পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিঃ কারোর আনন্দ শোভাযাত্রা, কারোর গ্লানিভরা বেদনা আর ক্ষোভ- অং শোয়ে সিং মারমা
১.
২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে দুই দশক ধরে চলা সশস্ত্র সংঘাত নিরসনে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সাথে পাহাড়ের মানুষের পক্ষে চুক্তি স্বাক্ষর করে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি। এ চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছিল, নিজেদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠায় শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পাহাড়ের আপামর জনগণ যে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে সংগ্রাম করেছিল তা ছিল ন্যায়সংগত এবং যুক্তিযুক্ত। চুক্তির মাধ্যমে এটিও প্রমাণিত হয়েছিল, এ আন্দোলন কোন বিচ্ছিন্নতাবাদের নয় বরং দেশের অপরাপর জনগোষ্ঠীর সাথে পাহাড়ের মানুষকে অন্তর্ভুক্তিকরণের আন্দোলন।
২.
প্রতি বছর এই দিনে দেশের বিভিন্ন জায়গায় স্বাক্ষরকারী দুপক্ষ ভিন্ন ভিন্ন ভাবে এ দিনটি উৎযাপন করে থাকে। চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী আওয়ামীলীগ ও তার অঙ্গসংগঠন সমূহ এ দিনটিকে অতি আনন্দের সাথে উদযাপন করে। দেশে-বিদেশে বিভিন্ন জায়গায় প্রচার করে চুক্তির অধিকাংশ ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে।
বিপরীতে চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী আরেক পক্ষ জনসংহতি সমিতি এবং চুক্তি সমর্থনকারী দলগুলো বিশেষ এ দিনটিকে পালন করে ২৬ বছর ধরে চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ার ক্ষোভ আর হতাশা নিয়ে। প্রতিবছরের ন্যায় এবারও জনসংহতি সমিতি চুক্তি বাস্তবায়নের অগ্রগতি বিষয়ে কোন ধারাটি বাস্তবায়িত হয়েছে, কোনটি আংশিক, কোনটি অবাস্তবায়িত সেগুলোর সুস্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধ একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেছে। জনসংহতি সমিতি কর্তৃক প্রকাশিত বইয়ে সুস্পষ্ট ভাবে বলা হয়েছে ৭২ টি ধারার মধ্যে ২৫ টি ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে, ২৯ টি ধারা সম্পূর্ণ অবাস্তবায়িত এবং বাকিগুলো আংশিক বাস্তবায়িত। এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- ৭২ টি ধারার মধ্যে যে ধারাগুলো মৌলিক (যেমন অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার, পার্বত্য ভূমি কমিশনের মাধ্যমে ভূমি সমস্যার সমাধান, অভ্যন্তরীণ ও ভারত প্রত্যাগত শরণার্থীদের পুনর্বাসন, পাহাড়ের স্থায়ী বাসিন্দা চিহ্নিত করে ভোটার তালিকা প্রণয়ন করে আঞ্চলিক পরিষদ, জেলা পরিষদ নির্বাচনের ব্যবস্থা এবং চুক্তি মোতাবেক প্রতিষ্ঠান গুলোর ক্ষমতায়ন, স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে পার্বত্য পুলিশ বাহিনী গঠন) সেগুলোর কোনটিই বাস্তবায়িত হয়নি। বরং পাহাড়ে যে পদক্ষেপগুলো নেয়া হচ্ছে সেগুলো চুক্তিবিরোধী এবং পাহাড়িদের স্বার্থ পরিপন্থী। ফলে জনসংহতি সমিতি তার বিভিন্ন সভা, সমাবেশ ও মিছিলে চুক্তি বাস্তবায়নের দাবি জানিয়ে আসছে। তাহলে সরকারি আনন্দ মিছিলের বিপরীতে পাহাড়ের মানুষের চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলন কি অমূলক?
পাহাড়ের মানুষ নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে এবং নিজেদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তারুণ্যকে বিসর্জন দিয়ে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে তুলে নেয়া যে গেরিলারা শাসকগোষ্ঠীকে বিশ্বাস করে অস্ত্র সমর্পণ করতে পারে তাঁরা কোনদিন মিথ্যা বলতে পারেনা এটা সন্দেহাতীত। যে বিশ্বাস করে অপরের কাছে ঠকে সে বোকা নয়, সে বিশ্বাসী। আর বিশ্বাস ভঙ্গ করে অপরকে যে ঠকায়, শঠতা দ্বারা প্রতারিত করে সে বিশ্বাসঘাতক। চুক্তি বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২৬ বছর ধরে যারা চুক্তি যথাযথ বাস্তবায়ন করেনি, কথা রাখেনি তারা অন্তত বন্ধু নয় বরং বিশ্বাসঘাতক। চুক্তি বাস্তবায়ন না করে এদেশের শাসকগোষ্ঠী যে ভূমিকা পালন করেছে তা পাহাড়ের মানুষের সাথে বিশ্বাসঘাতকার শামিল।
আজ পাহাড়ে পরোক্ষ সামরিক শাসন অব্যাহত চলছে, যাঁরা চুক্তিকে সমর্থন দেয় তাঁদের মিথ্যা মামলা-মোকদ্দমা দিয়ে ঘরছাড়া করা হয়েছে। চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ায় পাহাড়ে আজ নিত্য নতুন সমস্যার জন্ম নিচ্ছে। অথচ চুক্তিকে পাশ কাটিয়ে পাহাড়ের সমস্যাকে বিভিন্নভাবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। এমতাবস্থায় পাহাড়ের নিপীড়িত মানুষের প্রাণের দাবি পার্বত্য চুক্তির যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন। এমনকি চুক্তিকে “কালো চুক্তি”, “আপোষ চুক্তি” আখ্যা দিয়ে যারা চুক্তির বিরোধীতা করেছিল তারাও আজ নতুনভাবে মূল্যায়ন করছে, চুক্তিকে সমর্থন করছে, বাস্তবায়নের দাবি করছে।
৩.
চুক্তি দিবস পালনে তরুণদের অংশগ্রহণে দেখা যায় আরেক বৈচিত্র্যতা। চুক্তিকে অনুধাবন করে একপক্ষের মাঝে দেখা যায় হতাশা, ক্ষোভে চুক্তি বাস্তবায়নের তীব্র আকাঙ্খা। আরেক পক্ষকে দেখা যায় শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক আয়োজিত চুক্তি দিবসে আনন্দ মিছিল করতে। পার্বত্য চুক্তি কি? কি আছে চুক্তিতে, চুক্তির একটি পৃষ্ঠাও যে একবারও উল্টায়নি, বাস্তবায়িত হয়েছে নাকি হয়নি কোনরূপ ধারণা না রেখে তারা অংশ নেয় আনন্দ মিছিলে। চুক্তি স্বাক্ষরের ২৬ বছরেও যে পাহাড়ে মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়নি, ভূমি হারানোর বেদনায় জর্জরিত-শঙ্কিত, দেশান্তরিত হবার ভয় চোখে-মুখে, বাপ-দাদার ভূমিকে বাঁচাতে পাহাড়ী ভাইয়ের রক্তে সিক্ত যে মাটি এখনও শুকায়নি তাঁদের দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণাকে উপেক্ষা করে আমরা কোন বিবেকে আনন্দ মিছিল করবো? আমরা অত্যন্ত লজ্জিত হই, পাহাড়ের মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠায় যে পাহাড়িরা জীবন দিয়েছেন, পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন তাঁদের ত্যাগকে পূজি করে অর্জিত হওয়া ঐতিহাসিক পার্বত্য চুক্তির সুবিধা ভোগ করে যে পাহাড়ী তরুণরা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নের সুযোগ পাচ্ছে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী হিসেবে, সে সার্টিফিকেটধারী নব্য শিক্ষিতরা আজ তাঁদের শেকড়ের মানুষের শোষণ-বঞ্চনাকে উপেক্ষা করে দলে দলে যোগ দিচ্ছে আনন্দ মিছিলে, আনন্দ শোভযাত্রায়, আনন্দ উল্লাসে ফেটে পড়ছে।
একজন মানুষ শিক্ষিত হলে সে তাঁর দোষ-গুণ বুঝতে পারে। ন্যায়-অন্যায় অনুধাবন করতে পারে। সমাজ ও জাতির প্রতি দায়বদ্ধতা অনুধাবন করতে পারে। পাহাড়ের বর্তমান বাস্তবতায় যে শিক্ষিত তরুণরা ২ ডিসেম্বরে আনন্দ শুভযাত্রায় উল্লাসে ফেটে পড়তে পারে তারা কি আদৌ শিক্ষিত? প্রান্তিক গোষ্ঠীর পরিচয়ে সুবিধাপ্রাপ্ত শিক্ষিত পাহাড়ী তরুণরা কোন বুদ্ধি বিবেচনায় সার্টিফিকেট অর্জিত হবার নিজের শেকড়কে, শেকড়ের মানুষকে ভুলে যেতে পারে, নিজেদের মানুষের স্বার্থের বিপরীতে কাজ করতে পারে আমরা বুঝতে পারিনা। নিজেদের অস্তিত্ব টিকেয়ে রাখা এবং আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠায় চুক্তি যাঁরা করেছে, চুক্তি করতে যাঁরা ভূমিকা রেখেছে তাঁরা আজ ঘর ছাড়া, বরং চুক্তি স্বাক্ষরে যে ব্যক্তিদের বিন্দুমাত্র অবদান নেই, তারা বসে আছেন চুক্তির বদৌলতে অর্জিত হওয়া সেইসব চেয়ারে। শুধু চেয়ারে বসেই তারা ক্ষান্ত নয়, চুক্তি বিপরীত কার্যক্রমেও তারা সদা তৎপর। আমরা তরুণরা সেসব মানুষদের ভুলে গেছি, যাঁরা আমাদের প্রজন্মের জন্য আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। বরং পূজা করছি চুক্তি বিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল নেতাদের যারা বছরের পর বছর সংসদে বসেও চুক্তির কোন ধারা বাস্তবায়িত হয়নি, পাহাড়ের প্রকৃত সমস্যাকে জনসাধারণের কাছে তুলে ধরার ন্যূনতম সৎসাহস রাখেনা।আমাদের মনে রাখতে হবে- দুর্জন বিদ্বান হলেও পরিতাজ্য। আমাদের মাঝেও দলে দলে যেমন বিদ্বান তরুণের সৃষ্টি হচ্ছে সমান্তরালে বাড়ছে পরিতাজ্য বিদ্বান দুর্জনের সংখ্যাও। এটি তিক্ত সত্য যে আমরা এক কৃতঘ্ন তরুণ প্রজন্ম। এটি আমাদের তরুণ প্রজন্মের জন্য চরম লজ্জ্বার।
৪.
বন্যেরা বনে সুন্দর। একজন মারমা নারী থুবুইংএ সুন্দর, একজন চাকমা নারী পিনোনে। আদিবাসী নারী-পুরুষরা তাঁদের নিজস্ব পোশাক পরিধান করে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে যাওয়া, বমদের বাঁশ নৃত্য বা প্লুং বাজিয়ে ইয়াংবং হুংয়ের ম্রোদের উৎসব উৎযাপনের মাঝে যে স্নিগ্ধতা ও মনোরম দৃশ্য ফুটে ওঠে তা ভাষায় বর্ণনাতীত। আদিবাসী নারী-পুরুষ পাহাড়ে বসে উন্মুক্ত আকাশে তাকিয়ে নিঃশ্বাস ফেলতে চায়। আদিবাসী নারীরা বাধাহীনভাবে মুক্ত-স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াতে চায় পাহাড়ের পর পাহাড়ে। প্রশাসনিক জটিলতা ছাড়া বিনা সংশয়ে তঞ্চঙ্গ্যারা রাতভর ঘিলা খেলা খেলতে চায়। কিন্তু শান্তি, সম্প্রীতি আর উন্নয়নের নামে শাসকগোষ্ঠী যে সামরিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন জারি রেখেছে তার প্রতিরোধ রচনা করতে করতে আমরা এইসব সুন্দরে অবগাহন করতে ভুলে যাচ্ছি। এটা সত্যি যে, প্রতিরোধ রচনা করে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের কোন বিকল্প নেই। নতুবা এসব আগ্রাসনের থাবায় আমরা হারিয়ে যাবো, হারিয়ে যাবে আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ইতিহাস। কিন্তু একজন দায়িত্বশীল শিক্ষিত তরুণ হিসেবে আমরা এসব হারাতে দিতে পারিনা। আমাদের সমাজ ও জাতির প্রতি যে অপরিহার্য দায়িত্ব সেটি এড়িয়ে যেতে পারিনা।
পরিশেষে বলি- পাহাড়ের সমস্যা রাজনৈতিক এবং রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য পার্বত্য চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন অতীব জরুরী। আপনি রাজনীতি করেন বা নাই করেন। একজন শিক্ষিত পাহাড়ী তরুণ হিসেবে পাহাড়ের বহুমাত্রিক সমস্যাপূর্ণ বাস্তবতা বোঝা খুবই জরুরি। । যে পার্বত্য চুক্তিকে নিয়ে এত আলোচনা, সমালোচনা সেই পার্বত্য চুক্তি আসলে কি, চুক্তি স্বাক্ষরের নেপথ্যের ইতিহাস কি, কি আছে এ পার্বত্য চুক্তিতে যার কারণে শাসকগোষ্ঠী চুক্তিকে ভুলিয়ে দিতে চায়। পাহাড়ের মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠায় চুক্তির বাস্তবায়ন কেন জরুরি এসকল বিষয় জানা আমাদের একান্ত দায়িত্ব ও কর্তব্য। এসব বিষয় জানার পর চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনে শামিল হবেন নাকি আনন্দ মিছিল করবেন সিদ্ধান্ত আপনার। আর যদি এসব এড়িয়ে শাসকগোষ্ঠীর লেখা নাটকের স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী মুখ নাড়িয়ে জীবন কাটিয়ে দেন, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের বুনোফুলদের ভয়ংকর ভবিষ্যতের জন্য আপনি দায়ী এবং এর কৈফিয়ত আপনাকে একদিন দিতেই হবে।
লেখক-
অং শোয়ে সিং মারমা,
সাবেক শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)
ও আদিবাসী অধিকার কর্মী।