১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি সংক্রান্ত মামলায় অ্যাটর্নি জেনারেলের প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে নাগরিক সমাজ
বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টে চলমান ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি সংক্রান্ত এক রিভিশন মামলায় অ্যাটর্নি জেনারেলের প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকার প্রতিবাদ জানিয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের ৮ জন বিশিষ্ট নাগরিক। পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি ১৯০০-এর মাধ্যমে স্বীকৃত পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের জন্য বিশেষভাবে সংরক্ষিত অধিকার হরণের অপচেষ্টার বিরুদ্ধে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী নাগরিক সমাজের ৮ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি এই বিবৃতি প্রদান করেছেন।
গত ১২ মে ২০২৪ তারিখে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, এমপি, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির চেয়ারম্যান আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ, এমপি এবং আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক, এমপি মহোদয়ের কাছে এই আবেদন জানিয়ে নাগরিকবৃন্দ এই বিবৃতি প্রদান করেন।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “বিগত ২৬ জুলাই ২০২৩ তারিখে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি নাগরিক সমাজের বত্রিশ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি, যার মধ্যে ছিলেন চাকমা সার্কেলের প্রধান রাজা দেবাশীষ রায় এবং প্রাক্তন জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান গৌতম দেওয়ান, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমীপে স্বারক লীপি প্রদান করে মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট এর আপিল বিভাগে পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন ১৯০০ সংক্রান্ত চলমান দুটি রিভিউ মামলায় রেগুলেশন ও এতে স্বীকৃত আদিবাসীদের অধিকার সম্বলিত প্রচলিত আইন, প্রথা ও রীতির জোরাল ও চলমান কার্যকারিতার পক্ষে অবস্থান গ্রহণের জন্য অ্যাটর্নি জেনারেলকে যথাযথ নির্দেশ এর প্রার্থনা জানান।”
কিন্তু সংশ্লিষ্ট রিভিউ মামলায়, অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিনের অবস্থান, যা ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বিধান এবং বহু সাংস্কৃতি, ধর্ম নিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা সংক্রান্ত সাংবিধানিক বিধানেরও পরিপন্থী বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এটর্নি জেনারেল লিখিতভাবে কিছু শব্দ, বাক্যাংশ ও বাক্য বাদ দেয়ার জন্য বলছিলেন, যা আবেদনকারীগনের দাবী অনুসারে “পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের বহু সাংস্কৃতিক ও ধর্ম নিরপেক্ষ অভিমুখিতাকে দুর্বল করবে যার দ্বারা জাতীয় সংবিধানের ২ক, ১২ ও ২৩ক অনুচ্ছেদে নিহিত স্তম্ভের সাথেও আপোষ করা হবে’’। এটর্নি জেনারেল ‘‘Raja’’, ‘‘Indigenous Peoples’’ এবং প্রথাগত আইনের বিস্তারিত ব্যাখ্যা সম্বলিত সর্বমোট দশটিরও অধিক অনুচ্ছেদ বাদ দেয়ার জন্য প্রার্থনা করেছেন।
বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ি জেলার বসতি স্থাপনকারী, যথাক্রমে আব্দুল আজিজ আখন্দ এবং আব্দুর মালেক নামের দুই ব্যক্তি, পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন, ১৯০০ বিষয়ক সুপ্রিম কোর্টের উক্ত রায়দ্বয়ের বিরুদ্ধে দুটি রিভিউ পিটিশন দাখিল করেন (যার সিভিল পিটিশন নম্বর যথাক্রমে 54/2018 এবং 192/2018)। তাদের পক্ষে সিনিয়র আইনজীবী ছিলের তৎকালীন বিএনপি সরকারের পূর্বেকার নিয়োগপ্রাপ্ত অ্যাটর্নি জেনারেল জনাব এ এফ হাসান আরিফ। উল্লেখিত ব্যক্তিদ্বয় এই রেগুলেশন সংক্রান্ত উপরোক্ত মামলা সমুহে পক্ষভুক্ত ছিলেন না।
নাগরিকবৃন্দ আরো উল্লেখ করেছেন, ২০০৩ সালে তৎকালীন বিএনপি সরাকারের অ্যাটর্নি জেনারেল এ এফ হাসান আরিফের আবেদনের ভিত্তিতে হাইকোর্টের একটি বিভাগীয় বেঞ্চ ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন একটি ‘‘মৃত আইন’’ হিসাবে ঘোষণা করেন (Rangamati Food Products v. Commissioner of Customs & Others, 10 BLC (2005), 525)। পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের প্রেক্ষিতে উক্ত রায় বাতিলপূর্বক পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন ১৯০০ কে একটি সম্পূর্ণ বৈধ এবং ‘মৃত আইন’ নয় এই মর্মে ঘোষণা প্রদান করেন [Government of Bangladesh v. Rangamati Food Products and Others 69 DLR(AD) (2017)].
উপরোক্ত রিভিউ মামলাদ্বয়ে পূর্বোক্ত Rangamati Food Products এবং অপর একটি মামলা, Wagachara Tea Estate Ltd. মামলাদয়ের রায় বাতিল চাওয়া হয়েছে, যাতে পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন ১৯০০ এবং অঞ্চলের সার্কেল চীফ, মৌজা হেডম্যান ও গ্রামের কার্বারী সম্ভলিত বিশেষ প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা ও প্রথাগত আইনের প্রয়োগের মাধ্যমে অঞ্চলের আদিবাসী জাতি সমূহের পরিচয়, অধিকার ও কল্যাণের সুরক্ষার ব্যবস্থা অন্তর্নিহিত রয়েছে।
বিবৃতিতে আরো বলা হয়েছে, গত ৯ মে ২০২৪ তারিখে মামলাগুলি শুনানির তালিকার শীর্ষে আসলে অ্যাটর্নি জেনারেল আদালতকে আবারও তার পূর্বের আবেদনের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট বাক্য, শব্দ ও বাক্যাংশগুলি বাতিল করার জন্য অনুরোধ করেন। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অ্যাটর্নি জেনারেলকে বিস্তারিত নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত যাতে অ্যাটর্নি জেনারেল পার্বত্য চট্টগ্রামের রেগুলেশনের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন, যার মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের আইন, প্রথা, রীতি ও পদ্ধতি স্বীকৃত রয়েছে যেগুলো আদিবাসীদের অধিকার রক্ষা করে, সেইরুপ নির্দেশ ও পরামর্শের প্রার্থনা করা হয়। আশঙ্কা করা হচ্ছে যে, ১৬ মে ২০২৪, (অর্থাৎ শুনানির পরবর্তী তারিখে) সুপ্রিম কোর্ট এমন একটি সিদ্ধান্ত দিতে পারে যা ২০১৬ ও ২০১৭ এর মামলাগুলির রায়কে মারাত্মকভাবে দূর্বল করে দিতে পারে।
বিবৃতিতে নাগরিকবৃন্দ আর্জি জানিয়ে লিখেছেন, “আমরা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, এমপি, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির মাননীয় চেয়ারম্যান আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ, এমপি এবং মাননীয় আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক, এমপি মহোদয়ের কাছে আবেদন জানাচ্ছি এই মর্মে, যাতে বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিনকে এই মর্মে নির্দেশ ও পরামর্শ প্রদান করেন, যাতে তিনি সংশ্লিষ্ট মামলাসমূহে পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন ১৯০০ এর পক্ষ অবলম্বন করেন, যার মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনমানুষের অধিকার রক্ষিত হয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম ১৯৯৭ এর শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেওয়া হয় এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম সহ সমগ্র দেশের বহুমাত্রিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করা হয়।”
বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারী নাগরিকেরা হলেন, রাজা দেবাশীষ রায়, চাকমা সার্কেল চীফ, গৌতম দেওয়ান, সভাপতি, পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটি, কংজরী চৌধুরী , সদস্য, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, উ ক্য জেন, যুগ্ম সচিব (অবঃ) ও সাবেক পরিচালক, প্রধান মন্ত্রীর কার্যালয়, বাংলাদেশ, জুয়াম লিয়ান আমলাই, সভাপতি, বন ও ভূমি অধিকার সংরক্ষণ আন্দোলন, বান্দবান চ্যাপ্টার, হ্লাথোইরি, সভাপতি, বোমাং সার্কেল হেডম্যান হেডম্যান-কারবারি কল্ক্যান পরিষদ, শান্তি বিজয় চাকমা, সাধারণ সম্পাদক, সিএইচটি হেডম্যান নেটওয়ার্ক, এডভোকেট নিকোলাস চাকমা এডভোকেট, হাই কোর্ট।