মতামত ও বিশ্লেষণ

বৈচিত্র্যতাই বিজয়ের শক্তি: সারা মারান্ডী

কটা সময় ছিল যখন উত্তরবঙ্গের ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারী,রংপুর, জয়পুরহাট, নাটোর,নওঁগা, রাজশাহী জেলা গুলোতে ফুটবল বলতেই আদিবাসী সাঁওতাল, ওঁরাও,মুন্ডা ফুটবলারদের একচেটিয়া বেশ নামডাক শোনা যেত। ৮০’র দশকে মাঠেঘাটে যে ফুটবল খেলা হত সেখানে সুঠাম দেহী, লম্বা,চওড়া আদিবাসী খেলোয়াড়রা ছিল বিশেষ আকর্ষন। মাঠ দাপিয়ে বেড়াতো আদিবাসী খেলোয়াড়রা। আদিবাসীদের চেহারা সুরতের ভিন্নতার ফলে পাশ দিয়ে উৎসুক দর্শককে বলতে শোনা যেত-“এ যে নাইজেরিয়ান, এই যে-বাং কানা, চালাক্ কানা ( সান্তালী ভাষার বাংলা ভাবার্থ “না সে না, সে যাচ্ছে ”) ইত্যাদি।” কোনরকম তোয়াক্কা না করে দিড়িম দিড়িম সব সর্ট কখনও মাঝ মাঠ থেকে, কখনও কর্ণার কিক আর সুচারু হেড দর্শককে আনন্দ দিয়েছে বহুত। এই জেলাগুলোতে সেসময় অনেক আদিবাসী তারকা ফুটবলার এক নামে মাঠ কাঁপিয়েছে। এর মধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য দিনাজপুরের ডেভিড হাঁসদা, এনোস হেম্ব্রম, মিথুয়েল কিস্কু, ঠাকুরগাঁও-এর সুুগা মুরমু, নীলফামারীর সহোদর সামূয়েল পাহান, কাল্লু পাহান আরও অনেকে। সেই সাথে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী ফুটবল দলের হয়ে নিয়মিত খেলেছেন দিনাজপুর জেলার প্রয়াত মিথুশিলাক হাঁসদা মিঠুন। অপরদিকে পাহাড়ের তারকা খেলোয়াড় অরুন দেওয়ান, বরুন দেওয়ান, কিংসুক চাকমা জাতীয় ফুটবল দলেও অবদান রেখেছেন। অনেক ফুটবলার ফুটবলকে ভালবেসে ফুটবলকে নিয়েই সারা জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন উপজেলা ও সবোর্চ্চ জেলা পর্যায় পর্যন্ত। পায়ের কারুকাজ ও খেলার দম থাকা সত্তে¡ও অভাব অনটন,যোগাযোগ ও যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় খেলাকে পেশা হিসেবে ধরে রাখতে পারেনি অনেক সম্ভাবনাময় খেলোয়াড়।

তাই বলে ফুটবল থামেনি বরং কালপরিক্রমায় এর সাথে যুক্ত হয়েছে আদিবাসী মেয়েরাও। খেলোয়াড় বাপ কাকাদের উত্তরসূরি হয়ে আজ বাংলাদেশ প্রমিলা ফুটবল জাতীয় দলে যুক্ত হয়েছে আদিবাসী মেয়েরা। মেয়েদের ফুটবলার হিসেবে দক্ষ করে তুলতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নিবেদিতপ্রাণেরা নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন। এর মধ্যে উত্তরের জেলাগুলোর মধ্যে অন্যতম ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল উপজেলার রাঙ্গাটুঙ্গি ইউনাইটেড ফুটবল একাডেমি। যার পরিচালক হিসেবে নীবিড়ভাবে কাজ করে চলেছেন রানীশংকৈল ডিগ্রী কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ জনাব তাজুল ইসলাম। এই উদ্যোগের সাথে যুক্ত হন সাঁওতাল খ্যাতিমান ফুটবলার সুুগা মুরমু, এলাকার নামকরা খেলোয়াড় জয়নুল আবেদীন, সেতাউর রহমান,যারা একের পর এক দুর্দান্ত খেলোয়াড় তৈরী হতে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। ফলে, আদিবাসী সাঁওতাল জাতিসত্ত্বা নির্ভর রাঙ্গাটুঙ্গি গ্রামটি হয়ে উঠেছে নারী ফুটবলের সুতিকাগার। যেখানে তাদেরই হাত ধরে সোহাগী কিস্কু, মিনি হেম্ব্রম, বিথীকা মুরমু, কোহাতি কিস্কু সহ আরো অনেকে খেলছে অনুর্ধ-১৭, ১৮ ও ১৯ জাতীয় বয়সভিত্তিক দলের নিয়মিত সদস্য হয়ে। অপরদিকে পার্বত্যজেলা গুলো থেকে ফুটবল খেলোয়াড় রুপনা চাকমা, ঋতুপর্ণা চাকমা, কলসিন্দুরের মারিয়া মান্দা আমাদের গর্ব।
আজ এই সাফল্য আদিবাসীদের জন্য শুধু ফুটবলের সাফল্য নয় বরং তাদের মানুষ হিসেবে মর্যাদার বিজয়। এই তো সেদিনের কথা উত্তরবঙ্গের সাঁওতাল আদিবাসী মানুষেরা হোটেলে বসে বাঙ্গালীদের সাথে চা খেতে পারত না। সাঁওতালদের দেওয়া হতো দুই নম্বর কাপ। হাতল ছাঁড়া ভাঙ্গা কাপ ছিল তাদের জন্য বরাদ্দ। কারনে অকারনে আদিবাসীদের বলা হয় মদ মাতাল,নোংরা। আদিবাসী মা বোনদের জমিতে কাজ করতে গিয়ে তাদের আধো বাংলা শুনে টিপন্নী শুনতে হয় অহরহ। নারীদের মজুরী বৈষম্য, শ্লিনতাহানী, জমির মামলা,দিনের পর দিন নিজ জমি উদ্ধারের আশায় কোর্ট চত্বরে হাজিরা দিয়ে চপ্পল ক্ষয় আজও চলছে।

এতসব পুরোনো দীর্ঘমেয়াদী যন্ত্রনার মধ্যেও আমাদের আদিবাসী মেয়েরা সরলভাবে বার্তা দিল রাষ্ট্র, নাগরিক আর সমাজকে। ইনক্লুশন বা একিভূত হয়ে কোন কাজ কতটা শক্তিশালী তা অনুভব করালো। শক্তিটা কিন্তু শুধু প্রশিক্ষণ নয়, শুধু মেধা নয়। শক্তিটার উৎস অনেকাংশে জাতি,বর্ণ অনুযায়ী ভিন্নতাও বটে। পার্বত্য অঞ্চলের মেয়েটির জীবন সেই আদিকাল থেকে পাহাড়ের সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকার। যে মেয়েটিকে প্রতিদিন পাহাড় বেয়ে যেতে হয় জুম চাষে, যেতে হয় স্কুল কলেজে। আবার পানি সংগ্রহ করতে সেই উঁচু পাহাড় থেকে একটা কলস নিয়ে পাহাড়ের নীচে ঝিরিতে নামতে হয়। তারই সাথে নিজেদের বসবাসের বাড়ীটি পাহাড় রক্ষা করে আদি জ্ঞান ও দক্ষতায় নিজেরাই বানায়। আদি পোশাকও হাত তাতে নিজেরাই বুনে। সারাদিনে প্রতিটি কাজে এভাবে কায়িক পরিশ্রম করে জীবনপ্রনালী বহমান পাহাড়ে বসবাসরতঃ আদিবাসী জাতিসত্ত¡াসমূহের। এদিকে সমতলের সাঁওতাল,ওঁরাও সহ অন্যান্য আদিবাসী নারী মাঠে সকাল থেকে বিকেল অব্দি পরিশ্রম করে-ধান লাগানো,ধান কাঁটা,মাথায় ধান নিয়ে যাওয়া, নদী থেকে ঝিনুক-শামুক সংগ্রহ করা, বন আলু সংগ্রহ করা-যদিও বা আগের মত বন আলু পাওয়া যায় না এখন সেভাবে। যুগ যুগ ধরে আদিবাসীদের নিত্যদিনের কঠোর পরিশ্রম, সংগ্রাম, জীবনপ্রনালী ও খাদ্যাভাস তাদের শক্তি (স্টেমিনা) বৃদ্ধির ক্ষেত্রে রয়েছে যথেষ্ট অবদান। একই সাথে এই সংগ্রামী জীবন, বঞ্চনা ও আদি সামাজিক প্রথা আদিবাসীদের অনেক ধৈর্য্যশীল, নমনীয় ও অধ্যবসায়ী হবার ক্ষেত্রে মানসিক শক্তি দান করে। আদিবাসী গ্রাম গুলোতে আদি সংস্কৃতি চর্চা, মূল্যবোধ, বিশ্বাস বংশপরম্পরায় শিশুরা বয়োজৈষ্ঠ্যদের থেকে শিখে আসছে। যে সমাজ ব্যবস্থায় নারী ও পুরুষেরা একত্রে আলোচনা, সিদ্ধান্ত গ্রহন, সংস্কৃতি চর্চা, পারিবারিক ও আয় বর্ধন মূলক কাজে অংশগ্রহন করতে পারে। সে পরিবেশ একজন ছেলে শিশুর সাথে একজন মেয়ে শিশুকেও উদার মানসিকতা ও আভ্যন্তরিন অনুকূল পরিবেশে বেড়ে উঠতে সহযোগিতা করে। ফলশ্রুতিতে মেয়েরাও সকল কাজে অংশগ্রহন ও সফলতার সাথে অবদান রাখতে সক্ষম হচ্ছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে।

আমরা সৌভাগ্যবান, বাংলাদেশ একটি বৈচিত্রময় জাতিসত্ত্বার দেশ। প্রতিটি জাতিসত্ত্বারই রয়েছে স্ব স্ব সামাজিক প্রথা। যা বংশপরম্পরায় লালন ও পালন খুবই গুরুত্বপূর্ণ । কারন আদি সংস্কৃতি, ইতিহাস অবজ্ঞা নয় কিন্তু তা আলিঙ্গন করেই একটি জাতি মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে। যার অনন্য নির্দশন বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন। যেটি একদিনের কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এই ভারতবর্ষে একে একে অনেকগুলো বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছে। যার মূল উদ্দেশ্য ছিল মেহেনতী মানুষ, আদিবাসী সহ প্রান্তিক কৃষকের ন্যায্য প্রাপ্যতা ও মর্যাদার লড়াই। সন্ন্যাসী বিদ্রোহ (১৭৬০-১৮০০), তেভাগার কৃষক বিদ্রোহ ( ১৯৪৬-৪৭), সাঁওতাল বিদ্রোহ ( ১৮৫৫-৫৬), উলগুলান (১৮৯৯-১৯০০) সহ প্রায় ১৭ টি বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছে । পরবর্তীতে ১৯৪৭ এর দেশ ভাগ, ৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ৬৯ এর গণঅভূত্থান,বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষন। একে একে প্রতিটি ঘটনাবলী বাংলার মানুষকে সংঘবদ্ধ ভাবে উদ্দীপ্ত করেছে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে। নয় মাসের সশস্ত্র যুদ্ধে ৩০ লক্ষ শহীদের রক্ত আর ২ লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে বিশ্বের মানচিত্রে রচিত হয়েছে লাল সবুজের বাংলাদেশ। প্রতিটি অর্জনের পেছনে এর নৈপথ্য সংগ্রামের ধারাবাহিকতার গুরুত্ব অপরিসীম। সম্প্রতি বাংলাদেশের রজত জয়ন্তী পালিত হয়েছে। ভাষা,সংস্কৃতি,রাজনীতি,অর্থনীতিতে অসংখ্য অর্জন এই পঞ্চাশ বছরে আমাদের করেছে গর্বিত। যেভাবে আমরা একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছি । তেমনি দেশের মেয়েরাও ধাপে ধাপে বিভিন্ন ঘটনাবলী, পদক্ষেপ ও সংগ্রামের মাধ্যমে একজন মানুষ হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর লড়াই করেছে এবং এখনও করে চলেছে।
এরই ধারাবাহিকতায় ২০২২ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর হিমালয়ের দেশে হিমালয়কন্যাদের হারিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলচূড়ায় বাংলাদেশের মেয়েরা আর একটি উজ্জ্বল ইতিহাস রচনা করেছে। কাঠমুন্ডুর দশরথ ষ্টেডিয়ামে স্বাগতিক নেপালকে হারিয়ে সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপে বাঘীনিদের বিজয়,আমাদের অহংকার । বাংলার মেয়েদের দক্ষিণ এশিয়া জয়ের নৈপথ্যে রয়েছে দীর্ঘ পথপরিক্রমা। এই মেয়েদেরও শুনতে হয়েছে আশেপাশের কতজনের কটুকথা। পারিবারিক,সামাজিক,অর্থনৈতিক সকল বাঁধাকে জয় করে বিজয় মুকুট পড়িয়ে বিজয়ের আনন্দে সামিল করলো পুরো জাতিকে। স্যালুট! আমাদের বাংলার সোনার মেয়েদের। আজ এই বিংশ শতাব্দীর মেয়েরা অনেক ভাগ্যবতি। শতবাঁধা সত্তে¡ও তারা একটা ইতিবাচক পরিবেশে বিচরন করছে। নারীর আজকের এই অবস্থানে অধিষ্ঠিত করনের পেছনে প্রতিটি যুগে ত্যাগী নারীর সংগ্রামী ইতিহাসে রয়েছে। যাদের আতœত্যাগ, দৃঢ় মনোবল ও নির্ভিক পদক্ষেপ সকল প্রকার সামাজিক কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস ভেঙ্গে কন্টকাকীর্ণ পথকে মসৃন করে চলেছে।

একটা সময় ছিল যখন মেয়েরা খেলাধূলা তো দূরের কথা, এমনকি শিক্ষার্জনের কথাও ভাবতে পারত না। নারীদের ঘরের বাইরে বেরিয়ে এসে ক্রীড়া,শিক্ষা,সংস্কৃতি,রাজনীতি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে বিচরন ছিল দুঃসাধ্য। যার বাঁধ ভেঙ্গে যাত্রা শুরু করেছিলেন নারী জাগরনের পথিকৃত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন (১৮৮০-১৯৩২)। তিনি ছিলেন নারী শিক্ষা এবং অর্থনৈতিক মুক্তির অগ্রদূত। ১৮৮০ সালে রংপুরের মিঠাপুকুরের পায়রাবন্দ গ্রামে জন্মগ্রহন করেন তিনি। সে সময়ের সমাজব্যবস্থায় মেয়েরা ঘরের বাইরে গিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভের সুযোগ পেত না। যদিও বা বেগম রোকেয়ার পিতা আবু হায়দার সাবের বিভিন্ন ভাষা যেমন- আরবি, উর্দু,ফরাসি,বাংলা,হিন্দি, ইংরেজি’তে পারদর্শী ছিলেন। তারপরও তিনি মেয়েদের শিক্ষা গ্রহনের ক্ষেত্রে ছিলেন রক্ষণশীল। বেগম রোকেয়াকে মূলতঃ বড় দুই ভাই-মোহাম্মদ ইব্রাহীম আবুল আসাদ সাবের, খলিলুর রহমান আবু যায়গাম সাবের ও বড় বোন করিমুন্নেসা জ্ঞানচর্চা, সাহিত্যনুরাগী ,দর্শন ও মূল্যবোধ গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। তার শিক্ষাগ্রহনের সময় সমাজের লোকজন, আতœীয়-স্বজনের বাঁকা দৃষ্টি কটুক্তিও ছিল। কিšতু সব তুচ্ছ করে তিনি নিরলসভাবে নিজেকে নিবেদিত রেখেছিলেন জ্ঞান সাধনায়। গভীর রাতে যখন সকলে ঘুমিয়ে পড়ত তখন বালিকা বেগম রোকেয়া মোমবাতির আলোয় লুকিয়ে লুকিয়ে বড় ভাইদের বাংলা ও ইংরেজী বই পড়তেন। পরবর্তীতে ১৮৯৮ সালে বিহারের ভাগলপুর নিবাসী উর্দুভাষী সৈয়দ সাখাওয়াৎ হোসেনের সাথে বিয়ে হয় বেগম রোকেয়ার। উদার,মুক্তমনা,তদুপরি সমাজসচেতন,কুসংস্কারমুক্ত,প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী স্বামীর উৎসাহ ও সহযোগিতায় বেগম রোকেয়া ক্রমশঃ নিবিড়ভাবে সাহিত্যচর্চায় মগ্ন হন।বেগম রোকেয়া’র পথ অনুসরন করে বাংলার ঘরে ঘরে এখন শিক্ষার আলো জ্বলছে।
বাংলার নারীর অবদান রয়েছে সর্বক্ষেত্রে যা, নারী মুক্তিযোদ্ধা ও প্রথম বিপ্লবী শহীদ ব্যক্তিত্ব একজন বাঙ্গালী নারী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ( ৫ মে ,১৯১১- ২৪ সেপ্টেম্বর ,১৯৩২) । যিনি তৎকালীন পূর্ববঙ্গে জন্ম গ্রহন করেছিলেন। বাঙ্গালী বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র আন্দোলন করেছিলেন। ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব যেখানে সাইনবোর্ডে অবমাননাকর কথা লেখা ছিল “ কুকুর এবং ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ” সেখানে পুরুষবেশী প্রীতিলতা ১৫ জনের বিপ্লবী দলের নেতৃত্ব দেন। আক্রমনকালে গুলিবিদ্ধ হলে পরে তিনি পুলিশের আটক এড়াতে পটাসিয়াম সায়ানাইড খেয়ে ২১ বছর বয়সে নিজের জীবন বিসর্জন দেন।
নারীর শিক্ষার পাশাপাশি নারীর প্রতি সহিংসতা, সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ, প্রজনন অধিকার, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন,ধর্মান্ধতার অধিনতা প্রতিরোধ ও সর্বোপরি নারীর সকল প্রকার ভূমিকায় অংশগ্রহনের বিষয়ে আওয়াজ তোলা হয় ১৯৮৮ সালের ৮ মার্চ আর্ন্তজাতিক নারী দিবস প্রথম বার পালনের মাধ্যমে।
নারী’র রাজনৈতিক এবং সামাজিক অংশগ্রহনের সুযোগ সম্প্রসারনের লক্ষ্যে ১৯৭০ সালে সুফিয়া কামাল “বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ” প্রতিষ্ঠা করেন । এরই সাথে ৭০ দশকে ডঃ এঞ্জেলা গমেজ এর উদ্যোগ “বাঁচতে শেখা” উন্নয়ন সংগঠন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তৃনমূল পর্যায়ে নারীর প্রতি পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ, বাল্য বিবাহ রোধ, নারীর শ্রম বৈষম্য দূরীকরন, গৃহস্থালী কাজের মূল্যায়ন ও সর্বপরি নারীকে মানুষ হিসেবে সমাজে অধিষ্ঠিত করার সামাজিক আন্দোলন বেগবান হয়। একটি সাক্ষাৎকারে ডঃ এঞ্জেলা গমেজ বলেছিলেন “এই উদ্যোগ নারীকে উদ্ধার করা নয় বরং কিভাবে বাঁচতে হয় তা নারীকে শেখানোর সহযোগিতা ”।

পাহাড়ের আদিবাসী নারীর সুরক্ষা ও অধিকারের জন্য কল্পনা চাকমা ১৯৮৮ সালে “হিল উইমেন ফেডারেশন ” প্রতিষ্ঠা করেন। সমতলে আদিবাসী নারীর সংস্কৃতি ও অধিকার রক্ষায় “আদিবাসী নারী পরিষদ” এর সভাপতি বাসন্তী মুরমু ৯০ এর দশক হতে কাজ করে চলেছেন। ১৯৯০ সালে “নারী পক্ষ ” নারীর শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলে। ১৯৯৪ সালে “নারী পক্ষ” আšর্তজাতিক নারী দিবসের স্লোগান ছিল “শরীর আমার সিদ্ধান্ত আমার”। এরই সাথে “নারী পক্ষ” যৌন কর্মীদের অধিকার নিয়েও সোচ্চার ভাবে কাজ করেছে। সমাজে যারা ট্রান্সজেন্ডার,তৃতীয় লিঙ্গ বা হিজড়া নামে পরিচিত তাদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরন রোধে জয়া সিকদার একজন ট্রান্সজেন্ডার “ সম্পর্কের নয়া সেতু” নামে সংগঠনের মাধ্যমে কাজ করেন।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের নারী ও শিশু মন্ত্রনালয়ের অধীনে নিবিড়ভাবে নারীদের প্রতিটি ক্ষেত্রে অংশগ্রহন ও আয়বর্ধন মূলক কাজের মাধ্যমে স্বাবলম্বী করনের কাজ অব্যাহত রয়েছে। দেশে কর্মরতঃ বিভিন্ন উন্নয়ন সংগঠনসমূহ সরকারের সাথে হাতে হাত রেখে “সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য মাত্রা-এসডিজি” অর্জনে কাজ করে চলেছে। এসডিজির জেন্ডার ও নারীর প্রতি সকলপ্রকার বৈষম্য রোধে নিরলস ভাবে কাজ করে চলেছে।
এই সকল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পবিরার ও সমাজ নারীকে নিয়ে ভাবছে এবং নারীর জন্য অনুকুল পরিবেশ তৈরীতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। আমাদের এই ১,৪৭,৫৭০ বর্গকিলোমিটারের দেশে সকলের যৌথ প্রয়াস ও সংগ্রামের ফসল ধাপে ধাপে ঘরে তোলার সুবাতাস বইছে। যার ফলশ্রুতিতে জাতি,ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলের অংশগ্রহনে বাঙ্গালী, গারো,চাকমা,সাঁওতাল ফুটবলাররা এক ছন্দের যাদুতে বিজয় ছিনিয়ে এনেছে। দেশ ও দেশের বাহিরে আদিবাসী নারী’র সর্বক্ষেত্রে বিচরন আদিবাসী জাতিসত্ত্বার মানুষকে  আত্মবিশ্বাসী ও মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করে। যা সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা’র ভারত সফর এবং পরবর্তীতে ইংল্যান্ড সফরে ভারতের মহামান্য রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু’র সাথে সাক্ষাতকার আদিবাসীদের জন্য অংহকার ও উৎসাহের।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর অসমাপ্ত আত্মজীবনী এর শুরুতে একটি উক্তি তুলে ধরা হয়েছে যেটি বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত নোটবই থেকে সংগৃহিত “একজন মানুষ হিসাবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙ্গালি হিসাবে যা কিছু বাঙ্গালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা,যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।”এটি যেন শুধুএকটি উক্তি নয় কিনতু বাঙ্গালী জাতির প্রতি তাঁর গভীর ভালোবাসা নিজ জীবনের মাধ্যমে উজাড় করে তিনি রচনা করে গেছেন আর এক অধ্যায়। নিজ জনগনের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে যিনি ছিলেন আপোসহীন।”

বঙ্গবন্ধুর জীবনাদর্শ মানুষের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের কথা বলে।শুধু নিজ জ্ঞাতি নিয়ে ভাবনা নয় বরং বিশ্ব  ব্রহ্মান্ডে বসবাসরতঃ প্রতিটি মানুষের জন্য ভালোবাসা ও ভাবনার কথা বলে। তিনি কতটা গভীরভাবে উপলদ্ধি করেছিলেন যে, একজন বাঙ্গালি হিসেবে যা কিছু বাঙ্গালিদের সাথে সম্পর্কিত -ভাষা, সাহিত্য, সমাজ, ক্রীড়া,সংস্কৃতি, রাজনীতিসহ সকল বিষয়ের তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন। তাঁর উক্তি থেকে আমরা স্ব সমাজসংস্কৃতি সম্পর্কে উদার ভাবনার শিক্ষা খুঁজে পাই। যে শিক্ষার মাধ্যম একজন মানুষ নিজ জাতির প্রতি অসীম ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে উৎসাহিত হয় বারবার। যা ভ্রাতৃত্বের দৃঢ়হ বন্ধন ও সম্প্রীতির নির্দশন ।সর্বোপরি এক উদার মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকাকে অর্থবহ করে তোলে।
বঙ্গবন্ধু যে স্বপ্ন দেখেছিলেন সকল জাতিসত্ত¡ার সম্বিলন সেটির উজ্জ্বল নিদের্শন বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দল। যেখানে সাবিনা খাতুন, সানজিদা আক্তার, কৃষ্ণা সরকার, ঋতুপর্ণা চাকমা, মারিয়া মান্দা, আনাই মগিনী ও সোহাগী কিস্কু, স্বপ্না রানী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ স্কোয়াডে ছিলেন। বৈচিত্র্যতাই যে শক্তি তা প্রমান করলো বাংলার মেয়েরা আর একবার। এই বৈচিত্রপূর্ণ শক্তিসমূহ দেশের একপ্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত হতে একে একে আবিষ্কার করে তা যথাযথ যতœ নেওয়া ও সঠিক স্থানে সুযোগ সম্প্রসারনের মাধ্যমে আরও বিজয় ছিনিয়ে আনার প্রত্যয় হোক আমাদের।

লেখক- সারা মারান্ডী

সমাজকর্মী ও গবেষক। 

 

Back to top button