মতামত ও বিশ্লেষণ

দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরি চাই! পাভেল পার্থ

সবেমাত্র প্রাথমিকের বৃত্তি পরীক্ষা শেষ হয়েছে। ছুটিতে শ্রীমঙ্গলে মামার বাড়িতে। তেলতেলে লম্বা বারান্দা, বিশাল এক রান্নাঘর, সানবাঁধানো পুকুর আর বেতের সোফাভর্তি সাজানো পোর্টিকো। কালারাম উড়িয়া নামে একজন কামলা খাটতো ওই বাড়িতে। একদিন কালারামের সাথে লুকিয়ে চলে যাই দূরের এক চাবাগানে। উদনাছড়ায়। দুপুর ঘনায় কিন্তু কোনো খাবার দেয় না কেউ। সন্ধ্যায় রুটির সাথে এক থকথকে তরকারি জোগাড় হয়। আর শুরু হয় গান। অচিন ভাষার সেই গানের কোনো অর্থ না বুঝলেও নাড়িয়ে দিয়েছিল আমার অবুঝ শৈশব। অনেক পরে জেনেছিলাম ঐসময় চাবাগানে চলছিল ‘হাতবন্ধ আন্দোলন’। মজুরি কম বলে কয়েক পয়সা মজুরি বাড়ানোর জন্য অনাহারে ছিল বাগানের পর বাগান। এরপর বড় হতে হতে বহুবার দেখেছি ’চাবাগানের মজুরি আন্দোলন’। আজো চাবাগানে এই আন্দোলন চলছে। দিনে মাত্র ৩০০ টাকা মজুরির জন্য। দৈনিক ১২০ টাকা মজুরি দিয়ে একটা সংসার চলে কীনা এটি এখন এক পাবলিক আলাপ-তর্ক। আন্দোলন এখন এক ত্রিমুখী ধারা তৈরি করেছে। বলা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী এই মজুরি তর্কের এক ন্যায্য হিস্যা করবেন। আন্দোলনরত প্রধান ধারা প্রধানমন্ত্রীর দিকে চেয়ে আছেন। প্রধানমন্ত্রী টেলিভিশনে এসে ৩০০ টাকা মজুরির ঘোষণা দিলেই সবাই কাজে ফিরে যাবেন। এর ভেতর ২৫ টাকা বাড়িয়ে মজুরি ১৪৫ টাকার প্রস্তাব এসেছে এবং আন্দোলন স্থগিত করে আপাতত ১২০ টাকার মজুরিতে কাজে নিয়োগ করতে বলা হচ্ছে সবাইকে। চাশ্রমিক ইউনিয়নের শীর্ষ পর্যায়ের কিছু নেতৃবৃন্দ এ বিষয়টি মেনে নিয়েছেন। কিন্তু আন্দোলনের প্রধান ধারা এই নেতৃত্বের ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না। এ ঘটনাকে বড় নেতাদের ‘আপোষ’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে এমন ‘আপোষকামী’ নেতাদের নানা বাগানে চাশ্রমিকেরা তিরস্কারও করছেন । আর তৃতীয় ধারাটি হলো নয়াউদারবাদী করপোরেট ধারা। যাকে সহজেই দুম করে আমরা ‘মালিকপক্ষ’ বলে ফেলি। চাবাগানের ‘মালিকানা’ নি:সন্দেহে অপরাপর শিল্পের মালিকানার মতো নয়। এখানে পারিবারিক উত্তরাধিকারী বা শৌখিন উদ্যোক্তা আছেন, ফিনলে-ডানকান-ইউনিলিভারের মতো করপোরেট আছে, আবার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানও আছে। তো তৃতীয় ধারাটি কেবল ‘মালিক-শ্রমিক’ দ্ব›দ্ব-সমীকরণের সাথে জড়িত নয়। নয়াউদারবাদী বাজার ও মুনাফা নিয়ন্ত্রণের রাজনীতির সাথে এর গভীর সম্পর্ক। আর এই তৃতীয় পক্ষটিই প্রচার করছে ‘আন্দোলনের মাধ্যমে একটি শিল্প ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে’, ‘চাপাতা তোলার ভরা মৌসুমে শ্রমিকদের আন্দোলন করা ঠিক হচ্ছে না’, ‘শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানো সম্ভব নয়’ ইত্যাদি। মজুরি বিষয়ে তৃতীয়পক্ষের মহামিথ্যা এজেন্ডা কেউ বিশ্বাস করছে না। চলতি আলাপখানি চাবাগানের চলমান আন্দোলনে একাত্ম হয়ে দৈনিক মজুরি ৩০০ টাকা দাবি করছে।

৩০০ টাকা মজুরি আন্দোলন
চাশ্রমিকের দৈনিক মজুরি নির্ধারণ বিষয়ে প্রতি দুই বছর পরপর চাশ্রমিকদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ চাশ্রমিক ইউনিয়ন’ এবং বাগান মালিকদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ চা সংসদের’ ভেতর দ্বিপাক্ষিক চুক্তি হয়। সর্বশেষ চুক্তির মেয়ার শেষ হয়েছে ২০২০ সনের ডিসেম্বরে। কিন্তু দীর্ঘ ১৯ মাসেও কোনো নতুন চুক্তি হয়নি। এক দু:সহ করোনা মহামারীকাল আর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গোটা দুনিয়া আজ বিপর্যস্ত। জিনিসপত্রের অস্বাভাবিক দাম কিংবা ন্যূনতম বেঁচে থাকার প্রশ্ন আজ হুমকীর মুখে। জীবাশ্ম জ্বালানির সংকট আর বৈশ্বিক বাজারের রাজনীতি রাষ্ট্রসমূহেকে নানা নয়া সিদ্ধান্ত ও কৌশল গ্রহণ করতে বাধ্য করেছে। অথচ এক চাবাগান প্রশ্নে আমরা নির্বিকার। রাষ্ট্র, করপোরেট, এজেন্সি, ক্রেতা-বিক্রেতা-ভোক্তা, মিডিয়া কী নাগরিক প্রতিক্রিয়া সকলেই। যদিও চাবাগান নিয়ে ‘মূলধারার’ এই প্রবল নিষ্ক্রিয়তা বা উপনিবেশিক ঝিমিয়ে পড়া নতুন কোনো প্রবণতা নয়, এটি ঐতিহাসিক। গার্মেন্টস শ্রমিকেরা মজুরির জন্য রাস্তায় নামলে বা লকডাউনে ভিড়ের চাপে ফেরি পার হলে আমাদের ছিঁচকাদুনে নাগরিক প্রতিক্রিয়া কিছুটা হলেও নাকের জলে চোখের জলে ‘সর্দি’ তৈরি করে। কিন্তু চাবাগানে একের পর নির্মমতা, নিপীড়ন, অন্যায়, জবরদস্তি, দাসত্ব চলে। এসব নিয়ে আমরা কেন জানি কখনোই ‘রা’ করিনা। এর একটা কারণ হতে পারে এই চাশ্রমিকদের গরিষ্ঠভাগই ‘অবাঙালি’, আদিবাসী জনগণ। চাশ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি নিয়ে চা শ্রমিক ইউনিয়ন ও চা সংসদের ভেতর ২০২২ সনের জুন মাসে একটি বৈঠক হয়। এই বৈঠকে শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ৩০০ টাকা করার প্রস্তাব দেয় চাশ্রমিক ইউনিয়ন। কিন্তু চা সংসদ মাত্র ১৪ টাকা বাড়িয়ে দৈনিক ১৩৪ টাকা নতুন মজুরি প্রস্তাব করেন। ২০২২ সনের ৩ আগস্ট চাশ্রমিকেরা ৩০০ টাকা মজুরির জন্য মালিকপক্ষকে সাত দিনের আলটিমেটাম দেন। কিন্তু মালিকপক্ষ চাশ্রকিদের এই দীর্ঘ সময়ের দাবিকে কোনো গুরুত্বই দেয় না। বাধ্য হয়ে চাবাগানে আবারো আন্দোলন শুরু করতে বাধ্য হন চাশ্রমিকেরা। ৯-১২ আগস্ট ২০২২ টানা চারদিন প্রতিদিন দুই ঘন্টা করে কর্মবরিতি ও ধর্মঘট পালিত। ১১ আগস্ট বিভাগীয় শ্রম অধিদপ্তর চাশ্রমিক ইউনিয়ন ও মালিকপক্ষকে নিয়ে একটি সমঝোতা বৈঠক ডাকে, কিন্তু সেখানে মালিকপক্ষের কেউ না যাওয়ায় কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই এ বৈঠক শেষ হয়। বাধ্য হয়ে আবারো ১৩ আগস্ট থেকে ধর্মঘট শুরু করেন ২৩১টি চাবাগানের চাশ্রমিকেরা। ১৪ আগস্ট মৌলভীবাজারসহ দেশের প্রায় সব চাবাগানে কর্মবরিতির পাশাপাশি বিক্ষোভ মিছিল ও সড়কপথ অবরোধ করে শ্রমিকেরা। পরবর্তীতে ১৬ আগস্ট থেকে ফের কর্মবরিত ও বিক্ষোভ সমাবেশ চলতে থাকে। ১৬ আগস্ট শ্রীমঙ্গলে শ্রম অধিপ্তরের কার্যালয়ে চাশ্রমিক ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দকে নিয়ে এক বৈঠক করেন শ্রম অধিদপ্তরের মহাপিিরচালক। চাশ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মাখন লাল কর্মকার, ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নৃপেন পাল, সাতটি ভ্যালির সভাপতিসহ প্রায় ৪০ জন চাশ্রমিক নেতৃবৃন্দ অংশ নেন। ২১ আগস্ট ২০২২ শ্রীমঙ্গলে চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাথে শ্রম অধিপ্তরের বৈঠক হয়। এই বৈঠকে মজুরি ২৫ টাকা বাড়িয়ে ১৪৫ টাকা করার প্রস্তাব কিছু শীর্ষ নেতা মেনে নেন। ২২ আগস্ট মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসকের উদ্যোগে আরেক বৈঠক হয়। ঐ বৈঠকে ১২০ টাকা মজুরিতেই কাজে যোগ দেবেন বলে যৌথ বিবৃতিতে সই করেন চাশ্রমিক ইউনিয়নের কিছু শীর্ষ নেতা। প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠক করে শ্রমিকদের নতুন মজুরি ঘোষণার আশ্বাস দেয়া হয়। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত মেনে নেয়নি সাধারণ চাশ্রমিকেরা। ২২ আগস্ট সিলেট ভ্যালির ৪টি বাগানের কিছু শ্রমিক কাজে যোগ দেন। ২৩ আগস্ট সিলেট গলফ ক্লাবে সিলেট ভ্যালির ২৩টি চাবাগানের প ায়েত প্রতিনিধিদের সাথে দিনভর আলোচনা করে চাশ্রমিক ইউনিয়নের কিছু নেতা। কিন্তু চাশ্রমিকরো আবারো ২৩ আগস্ট থেকে কর্মবিরতি ও আন্দোলন অব্যাহত রেখেছেন। শ্রম দপ্তর আবরো ২৮ আগস্ট শ্রমিক-মালিক উভয়পক্ষের সাথে একটি সমঝোতা বৈঠকের কথা জানিয়েছেন।

চা শ্রমিকের আহামরি সুখ!
২০০৬ সনে একজন চাশ্রমিকের দৈনিক মজুরি ছিল ৩০ টাকা। ২০০৮ সনে একজন চাশ্রমিকের মজুরি ছিল দৈনিক ৩২ টাকা। ২০০৯ সনে নি¤œতম মজুরি বোর্ড সর্বনিম্ন মজুরি নির্ধারণ করে ৪৫ টাকা এবং সর্বোচ্চ ৪৮ টাকা। ২০১৫ সনে দৈনিক মজুরি ৮৫ টাকা হলেও অনেক বাগানে দেয়া হত ৭৯ টাকা। বর্তমানে এই মজুরি ১২০ টাকা। কিন্তু কীভাবে এই মজুরি নির্ধারিত হয় এবং এটি কী সবার জন্য একইরকম? ১৯৬২ সনের ‘দ্য টি প্লান্টেশন লেবার অর্ডিন্যান্স’ এবং ১৯৭৭ সনের ‘দ্য টি প্লান্টেশন লেবার রুলস’ দ্বারা চাশ্রমিকদের ‘কল্যাণ’ নিয়ন্ত্রিত হতো। পরবর্তীতে ২০০৬ সনের বাংলাদেশ শ্রম আইনে চাবাগানকে অর্ন্তভূক্ত করা হয়। চাশ্রমিকদের মজুরি নির্ধারিত হয় শ্রমিক পক্ষের প্রতিনিধি চাশ্রমিক ইউনিয়ন এবং মালিক পক্ষের প্রতিনিধি বাংলাদেশীয় চাসংসদের ভেতর সম্পাদিত চুক্তির মাধ্যমে। সর্বশেষ চুক্তিপত্রটি কার্যকর হয় ২০০৫ সনে এবং ২০০৭ সনে চুক্তির মেয়াদ শেষ হলেও দেশে জরুরি অবস্থার কারণে তখন চুক্তি হয়নি। প্রতি পাঁচ বছর পরপর মজুরী বোর্ড গঠন করে চাশ্রমিকের মজুরি নির্ধারণ করার কথা থাকলেও দীর্ঘ ১১ বছর পর করোনাকালে গেজেট আকারে চাশ্রমিকদের মজুরি কাঠামো প্রস্তাব করা হয়। গেজেটে সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার চাবাগানগুলোকে এ, বি এবং সি শ্রেণিতে এবং চট্টগ্রাম, রাঙামাটি ও অন্যান্য জেলার চাবাগানকে ১, ২ ও ৩ ক্যাটাগরিতে ভাগ করে মজুরি প্রস্তাব করা হয়েছে। বছরে ১,৮০,০০০ কেজি বা তারচে বেশি চা উৎপাদন করে এমন বাগান এ শ্রেণি এবং ১,০৮,০০০ কেজির কম উৎপাদন করে চাবাগানগুলো সি শ্রেণির। এ-শ্রেণির বাগানের স্থায়ী এবং সাময়িক/ক্যাজুয়াল শ্রমিকের জন্য দৈনিক ১২০ টাকা, বি-শ্রেণির বাগানের জন্য ১১৮ টাকা এবং সি-শ্রেণির বাগানের জন্য ১১৭ টাকা প্রস্তাব করে মজুরী বোর্ড। তবে এই মজুরি নানা শর্তের শেকলে বন্দি। দিনে ন্যূনতম ২৩ কেজি চাপাতা তুলতে পারলে এই মজুরি পাওয়া যায়। আর এই নির্ধারণ সীমার নাম ‘নিরিখ’। নিরিখের চেয়ে বেশি তুলতে পারলে প্রতি কেজির জন্য ৪ টাকা ২৫ পয়সা আর কম তুললে প্রতি কেজির জন্য কাটা হয় ৫ টাকা ২০ পয়সা। এই মজুরি ছাড়া আছে সাপ্তাহিক রেশন। একজন স্থায়ী শ্রমিক পুরুষ হলে তার পরিবার পাবে ৩ কেজি ২০০ গ্রাম আটা এবং শ্রমিক নারী হলে পাবে ২ কেজি ৪০০ গ্রাম। মজুরি আর রেশনের পর কিছু স্থায়ী শ্রমিক পরিবার পায় ক্ষেতল্যান্ড জমি। একজন স্থায়ী শ্রমিক চাবাগানে মাত্র এক কেয়ার (১ একর = ২.৪৭ কেয়ার) ক্ষেল্যান্ড জমিতে চাষাবাদের এই সুযোগ পান। আমন ও বোরো মওসুমে ধান আবাদ ছাড়াও কিছু মওসুমি শাকসব্জি ফলে এসব জমিনে। এক কেয়ার জমির জন্য বরাদ্দকৃত রেশন থেকে চাবাগান কর্তৃপক্ষে বছরে ৮০ কেজি চাল বা গম কর্তন করে। যদিও পরিসংখ্যান বলে, দেশে মাথাপিছু আবাদি জমির পরিমাণ ০.২৮ একর। এছাড়া শ্রমিকেরা তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে গাদাগাদি করে থাকার জন্য ‘লেবার লাইনে’ চৌদ্দ হাতের একখানি ঘর পান।

মালিকপক্ষের মিথ্যাচার
বাংলাদেশের চা উন্নয়ন বোর্ডের হিসাবে দেশে চাবাগান ১৬৭ টি। ১৬৭ বছর ধরে চা উৎপাদন করেও চাশ্রমিকের মজুরি ১৬৭ টাকা পর্যন্ত হয়নি। চলমান ৩০০ টাকা মজুরির আন্দোলনকে অস্বীকার করে মালিকপক্ষ গণমাধ্যমে বলছেন, চাশ্রমিকেরা মজুরি ছাড়াও অন্যান্য সুবিধা মিলিয়ে দৈনিক ৪০২ টাকা আয় করেন। ২০০৬ সনের ৪২ নং আইন হিসেবে দেশে গৃহীত হয় ‘শ্রম আইন ২০০৬’। উক্ত আইন অনুযায়ী চাবাগানসহ দেশের শ্রমিকের ‘মজুরীর’ সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছে রাষ্ট্র। আজ যখন চাবাগানে এত কম মজুরি কেন এই প্রশ্ন ওঠেছে দেশজুড়ে এবং পক্ষ-বিপক্ষ সকল মানুষ বলছেন, ‘১২০ টাকা দিয়ে এই দিনে কীভাবে হয়’? কিন্তু মালিকপক্ষ তারপরও মিথ্যা অংকের যোগফল টেনে সাফাই গাইছেন, চাবাগানে শ্রমিকের মজুরি কম নয়। মানে চাবাগানের মালিকেরা ‘মানবিক’ এবং তারা শ্রমিকদের কমেরও কম মজুরি দেন না। কিন্তু মালিকপক্ষ যেসব হিসাবকে শ্রমিকের মজুরির সাথে যোগ করেছেন তা কোনোভাবেই ‘মজুরি’ নয়, এক্ষেত্রে মালিকপক্ষের ৪০২ টাকার হিসাব শ্রম আইনের সংজ্ঞাকে লংঘন করে। শ্রম আইনের ২(৪৫) ধারায় উল্লেখ আছে, বাসস্থান, আলো, পানি, চিকিৎসা সুবিধা, অন্যকোনো সুবিধা, অবসর ভাতা, ভ্রমণ ভাতা বা ভবিষ্যত তহবিল ইত্যাদি মালিক কর্তৃক প্রদেয় ‘মজুরির টাকায়’ অর্ন্তভূক্ত হবে না। ১০ লাখ চাবাগানির সাথে মজুরি নিয়ে আজ যখন এক পাবলিক তর্ক ওঠেছে তখন মজুরি বিষয়ে কোনো বক্তব্যের ক্ষেত্রে চাবাগানের মালিকপক্ষকে অবশ্যই রাষ্ট্রীয় আইন ও নীতিকে মান্য করতে হবে।

উদোর পিন্ডি কেন চাশ্রমিকের ঘাড়ে?
চাশিল্পের উদ্যোক্তা ও সিলেট মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি গণমাধ্যমে বলেছেন, …৩০০ টাকা মজুরি দিতে গেলে একটি বাগানও টিকবে না। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর ২৫ টাকা মজুরি বাড়ানোর প্রস্তাব বাস্তবায়ন করতে গেলেও উৎপাদন খরচ প্রতি কেজিতে ২০০ টাকা ছাড়িয়ে যাবে। একটি সিন্ডিকেট চায়ের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে তাই চায়ের দাম বাড়িয়ে শ্রমিকদের বেতন বাড়ানো যাচ্ছে না বলে মন্তব্য করেন তিনি। কিন্তু এইরকমের কোনো সিন্ডিকেটের জন্য কেন চাশ্রমিকের ভোগান্তি হবে? কেন তার মজুরি বাড়বে না? এই সিন্ডিকেট কারা বহাল রাখছে? এর দেখভালের দায়িত্ব কার? চা সংসদ সিলেট ভ্যালির সভাপতি গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন…চায়ের গুণগত মান কমে যাওয়া, উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি, রপ্তানি কমে যাওয়া, ভারত থেকে অবৈধভাবে চা আমদানিসহ নানা কারণে দেশের চাশিল্প ঝুঁকিতে আছে। এ অবস্থায় শ্রমিকদের ৩০০ টাকা মজুরির দাবি পূরণ করতে গেলে চাশিল্প আরো সংকটে পড়বে বলে তিনি জানান। মালিকপক্ষের এই ভাষ্য কোনোভাবেই চাশ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধির সাথে সম্পর্কিত নয়। চাশিল্পের ঝুঁকি বাড়বে যদি শ্রমিক অসুস্থ ও অনাহারী থাকে। নিরানন্দ আর হতাশা ঘিরে থাকে চারপাশ। বহুজাতিক বাজার, মুনাফার রাজনীতি আর দখলিপনার সংস্কৃতিকে প্রশ্ন না করে বারবার কেন চাশ্রমিকের ঘাড়ে উদোর পিন্ডি চাপানোর চেষ্টা চলে? স্মরণে রাখা জরুরি করোনা মহামারিতে দেশ-দুনিয়া লকডাউন হলেও চাবাগান নির্ঘুম ছিল। বাংলাদেশ চা সংসদের হিসাবে ২০২১ সনে দেশে রেকর্ড ৯ কোটি ৬৫ লাখ কেজি চা উৎপাদিত হয় এবং ২০১৯ সনে হয় ৯ কোটি ৬০ লাখ কেজি। জীবন দিয়ে চাশিল্পকে চাঙ্গা রাখা চাশ্রমিকের কোনো স্বীকৃতি ও মর্যাদা এখনো নিশ্চিত করেনি রাষ্ট্র। চলমান ৩০০ টাকা মজুরি আন্দোলন সফল হোক। আশা করি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি নিশ্চিত করবেন।

পাভেল পার্থ, গবেষক ও লেখক। ই-মেইল:[email protected]

Back to top button