তিপ্রাসা চুক্তির ভবিষ্যৎ কি হতে পারে?- অনুরাগ চাকমা
২ মার্চ ২০২৪। তিনটি পক্ষ – ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার, ত্রিপুরার রাজ্য সরকার এবং তিপ্রা মোথা পার্টি – দিল্লিতে মিলিত হয় এবং তিপ্রাসা চুক্তি স্বাক্ষর করে। ভারতের ইউনিয়ন হোম মিনিস্টার অমিত শাহ সমগ্র ত্রিপুরার জন্য এই চুক্তিকে একটি ঐতিহাসিক অর্জন হিসিবে দাবি করেছেন। সেই খবর আবার ভারতের বিভিন্ন মূলধারার গণমাধ্যম (যেমন, The Hindustan Times, NDTV এবং Indian Express) ফলাও করে প্রচার করেছে। অনেকের প্রশ্ন থাকতে পারে, কেন এটি একটি ঐতিহাসিক ঘটনা? সাধারণত ইন্সারজেন্সি থামানো এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য এযাবৎ পর্যন্ত উত্তরপূর্ব ভারতে কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারগুলো সবসময় সশস্ত্র বিদ্রোহী গ্রুপের সাথে চুক্তিগুলো করেছে। উদাহরণস্বরূপ, মিজোরামে Mizo National Front (MNF) এর সাথে চুক্তি হয়েছে, আসামে Bodo Liberation Tigers (BLT) এর সাথে হয়েছে, নাগাল্যান্ডে Naga National Council (NNC) এর সাথে হয়েছে এবং ত্রিপুরাতে Tripura National Volunteers (TNV) এবং All Tripura Tribal Force (ATTF) সাথে হয়েছে। শুধুমাত্র এই তিপ্রাসা চুক্তিটি ভারতের কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকার এমন একটি দলের সাথে করেছে, যেটার কোন সশস্ত্র কার্যক্রম নেই এবং দল হিসিবেও মহারাজা প্রদ্যুত বিক্রম মাণিক্য দেববর্মার হাতে গড়া তিপ্রা মোথা পার্টির জন্ম কয়েক বছর আগে। এদিক থেকে নিঃসন্দেহে এই চুক্তিটিকে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা বলা যেতে পারে। এখন কথা হচ্ছে ত্রিপুরার জনগণ এই চুক্তিটিকে কিভাবে গ্রহণ করেছে?
কিছু দিন ধরে এই চুক্তির অন্যতম মূল কারিগর মহারাজা প্রদ্যুতের ভেরিফাইড ফেসবুক প্রোফাইলে চোখ রাখছিলাম। দেখুন, মহারাজা প্রদ্যুতের হাজার-হাজার ফলোয়ার চুক্তি পরবর্তী প্রথম সপ্তাহে তাদের প্রিয় নেতার প্রতিটি ফেসবুকের স্ট্যাটাসের নিচে আবেগঘন কমেন্ট করেছে। চলতি মার্চের ২ তারিখে মহারাজা প্রদ্যুত “Tomorrow” লিখে পোস্ট করেছিলেন। শুধুমাত্র এই একটি পোস্টে লাইক, লাভ এবং কেয়ার এসব ইমোজি ব্যবহার করে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ৭,০০০ ফলোয়ার (7K), কমেন্ট করেছেন ১,৬০০ ফলোয়ার (1.6K) এবং শেয়ার হয়েছে ৪৯৫ বার। তার প্রতিটি পোস্টে লাইক, লাভ এবং কেয়ার এসব ইমোজি দিয়ে তার ফলোয়াররা প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। তার একজন ফলোযার লিখেছে, “Ju! Ju! Ju! Bubgara, we have won the first battle. Yet to win the last battle and will fight till we achieve it।” আরেকজন লিখেছে, “Bubgara this is only happened because of you. You are our real hero।” আরেকজন ফলোয়ার তার প্রতি ভালবাসা এবং আবেগ প্রকাশ করেছে এভাবে, “Hat’s off Bubgara. A big salute to you for your sacrifice for Tiprasa dopha and your commitment।” সোশাল মিডিয়ায় চুক্তি সমর্থকদের বাঁধ ভাঙা আবেগের উল্লাস প্রমাণ করে মহারাজা প্রদ্যুত ত্রিপুরাতে অনেকের কাছে একটি আবেগের নাম, একটি ভালবাসার নাম। তার রাজনীতির পিছনে জনগণের একটি বিশাল অংশের সমর্থন আছে, ভালবাসা আছে এবং গভীর বিশ্বাস আছে। বলতে পারেন, তিনি রিভুলেশনারী লিডারশীপ ধারণ না করলেও তার এই জনপ্রিয়তার পিছনে হয়তোবা রাজপরিবারের ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের (Hereditary leadership) ভূমিকা আছে।
কিন্ত প্রশ্ন হল, শুধুমাত্র কি প্রদ্যুত এবং তিপ্রা মোথা পার্টি চাইলে এই চুক্তির বাস্তবায়ন হবে? কখনো “না”। যেহেতু যে কোন চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য দল-মত নির্বিশেষে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের সমর্থন গুরুত্বপূর্ণ, তাই ২রা মার্চ থেকে প্রতিদিন Tripura Times, News Vanguard, The Social Bangla, এবং CPIM Tripura অফিসিয়াল পেজে চোখ রাখছিলাম। এক কথায়, অনেকের চুক্তি বিরোধী বক্তব্য দেখে খুবই হতাশ এবং অবাক হলাম। উল্লেখ্য যে, CPIM Tripura, কংগ্রেস, গণমুক্তি পরিষদ এবং Tipraland State Party (TSP) এই চুক্তিকে কেবল বিরোধিতা করেনি তারা প্রদ্যুতকে “চিটার”, “দালাল” “গ্রেট বাটপার”, “প্রতারক” এবং “জোকার” হিসিবেও অভিহিত করেছে। রাজ্যের CPIM এর নেতা কমরেড জীতেন্দ্র চৌধুরী তো বলেই দিলেন, প্রদ্যুত সহজ-সরল জনগণের আবেগ নিয়ে ছিনিমিনি খেলা খেলছে। সামনে ভারতের লোকসভা ইলেকশন। তাই, এই চুক্তি একটি “Election Lollipop” ছাড়া কিছু নয়। ইতিমধ্যে তিপ্রা মোথা পার্টি রাজ্য সরকারে যোগদান করাতে এই বক্তব্যের সত্যটা মিলেছে। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার, যে দল রাজ্যের বিজেপি সরকারের কর্মকাণ্ডকে এতই তীব্রভাবে সমালোচনা করেছিল, সেই দল কিভাবে বিজেপি সরকারে যোগ দিল! সেটাও রাজ্যবাসীকে বিস্মিত করেছে। কিছদিন পরে ভারতের লোকসভা ইলেকশন। এই ইলেকশনে রাজ্যের সিডিউলড ট্রাইবদের জন্য সংরক্ষিত পূর্ব আসনে মহারাজা প্রদ্যুত তার বোন মহারাণী কৃতি দেবী সিং দেববর্মাকে বিজেপির প্রার্থী হিসিবে দাঁড় করিয়ে কি প্রমাণ করলেন? এক, বিজেপি-তিপ্রা মোথা পার্টির মধ্যেকার দীর্ঘদিনের গোপন আঁতাত তিপ্রাবাসীদের সামনে ফাঁস হয়ে গেল। এই যদি হয়, তাহলে প্রদ্যুতের আমরণ অনশনের নাটকটির কি প্রয়োজন ছিল? এই প্রশ্ন এখন চারিদিকে ঘুরপাক খাচ্ছে। দুই, নিজের বোনকে ক্যান্ডিডেট বানিয়ে রাজপরিবারের স্বার্থটাই প্রাধান্য দিলেন যদিও তিনি সবসময় তার বক্তৃতায় বলেন, “আই লাভ মাই তিপ্রাসা পিপল”। রাজ্যের কংগ্রেস নেতা সুদীপ রায় বর্মণ প্রদ্যুতের সমালোচনা করে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন, তিপ্রা মোথা পার্টিতে নিজের বোন ছাড়া আর কি কোন যোগ্য নেতা নেই?
গত পরশুদিন “আগেও দেশজুড়ে লাগু হল CAA – এখন চুপ কেন প্রদ্যুত/মথা?” লিখে CPIM Tripura অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিল। এই স্ট্যাটাসের নিচে একজন কমেন্ট করেছে, “আস্তে আস্তে বুবাগ্রা বাটপার উপাধি লাভ করছেন। এরাই নির্লজ্জ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব”। চুক্তি বিরোধীরা তো আছেই, তার সাথে তিপ্রা মোথা পার্টির কিছু সংক্ষুব্ধ বিধায়কদের বক্তব্য হল, এই চুক্তির কোথাও “কনস্টিটিউশনাল সল্যুশনের” কথা নেই। কোথাও “গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ড” শব্দের উল্লেখ নেই। অথচ, “গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ড” প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখিয়ে ২০১৯ সালে তিপ্রা মোথা পার্টির জন্ম হয়েছিল। তাই, এই চুক্তি একটি ধাপ্পাবাজি! ৩রা মার্চ Tripura Times লিখেছে, মাত্র এক পৃষ্ঠার তিনটি প্যারাগ্রাফ নিয়ে এই চুক্তিটিতে কোন কিছু স্পষ্টভাবে নেই। একই কথা কিন্ত এডভোকেট পুরুষোত্তম রায়বর্মণ, চিত্তরঞ্জন দেববর্মা এবং দীনেশ দেববর্মাদের। গণমুক্তি পরিষদের নেতা রাধাচরন দেববর্মার মতে, এই চুক্তিতে কোন দাবিটি মানা হল, কোন দাবিটি মানা হল না সেই বিষয়ে কোন স্পষ্টতা নেই। এমনকি, যে যৌথ ওয়ার্কিং কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে, সেটাও কখন এবং কাদের নিয়ে গঠিত হবে সেই বিষয়ে তিপ্রাবাসী পুরোটাই অন্ধকারে আছে।
মোটকথা, এই চুক্তিকে ঘিরে দুটো শিবির দেখা যাচ্ছে। একদিকে চুক্তি সমর্থকরা, অপরদিকে চুক্তি বিরোধীরা। এখন প্রশ্ন হল, রাজ্যের অনেক রাজনৈতিক দল এবং জনগণের একটি অংশ যদি চুক্তি বিরোধীতা করে সেটা কিসের ইঙ্গিত দেয়? তাহলে কি ধরে নিতে পারি তিপ্রাসা চুক্তির ভবিষ্যত প্রশ্নবিদ্ধ? অতীতেও ত্রিপুরাতে এত চুক্তি হয়েছে, তবুও চুক্তির সুফল মিলেনি কেন? কি কারণে এসব চুক্তিগুলো সফল হতে পারেনি? সেই একই পথে কি তিপ্রাসা চুক্তি হাঁটবে? নিচের আলোচনাতে তিনটি Explanatory variables (চুক্তির ডিজাইন এবং বিষয়বস্ত, এক্সক্লুসিভ প্রক্রিয়ার কারণে চুক্তি বিরোধীদের উত্থান এবং চুক্তি বাস্তবায়নে তৃতীয় পক্ষের ভূমিকা) দিয়ে এসব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তরটা দিতে চায়।
চুক্তির ডিজাইন এবং বিষয়বস্তর ভূমিকা
সাধারণত চুক্তিগুলোতে পলিটিক্যাল রিফর্ম, মানবাধিকার, নারী এবং সেক্সুয়াল ভায়োলেন্স, উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন, অ্যামনেস্টি, ট্রানজিশনাল জাস্টিস, রিকনশিলেয়েশন এবং সিকিউরিটিসহ ইত্যাদি বিষয়বস্ত প্রাধান্য দেওয়া হয়। এছাড়াও, চুক্তিগুলোতে টেরেটোরিয়াল, পলিটিক্যাল, ইকোনমিক এবং মিলিটারি পাওয়ার শেয়ারিং এর বিভিন্ন ধারা অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তার মানে একটি চুক্তিতে বিভিন্ন বিষয়বস্ত (Contents) থাকতে পারে। চুক্তির ডিজাইন এবং বিষয়বস্তর গুরুত্বটা বুঝতে পড়ে নিতে পারেন Madhav Joshi, Sung Young Lee, and Roger Mac Ginty দের “Built-in Safeguards and the Implementation of Civil War Peace Accords” গবেষণাটি। এখানে দাবি করা হয়েছে, একটি চুক্তিকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য তিনটি রক্ষাকবচ (Built-in Safeguards) – অন্তর্বর্তীকালীন ক্ষমতা ভাগাভাগি করার ব্যবস্থা (Transitional power sharing), বিরোধ নিষ্পত্তি করার ব্যবস্থা (Dispute resolution), এবং যাচাইকরণ প্রক্রিয়া (Verification mechanism) – অতীব প্রয়োজন। অন্তর্বর্তীকালীন ক্ষমতা ভাগাভাগি করার ব্যবস্থা থাকলে সরকার এবং বিদ্রোহীদের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান গড়ে উঠতে পারে। বিরোধ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা থাকলে চুক্তি বাস্তবায়নের সময় চুক্তি স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে কোন বিরোধ উদ্ভূত হলে সেটা নিরসন হতে পারে। চুক্তি বাস্তবায়ন কতটুকু হয়েছে এবং চুক্তি স্বাক্ষরকারীরা চুক্তি মানছে কিনা সেটা যাচাই করার জন্য ভেরিফিকেশনের দরকার হয়। মোটকথা, যারা চুক্তির ডিজাইন এবং বিষয়বস্ত নিয়ে গবেষণা করেন, তাদের মূল বক্তব্য হল চুক্তির সফলতা এবং ব্যর্থতা নির্ভর করে চুক্তির ডিজাইন এবং বিষয়বস্তর উপরে। অর্থাৎ, কোন একটি চুক্তিতে তিনটি Built-in Safeguards না থাকলে সেই চুক্তির বাস্তবায়নের সম্ভাবনা অনেকাংশে হ্রাস পায়। এছাড়াও, চুক্তির ডিজাইন এবং বিষয়বস্ত উপরে জনসমর্থন নির্ভর করে। আর চুক্তির পিছনে জনগণের সমর্থন না থাকলে সেই চুক্তির ভবিষ্যৎ অন্ধকার, তাই না? তাই, একাডেমিকেলি তিপ্রাসা চুক্তি বিশেষণ করলে এই চুক্তির ডিজাইন এবং বিষয়বস্ত ব্যাপারে অনেক কিছু তো অস্পষ্ট রয়ে গেছে। যেমন রাধাচরন বাবুর বক্তব্য ধরুন, এই চুক্তিতে কোন কোন রাজনৈতিক অধিকারের দাবিগুলো মানা হয়েছে এবং কোন কোন অর্থনৈতিক বিষয়গুলোর ব্যাপারে চুক্তি স্বাক্ষরকারীরা ঐক্যমতে পৌঁছেছেন সেই বিষয়ে তিন প্যারাগ্রাফের এই চুক্তিতে কোন কিছুই লেখা নেই। বিদ্যমান গবেষণার ফলাফলের আলোকে তাই প্রশ্ন থেকে যায় তিপ্রাসা চুক্তির ভবিষ্যৎ কি হতে পারে?
এক্সক্লুসিভ প্রক্রিয়া এবং চুক্তি বিরোধীদের উত্থানঃ
যে কোন চুক্তির ভবিষ্যৎ নির্ভর করে Inclusivity–exclusivity উপর। সব পক্ষকে নিয়ে যদি একটি চুক্তি সম্পাদিত হয়, সেই চুক্তির পিছনে জনসমর্থন এবং বৈধতা (Public legitimacy) থাকবে। যেসব চুক্তি Exclusive হয়, সেসব চুক্তিগুলোর বাস্তবায়ন কঠিন হতে পারে। কারণ, একটি চুক্তি যদি সকল পক্ষের মতামত না নিয়ে সম্পাদিত হয়, সকল পক্ষের ইন্টারেস্ট সংরক্ষণ করতে ব্যর্থ হয়, তখন সেরকম পরিস্থিতিতে চুক্তি বিরোধী গোষ্ঠীর (Spoilers) উত্থান হতে পারে। যেমন ১৯৮৮ সালে বাম ফ্রন্ট এসেম্বলি ইলেকশনে হেরে যায় এবং ত্রিপুরা উপজাতি যুব সমিতি-কংগ্রেস কোয়ালিশন ক্ষমতায় আসে। সরকার গঠনের তিন মাসের মধ্যে Tripura National Volunteers (TNV) অস্ত্র সমর্পণ করে এবং সরকারের সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। কিন্ত, চুক্তির অধিকাংশ ধারা অবাস্তবায়িত থেকে যায়। এছাড়াও, এই চুক্তিটিতে অনেক মৌলিক বিষয় যেমন ভূমি ইস্যুটি এড়িয়ে যাওয়া হয়। যার ফলে এই চুক্তিকে বিরোধিতা করে ১৯৮৯ সালে National Liberation Front of Tripura (NLFT) এবং ১৯৯০ সালে All Tripura Tribal Force (ATTF) আত্মপ্রকাশ করে। এই উদাহরণ প্রমাণ করে একটি চুক্তি সম্পাদন হলে সেটা যেসব গোষ্ঠী বা দলের স্বার্থে আঘাত করবে সেসব গোষ্ঠী বা দল চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে Spoilers হিসিবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। প্রয়োজনে তারা বিভিন্ন ধরনের সহিংসতামূলক কর্মকাণ্ডের (যেমন বোমা বিস্ফোরণ, অপহরণ, গুপ্তহত্যা এবং বেসামরিক ও সামরিক বাহিনীর উপর সশস্ত্র হামলা) মাধ্যমে চুক্তি বাস্তবায়নকে বাঁধাগ্রস্ত করতে পারে। তবে হ্যাঁ, চুক্তি বিরোধী গ্রুপের উত্থানের পিছনে আরও অনেক কারণ থাকতে পারে। যেমন সরকার Divide and Rule নীতির প্রয়োগ করে চুক্তির পক্ষ এবং বিপক্ষদেরকে উস্কানি এবং ইন্ধন দিয়ে নতুন করে তাদের মধ্যে সহিংসতাকে উস্কে দিতে পারে যেটা ভারতের আসামের Bodo Accord-এর ক্ষেত্রে হয়েছে। এছাড়াও, বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর ভিতরে ক্ষমতা এবং আধিপত্য লড়ায় হতে পারে, যেটা ত্রিপুরার ইন্সারজেন্সির ইতিহাসে দেখা গেছে।
তাই, তিপ্রাসা চুক্তির সফলতার কথা চিন্তা করে Inclusivity–exclusivity বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া উচিত ছিল। কারণ, ত্রিপুরাতে বর্তমানে একটি Multi-players গেম স্ট্রাকচার আছে। তারপরও সেখানে শুধুমাত্র ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার, রাজ্য সরকার, এবং তিপ্রা মোথা পার্টি ক্লোজড দোর মিটিং করে এই চুক্তিটিতে স্বাক্ষর করেছে। অথচ, রাজ্যসহ ভারতের কোন মেইনস্ট্রিম পলিটিক্যাল পার্টি এই চুক্তিতে অংশগ্রহণ করেনি। ফলশ্রুতিতে, ইতিমধ্যে CPIM Tripura, রাজ্যের কংগ্রেস এবং গণমুক্তি পরিষদ এই চুক্তির বিরোধিতা শুরু করেছে। মহারাজাকে তারা “দালাল”, “প্রতারক”, “বিশ্বাসঘাতক” এবং “জোকার” হিসিবে আখ্যায়িত করেছে। সাধারণ নিরীহ আদিবাসীদের আবেগ নিয়ে তিনি ছিনিমিনি খেলা খেলছে বলে তারা অভিযোগ করেছে। তারা আরও বলেছে, তিপ্রা মোথা পার্টি তার আগের দাবি “গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ড” এবং কনস্টিটিউশনাল সল্যুশনের দাবি থেকে সরে এসেছে। যেটা বিশ্বাসঘাতকতার শামিল! বুঝতে পারছেন, এসব দলগুলোকে চুক্তি স্বাক্ষর প্রক্রিয়ার মধ্যে নিলে আজকের দিনে এই চুক্তির বিরোধিতা হত কিনা সেই প্রশ্নটি থেকে যায়। কারণ, তারা যেহেতু এই চুক্তিতে অংশগ্রহণ এবং প্রতিনিধিত্ব করত, তাই এই চুক্তিকে তারা Own করত এবং চুক্তির পক্ষে থাকত। আরও অবাক হতে হয়, ত্রিপুরা পুলিশ ওয়েবসাইটের মতে এখনো দুটো সশস্ত্র বিদ্রোহী গ্রুপ – ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট অব ত্রিপুরা (এনএলএফটি) এবং অল ত্রিপুরা ট্রাইবাল টাইগার ফোরস (এটিটিএফ) – সক্রিয় আছে। তা স্বত্বেও কোন গেরিলা সংগঠনের প্রতিনিধি এই চুক্তিতে অংশগ্রহণ করেনি। তাদের মধ্যে থেকে যদি কোন সংগঠন বিরোধিতা করে সেটার প্রভাবও কিন্ত চুক্তি বাস্তবায়নকে ব্যাঘাত করতে পারে। এছাড়াও, সিভিল সোসাইটি এবং জেন্ডারের দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও দেখলে এই চুক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ এবং প্রতিনিধিত্ব একেবারেই উপেক্ষিত থেকে গেছে। অথচ, Desirée Nilsson তার “Anchoring the Peace: Civil Society Actors in Peace Accords and Durable Peace” গবেষণাটিতে দাবি করেছেন, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্তি শান্তির স্থায়িত্ব বাড়ায়। কারণ, শান্তি প্রক্রিয়ার জন্য একটি ঐক্যমত্য তৈরি করা প্রয়োজন এবং যেটা করতে হলে সুশীল সমাজের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি, চুক্তি স্বাক্ষরকারীদের মধ্যেও শান্তি বিনির্মাণে স্বচ্ছতা, অধিকতর দায়বদ্ধতা এবং জবাবদিহিতা তৈরি করতে সুশীল সমাজের ভূমিকা থাকতে পারে। আরও ইন্টারেস্টিং হল, ত্রিপুরাতে আরও অনেক জাতিগোষ্ঠী আছে। কিন্ত তাদেরও অংশগ্রহণ এবং প্রতিনিধিত্ব এই চুক্তিতে নেই। তাই স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন থেকে যায়, এরকম একটি Exclusive চুক্তির পিছনে কতটুকু রাজনৈতিক ঐক্যমত থাকতে পারে এবং দল-মত জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে আপামর জনগণের সমর্থন থাকতে পারে? এদিক থেকে দেখলে তিপ্রাসা চুক্তির ভবিষ্যৎ আছে কি?
চুক্তি বাস্তবায়নে তৃতীয় পক্ষের ভূমিকাঃ
কেন চুক্তি বাস্তবায়নে তৃতীয় পক্ষের ভূমিকা প্রয়োজন? চুক্তি করা এবং চুক্তি বাস্তবায়ন করা – এই দুটো বিষয় সম্পূর্ণ আলাদা। সরকার তো বিভিন্ন কারণে চুক্তি করতে পারে। যেমন, সরকার জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে তার সুনাম বাড়ানোর উদ্দেশ্যে চুক্তি করতে পারে। সরকারের নির্বাচনেরও হিসাব থাকতে পারে। এছাড়াও, সরকার বিদ্রোহ থামিয়ে দিয়ে তার প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসার অসৎ উদ্দেশ্য নিয়েও চুক্তি করতে পারে। আমাদের বুঝতে হবে চুক্তির পরে বিদ্রোহীরা অস্ত্র সমর্পণ করলে পাওয়ার অব ব্যালেন্স ভেঙে যায়। অর্থাৎ, সরকারকে চ্যালেঞ্জ করার মত ক্ষমতা আর বিদ্রোহীদের থাকে না। এই সুযোগটাকে সরকার কাজে লাগিয়ে চুক্তি পরবর্তী সময়ে জিরো-সাম গেম খেলতে পারে। অর্থাৎ, সরকার যদি নন-কোপারেটিভ গেম থেকে বের হয়ে আসতে না চায় তখন সরকার প্রতিপক্ষকে ট্র্যাপে ফেলার কৌশল হিসিবেও চুক্তি স্বাক্ষর করতে পারে। এজন্য, চুক্তির পরে সরকার এবং প্রতিপক্ষের মধ্যে সিকিউরিটি ডিলেমা কাজ করে। কেন এবং কিভাবে সিকিউরিটি ডিলেমা কাজ করে? সহজভাবে বললে, সরকারের ভিতরে কি ইনটেনশন কাজ করছে, সেটা তো চুক্তি করার সময় চুক্তির অপরপক্ষ জানার কথা না। বিদ্রোহীদের জায়গা থেকে দেখলে সরকারকে সরল মনে বিশ্বাস করার মত কোন সুযোগই তাদের হাতে নেই। কারণ, সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে গিয়ে উভয় পক্ষের অনেক ক্ষতিসাধন হয়েছে। তাই, শুধুমাত্র একটা কাগজে স্বাক্ষর করে গতদিনের চরম শত্রু সবচেয়ে আপন বন্ধু হবে সেটা ভাবার কোন অবকাশ নেই। অর্থাৎ, এমন একটি বৈরি ইতিহাস সামনে রেখে চুক্তি করে সরকার ভাল হয়ে গেছে এমনটা ভাবার জন্য বিদ্রোহীদের কোন সুযোগই নেই। অর্থাৎ, সিকিউরিটি ডিলেমার আসল কথা হচ্ছে এরকম পরিস্থিতিতে সবসময় উভয় পক্ষের ভিতরে সন্দেহ এবং অবিশ্বাস কাজ করতে পারে। যদি তাই হয়, সিকিউরিটি ডিলেমার কারণে সরকারের কাছে বিদ্রোহীরা অস্ত্র সমর্পণ করতে চায়বে না, যেটা নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড এবং কলাম্বিয়াতে দেখা গেছে। এজন্য, এই সিকিউরিটি ডিলেমার সমাধান করতে অস্ত্র সমর্পণের পরে বিদ্রোহীদের জন্য সিকিউরিটি গ্যারান্টি দরকার। চুক্তির তৃতীয় পক্ষ এক্ষেত্রে সিকিউরিটি গ্যারান্টর হিসিবে ভূমিকা রাখতে পারে। এছাড়াও, কোন পক্ষ চুক্তি মানছে, কোন পক্ষ চুক্তি লঙ্ঘন করছে, এসব মনিটরিং এবং ভেরিফাই করতে থার্ড পার্টি দরকার হয়। এই থার্ড পার্টি হতে পারে জাতিসংঘ, আঞ্চলিক জোট (যেমন ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং আসিয়ান), এমনকি প্রতিবেশী রাষ্ট্র অথবা যে কোন বৈশ্বিক এবং আঞ্চলিক শক্তি। তাই, চুক্তি বাস্তবায়নে তৃতীয় পক্ষের ভূমিকা নিয়ে বিদ্যমান গবেষণার ফলাফল বিবেচনায় নিলে নিঃসন্দেহে তিপ্রাসা চুক্তির বড় ধরনের সীমাবদ্ধতা আছে। এই চুক্তিতে তৃতীয় পক্ষের মত কোন গ্যারান্টর না থাকাতে এই চুক্তির ভবিষ্যৎ অনেকটা একচেটিয়াভাবে ভারত সরকারের সদিচ্ছার উপর নির্ভর করছে। সরকার চাইলে চুক্তি বাস্তবায়ন হবে, সরকার না চাইলে হবে না।
চুক্তি বাস্তবায়ন না হলে মহারাজা প্রদ্যুত এবং তিপ্রা মোথা পার্টি কোন পথে হাঁটবে?
উত্তরপূর্ব ভারতের বিভিন্ন চুক্তির ইতিহাস দেখলে এই তিপ্রাসা চুক্তি নিয়ে তেমন বেশি আশাবাদী হওয়ার সুযোগ নেই। অধ্যাপক কমল সিংহ এবং অধ্যাপক এম অমরজিত সিং তাদের “Politics of Peace Accords in Northeast India” বুক চ্যাপ্টারটিতে বলেছেন, একমাত্র ১৯৮৬ সালের মিজো চুক্তিটি বাদে উত্তরপূর্ব ভারতের সব চুক্তিগুলো ব্যর্থ হয়েছে। কেন ১৯৮৬ সালে সম্পাদিত মিজোরামের চুক্তিটি সফল হয়েছে? এই প্রশ্নের অনেক উত্তরের মধ্যে একটি হল আন্দোলনের লিডারশীপের ভূমিকা। চুক্তি বাস্তবায়নে লিডারশীপ কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সেটা বিবেচনায় নিলে প্রশ্ন জাগে প্রদ্যুতের মধ্যে কি সেই লিডারশীপ আছে? তিনি তো রাজ্যের অনেকের মধ্যে ইতিমধ্যে বিতর্কিত হয়েছেন। রাজ্যের অনেকগুলো রাজনৈতিক দল এই চুক্তিকে তো শুধুমাত্র স্বাগত জানায়নি, বরং এই চুক্তিকে একটি “দালালী চুক্তি” হিসিবে প্রচারণায় নেমেছে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল, অতীতের চুক্তিগুলোর মত তিপ্রাসা চুক্তি পুরোপুরি বাস্তবায়ন না হলে মহারাজা প্রদ্যুত কতটুকু রিস্ক নিতে পারবেন? নিজেকে কতটুকু উৎসর্গ করতে পারবেন? তার লিডারশীপ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তিনি আগে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের নেতা ছিলেন এবং বর্তমানে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। অর্থাৎ, প্রদ্যুত সবসময় দল বদলান এবং ক্ষমতার রাজনীতি করে এসেছেন। পুরো রাজপরিবার এই সুবিধাবাদী ক্ষমতার রাজনীতির সাথে যুক্ত। তার মা ভিবু কুমারী দেবী নিজেও কংগ্রেস সরকারের দুই বারের নির্বাচিত এমএলএ ছিলেন। তার বাবাও ছিলেন কংগ্রেস সরকারের নেতা এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। অথচ, যে কংগ্রেস সরকার ১৯৬০ এবং ১৯৭০ দশকে তিপ্রাসাবিরোধী পলিসি নিয়েছিল পুরো রাজপরিবার সেই দলের সুবিধাবাদী রাজনীতি করে এসেছে। সোজা কথায় বললে, প্রদ্যুত কিন্ত মাঠে পোড় খাওয়া লড়ায়-সংগ্রাম করে উঠে আসা এমন রিভুলেশনারী লিডারশীপকে প্রতিনিধিত্ব করেন না। কিন্ত, অধিকার পাওয়ার জন্য দরকার হয় এরকম রিভুলেশনারী লিডারশীপ। এটাও বলে রাখা দরকার, জনগণের মুক্তিকামী আন্দোলনে সাধারণত সামন্ত শ্রেণীর সম্পৃক্ত থাকে না। বরং, তারা সবসময় শাসক শ্রেণীর হয়ে জনগণের লড়ায়কে ক্ষতিগ্রস্ত করেন। তবে মহারাজা প্রদ্যুত যদি এই ট্র্যাডিশনটা ভেঙে সত্যিকার অর্থে “রিভুলেশনারী লিডার” হয়ে উঠতে পারেন সেটাই হবে ত্রিপুরার ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায়।
লেখকঃ ড. অনুরাগ চাকমা,
রিসার্চ ফেলো, অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি এবং
সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।