। যার ফলে এসব বিপর্যস্ত মানুষের সেবায় সহায়তা ও ত্রাণও চোখে পড়েছে খুবই কম। অনেক ক্ষতিগ্রস্ত আদিবাসী পরিবার রয়েছে যারা এখনও কারও কাছ কোনো ত্রাণ বা সহায়তা পায়নি।

এখন শেরপুরে বন্যার পানি কমায় স্পষ্ট হয়ে উঠছে ক্ষয়ক্ষতির চিহ্ন। এসব অঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি কিছুটা উন্নত হওয়া শুরু করলেও যে ক্ষতটা ক্ষতিগ্রস্ত আদিবাসী ও বাঙালি সকল মানুষের জীবনে রেখে গেল তা পূরণে দীর্ঘ সময় সংগ্রাম করতে হবে। অপূরণীয় ক্ষতি রয়ে যাবে স্বজন হারানো পরিবারগুলোর। এ ভয়ানক ক্ষতি থেকে কীভাবে কাটিয়ে ওঠবে তা নিয়ে এখন চিন্তিত তারা। এবারের বন্যায় প্রান্তিক আদিবাসী মানুষের জীবনের অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে আরো প্রান্তিকতর। তাদের সাংস্কৃতিক জীবনকে করেছে বিপন্ন। তবু এর মধ্যে যারা সহায়তার হাত বাড়িয়েছেন, সাহস ও উদারতা দেখিয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন এসব অঞ্চলের অসহায় মানুষের পাশে থাকার এবং বন্যা পরবর্তী অবস্থা মোকাবেলায় বিপর্যস্ত মানুষকে সহযোগিতায় যারা এগিয়ে আসছেন সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। আবারো জেগে ওঠুক, চিরঞ্জীব গারো পাহাড়ের পাদদেশ, টংক আন্দোলন ও মাতা রাশিমণির উত্তরসূরীরা।

সোহেল হাজং- কার্যনির্বাহী সদস্য, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম 

Back to top button