জাতীয়

জনসংহতি সমিতি সবসময় পাহাড়ের সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানে সচেষ্ট: রাশেদ খান মেনন

আইপিনিউজ ডেক্স(ঢাকা): আজ ১৫ ফেব্রুয়ারি। দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের পথ ধরে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি সমিতি পালন করেছে প্রতিষ্ঠার সুবর্ণজয়ন্তী। এ উপলক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির উদ্যোগে আজ ঢাকার বিশ^ সাহিত্য কেন্দ্রে বিকাল ৩:০০ ঘটিকায় সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।

সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন ও আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় সদস্য ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য সাধুরাম ত্রিপুরা। এছাড়াও আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন, লেখক ও সাংবাদিক আবু সাইদ খান, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, ঐক্য ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক আসাদুল্লাহ তারেক, বাংলাদেশ জাসদের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধান, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সহ-সাধারণ সম্পাদক ডা. গজেন্দ্রনাথ মাহাত্।ো এছাড়া স্বাগত বক্তব্য রাখেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির তথ্য ও প্রচার বিভাগের সদস্য দীপায়ন খীসা। সংহতি বক্তব্য রাখেন পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, ঢাকা মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক জগদীশ চাকমা প্রমুখ।

প্রারম্ভিক বক্তব্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি, তথ্য ও প্রচার বিভাগের সদস্য দীপায়ন খীসা বলেন, জনসংহতি সমিতির আন্দোলনকে বুঝতে হলে, পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামের সমাজব্যবস্থাকে বুঝতে হবে। আজকের এই দিনটি জুম্ম জণগনের জন্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ একটি দিন। জনসংহতি সমিতি পাহাড়ের সর্বসাধারণের দল। আমরা দৃঢ় কণ্ঠে বলতে চাই, জুম্ম জনগনের অধিকার রক্ষার লড়াই থেকে জনসংহতি সমিতিকে শূন্য করা যাবে না। আমরা বহাল তবিয়তে থাকব। জনসংহতি সমিতি তার এই লড়াই চলমান রাখবে। সামনে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার জন্য আমরা প্রস্তুত আছি।

রাশেদ খান মেনন বলেন, যারা এই দলটি গঠন করেছিল তারা আজ বয়সের ভারে নুহ্য। রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষেই পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সৃষ্টি। কাপ্তাই বাঁধের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েই পাহাড়ের তৎকালীন তরুণরা সংগঠিত হয়েছিল। তারই ধারাবাহিকতায় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি গঠন করে তারা। এই দলটি স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত করেছে যে, বাংলাদেশে বাঙালি ভিন্ন আপরাপর আদিবাসীদেও স্বীকৃতি চেয়েছেন। এবং সেটা অনিয়মতান্ত্রিক ভাবে নয়। তারা সংবিধানের আওতার মধ্য দিয়েই এই স্কীকৃতি চেয়েছেন।

আলোচনা সভায় উপস্থিত শ্রোতাবৃন্দ। ছবি: আইপিনিউজ। 

জিয়া যখন পাহাড়ের সমস্যাকে সামরিক সমাধানের দিকে নিয়ে যাচ্ছিলেন তখনই জনসংহতি সমিতি সশস্ত্র আন্দোলনে গেল দাবি করে তিনি আরো বলেন, বঙ্গবন্ধু পাহাড়ের সমস্যাকে সামরিক সমাধান চেয়েছেন এটা আমি মনে করি না। জিয়াউর রহমান পাহাড়ে কেবল ক্যান্টনমেন্ট বাড়াননি। বাঙালি অভিবাসীদেরকে পাহাড়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে সামরিক প্রশাসনের আওতার মধ্যে রেখেই বসবাস করিয়েছিলেন।

তিনি আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি সরবসময় রাজনৈতিক সমাধানে সচেষ্ট ছিল। এমনকি জেনারেল এরশাদের সময়ও তারা আলোচনা অব্যাহত রেখেছিল। কাজেই এখানেও তারা রাজনৈতিক সমাধানের চেষ্টা চালিয়েছিল। সুতরাং পাহাড়ে সমস্যার পেছনে জনসংহতি সমিতির দিকে যে আঙ্গুল তোলা হয় তা সঠিক নয়। এটাও জনসংহতি সমিতির প্রতি একটা অন্যায়।

জনসংহতি সমিতির লড়াই একার নয়, আমাদের সবার লড়াই দাবি করে সাম্প্রতিক সময়ের কুকি-চিন প্রসঙ্গে রাশেদ খান মেনন আরো বলেন,
সামরিক প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের নাকের ঢগায় বসে (কুকি-চিন) কেএনএফ নামের সংগঠনটি জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে কেন হঠাৎ র‌্যাব, সামরিক বাহিনী এবিষয়ে সচেতন হয়ে উঠল। তাহলে আগে নাইক্ষংছড়িতে পাওয়া অস্ত্রের উৎস কোথায়। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি চুক্তির ২৫ বছর ধরে চুক্তি বাস্তবায়নের আশা করছে এটাও তাদের রাজনৈতিক সমাধান খোঁজারই পন্থা। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতিকে জাতীয় দল হিসেবেও স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি করেন এই বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ। দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি একটি প্রাগ্রসর রাজনৈতিব দল।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামাল বলেন, “পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের একটি আত্মনিবেদিত রাজনৈতিক সংগঠন। এ দেশকে গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য যেসমস্ত বিষয়াবলি জাতীয় জীবনে এবং গণতন্ত্রের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ তা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে এই দলটি। আমরা যখন সংবিধান প্রনয়নের কাজে হাত দিলাম তখনই আমরা দেখলাম, আমরা জাতীয়বাদের আতিশয্যে এমন একটা পদক্ষেপ নিলাম, যে পদক্ষেপ আমাদের গণতন্ত্রের ভিত্তিকে ভেঙে চুরমার করে দেওয়ার জন্যে যথেষ্ট। সংবিধানে বলা হলো এ দেশের জনগণ জাতিতে বাঙালি। আমাদের ৭২-এর সংবিধান সে কথাই বলেছে। এ দেশটা শুধু বাঙালির নয়, বাঙালির বাইরে আরও অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মানুষের জন্যও। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, বাঙালি শাসকশ্রেণীর কর্তৃত্ব এখনও শেষ হচ্ছে না।জনসংহতি সমিতিকে জাতীয় রাজনৈতিক দল হিসাবে ঘোষণারও আহ্বান জানান এই আদিবাসী গবেষক।

লেখক ও সাংবাদিক আবু সাইদ খান বলেন, ভাষা আন্দোলন থেকে যে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু হয়, সে লড়াইয়ের একপর্যায়ে আদিবাসীরাও যুক্ত হয়েছিল। সঙ্গত কারনে সে লড়াইটা বাঙালির জাতীয়তাবাদের আন্দোলন ছিল। কিন্তু স্বাধীনতা উত্তর অন্যান্য আদিবাসী জনগোষ্ঠীর যারা সামিল হয়েছিলো তাদের বিষয়গুলো বিবেচনা করা হয়নি।
বিশিষ্ট এই সাংবাদিক ও মুক্তিযোদ্ধা আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে যে দাবিগুলোকে নিয়ে জনসংহতি সমিতি গঠিত হয়েছিল সেটার প্রথম সমাধানের উদ্যোগ নিয়েছিল আওয়ামলীগ। কিন্তু সেটাকে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমরা যে সাধুবাদটা দিয়েছি সেটা এখন ধরে রাখা যাচ্ছে না।

প্রশাসনিক কর্মকর্তারা যারা যাচ্ছেন তাদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জ্ঞান ছাড়া সেখানে পাঠানো হচ্ছে দাবী করে তিনি আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশনের কাজের কোনো অগ্রগতি নাই। বিভিন্নভাবে পদে পদে বাধাগ্রস্থ করা হচ্ছে। ভূমি কমিশনকে কার্যকর করতে হলে প্রথমত রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও মনস্তত্বের পরিবর্তন দরকার। যারা সেখানে প্রশাসনিক কর্মকর্তারা যাচ্ছেন তারা যেন না ভাবে ‘বাঙালি’ শাসক আর পার্বত্য চট্টগ্রাম একটা উপনিবেশ। আরেকটা ভুল চিন্তা প্রচলিত আছে। সেটা হল, পার্বত্য চুক্তির মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামকে অনেক বেশি দেয়া হয়েছে। ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রেও কেবল বাঙালির শৌর্য্য বীর্য নিয়েই লেখা হচ্ছে। ইতিহাসে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদেরকেও স্থান দেয়া দরকার। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতিকে আঞ্চলিক দল মনে হতে পারে কিন্তু তার কর্মপরিধি বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক করারই সংগ্রাম। পাহাড়ী-বাঙালির পারষ্পরিক যোগাযোগ ও আদান প্রদানের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশকে সুন্দও করতে হবে।

কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, “আমাদের দেশের প্রচলিত ধারার রাজনৈতিক দলগুলো থেকে জনসংহতি সমিতি পৃথক। জনসংহতি সমিতি নিঃসন্দেহে একটি জাতীয় রাজনৈতিক দল। তারা যে দীর্ঘ লড়াই সংগ্রাম করেছে, এবং কি সংকটের মধ্যে এখনও লড়াই করছে- এটা আমরা কমবেশি জানি। তাঁদের এই সংগ্রাম একটি ভিন্ন মাত্রার সংগ্রাম। তাদের মধ্যে বিভেদ ঘটানোর জন্য একেবারেই সরাসরি রাষ্ট্রসহ বিভিন্ন পক্ষ থেকে ইন্ধন দেওয়া হচ্ছে যেন তারা ঠিকমত দাঁড়াতে না পারে, এটা একটা বড় সংকট। তার মধ্যেও তারা যে কার্যক্রম ও লক্ষ্য অর্জনে তারা তাদের ভূমিকা পালন করবে, প্রত্যাশা করছি। এ লড়াই শুধু জুম্ম জনগোষ্ঠীর সাথে সম্পর্কিত না, এ লড়াই আমাদের দেশের অগ্রগতির সাথে জড়িত। এ লড়াই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথেও জড়িত।

ঐক্য ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক আসাদুল্লাহ তারেক বলেন, আজকের পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণ শতশত বৎসর যাবত লড়াই-সংগ্রাম করছে। কিন্তু বাহাত্তরের সংবিধানে আদিবাসী শব্দটি স্থান পায়নি। আদিবাসীদের যে লড়াই সংগ্রাম শুধূ পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী নয়, সমতলের যে আদিবাসীরা লড়াই করছে সেই স্বীকৃতি তারা পায়নি। সেই স্বীকৃতি আদায় করার জন্যে তাদের শত বছরের শোষণ-বঞ্চনার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এবং বৈষম্যের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ১৯৭২ সালে তারা জনসংহতি সমিতি গঠন করে।

সভাপতির বক্তব্যে জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় সদস্য সাধুরাম ত্রিপুরা মিল্টন বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদেরকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। নোংরা রাজনীতিকে সুষ্ঠ রাজনীতি দিয়ে ঠেকিয়ে রাখবার জন্যই আমরা রাজনীতি করেছি। আমরা যুদ্ধ চাইনি। রাষ্ট্র আমাদের উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল। সেই যুদ্ধকে ঠেকিয়ে দেওয়ার জন্যই আমরা যুদ্ধ করেছি। সামরিক কর্তৃত্ব যখন রণক্লান্ত এবং বুঝলেন যে, পাহাড়ের সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান করতে হবে তখনই আমরা চুক্তিতে উপনীত হই। আমরা বিচ্ছিন্নতাবাদের জন্য লড়াই করিনি। বাংলাদেশের সংবিধানকে সমুন্নত রেখেই আমরা পার্বত্য চুক্তি করেছি। সেই চুক্তি অবিলম্বে বাস্তবায়নের জোর দাবী জানাই।

 

 

Back to top button