শিল্প ও সংস্কৃতি

নিজ মাতৃভাষা ও বর্ণমালা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে চর্চা জরুরী: চবিতে রঁদেভূ’র আয়োজনে বক্তারা

আইপিনিউজ (চবি প্রতিনিধি): আদিবাসীদের নিজ মাতৃভাষা ও বর্ণমালা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে চর্চা করাটা জরুরী । এসব মাতৃভাষা সংরক্ষণে সরকারের আন্তরিকতা খুবই প্রয়োজন। এসব ভাষা সমূহ রক্ষায় যথাযথ উদ্যোগ নেওয়াও সময়ের দাবী। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আদিবাসী শিক্ষার্থীদের সাংস্কৃতিক সংগঠন রঁদেভূ শিল্পীগোষ্ঠী’র মাতৃভাষায় বর্ণমালা শিক্ষা কর্মশালার সনদ বিতরণ অনুষ্ঠানে অতিথিরা এসব মন্তব্য করেন। গতকাল মঙ্গলবার  (৬ সেপ্টেম্বর ২০২২) রঁদেভূ শিল্পীগোষ্ঠী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক আয়োজিত মাসব্যাপী “মাতৃভাষায় বর্ণমালা প্রশিক্ষণ কর্মশালা-২০২২” এর প্রশিক্ষণার্থীদের সনদ বিতরণ ও সমাপনী অনুষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ও মানববিদ্যা অনুষদ ভবনের ২ নং গ্যালারীতে অনুষ্ঠিত হয়।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড.কাঞ্চন চাকমা। এছাড়াও উদ্ধোধক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের সম্মানিত ডিন অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাহবুবুল হক । এছাড়াও বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক বসুমিত্র চাকমা,আধুনিক ভাষা ইন্সটিটিউট এর প্রভাষক জেসী ডেইজী মারাক, বিশিষ্ট লেখক ও সমাজকর্মী ইয়াংঙান ম্রো, চাকমা ভাষা গবেষক ও প্রশিক্ষক ইনজেব চাঙমা প্রমুখ।
রঁদেভূ শিল্পীগোষ্ঠীর সাধারণ সম্পাদক মুন চাকমা ও সদস্য এনা চাকমার সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানের উদ্বোধক ও কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ  মাহবুবুল হকের  উদ্বোধনী বক্তব্যের মধ্য দিয়ে এই সনদ বিতরণ ও সমাপনী অনুষ্ঠানের আলোচনা সভা দুপুর ১২ঃ৩০ ঘটিকায় শুরু হয়। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন রঁদেভূ শিল্পীগোষ্ঠীর সভাপতি প্রান্তিকা চাকমা।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে ড. কাঞ্চন চাকমা বলেন, “চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পার্বত্য চট্টগ্রামের কাছাকাছি হওয়ায় বাংলাদেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে পাহাড় ও সমতল থেকে প্রতিবছর সবোর্চ্চ সংখ্যক আদিবাসী শিক্ষার্থী ভর্তি হয়।যার ফলে আদিবাসী বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন গড়ে ওঠার সুযোগটা তৈরি হয় এখানে। সেজন্য এসব শিক্ষার্থীদের মাতৃভাষায় বর্ণমালা প্রশিক্ষণ করাটা অনেক কার্যকরী বলে মনে করি”। তিনি সকল আদিবাসী শিক্ষার্থীদের নিজস্ব মাতৃভাষা চর্চা অব্যাহত রাখাসহ তা সকলের মাঝে প্রসার করার এবং এই ধরণের কার্যক্রমে আদিবাসীবান্ধব ও প্রগতিশীল ব্যাক্তিবর্গদের এগিয়ে আসারও আহ্বান জানান।
উদ্বোধনী বক্তব্য রাখছেন চবি’র সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাহবুবুল হক। ছবি- সংগৃহীত।
উদ্বোধনী বক্তব্যে অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাহবুবুল হক বলেন, “ব্রিটিশরা আসার পর থেকে পাহাড় ও সমতলে তাদের আধিপত্য বিস্তার শুরু করে।তারা পার্বত্য চট্টগ্রামকে তিনটি সার্কেলে বিভক্ত করে।পাকিস্তান আমলেও আদিবাসীদের তেমন গুরুত্ব দেয়া হয়নি।আর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাহাড়ে সংঘাত ও সামরিকায়ন শুরু হয় এবং অবশেষে ১৯১৯৭ সালে চুক্তি হয়।”
তিনি আরো বলেন, “বাংলাদেশে বসবাসরত প্রত্যেকে যদিও বাংলা ভাষায় কথা বলি কিন্তু তার পাশাপাশি যার যার নিজস্ব মাতৃভাষাও রয়েছে। এসব ভাষার অনেক শব্দ কম ব্যবহারের ফলে হারিয়ে যাচ্ছে। তাই নিজ নিজ মাতৃভাষা ও বর্ণমালা প্রজন্ম প্রজন্মান্তরে চর্চা করাটা জরুরী। রঁদেভূ’র এই ধরনের আয়োজন সেইসব মাতৃভাষাগুলো রক্ষার্থে অনেক ভূমিকা রাখবে। এছাড়াও তিনি ইয়াঙান ম্রো’র রচিত ম্রো ভাষার প্রথম ব্যাকরণ বই ‘ততোং’কে আধুনিক ভাষা ইন্সটিটিউটের সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করা হবে বলেও আশ্বাস প্রদান করেন।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বসুমিত্র চাকমা বলেন, “ভাষা একটি জাতির অস্তিত্বকে ইঙ্গিত করে। বর্তমানে দেশে বসবাসরত জাতিসমূহের মধ্যে বিজু,সাংগ্রাই, বৈসুক, বিহু মতো প্রভৃতি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমূলক অনুষ্ঠান পালনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে বাঙ্গালিদের পাশাপাশি অনেক জাতিগোষ্ঠীর অস্তিত্ব আছে তার প্রমাণ দেয়। কোনো জনগোষ্ঠীর যে যেখানে থাকিনা কেনো মূলত ভাষার মিলের কারণে আমাদের পরিচয় এক ও অভিন্ন। তাই এই ভাষাকে চর্চা ও সংরক্ষণে সরকারের উদ্যোগে মাতৃভাষায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাদান করা উচিত আর সকল জনগোষ্ঠীর ভাষা সংরক্ষণে ভাষা নিয়ে গবেষণা করা দরকার”। তিনি রঁদেভূ শিল্পীগোষ্ঠীর এইধরণের কার্যক্রম অব্যাহত করার জন্য আহ্বান জানান।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইন্সটিটিউটের প্রভাষক জেসী ডেইজী মারাক বলেন, “রঁদেভূ’র এই ধরনের কার্যক্রম প্রশংসনীয় এবং এতে  তারুণ্যের উদ্যমের বহি:প্রকাশ  ঘটেছে। এটাই সত্য যে একটি অঞ্চলে তুলনামূলক অধিক প্রচলিত ভাষার প্রভাবে অন্যান্য ছোট ছোট জাতিগোষ্ঠীর ভাষাগুলোর উপর প্রভাব পড়ে। যার ফলে এভাবে অনেক ভাষা আজ বিলুপ্তির পথে। পরিবারে সবসময় মাতৃভাষায় কথা বললেও আমরা লিখিতরূপ না শেখার কারণে ধীরে ধীরে অনেক শব্দ হারিয়ে ফেলি। তাই ভাষা সংরক্ষণে প্রজন্ম প্রজন্মান্তরে স্থানান্তরের ক্ষেত্রে লিখিত ভাষা চর্চা ও ভাষা সংরক্ষণে সচেতন থাকা উচিত এবং এক্ষেত্রে সরকারকেও আন্তরিকতার সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে।”
লেখক ও গবেষক ইয়াঙান ম্রো বলেন, “পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে ম্রো’রা তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে। এই উপলদ্ধি থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা লাভের পর  ম্রোদের ভাষাকে সংরক্ষণ ও তাদের সচেতনতার জন্য কাজ করে যাচ্ছি।”
এছাড়া তিনি ‘রেংমিটচ্য’ ভাষাকে নিয়ে ২০১৪ সাল থেকে গবেষণা শুরু করেন। তখন সেই ভাষাভাষীর  লোকসংখ্যা ছিল ৩২ আর ২০২২ সালে এসে সেই সংখ্যা হয়ে দাঁড়ায় ৬ জনে। তাই তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা সমতলের আদিবাসীদের ভাষার সংকটকে উপলদ্ধি করে আদিবাসী  সচেতন ছাত্রসমাজকে এগিয়ে আসা ও ভাষা নিয়ে গবেষণা করাটা জরুরী বলে মনে করেন এই লেখক।
চাকমা ভাষা গবেষক ও প্রশিক্ষক ইনজেব চাকমা তার বক্তব্যের মাধ্যমে পাবর্ত্য চট্টগ্রাম ও সমতলে বসবাসরত আদিবাসী জনগোষ্ঠীদের ভাষার চর্চায় তরুণ প্রজন্মকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন রঁদেভূ শিল্পীগোষ্ঠীর সাংগঠনিক সম্পাদক সজীব তালুকদার। এছাড়াও অনুষ্ঠানের শুরুতে বিভিন্ন ভাষার প্রশিক্ষণার্থীবৃন্দ এই কর্মশালাকে নিয়ে নিজস্ব অনুভূতি ব্যক্ত করেন।রঁদেভু শিল্পীগোষ্ঠীর সম্মানিত সভাপতি প্রান্তিকা চাকমার সভাপতিত্বে আলোচনা সভার সমাপ্তি হয়। আলাচনা সভা শেষে অতিথিদের মাধ্যমে মাতৃভাষায় বর্ণমালা প্রশিক্ষণ কর্মশালা-২০২২ এর প্রশিক্ষকদের ক্রেস্ট ও প্রশিক্ষণার্থীদের সনদ বিতরণ করা হয়। সবশেষে ক্ষুদ্র পরিসরে প্রশিক্ষনার্থী ও চবি আদিবাসী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়।
সনদ হাতে প্রশিক্ষণার্থীবৃন্দ। ছবি- সংগৃহীত।
উল্লেখ্য যে, গত ৩০ মে ২০২২ ‘আমার বর্ণমালা, আমার অহংকার’ এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে  রঁদেভূ শিল্পীগোষ্ঠীর উদ্যোগে আদিবাসী ‘মাতৃভাষায় বর্ণমালা প্রশিক্ষণ কর্মশালা-২০২২’ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শুরু হয়। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে ফলে অস্তিত্ব সংকটে থাকা আদিবাসীদের মাতৃভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার তরুণ-সচেতন প্রজন্মের যে দায়, সেই দায়বোধ থেকেই রঁদেভূ শিল্পীগোষ্ঠীর মাসব্যাপী এই উদ্যোগ। রঁদেভূ’র এইবারের আদিবাসী মাতৃভাষায় বর্ণমালা প্রশিক্ষণ কর্মশালায় মোট পাঁচটি আদিবাসী (রাখাইন, ম্রো, তঞ্চঙ্গ্যা, মারমা, চাকমা) ভাষার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।

Back to top button