মতামত ও বিশ্লেষণসাহিত্য

সুহৃদ সমাচার

জুম পাহাড়ের আধুনিক কাব্যসাহিত্য চর্চার অন্যতম পথিকৃৎ কবি সুহৃদ চাকমার জন্মদিবসে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নিজের অনুভুতি প্রকাশ করেছেন পাহাড়ের উদীয়মান লেখক বাবু হান্যারাম। আইপিনিউজের পাঠকদের জন্য তাঁর লেখাটি প্রকাশ করা হল।

কবিতাকে যারা ‘ভাত দেওয়া বা রোজগার’র প্রশ্নে বাঁধতে চান, কবিতার নিজের যে ছাঁচ, ওটাকে মডিফাই বা ডিনাই করতে চান, যাদের জানা – বোঝার দৌড় কেবলই জীবিকা কেন্দ্রীক, যাদের শেখার মূলে কেবলই রোজগার বা নাগরিক অ্যাটিটিউড বেইসড, এদের কাছে কবিতার দাম আর.বি লজেন্সের চাইতেও কম। তারা দুই টাকা বাঁচিয়ে চকলেট খাবে, তবু কবিতার বই কিনে পড়বে না। কবিতা ফ্রি বা মাগনা পড়ার জিনিস নয়, এটা আর আট-দশটা সৃষ্টিশীল কাজের মতোই কিনে পড়া বা রাখার জিনিস, এটাও পারচেইজেবল। অবশ্য, মন চাইলেই বই লিখে ফেলার যে কালচার এদেশে চলছে, এদিকটা ভাবলে খারাপ লাগে না। মন চাইলেই বই লিখতে হবে—এইরকম একটা অ্যাটিটিউড আমাদের ভেতর খুব সক্রিয় থাকে। আয়মান সাদিক, হালের তাসরিফ খান বা সোলায়মান সুখন—এরা আসলে মন চেয়েছে বলেই বই পাবলিশ করেছে। হাতে টাকা ছিলো, সার্কেলের ভেতর থেকে মোটিভেশন এসেছে ব্যাস, একটা বই হয়ে গেলো!

আজ ২০ই জুন, কবি সুহৃদ চাকমা’র ৬৬তম জন্মদিবস। সুহৃদকে চিনতেই হবে, এইরকম কোনো কথা নেই—কবি সুহৃদ চাকমাকে না চেনা অপরাধও নয়। কবিতা লিখে তো আর ঘুষ খাওয়া যায় না, কবিতা লিখে অতিকায় বিল্ডিং করে দিয়ে কারো মনোরঞ্জনও সম্ভব নয় যে, মনে রাখা যাবে। কবি এবং তার কবিতা হলো ঝর্ণার মতো। গান মনে করলে গান, কেবলই কলকল ধ্বনি মনে করলে হয়তো তাই। কবি সুহৃদ চাকমা তার মাস্টারপিস ‘বার্গী’ কবিতায় বলছেন:

❝কাদিমায ফুত্যে সুধোখলার জুমতুগুনোত জুনোপহর ফুদিলে
একঝাক সনারঙ মেদোনী-বার্গী উরি যান
মেঘঃ সেরে খুওর খবং মুগুচ্যে মোন’সান স্ববনত❞

এই বার্গী কবিতাটা পড়লে শেলী’র ‘টু অ্যা স্কাইলার্ক’ কবিতাটা মনে পড়ে যায়। কার্তিকের সূতোকলি-ফোটা জুমের কথা বলছেন কবি সুহৃদ চাকমা, যে জুমের ওপর গর্ভিনী বার্গী(মেদোনী শব্দটার অর্থ গর্ভিনী) উড়ে যায় স্বপ্নে। যে স্বপ্ন আবার মেঘে ঘেরা কুয়াশার খবঙে ঢাকা সু-উচ্চ পর্বতের মতো। এই যে ইমাজিন করার ক্ষমতা, স্বপ্নকে কেবল স্বপ্নের আকারে না রেখে একটা সুউচ্চ পর্বতের আকৃতি দিতে চাওয়ার ক্ষমতা—এটাকেই ইংলিশ রোমান্টিক কোলেরিজ বলছেন সেকেন্ডারি ইমাজিনেশন। ইমাজিন সবাই করতে পারে, সবারই যার যার কল্পনার জগত আছে, সীমাবদ্ধতা আছে। আমরা নরমাল পাবলিকেরা প্রাইমারী ইমাজিনেশন পর্যন্তই যেতে পারি। যারা এটাকে ছাড়িয়ে যায়, তারা হন সৃষ্টিশীল মানুষ বা আর্টিস্ট। ইমাজিনেশনের ডিফারেন্সটাই মূলত আর্টিস্ট এবং নরমাল হিউম্যানদের ভেতর পার্থক্য গড়ে দেয়। পোয়েটিক ইমাজিনেশনের গুণ সবার থাকে না। তিনি আবার বলছেন:

❝সোজরঙ সাজুরি সনারঙ বার্গীজাঙাল জুনপহরে ভিজে মোন
জিংকানির ঘর-গিরিত্থি-পোচপানা-লুভ-ধাব-আওঝ
কৃষ্ণাগাবুরীর ভরনভিরোন বুগ সান❞

তারাজাঙাল’র মতো বার্গীজাঙাল বা বার্গীর পাল নীল মেঘ সাঁতরে জোৎস্নায় ভেজা পাহাড়। এই তারাজাঙাল বলতে মূলত মিল্কিওয়েকে বোঝানো হয় বলে-ই আমার ধারণা (ভুল বলে থাকলে কমেন্টে জানাবেন, এডিট করতে প্যারা নাই)। এই সনারঙ বার্গী ধরার বায়না রাধামনের কাছে ধরেছিলো ধনপুদি। এই বার্গী মূলত দেব— ‘স্যাক্রেড বা মাইটি’ ঘরানার একটা পাখি, যেটাকে নরমাল হিউম্যান ধরতে পারবে না। এজন্য ‘দেবর বার্গী’ টার্মটা বোঝা জরুরি। এই বার্গী অনেক চেষ্টা করেও রাধামন ধরতে পারে নাই। রাধামনও যে দেবকূলের কেউ ছিলেন, তার প্রমাণ আমরা এখানে পাই। রাধামন কিছু একটা করে আর দেবরাজ ইন্দ্র নাকি ব্রম্মা স্বর্গ থেকে তিনজোড়া বা ছয়জন ব্যাধ (একটু ডাউট আছে ব্যাধের সংখ্যাটা নিয়ে। যতদূর মনে পড়ে তিন জোড়া ব্যাধই এসেছিলো রাধামনের হয়ে বার্গী ধরতে) পাঠান, যারা রাধামনের হয়ে বার্গী ধরে আবার স্বর্গে চলে যায়। এভাবেই সে জেদি ধনপুদির অসম্ভব চাওয়াগুলোকে পূরণ করে আর প্রতিনিয়ত ইম্প্রেস করতে থাকে।
কবি সুহৃদ চাকমার আরেকটা মাস্টারপিস ‘ইরুক মর চম্পকনাগরী’ কবিতায় তার প্রেয়সীকে উদ্দেশ্য করে বলছেন:

❝এ ফাগোনত তরেঃ সাজেবার ওচ এলঃ পরানী
বুগোত ফুলর খাদি সামোলেজ-চাবুগী সোজ পিনোনে,
কানত সধরক ফুল পিনিনে চুলানত নাক্সাফুল গুজেনে
জুনপহর ইজোরত মর কায় ম’ ধাগত থেকে লাঙনি❞

আমরা এস্থেথিজম ফেসবুকে মাড়াই, উনারা প্র্যাক্টিস করতেন। হালের চাকরির সংস্কৃতি বা চাকর হওয়ার দিকে আমাদের যে ঝোঁক, ওটা তখনো পাহাড়ে আসে নাই। আর কল্পনার ধরনটা দেখেন কি অস্থির লেভেলের! এ ফাগোনত তরেঃ সাজেবার ওচ এলঃ পরানী—বুগত ফুলর খাদি সামোলেজ চাবুগী সোজ পিনোনে, ক্যান ইউ ইমাজিন গাইস! এখন আমাদের জীবনে যান্ত্রিক যে জবরদখল, যে দমন-পীড়ন, যে রাজনৈতিক ক্যাঁচাল অক্সিজেনের সাথে শরীরে ঢুকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড হয়ে প্রতিনিয়ত বেরোচ্ছে, এতে করে নন্দনের কিছু আর অবশিষ্ট থাকার কথা নয়। তাও কিছু সুন্দর কিছু মানুষ চিনি, যারা নন্দন বুঝতে চায় আর বুঝেও ফেলেছে অনেকে। হালের ওয়েডিং ফটোগ্রাফির কালচারটাও প্রশ্নের মধ্যে দিয়ে গেছে। কারণ, কিছু মানুষ এখনো অসুন্দর কে অসুন্দর বলার সাহস রাখেন। সাংস্কৃতিক এই দ্বন্ধটা কেবল সাংস্কৃতিক নয়, এটা একইসাথে আমাদের দর্শন বা তত্ত্ব চর্চারও। লিবারেল আর কনজার্ভেটিভ অথবা কালেক্টিভিজম আর ইনডিভিজুয়ালিজমের আলাপও এখানে চলে আসে। এখন আমার যেটা মনে হয়, আমরা হলাম বখে যাওয়া কল্পনাকাতর বর্গ।
সুহৃদ আবার বলছেন:

❝তুই অভে চম্পকর ধনপুদি লাঙমেয়্যে সদর ঘরনী;
কুঝিরাইন্যের কজমা-হরিং মেঘনার চিদত চোগমারিনে—
গানর হেংগরঙর পোত্তিসুরত বনাবনা ফুল ফুদেনে
মোনমুরোয় স্ববনর সাগর ফুল ছিদি যর কাবিলবানী❞

এখানে কবি সুহৃদকে আমরা দেখি তার প্রেয়সীকে ‘কাবিলবানী’ নাম দিতে। তাহলে, নারীদের ওপর তার একটা ভিউপয়েন্ট এখানে পাওয়া গেলো যে তারা কাবিল। অন্তত একজন নারী কবির কাছে কাবিলিয়ত দেখিয়েছেন বা দেখাতে সমর্থ হয়েছেন বা কবির মনে ধরেছে। এখানে কবি সুহৃদকে বিচারকের চেয়ারে বসাতে চাওয়া আমার লক্ষ্য নয় বা উদ্দেশ্য কোনোটাই নয়।
কবি সুহৃদ তার চাকমা ভাষায় লেখা কবিতাগুলো নিজেই বাংলায় অনুবাদ করতেন। তিনি টি.এস এলিয়টের কবিতা নিয়েও কাজ করেছেন। তার রাঙামাত্যা কবিতাটাও খুব সুন্দর। এদিক থেকে কবি সুহৃদ একজন অনুবাদকও ছিলেন। তাহলে, কবি ও অনুবাদক—এই দুটি বিশেষণ কবি সুহৃদের সাথে যাচ্ছে।

সিঝি জনমপুর কবি সুহৃদ দাঘি।
শুভ জন্মদিন, কবি সুহৃদ চাকমা।

[জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে বি.এ ও এম.এ করা মানুষটার কল্পনা দেখলে খেই হারিয়ে ফেলি। যান্ত্রিকতার ছোঁয়া পাওয়া একটা মানুষের কবিতায় নাগরিক যান্ত্রিক জীবনের এতো অল্প আলাপ! মাঝেমধ্যে মনে হয় কবি সুহৃদ মাস্ক পড়তেন। কবিতা লিখলে এক মাস্ক তো ব্যাক্তিজীবনে আরেক।]

Back to top button