পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক ও বিস্ফোরণোন্মুখ: পার্বত্য চট্টগ্রামের মানবাধিকার পরিস্থিতির উপর জেএসএসের প্রতিবেদন
পার্বত্য চট্টগ্রামের পার্বত্য চট্টগ্রামের সামগ্রিক মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৬ মাসের একটি অর্ধ-বার্ষিক প্রতিবেদন তৈরী করেছে পাহাড়ের রাজনৈতিক দল পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস)। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রামের সামগ্রিক পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক ও বিস্ফোরণোন্মুখ বলে এই প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়েছে। ।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সহ-তথ্য ও প্রচার সম্পাদক সজীব চাকমা কর্তৃক স্বাক্ষরিত গণমাধ্যমে পাঠানো এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ৩০ এপ্রিল ২০২৪ জাতীয় সংসদ ভবনে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটির ৯ম সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভায় আরেকবার প্রমাণিত হয়েছে যে, চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির পূর্ববর্তী সভাগুলোতে গৃহীত কোনো সিদ্ধান্তই বাস্তবায়নে সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। এভাবেই আজ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটিকে অথর্ব অবস্থায় রেখে চলেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রামের সামগ্রিক পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক ও বিস্ফোরণোন্মুখ। শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরকারী আওয়ামী লীগ সরকার একনাগাড়ে প্রায় ১৬ বছরের অধিক রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির অবাস্তবায়িত বিষয়গুলো বাস্তবায়নে এগিয়ে আসেনি। বর্তমানে সরকার পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া সম্পূর্ণভাবে বন্ধ রেখেছে। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে পার্বত্য সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের পরিবর্তে সরকার বর্তমানে পূর্ববর্তী স্বৈরশাসকদের মতো ব্যাপক সামরিকায়ণ করে দমন-পীড়নের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের নীতি গ্রহণ করেছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের ব্যর্থতা এবং অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করার ষড়যন্ত্র ধামাচাপা দিয়ে পার্বত্যাঞ্চলের পরিস্থিতিকে অন্যত্র ধাবিত করার হীনউদ্দেশ্যে সাম্প্রতিক সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সন্নিকটস্থ অঞ্চল নিয়ে একটি খ্রীষ্টান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার কল্পকাহিনী জোরালোভাবে অপপ্রচার চলছে। সেই অপপ্রচারে প্রথমদিকে রাষ্ট্রীয় কিছু সামরিক-বেসামরিক মহল সামিল থাকলেও অতি সম্প্রতি সেটি প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত গড়িয়েছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি মোতাবেক সংশোধন না করে, সাম্প্রতিক কালে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্ম জনগণের ঐতিহাসিক, ঐতিহ্যগত, প্রথাগত ও বিশেষ অধিকারের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধিকে মৃত আইন ঘোষণা করা কিংবা বাতিল বা অকার্যকর আইনে পরিণত করার জোর ষড়যন্ত্র চলছে। জুম্ম বিদ্বেষী ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী কর্তৃক পূর্বের দুটি মামলার হাইকার্টের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগে এই ষড়যন্ত্রমূলক রিভিউ পিটিশন দায়ের করলেও খোদ বর্তমান সরকারের এ্যাটর্নি জেনারেল ষড়যন্ত্রকারীদের পক্ষ নেওয়ায় সেই ষড়যন্ত্র এখন বিপদজনক পর্যায়ে উপনীত করা হয়েছে। রিভিউ পিটিশন অনুসারে ২৭টি দফা বিলুপ্ত হলে শুধু পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি নয়, ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি এবং এর অধীনে প্রণীত পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০০১, তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক আইনের বিধানাবলী ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে জুম্ম জনগণের ভূমি অধিকার এবং সামাজিক রীতি-প্রথা।
প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়, গত ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ম্যাজিস্ট্রেট ফাতেমা বেগম মুক্তার নেতৃত্বে রাঙ্গামাটির সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত অপহৃত কল্পনার হদিস, অপরাধীদের গ্রেপ্তার ও শাস্তি এবং ভুক্তভোগী পরিবারের ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত না করেই কল্পনা চাকমা অপহরণ মামলাটি খারিজের আদেশ দিয়েছেন। প্রায় দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে মামলাটি চলার পর নিম্ন আদালতের এই আদেশ যেমন প্রশাসনকে অপহৃত কল্পনা চাকমার হদিস প্রদানের দায়িত্ব থেকে রেহাই ও কল্পনা চাকমা অপহরণকারীদের অপরাধ থেকে দায়মুক্তি দিয়েছে, তেমনি অপরদিকে ভুক্তভোগী কল্পনা ও তার পরিবারের মানবাধিকারকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, যা পার্বত্য চট্টগ্রামে বিচারহীনতার এক চরম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
এছাড়াও উল্ল্যেখ করা হয়েছে, ‘অপারেশন উত্তরণ’-এর বদৌলতে সেনাবাহিনী ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক জুম্মদের উপর রাত-বিরাতে সামরিক অভিযান পরিচালনা করা, ঘরবাড়ি তল্লাসী ও ঘরবাড়ির জিনিষপত্র তছনছ করা, অস্ত্র গুঁজে দিয়ে গ্রেফতার, অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী তকমা দিয়ে ক্রসফায়ারের নামে ঠান্ডা মাথায় গুলি করে হত্যা করা, মিথ্যা মামলায় জড়িত করে জেল-হাজতে প্রেরণ করা, নির্বিচারে মারধর ইত্যাদি ঘটনা পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের জীবনে নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম এখন একটি বৃহত্তর সেনানিবাস এলাকা ও নির্যাতন সেলে পরিণত হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করা এবং চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে জুম্ম জনগণের চলমান আন্দোলনের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে সেনাবাহিনী তথা সরকার কর্তৃক সুবিধাবাদী ও জুম্ম স্বার্থ বিরোধী পাহাড়িদের দিয়ে একের পর এক সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী সৃষ্টির ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ সৃষ্টি করা হয়েছে বম পার্টি নামে খ্যাত কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)। সেনাবাহিনীর সৃষ্ট এই কেএনএফ এক পর্যায়ে তাদের আস্তানায় ইসলামী জঙ্গীগোষ্ঠীকে আশ্রয় ও সামরিক প্রশিক্ষণের কথা ফাঁস হলে আন্তর্জাতিক চাপে পড়ে সেনাবাহিনী তথা সরকার কেএনএফের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালনা করতে বাধ্য হচ্ছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ২ ও ৩ এপ্রিল কেএনএফ কর্তৃক রুমা ও থানচিতে ব্যাংক এবং রুমা থেকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ১৪টি আগ্নেয়াস্ত্র লুটের ঘটনার ফলে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে যৌথবাহিনী কেএনএফের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের দোহাই দিয়ে নিরস্ত্র নিরীহ বম গ্রামবাসীদেরকে- নারী, শিশু, গর্ভবর্তী নারী নির্বিশেষে- ধর-পাকড়, শারিরীক নির্যাতন, গ্রেফতার ও জেলে প্রেরণ, কেএনএফ তকমা দিয়ে ঠান্ডা মাথায় গুলি করে হত্যা ইত্যাদি চালিয়ে যাচ্ছে। গত ৭ এপ্রিল থেকে সেনাবাহিনী নেতৃত্বাধীন যৌথবাহিনীর কেএনএফ বিরোধী অভিযানে এযাবত গুলি করে হত্যা করা হয়েছে একজন শিশুসহ ১২ জন নিরীহ বম ব্যক্তিকে এবং গ্রেফতার করা হয়েছে গর্ভবতী নারী ও শিশুসহ ১১১ জন নিরীহ বম গ্রামবাসীকে (কয়েকজন ত্রিপুরাসহ)। অত্যাচারের ভয়ে ৪৭টি গ্রামের কমপক্ষে ১,০০০ পরিবারের আনুমানিক ৫,০০০ বম গ্রামবাসী গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র চলে গেলে তাদের মধ্যে দুই দফায় কমপক্ষে ১৯২ জন বম গ্রামবাসী প্রতিবেশী রাজ্যে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত মিজোরামে সরকারিভাবে তালিকাভুক্ত বম শরণার্থীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১,৪৩৩ জন, যদিও বেসরকারি হিসেব মতে এই সংখ্যা দুই হাজারের অধিক হবে।
পার্বথ্য চট্টগ্রামে সিমান্ত সড়ক নির্মাণ করার প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাঘাইছড়ি উপজেলায় সীমান্ত সড়ক ও সীমান্ত সংযোগ সড়ককে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বিজিবি স্থানীয় আদিবাসী জুম্মদের বিভিন্ন আবাসভূমিতে স্থানীয় নামের বিপরীতে মুসলিম ব্যক্তির নামে নামকরণ করে সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে দিয়েছে। এধরনের সাইনবোর্ড স্থাপনের কয়েকটি উদাহরণ হল- বাঘাইছড়ির সার্বোয়াতলী এলাকার ভিজে হিজিং নামক স্থানের জায়াগায় ‘শাহীন টিলা’, সাজেক এলাকার কিংকরপাড়া স্থানের জায়গায় ‘মাহমুদ টিলা’, সাজেক এলাকার দুরবাছড়া স্থানের জায়গায় ‘এনামুল টিলা’, সাজেক এলাকার বটতলা নামক স্থানের জায়গায় ‘সজিব টিলা’, সাজেক এলাকার কিংকরপাড়ার স্থানে আরেকটি টিলার নাম ‘শামিম টিলা’, সাজেক এলাকার ভুইয়োছড়া নামক স্থানের জায়গায় ‘সাইদুর টিলা’, সাজেক এলাকার কিংকরপাড়ায় আরো একটি টিলার নাম ‘ইসমাইল টিলা (বিওপি পোস্ট)’, সাজেক এলাকার ভুইয়োছড়া নামক জায়গায় আরো একটি টিলার নাম ‘আল-আমিন টিলা’ ইত্যাদি নাম সম্বলিত সাইনবোর্ড। সেনাবাহিনী ও বিজিবি মূলত পার্বত্য চট্টগ্রামে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন এবং স্থানীয় জুম্মদের ভূমি বেদখল ও উচ্ছেদের লক্ষেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এইসব সাইনবোর্ড স্থাপন করেছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২৪ সালের জানুয়ারি হতে জুন মাস পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে নিরাপত্তা বাহিনী ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, সেনা-মদদপুষ্ট সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ, সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী গোষ্ঠী, মুসলিম বাঙালি সেটেলার ও ভূমিদস্যুদের দ্বারা ১০৭টি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে এবং এসব ঘটনায় কমপক্ষে ৫,০০০ বম নারী-পুরুষসহ ৫,৪৪৮ জন জুম্ম মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়। এছাড়া কমপক্ষে ১,০০০ বম পরিবারসহ ১,২৮৪ পরিবার ও ৪৭টি বম গ্রামসহ ৭৬টি গ্রাম প্রত্যক্ষভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়। অপরদিকে ১,৮০৬ একর ভূমি বহিরাগত এনজিও, প্রভাবশালী ব্যক্তি ও সেটেলার কর্তৃক বেদখল করা হয়েছে।