আরো অনেক স্বপ্ন দেখা বাকি, আরো অনেক দূর যাওয়া বাকি : উক্রাচিং চৌধুরী
খাগড়াছড়ির প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত কালাডেবা গ্রাম। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা ছোট্ট ছিমছাম চেঙ্গী নদী। আর দশটা সাধারণ মেয়ের মতো চেঙ্গী নদীর বালুচরে বালির ঘর বানাতে বানাতে আমার বেড়ে উঠা। আমার জীবনে সবথেকে বড় সৌভাগ্য খাগড়াছড়ি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাওয়া। জীবনের পাঁচটা সোনালি বছর আমি ঐ প্রতিষ্ঠানে পার করেছি যা অবিস্মরণীয়। আঠারোটি বসন্ত পার করেছি ঘরকুনো ব্যাঙের মতো, যার দৌড় স্কুল-টিউশন আর ঘরের উঠোন পর্যন্তই সীমাবদ্ধ।
২০১৫ সাল। ছলছল ধ্বনিতে বয়ে যাওয়া চেঙ্গী নদী আর আলুটিলা পাহাড়ের বুকে অস্ত যাওয়া সুয্যিমামাকে ছেড়ে আকস্মিকভাবে ঢাকায় চলে গেলাম পড়াশোনা করবো বলে। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা অন্তর্ভুক্ত কলেজ, সাথে অপছন্দের বিষয় সব মিলিয়ে মানসিকভাবে খুবই ভেঙে পড়েছিলাম। সেই সময়ে একটা আবৃত্তি সংগঠনে যুক্ত হয়েছিলাম। সেখানের একজন মেন্টর আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন দীপনপুরের সাথে। দীপনপুর মিলেমিশে একাকার করে ফেললো আমার সমগ্র সত্ত্বাকে, আমি খুঁজে পেলাম নতুন এক আমিকে। যে আমিতে বসবাস একজন স্বপ্নাতুর আমি।
২০১৭ সাল। স্বপ্ন দেখা শুরু উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের বাইরে পাড়ি জমানোর। শুরু করলাম ফেইসবুকে উচ্চশিক্ষা বিষয়ক নানা গ্রুপ খোঁজাখুঁজি এবং মাকে রাজি করানো। বাড়ির একমাত্র মেয়ে, আজ রাজি হয় তো পরেরদিন অমত করে দেয়। একসময় বিরক্ত হয়ে কিছুই আর জানাতাম না। রাত জেগে চীনের বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটগুলো ঘাঁটতাম। সময়ের আবর্তে করোনা মহামারি হানা দিলো, স্নাতকের চূড়ান্ত পরীক্ষার আগে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলো। পরীক্ষার রুটিন কয়েকবার পেছাতে থাকে, পরীক্ষা দেওয়া আর হয়ে উঠে না। দীর্ঘ আঠারোটি মাস অপেক্ষার পর সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, স্নাতক পরীক্ষায় বসলাম। কী আশ্চর্য! ক্লাসের সবচেয়ে ফাঁকিবাজ ব্যাকবেঞ্চার মেয়েটাও স্নাতক পাশ করে ফেললো। এরপর শুরু হলো কাগজপত্র গুছানো। মার্কশীট তোলা, প্রফেসরের কাছ থেকে সুপারিশপত্রের জন্য দৌড়াদৌড়ি। এখনও মনে আছে একটা সুপারিশপত্রের জন্য আমি দুই দুইটা মাস কেমন করে প্রফেসরের পিছনে লেগে ছিলাম।
আমাদের দেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্টার্নি স্নাতকে থাকাকালীনই শেষ করতে হয়। কিন্তু গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ যার বর্তমান নাম গর্ভনমেন্ট কলেজ অব এ্যাপ্লাইড হিউম্যান সাইন্সে খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান বিষয় ব্যতীত অন্য বিষয়গুলোকে যারা অধ্যয়ন করেন তাদের স্নাতকোত্তরে ইন্টার্নি করতে হতো। বিনা পারিশ্রমিকে একটা ব্যাংকে সকাল দশটা থেকে বিকাল চারটা পর্যন্ত তিন মাসের জন্য ইন্টার্নি হিসেবে যোগ দিলাম। একদিন ফেইসবুকে পৃথিবীতে ঘটে চলা কর্মকাণ্ডগুলোতে নজর দিতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম ভারতে বৃত্তির আবেদন চলছে এবং যার আবেদনের সময়সীমা আর মাত্র দশদিন। এইদিকে ব্যাংকের কাজ, স্নাতকোত্তরের ক্লাস, নিজের রান্নাবান্না সবকিছু মিলিয়ে এতোটাই ক্লান্ত হয়ে যেতাম যে বৃত্তির আবেদনের জন্য একটা রচনা লেখার সময় বের করতে পারিনি ঐ দশটা দিনে। ভাগ্যক্রমে আবেদনের সময়সীমা বাড়ানো হলো আরো একটা মাস। মনের মাধুরি মিশিয়ে রচনা লিখে আবেদন সম্পন্ন করলাম। অতঃপর প্রতীক্ষা। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাইভা, হাই কমিশনে পরীক্ষা -ভাইভাতে উত্তীর্ণ হয়ে ভারত সরকারের স্বনামধন্য বৃত্তি আইসিসিআর’এর জন্য নির্বাচিত হয়ে গেলাম।
২০২২ সালের ৩০ অগাস্ট। তল্পিতল্পা গুটিয়ে চলে এলাম পৃথিবীর বুকে গড়ে উঠা সর্বপ্রথম আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় নালন্দা’য়। জীবন মুহূর্তেই বদলে গেলো।দশ একরের ছোট্ট হোম ইকোনমিক্স থেকে প্রায় পাঁচশত একরের বিশাল নালন্দা। চেঙ্গী নদীর কোলে বেড়ে উঠা সাধারণ মেয়েটা অবাক হয়ে দু’চোখ ভরে অবলোকন করলো নালন্দার সৌন্দর্য। নতুন পরিবেশ, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের শিক্ষার্থী, ভিন্ন শিক্ষাব্যবস্থা, রাজগীরের পাথুরে পাহাড় সবকিছু যেন উজাড় করে ঢেলে দেয় নতুন কিছু শেখার।
ঝা চকচকে হোস্টেল-স্কুল বিল্ডিং, বিশাল নালন্দার লোগো বসানো সাদা আর নীলের মিশেলে স্কুল বাস, সন্ধ্যে নামলেই হরেক রঙের আলোর খেলা, রাস্তার দুপাশে নানা রঙের ফুলের সমাহার আরো কতো বৈচিত্র্যতা!
পড়াশোনার জন্য এক অনন্য সাধারণ এই প্রতিষ্ঠান। একজন প্রফেসরের সুপারভিশনে মাত্র তিন কি চারজন ছাত্রছাত্রী। প্রত্যেক প্রফেসর খুবই সুশৃঙ্খল (অর্গানাইজড)। প্রত্যেক দিনের পাঠক্রম সু্ন্দরভাবে সাজানো থাকে। নিয়মিত ক্লাস, ল্যাব, লাইব্রেরী একজন শিক্ষার্থীকে গড়ে তোলার জন্য সর্বদা প্রস্তুত। অতি আদরে মানুষ নাকি বাদর হয়ে যায়। নালন্দায় শিক্ষক, কর্মকতা, কর্মচারী সবাই ছাত্রছাত্রীদের প্রতি এতো সহানুভূতিশীল তা স্বচক্ষে অবলোকন না করে কয়েকটা শব্দে তা বর্ণনা করলে গেলে আমার শব্দের ভাণ্ডারে ঘাটতি পরে যাবে, শিক্ষার্থীবান্ধব পরিবেশ বুঝি একেই বলে।
নালন্দা আমাকে এতোকিছু দিচ্ছে এবং দেবে তা আমি এখানে পড়ার সুযোগ না পেলে কখনোই কল্পনা করতে পারতাম না। শীতের ছুটিতে হিমালয় কন্যা সিকিম যাবার সৌভাগ্য হয়েছিলো। মাইনাস দুই ডিগ্রি সেলসিয়াসে তুষারকণাগুলো সাদা তুলার মতো উড়ে যেতে দেখেছি। শৈলশহরের সবুজ এবং সাদা চা খ্যাত দার্জিলিং দেখেছি। লোকে বলে ‘সারা ভারতবর্ষ দেখলে নাকি পৃথিবীর অর্ধেক দেখা হয়ে যায়’। কথাটা কতোটুকু সত্য জানি না তবে এই গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে হিমাচলের ধর্মশালায় এক মাস থাকার সৌভাগ্য হয়েছিলো। সত্যি বলতে আমার এক প্রফেসর একপ্রকার জোড়-জবরদস্তি করে পাঠিয়েছেন। আমাদের ন’ক্রেডিটের একটা ডিজার্টেশন করতে হয় ফোর্থ সেমিস্টারে এসে, সেকারণে নিজেকে উপযুক্ত করে তোলার জন্য একপ্রকার ধরে-বেধে পাঠিয়েছিলেন। বাংলাদেশে যখন একফোঁটা বৃষ্টির জন্য হাহাকার তখন দালাই লামার আবাসস্থল হিসাবে সুপরিচিত ধর্মশালার সবচাইতে উঁচু পাহাড় ম্যাকলয়েডগঞ্জে প্রতিদিন আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামে। প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ যে কতোটা ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে তা খুব সুক্ষ্মভাবে অনুধাবন করেছি এই সময়ে। ব্রিটিশ আমলে ভারতের রাজধানী ‘দ্য সিটি অব জয় খ্যাত’ কলকাতা শহর দেখেছি। দেখেছি ব্যস্ত রাজধানী শহর দিল্লি।
স্বপ্ন না থাকলে নাকি কথাও থাকে না। প্রত্যেক মানুষেরই স্বপ্ন থাকা উচিত, নতুবা মানুষ বাঁচবে কেমন করে? আরো অনেক স্বপ্ন দেখা বাকি, আরো অনেক দূর যাওয়া বাকি।
উক্রাচিং চৌধুরী, আইসিসিআর স্কলার এবং শিক্ষার্থী, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়, ভারত