‘আদিবাসী’ স্বীকৃতির জন্য এক হয়ে লড়ার আহ্বান
বাংলাদেশে বিভিন্ন আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ে লড়াই চালানোর আহ্বান এসেছে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসের কর্মসূচি থেকে।
দাবি পূরণে আলোচনা ও স্লোগান এবং পাহাড় ও সমতলের বিভিন্ন অাদিবাসী বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস পালিত হয়।
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে কেন্দ্রীয় কর্মসূচিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা রাজা দেবাশীষ রায় নিজেদের আদিবাসী স্বীকৃতি এখনও না পাওয়ার খেদ প্রকাশ করেন।
“সরকার কবে স্বীকৃতি দেবে, তার আশায় বসে থাকলে চলবে না। অধিকার রক্ষায় আদিবাসীদের একতাবদ্ধ হতে হবে, লড়াই করতে হবে।”
“সাংবিধানিক উপায়ে, আইনি পন্থায় সে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে,” লড়াইয়ের পথও বাতলে দেন চাকমা রাজা।
পাহাড় ও সমতলে বসবাসরত বিভিন্ন জাতিসত্তার অধিকারহরণ, নির্যাতন ও লাঞ্ছনার দায়ে অভিযুক্তদের আগামীতে ভোট না দিতে অনুরোধ জানান বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত।
সমাবেশে আসা চাকমা, ওঁরাও, ম্রো, কাচালং, ত্রিপুরা, গারো, লামা ও হাজং জনগোষ্ঠীর সংগঠনগুলোর সদস্যরা সমস্বরে তাকে সমর্থন জানান।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের এই অনুষ্ঠানের উদ্বোধক লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, “আমি বৈচিত্র্যে সৌন্দর্য খুঁজে বেড়াই। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের দেশের! বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবন যাদের, সেই আদিবাসীদের সংখ্যা দিন দিন কমে আসছে।
“আদিবাসীরা তাদের ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি সঠিকভাবে পালন ও পরিচর্যা করতে পারছে না। আমরা সংখ্যাগুরুরা দায়িত্ব পালন করতে পারছি না।”
জাফর ইকবাল ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংবিধানিক স্বীকৃতির পাশাপাশি আদিবাসী অধিকার বিষয়ে জাতিসংঘের নির্দেশনাগুলোর বাস্তবায়ন করতে সরকারের প্রতি অনুরোধ জানান।
২০০৭ সালের ৯ অগাস্ট জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে আদিবাসী অধিকারের ঘোষণাপত্র গৃহীত হয়।
তারপর থেকে বিশ্বজুড়ে দিনটি আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস হিসেবে পালিত হয়।
বাংলাদেশে দিনটি রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে লেখক ও কলামনিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, “জাতিসংঘের ঘোষণার পরও বাংলাদেশে দিবসটি রাষ্ট্রীয়ভাবে উদযাপিত না হওয়া ভীষণ লজ্জার।”
আদিবাসী বিষয়ক ঘোষণাপত্রে আদিবাসীদের মৌলিক অধিকার, আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার, ভূমি, অঞ্চল বা টেরিটরি ও প্রাকৃতিক সম্পদের উপর পূর্ণ অধিকার, ভূমির উপর ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ, আদিবাসীদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক উন্নয়ন, শিক্ষাসহ নিজস্ব ভাষা ও জীবনধারা সংরক্ষণের স্বীকৃতি দেয় জাতিসংঘ।
কর্মসূচির প্রধান অতিথি সরকারের মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন তাদের আদিবাসী স্বীকৃতি পাওয়ার দাবির প্রতি সমর্থন জানান।
তিনি বলেন, “আদিবাসীদের অধিকারের বিষয়টি সংবিধানে বিক্ষিপ্তভাবে উপস্থাপন হয়েছে। সেই সঙ্গে পার্বত্য শান্তি চুক্তি পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন এখনও হয়নি।”
পাহাড়ের মতো সমতলের নৃ-গোষ্ঠীর জন্যও আলাদা একটি ভূমি কমিশন গঠনের পক্ষে মত দেন তিনি।
ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি মেননের সঙ্গে সহমত পোষণ করেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম।
“আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উপর যে অন্যায়, অত্যাচার, নিপীড়নের মনোভাব, তা পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর মতো। এক জাতি আরেক জাতির অধিকার খর্ব করে মূলত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছে।”
পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশনের দাবির পাশাপাশি নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের সুযোগ সৃষ্টির দাবিও উঠে আসে সমাবেশ থেকে।
সে দাবির প্রতি একাত্মতা জানিয়ে ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, “প্রাথমিক স্তরে মাতৃভাষায় পাঠদানের প্রক্রিয়াটি নানা ষড়যন্ত্র আর প্রতিবন্ধকতায় থমকে গেছে।”
বাংলাদেশে বসবাসরত বিভিন্ন জাতিসত্তার মানুষদের বাদ দিয়ে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন বা এসডিজি গোল অর্জন করা ‘যাবে না’ বলে মত প্রকাশ করেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান।
পার্বত্য এলাকার আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনে অংশগ্রহণের নিষেধাজ্ঞা ‘অগণতান্ত্রিক কালাকানুন’ হিসেবে অভিহিত করে ক্ষোভ প্রকাশ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মেজবাহ কামাল।
আদিবাসী ফোরামের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমার ( সন্তু লারমা) সভাপতিত্বে এই সমাবেশে নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ, জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন, আদিবাসী নারীনেত্রী সারা মারান্ডি উপস্থিত ছিলেন।
সকাল ১০টায় শুরু হওয়া এই সমাবেশে রাজধানীতে বসবাসরত বিভিন্ন জাতিসত্তার প্রতিনিধিরা তাদের দাবি-দাওয়া সম্বলিত ব্যানার ও প্ল্যাকার্ড নিয়ে সমাবেশে অংশ নেন।
বেলা ২টায় মূল অনুষ্ঠান শেষে একটি শোভাযাত্রা বের হয়। শহীদ মিনার থেকে দোয়েল চত্বর, বাংলা একাডেমি, টিএসসি ঘুরে আবার শহীদ মিনারে ফিরে শেষ হয় শোভাযাত্রাটি।