সংবিধান দিবস উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় আদিবাসী পরিচয়ে স্বীকৃতির দাবি
‘আদিবাসীদের আদিবাসী পরিচয়ে স্বীকৃতি দিয়ে ৭২-র বঙ্গবন্ধুর সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠা চাই’ শীর্ষক বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ আয়োজিত আলোচনা সভায় সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা সাবেক মন্ত্রী অধ্যাপক ড. আবু সাইয়িদ বলেছেন, ‘আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম সামরিকতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার জন্যে। উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশ হবে ‘রিপাবলিক’। আমরা সংবিধানে সেটা লিখেছিলাম। রিপাবলিক মানে রাষ্ট্র হবে সবার যেখানে ধর্মীয় পরিচয় থাকবে না। কিন্তু আজকের সংবিধান সেটি ধারণ করে না।
তিনি বলেন, সামরিক শাসকরা কখনও ধর্মনিরপেক্ষতাকে ধারণ করেনা। কারণ পৃথিবীর সব দেশে সামরিক শাসকরা বিভক্তি নীতি অনুসরণ করে। বাংলাদেশেও তা-ই হয়েছে। সামরিকতন্ত্র বিদায় নিলেও তাদের বিভক্তি নীতি বিদায় নেয়নি।
আজ শনিবার (৫ নভেম্বর ২০২২) জাতীয় প্রেস ক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে আয়োজিত আলোচনা সভায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, বিশিষ্ট সাংবাদিক জনাব শাহরিয়ার কবির, বিশিষ্ট নাট্যজন জনাব মামুনুর রশিদ, বিশিষ্ট নারী নেত্রী ডা. ফৌজিয়া মোসলেম, নির্মল রোজারিও, এ্যাড. সুব্রত চৌধুরী ও কাজল দেবনাথ। ড. নিমচন্দ্র ভৌমিক এতে সভাপতিত্ব করেন।
অধ্যাপক আবু সাইয়িদ দুঃখ করে বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার আগ পর্যন্ত সকল রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান চার ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠ করে শুরু হতো। এখন আর কোন অনুষ্ঠানে তা হয় না। পশ্চিম বাংলা বা ত্রিপুরার মানুষরা বাঙ্গালী হলেও তারা জাতিরাষ্ট্রে অন্তর্ভুক্ত নয়। বঙ্গবন্ধু এপার বাংলার বাঙ্গালী জনগণকে নিয়ে স্বাধীন জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। অথচ আমরা আর জনগণের কথা বলি না। মুক্তিযুদ্ধ ছিলো সাধারণ মানুষের, খেটে খাওয়া মানুষের। তাদের সাথে সামরিক আধা সামরিক বাহিনীর সদস্যরাও ছিলো। তিনি আরও বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার পঞ্চদশ সংশোধনী করেছে। কিন্তু জাতির পিতার হত্যাকারীরা সংবিধানের প্রস্তাবনার মাথায় যে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম যোগ করলো, একই ধারায় রাষ্ট্রধর্ম সংযুক্ত করলো তাকে আরও পাকাপোক্ত করেছে। এটি নিঃসন্দেহে দুঃখ ও দুর্ভাগ্যজনক।
অধ্যাপক আবু সাইয়িদ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, হিন্দুদের বাড়ি পোড়ানো হল যে এমপি’র ইন্ধনে তাকেই সংসদে ডেপুটি স্পীকার করা হয়েছে।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক শহীদের রক্তের আখড়ে ৭২-র সংবিধান রচিত হওয়ার কথা উল্লেখ করে বলেন, এটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও স্বপ্নকে ধারণ করে আছে। এ সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠা ছাড়া প্রকৃত অর্থে গণতন্ত্র, আইনের শাসন, সাম্য, সমতা ও সামাজিক মর্যাদা সুনিশ্চিত হতে পারেনা। তা-ই এ লক্ষে কালবিলম্ব না করে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হবার তিনি আহ্বান জানান।
বিশিষ্ট সাংবাদিক জনাব শাহরিয়ার কবির বঙ্গবন্ধুর ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র যে দর্শন তা ইতিহাসে ‘অনন্য’ হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেছেন, তিনি স্বাধীনভাবে ধর্মচর্চার ওপর জোর দিয়েছেন এবং একই সাথে বলেছেন ধর্মের পবিত্রতা রক্ষায় রাষ্ট্র ও রাজনীতি থেকে তা দূরে থাকবে যাতে ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার না করতে পারে।
তিনি বলেন, রাষ্ট্রধর্মের সুযোগ নিয়ে এদেশের ধর্মান্ধ মৌলবাদী শক্তি গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও প্রগতিকে খামচে ধরার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। এ অপচেষ্টার বিরুদ্ধে তিনি ধর্মপ্রাণ সকল শক্তির ঐক্যবদ্ধতা কামনা করেন এবং ৭২-র সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠায় অব্যাহত সংগ্রাম পরিচালনার ওপর জোর গুরুত্ব আরোপ করেন।
শাহরিয়ার কবির বলেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচনী ইশতেহারে যেসব সংখ্যালঘু স্বার্থবান্ধব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন অতি দ্রুত তা বাস্তবায়নে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে, না হলে এর খেসারত আগামী নির্বাচনে সরকারকে দিতে হবে।
নাট্যজন মামুনুর রশিদ বলেন, আমাদের শাসকগোষ্ঠী সবসময়ই পাকিস্তানকে অনুসরণ করে। এটি হল আমাদের সমস্যার ধারাবাহিকতা। পাকিস্তান হল সংবিধান সংশোধনের পরীক্ষাগার। তাদের মত আমাদের দেশেও সংবিধান সংশোধন হয়েছে, স্থগিতও হয়েছে। সেখানেই ঢুকে গেছে রাষ্ট্রধর্মের বিধান।
তিনি বলেন, আজকেতো সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম থাকার কথা না। সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ মেজরিটি হলে সংবিধান সংশোধন করা যায়। পঞ্চদশ সংশোধনের পরেও রাষ্ট্রধর্মও থাকলো আবার জিয়াউর রহমানের বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম থাকলো কেন? এ প্রশ্নের জবাব মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারকে দিতে হবে।
নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশিদ আরও বলেন, আদিবাসীদের বলা হল ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী। তাদের আমরা উপেক্ষা করতে পারিনা। শান্তিচুক্তি হওয়ার পরেও আদিবাসীদের আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি আজও মিললো না।
তিনি বলেন, সংবিধানের প্রণেতাদের সম্মানিত করা হয়েছে। কিন্তু জনগণকে এবং স্বাধীনতাকে সম্মানিত করা হবে কবে ?
বিশিষ্ট নারী নেত্রী ডা. ফৌজিয়া মোসলেম দুঃখ করে বলেন, স্বাধীনতার ইশতেহারে বর্ণিত সাম্য, মর্যাদা ও ন্যায়বিচার যা ছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের মূল লক্ষ্য তা থেকে দেশ অনেক দূরে সরে এসেছে। দারিদ্র কমে আসলেও ধনবৈষম্য অনেক বেড়ে গেছে, সাম্যের প্রশ্ন অনেক দূরে সরে গেছে, মর্যাদার প্রশ্নও উপেক্ষিত। মূল লক্ষ্য থেকে দূরে সরে যাওয়ার কারণে রাষ্ট্রও চার মূলনীতি থেকেও অনেক দূরে সরে গেছে।
তিনি বলেন সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম থাকার সুযোগ নিয়েই সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার ঘটানো হচ্ছে। রাষ্ট্রক্ষমতায় যারা আছেন তারাও আপোষের পথে হেঁটেছেন। কে কত বড় ধার্মিক তা প্রমাণের প্রতিযোগীতা শুরু হয়েছে। ধার্মিক হওয়ার চেয়ে মানবিক হওয়া এখন অনেক বেশি জরুরী।
স্বাগত বক্তব্যে ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট রাণা দাশগুপ্ত বলেন, আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা কথায় কথায় বলেন, সংবিধানে সংখ্যাগুরু- সংখ্যালঘু বলতে কিছু নেই। বাস্তবতায় রাষ্ট্রধর্ম শুধু ঐক্যবদ্ধ বাঙ্গালী জাতিসত্তায় বিভাজন টানেনি ধর্মীয় সংখ্যাগুরু জনগণের ধর্ম রাষ্ট্রধর্ম হওয়ায় এদেশের ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘুরা কার্যত রাষ্ট্রীয় সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে। অথচ তা হওয়ার জন্যে এরা ৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ করেনি, সীমাহীন আত্মত্যাগও করেনি। সংখ্যাগরিষ্ঠতার ধোঁয়া তুলে রাষ্ট্রধর্ম সংবিধানে জিইয়ে রেখে আর যা-ই হোক গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কখনও কোনদিন প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনা। সংবিধানে সংখ্যাগুরু সংখ্যালঘু বলতে কিছু নেই-এ কথাটি আপ্তবাক্যের মত আওড়িয়ে রাজনীতিবিদরা দেশের তাবৎ জনগণের সাথে প্রতারণা করছে, মিথ্যাচার করছে।
তিনি বলেন, ৭২-র সংবিধান পাকিস্তানী মোড়কের সংবিধানের অনুরূপে আজও আবর্তিত। রাষ্ট্র, রাজনীতি, শিক্ষানীতি, সমাজনীতি, প্রশাসন সবটাই আজ মুক্তিযুদ্ধের মৌলচেতনা থেকে অনেক দূরে ছিটকে পড়েছে। বিগত ১৩ (তের) বছরে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দলের সরকারে অবস্থানে দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে প্রচুর অগ্রগতি হয়েছে কিন্তু আপামর বাঙ্গালী জাতি মননে-মানসিকতায় ক্রমশই পিছিয়ে যাচ্ছে এবং এর করুণ পরিণতি আজকে মুক্তিযুদ্ধপ্রেমী সকল নাগরিক হতাশায় ও বিষ্ময়ে প্রত্যক্ষ করছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে আদিবাসীদের আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে বঙ্গবন্ধুর ৭২-র সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠার ঐক্যবদ্ধ লড়াই ছাড়া আজ আর কোন বিকল্প নেই।