‘শালবনের চিৎকার’ – মধুপুরের বন ও বনবাসীদের কথা
চেলসি রেমাঃ আগামী ৯ই সেপ্টেম্বর টাঙ্গাইল জেলার মধুপুরে আদিবাসীদের আবাদী জমিতে ‘লেক খননের’ প্রতিবাদে ‘শালবনের চিৎকার’ নামে সাংস্কৃতিক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। মধুপুরের আমলীতলা খেলার মাঠে এই প্রতিবাদ কর্মসূচী আয়োজন করছে সম্মিলিত আদিবাসী জনতা।
এবার একটি গল্প দিয়ে শুরু করা যাক। ধরা যাক, গল্পের মূল চরিত্র ‘রাজ্জাক’। বংশগত ভাবে নিজ পৈত্রিক ভিটায় আম-জাম-কাঁঠাল-লিচুর বাগান করলো ঋণ নিয়ে। সময় হলেই নিজ চাষের ফলফলান্ত বাজারে বিক্রির টাকা দিয়ে ঋণ শোধ করবে, সেই সাথে পরিবারের যাবতীয় প্রয়োজন মেটাবে।
একদিন গ্রামের জমিদার এসে বললো ‘ভাই! আমি তোমার জমিতে ভূগর্ভস্থ জলাধার নির্মাণ করবো। এতে করে তোমার জমির উন্নয়ন হবে। আর আমাদের গ্রাম দেখতেও অনেক মানুষ আসবে। বিনিময়ে তোমাকে আমি কিছু টাকা দেবো।’
কম জানা রাজ্জাক, ‘ভূগর্ভস্থ জলাধার’ এর অর্থ জানে না। সে বললো ‘সাহেব, আমাকে একটু সময় দিন, চিন্তা করার।’ সে পরবর্তীতে অন্যান্য জায়গা থেকে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলো, তার জমির যে দাম জমিদার প্রস্তাব করেছে, বর্তমানে তার থেকে দ্বিগুণ সেই জমির দাম। শুধু তাই নয়, একবার তার চাষের জমিতে এই জলাধার নির্মাণ হলে হয়তো নিজের বাপ দাদার জমি থেকেও তাকে উচ্ছেদ করে দিবে জমিদার সাহেব। সে তার পৈত্রিক ভিটে মাটি ছেড়ে যাবে কোথায়? খাবে কি? যেই ঋণ মাথার উপর, সে শোধ হবে কিভাবে? তার উপর এখানে তার নিজের জন্ম, ছেলেমেয়ের জন্ম। বাবা মা, দাদা, দাদীর কবর আছে। সারা পৃথিবীতে একমাত্র সম্পদ যা তার নিজের।
এবার সে জমিদারের কাছে যেয়ে, প্রস্তাব নাকোচ করে দিলো। এবার জমিদার, তার পালোয়ানদের পাঠিয়ে রীতিমত অত্যাচার শুরু করলো। ফসল নষ্ট করে দিচ্ছে, তলোয়ার নিয়ে হুমকি দিচ্ছে, অবাধ জীবনযাপণে কষ্ট আসতে লাগলো। তার বাপ দাদার কবরের উপর লেক খনন হবে এই বিষয় রাজ্জাক কোনো ভাবেই মানতে পারছে না। এদিকে, সময় এসে গেলো আম-জাম-কাঁঠাল-লিচুর। কিন্তু রাজ্জাকের সব ফসল নষ্ট। পেটে ক্ষুধা নিয়ে সে মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকে।
গল্পের শেষটার মত বাস্তব জীবনের কাহিনী বেশ ধোয়াশা।
জুলাই ৬, ২০২২। একটি ভিডিও তে দেখা যায়, কিছু ব্যাক্তি অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে আছে। সেখানে একজন আদিবাসী নারী বার বার বলছে ‘এ জমি তো আদিম যুগ থেকে আমাদের। এখানে চাষ করে খাচ্ছি।’ এবং সেই অস্ত্র সহ ব্যাক্তিরা বার বার বলছে ‘কাগজ নিয়ে আসেন। কাগজ নিয়ে আসেন। কথায় বললেই হবে না। ’ এক পর্যায়ে তিনি বলতে শুরু করলেন ‘আমি সরকারী চাকরীজীবি। জোরে পারবেন না। গুলি করে মেরে ফেলবো।’ কথিত সশস্ত্র ব্যাক্তিটি টাঙ্গাইল বনবিভাগ সরকারি রেঞ্জ কর্মকর্তা ‘ইসমাইল হোসেন’।
ভিডিও লিঙ্কঃ https://www.facebook.com/ipnewsbd/videos/499482278617605
আইএলও কনভেনশন ১০৭, অনুচ্ছেদ ১২ অনুযায়ী, ‘জাতীয় নিরাপত্তা কিংবা জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন কিংবা সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য সম্পর্কিত কারণে দেশের আইন এবং বিধি ব্যতিরেকে সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীকে তাদের আবাসভূমি থেকে তাদের স্বাধীন সম্মতি ছাড়া বাস্তচ্যুত করা যাবে না।’
উপধারা নং ০৩ : আদিবাসী জনগণ যে ভূমির ওপর দীর্ঘদিন ধরে বসবাস ও অধিকার ভোগ করে আসছে যা ব্যক্তিগত কিংবা সমষ্টিগত হতে পারে, তা রাষ্ট্রকে স্বীকার করতে হবে।
ক. ঐতিহ্যগত অলিখিত সংস্কৃতি : এই ধারায় একটি ভূখন্ড- ও তার যত সম্পদ বংশ পরম্পরায় একটি গোষ্ঠী বা একাধিক গোষ্ঠী ভোগ দখল করতে পারবে। এতে কাগজপত্রের কোন প্রয়োজন পরে না, কারণ ভূমির মালিক জনসমষ্টি।
অর্থাৎ কাগজ বা দলিল থাকুক বা না থাকুক, আদিবাসীরা যে বনে বা জমিতে বাস করে ঐতিহ্যগতভাবে সেটি তাদের।
মধুপুরের দোখলা এলাকার চুনিয়া গ্রামে, গারোদের ফসলি জমির উপর ‘লেক’ প্রতিষ্ঠার ঘোষনা যখন আসে তখন কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বিষয়টি গুজব বলে এড়িয়ে গেলেও পরবর্তীতে ২-৩ মাস পর জলছত্র হরিসভাতে এসে তিনি প্রকাশ্যে বলেন, আদিবাসীদের জন্য একটি উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ব্যাপারটাকে এমন ভাবে বলা হয়েছিলো, যা সাধারণ আদিবাসীদের জন্য বোঝা জটিল ছিল।
পরবর্তীতে সে ব্যাপারটি পরিষ্কার ভাবে বোঝা গেলে, আদিবাসীরা বিভিন্ন ভাবে প্রতিবাদ জানায়। এবং বরাবরের মতই গল্পের পালোয়ানদের চরিত্রে থাকে ‘টাঙ্গাইল বনবিভাগ’। যার ফলে আদিবাসীদের জীবনযাত্রা আবারো হুমকির মুখে পরে যায়।
যার প্রেক্ষিতে ৯ই সেপ্টেম্বর ২০২২ তারিখ বিকেল ৩ টায় ‘শালবনের চিৎকার’ নামে মধুপুরের আমলীতলী খেলার মাঠে গানে গানে প্রতিবাদ কর্মসূচীর আয়োজন হচ্ছে। এতে গান গাইবে মাদল, কফিল আহমেদ, সমগীত, আচিক ব্লুস, রংখেক রংসা ও সবুজ মাজি।
এই উদ্যোগের সদস্য সচিব লিয়াং রিছিলের মতে ‘আদিবাসীরা নিবিড় ভাবে প্রকৃতি,,বন ও পাহাড়ের সাথে জড়িয়ে আছে। ‘সংরক্ষিত বন’ ঘোষণার পর আমাদের জীবনযাত্রা হুমকির পথে। তবে আমরা ত্রিদলীয় সার্ভের জন্য বরাবরই আবেদন করে এসেছি। অর্থাৎ আদিবাসী, বনবিভাগ এবং রাজস্ব আলাদা করে চিহ্নিত করা হোক। আদিবাসীরা যে জায়গায় বংশ পরম্পরায় বাস করে সেই জায়গাটি এবং বনভূমি কতটুকু আছে সেটি সুচিহ্নিত করা হোক। আর আদিবাসীদের যে জায়গা-জমি আছে তা স্থায়ীভাবে বন্দোবস্ত করে দেয়া হোক।’
তিনি আরও বলেন ‘শালবনের প্রতি যে অন্যায়গুলো ঘটছে তার প্রতিবাদ শালবনের পক্ষে করা সম্ভব নয়। তাই লেখক সহ, তরুণ-তরুণী এবং গানপ্রিয় মানুষের অংশগ্রহণের মাধ্যমে শালবনের হয়ে আমরা প্রতিবাদ করছি তাই এর নাম রেখেছি ‘শালবনের চিৎকার’। আমাদের প্রত্যাশা, শালবন ও এই বনকে অবলম্বন করে বসবাসরত আদিবাসীদের অধিকারের কথা গানে গানে ছড়িয়ে যাবে মুক্তিকামী গণমানুষের কাছে।
শালবন বিস্তৃত মধুপুরকে স্থানীয় গারো সম্প্রদায় বলে ‘আ’বিমা।’ অর্থাৎ ‘মায়ের মাটি’। এই ‘মায়ের মাটি’-কে ঘিরে খবরাখবর এই প্রথম নয়। বনবিভাগের উন্নয়নের নামে বিভিন্ন প্রকল্প যেমন ইকোপার্ক এবং বিদেশী বিভিন্ন উদ্ভিদ ও বাগানের চর্চায়, একরকম বলির শিকার মধুপুর। ১৯৫৫ সালে মধুপুরের শালবনের কিছু অংশ ‘সংরক্ষিত বন’ হিসেবে ঘোষণা করে দেয়া হয়। যার অর্থ, সেই সংরক্ষিত অংশে গোচারণ, বসতি স্থাপন থেকে শুরু করে পাতা পর্যন্ত সংরক্ষন করা সহ বিভিন্ন বিধিনিষেধ প্রয়োগ করা।
এরপর এরশাদের সময়, ১৯৮২ সালে ‘ন্যাশনাল পার্ক’ গঠনের ঘোষনা হয়। ১৯৭৭ থেকে ১৯৭৮ সালে গারো গ্রাম উচ্ছেদ করে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণের জন্য ‘ফায়ারিং রেঞ্জ’ নির্মাণ করা হয়। এরপর ২০০০ সালে এডিপি ও বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে বনবিভাগ ‘ইকোপার্ক’ প্রকল্প করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এই প্রকল্প অনুযায়ী ৬টি পিকনিক স্পট ও ১০টি ব্যারাক নির্মাণের সম্ভাবনা ছিলো। বনের ও নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় আদিবাসীদের প্রতিবাদের মুখে, প্রকল্পটি বাতিল হয়। তবে মূল্য হিসেবে, এতে নিহত হয় ‘পীরেন স্নাল’ এবং আজীবন পঙ্গুত্ব লাভ করেন ‘উৎপল নকরেক’।
গারো আদিবাসীদের নিজস্ব ধর্ম সাংসারেক। অতীতে প্রকৃতির পূজারী ছিলো এই আদিবাসী গোষ্ঠী। কালের বিবর্তনে খ্রিষ্ট ধর্ম গ্রহন করলেও, গারো আদিবাসীরা এখনো বনকে অবলম্বন করেই বাঁচতে চায়। তাদের উচ্ছেদ আতংক থেকে তারা মুক্তি চায়। স্থায়ী বন্দোবস্ত হোক এবং বন ও বনবাসীদের সহাবস্থানের মাধ্যমে সুন্দর ধরণী গড়ে উঠুক।