বলাইশিমূল মাঠ রক্ষা আন্দোলন: পাভেল পার্থ
‘খেলার মাঠ’ এক জীবন্ত সত্তা। মানুষের প্রতিদিনের ক্রীড়া, কসরত কী যত্নেই খেলার মাঠ ‘খেলার মাঠ’ হিসেবে জীবন্ত থাকে। মানবসভ্যতার অবিচ্ছেদ্যসঙ্গী এই খেলার মাঠের গুরুত্ব নিয়ে আলাদা আলাপের দরকার আছে কী? ঊনিশশতকে উন্নয়ন মনস্তত্ত্ববিদ ফ্রেডরিক ফ্রোবেল শিশুদের মনোসামাজিক বিকাশ ও সুস্বাস্থ্যের জন্য ‘খেলার মাঠের’ গুরুত্ব তুলে ধরেন। ২০২২ সনের ১১ মে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও শিশুদের মানসিক এবং শারিরীক বিকাশের জন্য প্রতিটি এলাকায় খেলার মাঠের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন, সরকার যেখানেই খালি জায়গা পাচ্ছে সেখানেই খেলার মাঠ করে দিচ্ছে। দেশ-দুনিয়া জুড়ে সবাই খেলার মাঠের গুরুত্ব বুঝলেও কিছু মানুষ ও প্রকল্প বাংলাদেশের সকল খেলার মাঠ চুরমার করে দিচ্ছে। নগরায়ণ, শিল্পায়ন, দখল কিংবা অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে আমাদের স্মৃতিময় খেলার মাঠ গুলো আজ বিপদে। খেলার মাঠ বাঁচাতে দেশজুড়ে আজ লড়ছে মানুষ। যদিও খেলার মাঠ রক্ষায় জনআন্দোলন নতুন ঘটনা নয়। ১৯০৬ সনে কানাডার নোভা স্কশিয়াতে গড়ে ওঠা খেলার মাঠ রক্ষা আন্দোলন কিংবা বাংলাদেশের তেঁতুলতলা মাঠ রক্ষা আন্দোলন এক গর্বিত উদাহরণ। বলাইশিমূল মাঠ রক্ষায় আজ জাগছে আরেক জনআন্দোলন। নেত্রকোণার কেন্দুয়ার এই শতবর্ষী মাঠের ঐতিহ্য বিনষ্ট করে গড়ে তোলা হয়েছে ভূমিহীন গরিব মানুষের জন্য সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্প। চলতি আলাপখানি বলাইশিমূল মাঠ রক্ষার আন্দোলনে একাত্ম হয়ে দেশের সকল খেলার মাঠ সুরক্ষার দাবি তুলছে।
বলাইশিমূল মাঠ, কেন্দুয়া, নেত্রকোণা
নেত্রকোণার কেন্দুয়ার বলাইশিমূল ইউনিয়নে এক শতবর্ষী খেলার মাঠের নাম বলাইশিমূল মাঠ। উক্ত মাঠে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় ১০০টি গৃহ নির্মাণের জন্য একটি প্রকল্প গৃহীত হয়। বলাইশিমূল মৌজায় ৮৫ একর খাসজমির ভেতর আশ্রয়ণ প্রকল্পের জন্য ১০ একর জমি থাকা সত্তে¡ও প্রশাসন খেলার মাঠের এক একর ৮০ শতাংশ ভূমিতে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণ করছেন। শুরু থেকেই খেলার মাঠ রক্ষায় এলাকাবাসী আন্দোলনে নামে এবং স্থানীয় প্রশাসন এলাকাবাসীর দাবিকে গুরুত্ব না দিয়ে ২৩টি ঘর নির্মাণের কাজ শুরু করে। ২০২২ সনের ১২ আগস্ট রাতে বলাইশিমূল মাঠে নির্মাণাধীন আশ্রয়ণ প্রকল্পের সাত ও আট নং ঘরে আগুন লাগে। এ প্রেক্ষিতে পরদিন আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আন্দোলনকারীদের হুমকী দেন। নির্মাণকাজ বন্ধ না হওয়ায় আন্দোলনকারীদের পক্ষে হাবিবুর রহমান মন্ডলসহ আটজন বাদী হয়ে ২০২২ সনের ৩০ মে জেলা প্রশাসক, উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউএনও, সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) আসামি করে আদালতে মামলা দায়ের করে। মামলা বিচারধীন থাকলেও প্রশাসান পুলিশি পাহারায় নির্মাণ কাজ অব্যাহত রাখে। ২০২২ সনের ২ জুন রাতে নির্মাণাধীন ঘরের গাঁথুনি কারা যেন ভেঙে দেয়। ৩ জুন প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা কার্যালয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী বাদী হয়ে বলাশিমূল ১৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলায় বলাইশিমূল ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আলী আকবর তালুকদার ও ৫ নং ওয়ার্ডের সাবেক ইউপি সদস্য হায়দার আলী তালুকদারেক গ্রেপ্তার করা হয়, বর্তমানে তারা জামিনে আছেন। মাঠরক্ষা গণকমিটির আহবায়ক আবুল কালাম আল আজাদ, আবদুল আওয়াল মাস্টার, মামুনুর রহমান খান হলিসহ ৬২ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়েছে। ২০২২ সনের ১ জুলাই বলাইশিমূল মাঠ রক্ষায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে একটি মানববন্ধন হয়। ১২ জুলাই কেন্দুয়ায় সহ¯্র মানুষ মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করেন। ‘বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) আবেদনের প্রেক্ষিতে ১৪ আগস্ট হাইকোর্ট বলাইশিমূল মাঠে নির্মাণকাজের উপর তিনমাসের নিষেধাজ্ঞা জারি করে। কিন্তু খেলার মাঠের শ্রেণি জোর করে পরিবর্তন করে এখন এটিকে ‘কান্দা জমি’ হিসেবে দেখানো হচ্ছে। সাংবাদিককে মামলার হুমকী দেয়ায় কেন্দুয়ার ইউএনওকে সতর্ক করেছেন জেলা প্রশাসক। ১৯ আগস্ট বলাইশিমূল ইউনিয়নের ২৮ গ্রামের মানুষ এক গণবৈঠকে কেন্দুয়ার ইউএনও মাহমুদা বেগমকে অবাঞ্চিত ঘোষণা করে, ২৪ আগস্ট তাকে মদনে বদলি করা হয়। পরে চট্টগ্রামে বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে পদায়ন করা হয়। বলাইশিমূল ঈদগাহ ময়দানে মাঠরক্ষা গণকমিটি ২ সেপ্টেম্বর এক সমাবেশের আয়োজন করে। তেঁতুলতলা মাঠ রক্ষাকর্মী, পরিবেশবিদ, সংস্কৃতিকর্মী, মানবাধিকারকর্মীরা এতে সংহতি জানান।
দেশ জুড়ে মাঠ রক্ষা আন্দোলন
ঢাকার তেঁতুলতলা মাঠ, ধূপখোলা ও বকশিবাজার মাঠ, লক্ষীপুরের মান্দারী বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠ, রাঙামাটির লংগদুর বাইট্টাপাড়া মাঠ, সিলেটের এমসি কলেজ মাঠ, সিরাজগঞ্জের হলদিঘর মাঠ, নারায়ণগঞ্জের আলিগঞ্জ ও পঞ্চমীঘাট মাঠ, সুনামগঞ্জের বড়গোপটিলা মাঠ, রাজশাহীর নামোভদ্রা মাঠ, নীলফামারীর ভেড়ভেড়ী মাঠ, ঝালকাঠির তারুলী মাঠ, ফেনীর শমসেরগাজী দীঘি মাঠ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অন্নদা স্কুল মাঠ, কক্সবাজারের শামলাপুর মাঠ, দিনাজপুরের চাঁদপাড়া মাঠ, খুলনার আইচগাতি-দেয়াড়া অগ্রদূত মাঠ, নাটোরের বিয়াঘাট মাঠ, বরিশালের কাউনিয়া স্কুল মাঠ কিংবা পটুয়াখালীর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের খেলার মাঠ রক্ষায় তৈরি হয়েছে জনআন্দোলন। শিশু-কিশোর-যুব, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, এলাকাবাসীসহ সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ মাঠ রক্ষার আন্দোলনে সামিল হচ্ছে। শারিরীক ও মানসিকভাবে সুস্থ প্রজন্ম গড়ে তুলতে উন্মুক্ত পাবলিক মাঠের কোনো বিকল্প নেই। আর তাই মাঠ রক্ষায় জাগছে দেশ।
কী আছে আইনে?
খেলার মাঠ ও উন্মুক্ত স্থান সুরক্ষায় দেশে একটি আইন আছে। ‘মহানগরী, বিভাগীয় শহর ও জেলা শহরের পৌর এলাকাসহ দেশের সকল পৌর এলাকার খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান এবং প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন ২০০০’। বেশ দীর্ঘ নামের এই আইনটি কার্যকরেও রয়েছে দীর্ঘসূত্রিতা। আইন বলা হয়েছে, …খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান এবং প্রাকৃতিক জলাদার হিসেবে চিহ্নিত জায়গার শ্রেণী পরিবর্তন করা যাইবে না বা উক্তরূপ জায়গা অন্য কোনভাবে ব্যবহার করা যাইবে না বা অনুরূপ ব্যবহারের জন্য ভাড়া, ইজারা বা অন্য কোনভাবে হস্তান্তর করা যাইবে না। কিন্তু দেশে নগর কী গ্রাম সর্বত্র খেলার মাঠ দখল করে মূলত কী করা হয়েছে? হয়তো নতুন কোনো অবকাঠামো বা স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে কিংবা সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে কোনো অপকিল্পিত বাণিজ্যিক প্রকল্প। এর ফলে সেই খেলার মাঠের বৈশিষ্ট্য এবং শ্রেণি অবশ্যই পরিবর্তন ঘটানো হয়েছে। কারণ প্রাকৃতিক, ভৌগলিক, বাস্তুসংস্থান, পরিবেশগত, সাংষ্কৃতিক ও সামাজিকভাবে সেটি এখন আর ‘খেলার মাঠ’ হিসেবে নেই। কিন্তু দেশে কতগুলো খেলার মাঠ হত্যা ও বিনষ্টের বিরুদ্ধে মামলা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয়েছে? এমনকি আইনে দেশের গ্রাম ও ইউনিয়ন পর্যায়ে খেলার মাঠ রক্ষার কোনো বিধান নেই। অবশ্যই গ্রাম কী শহর, পৌর এলাকা-সিটি করপোরেশন কী ইউনিয়ন পরিষদ এলাকার খেলার মাঠের আইনগত নিরাপত্তা আইনে যুক্ত করা জরুরি।
খেলার মাঠ চাই
খেলার মাঠের অধিকার নাগরিক অধিকার। এটি মন-শরীর ও সংস্কৃতির সুস্থ বিকাশের এক অন্যতম শর্ত। কিন্তু দেশজুড়ে প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য ও প্রতিবেশের মতই খুন হচ্ছে খেলার মাঠ। উন্নয়ন বাহাদুরিতে উধাও হচ্ছে শত শত টুকরো টুকরো ছোট-বড় খেলার মাঠ। নগর পরিকল্পনাবিদেরা বলেন, একটি শহরে প্রতি আধা বর্গকিলোমিটারে একটি করে খেলার মাঠ প্রয়োজন। ৩০৫.৪৭ বর্গকিলোমিটার আয়তন বিবেচনায় ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে খেলার মাঠ দরকার অন্তত ৬১০টি, কিন্তু মাঠ রয়েছে ২৫৬টি, ৪১টি ওয়ার্ডে কোনো মাঠ নেই। ঐতিহ্যবাহী ধূপখোলা নির্মিত হচ্ছে বিপণিবিতান, শ্যামলী ক্লাব মাঠ দখল করে চলে তাঁত ও বস্ত্রমেলা। রাজধানীর জন্য করা ড্যাপের খসড়ায় বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুযায়ী ঢাকায় মাঠ দরকার ১৪৬৬টি। নগর পরিকল্পনাবিদদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি)’ ২০১৯ সনে ‘ঢাকা শহরে বিদ্যমান খেলার মাঠের ঘাটতি ও চহিদা পর্যালোচনা’ বিষয়ক এক গবেষণা করে। তাদের গবেষণায় ঢাকায় ২৩৫টি মাঠের উল্লেখ আছে। কেবল ঢাকা নয়, খুন হয়ে গেছে দেশের সব এলাকার খেলার মাঠ। সিলেটের বিখ্যাত কালাপাথার মাঠ, কয়েদির মাঠ, গাছতলা মাঠ, মজুমদারবাড়ি মাঠ, বাগবাড়ি মাঠ, বাদামবাগিচা মাঠ, রাজবাড়ি মাঠ, ছড়ারপাড় মাঠ চোখের নিমিষে উধাও হয়ে গেল। কেবল খেলা নয়, পাবলিক মাঠগুলো জনসংস্কৃতির এক দেশীয় মঞ্চ। এখানে পালাগান হয়, সার্কাস, ষাঁড়ের লড়াই, বারুণী, আড়ং, মওসুমী মেলা, ঘোড়দৌড়, যাত্রাপালা, বার্ষিক প্রতিযোগিতা, মাহফিল, কীর্তন কতকিছুর আয়োজন ঘটে এইসব মাঠে। নওগাঁর মহাদেবপুরের নাটশাল মাঠে ওঁরাও-সাঁওতাল-মুন্ডাদের ঐতিহ্যবাহী কারাম পরব আয়োজিত হয় প্রতিবছর। এভাবে একের পর এক খেলার মাঠ খুন হয়ে যাওয়ার পরিণতি কী? এর শারিরীক, সাংস্কৃতিক, মনস্তাত্তি¡ক, সামাজিক, অর্থনৈতিক কিংবা রাজনৈতিক প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া কী? এ বিষয়ে আমরা কী জোরদার আওয়াজ তুলেছি? নীতিনির্ধারক কী জাতীয় সংসদ কী দেশের খেলার মাঠের সুরক্ষায় জোরদার কোনো তর্ক তুলেছে কখনো? হয়তো সব পাবলিক মাঠ সবার জন্য এখনো সমানভাবে ‘উন্মুক্ত’ নয়। সমাজে বিদ্যমান শ্রেণি-বর্গ বিবাজন ও কাঠামোগত বৈষম্য খেলার মাঠ ঘিরেও জারি রাখে নানা বঞ্চনা ও অপরত্বের উদাহরণ। বিশেষ করে সব বয়েসী মেয়েদের সব মাঠে প্রবেশ ও নিজের মতো করে মাঠ ব্যবহারের সামাজিক পরিস্থিতি থাকে না। অনেক এলাকায় বাঙালি জাত্যাভিমান আদিবাসীদের মাঠে প্রবেশাধিকার সংকুচিত করে রাখে। সামাজিকভাবে ‘অস্পৃশ্য’ অনেকে একেই মাঠে খেলতে পারে না। খেলার মাঠ নিয়ে জারি থাকা এমনতর সামাজিক বঞ্চনা ও শ্রেণিদ্ব›দ্বকেও প্রশ্ন করা জরুরি। অবশ্যই দেশের সব খেলার মাঠগুলোর পাবলিক নথিভূক্তকরণ জরুরি। নামকরণ, ইতিহাস, বর্তমান অবস্থা, সংকটের কারণ ও ভবিষ্যত পরিকল্পনা এসব বিবরণ সম্মিলিত একটা জাতীয় তথ্যভান্ডার। পাশাপাশি খেলার মাঠ সুরক্ষায় আইন ও আইনি তৎপরতা জোরালো ও সক্রিয় হওয়া জরুরি। আবারো কেন্দুয়ার বলাইশিমূল মাঠের সুরক্ষা ও ন্যায়বিচারের দাবি জানিয়ে চলতি আলাপখানি মাঠ রক্ষার আন্দোলনে সবাইকে সক্রিয় হওয়ার আহবান জানায়।
পাভেল পার্থ।*
লেখক, প্রতিবেশ ও বৈচিত্র্য সংরক্ষণ গবেষক।