পার্বত্যাঞ্চলে প্রলয়ঙ্করী পাহাড়ধসে ১৩১ জন নিহত, ২২৭ জন আহত ও ১৫,০০০ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত
নিজস্ব প্রতিবেদকঃ তীব্র বজ্রপাত ও মেঘের গর্জনসহ কয়েকদিন ধরে অবিরাম বৃষ্টির ফলে গত ১৩ জুন ২০১৭ রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলায় ব্যাপক পাহাড় ধস ঘটে। এর ফলে কেবল রাঙ্গামাটি জেলায় ১২১ জনসহ বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলায় কমপক্ষে ১৭০ লোকের প্রাণহানি ঘটে। এর পাশাপাশি ২২৭ জন আহত হয় বলে জানা যায়। এছাড়া রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান জেলাধীন বিভিন্ন উপজেলায় পাহাড় ধসের ফলে হাজার হাজার একরের বাগান-বাগিচা, ধান্য জমি ও ফসল, বসতভিটার ক্ষতি হয়। তিন পার্বত্য জেলায় ভূমিধস ও পাহাড়ী ঢলের আঘাতে যে প্রলয়ঙ্করী ঘটনা ঘটেছে তাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে রাঙ্গামাটি শহর এলাকা। প্রশাসনের তালিকা অনুসারে রাঙ্গামাটি জেলার মধ্যে রাঙ্গামাটি পৌরভাসহ রাঙ্গামাটি সদর, কাউখালী, কাপ্তাই, জুরাছড়ি, বিলাইছড়ি, রাজস্থলী ও নানিয়ারচর উপজেলায় ১২,৪৫০ পরিবারসহ তিন পার্বত্য জেলায় ১৫,০০০-এর অধিক পরিবার ক্ষতির শিকার হয় বলে জানা যায়। কাপ্তাই হ্রদের জলেভাসা জমিসহ প্রত্যক্ষ অ লে ফসলী জমি ও ফলজ বাগানের ব্যাপক ক্ষতির ফলে ভবিষ্যতে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় খাদ্যাভাব দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
১. রাঙ্গামাটি জেলার ক্ষয়ক্ষতি
মুষলধারে বৃষ্টি ও ভুমিধসের ফলে রাঙামাটি জেলাতেই ১৪৫টি স্থানে পাহাড়ে ধস হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষযক মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। রাঙ্গামাটি শহরের সাথে চট্টগ্রাম সড়ক, খাগড়াছড়ি সড়ক ও কাপ্তাই সড়ক এবং ঘাগড়া-বরইছড়ি সড়কের ব্যাপক ক্ষতি হয়। এর মধ্যে রাঙামাটি-চট্টগ্রামসড়কের ২০ কিলোমিটারের প্রায় ৫০টি স্থান নজিরবিহীনভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে। সাপছড়ি এলাকায় ব্যাপক ভূমিধসে সাপছড়ি শাল বাগান এলাকায় ১৫০ ফুট নিচে দেবে যায় ও রাস্তা অকেজো হয়ে পড়ে। মঘাইছড়ি থেকে রাঙামাটি শহরের মানিকছড়ি পর্যন্ত সড়কের দুই পাশের এবং নিকটবর্তী অন্তত ১৬টি পাহাড়ের ভয়াবহ ধসজনিত ফাটল দেখা যাচ্ছে। সড়কটির অন্তত ২৫টি অংশের অর্ধেক ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। রাঙ্গামাটি জেলায় অনেক বিদ্যুৎ খুঁটি ভেঙ্গে যায়। ফলে পাঁচদিন পর্যন্ত রাঙ্গামাটি জেলা বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকে।
রাঙ্গামাটি-খাগড়াছড়ি সড়কের কুতুকছড়ি ইউনিয়নের খামার পাড়ায় রাস্তা দেবে যাওয়াসহ বিভিন্ন জায়গায় রাস্তা সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়ে। ফলে রাঙ্গামাটি থেকে চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের সাথে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। জরুরী ভিত্তিতে রাঙ্গামাটি থেকে কাপ্তাই জলপথে ল সার্ভিস চালু করা হয় এবং কাপ্তাই-চট্টগ্রাম সড়কের মাধ্যমে চট্টগ্রাম ও ঢাকার সাথে যোগাযোগের সাময়িক বিকল্প ব্যবস্থা চালু করা হয়। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ার ফলে ভূমিধস পরবর্তী কয়েক দিনে রাঙ্গামাটি শহরে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের ব্যাপক অভাব দেখা দেয়। বিশেষ করে জ্বালানী তেলের সংকট দেখা দেয়। বাজারে যে পরিমাণ রয়েছে এর মূল্য দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে যায়। সড়ক যোগাযোগ বন্ধ থাকার ফলে সৃষ্ট দ্রব্যমূল্যের প্রভাব জেলাধীন অপরাপর উপজেলাগুলোয়ও বিপর্যয় নেমে আসে।
রাঙ্গামাটি জেলার মধ্যে ভূমিধসে রাঙ্গামাটি সদর উপজেলায় ৫ জন সেনাসদস্যসহ ৭৪ জন, কাউখালীতে ২১ জন, কাপ্তাইয়ে ১৮ জন, জুরাছড়িতে ৬ জন ও বিলাইছড়ি উপজেলায় ২ জনের মৃত্যু হয় বলে জানা যায়। তার মধ্যে পাহাড়ি ৬১ জন ও বাঙালি ৬০ জন। রাঙ্গামাটি জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে রাঙ্গামাটি শহর এলাকা। রাঙ্গামাটি জেলা শহরে শত শত মানুষের ঘরবাড়ি ও সহায়-সম্পত্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রাঙ্গামাটি পৌরসভার ৬নং ওয়ার্ডের কেবল ভেদভেদী, রাঙ্গাপানি, মোন আদাম, উদন্দী আদাম, মোনঘর এলাকায় মাটি চাপা পড়ে ২২ জন জুম্ম নিহত হয় এবং ২০৭ জুম্ম পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসব এলাকায় ঢালু পাহাড়ের ভূমিও ধসে পড়ে। ফলে শত শত একরের ফলজ ও বৃক্ষ বাগান ধ্বংস হয় এবং ধসে পড়া মাটির ফলে পাহাড়ের লাগোয়া শত শত একরের ধান্যজমি ভরাট হয়ে যায়, যা চাষাবাদের অনুপযুক্ত হয়ে পড়ে। এছাড়া ৫নং ওয়ার্ডের খিপ্যা পাড়া, ত ঙ্গ্যা পাড়া, বিলাইছড়ি পাড়া, আসামবস্তী ইত্যাদি গ্রামের ১৪১ পরিবার এবং ৯নং ওয়ার্ডের ভালেদী, বিহারপুর, উলুছড়া ইত্যাদি এলাকায় ব্যাপক ভূমিধসের ফলে ১৪২ পরিবারের ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং তাদের ঘরবাড়ি বসবাসের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। পাহাড় ধসে রাঙ্গামাটিতে বাংলাদেশ টেলিভিশন উপকেন্দ্র, বাংলাদেশ বেতার রাঙ্গামাটি উপকেন্দ্র, পাসপোর্ট অফিস, ডিসি বাংলো, এসপি বাংলো, মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস, সার্কিট হাউস, রাঙামাটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ইনস্টিটিউটের জাদুঘর ও ডরমিটরি ভবন, সমাজসেবা কার্যালয়, এলজিইডি অফিস, ফিশারি ঘাট, মৎস্য ভবন বাংলোসহ শত কোটি টাকার গুরুত্বপূর্ণ অন্তত ১৫টি স্থাপনা নিয়ে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
রাঙ্গামাটি জেলার আওতাধীন দশটি উপজেলাও ভূমিধসে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। বিশেষ করে রাঙ্গামাটি সদর, কাউখালী, কাপ্তাই, জুরাছড়ি, বিলাইছড়ি ইত্যাদি উপজেলায় ঘরবাড়ি, শত শত একরের ফলজ ও বৃক্ষ বাগান এবং ফলসী জমির ক্ষতি হয়। টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের কারণে কাপ্তাই হ্রদের উজানে পানি বেড়ে যায়। ফলে কাপ্তাই হ্রদের জলেভাসা হাজার হাজার একরের ফসল পানিতে ডুবে যায়। রাঙ্গামাটি উপজেলাধীন ৬টি ইউনিয়নে ১৯১টি বাড়ি সম্পূর্ণ ও ৩৭৪টি বাড়ি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত এবং ৩,৫৪৩ পরিবারের ফসল, বাগান-বাগিচা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
কাউখালী উপজেলা প্রশাসনের মতে ৪টি ইউনিয়নে ১,৬৯৭ পরিবারের ঘরবাড়ি, ফসল, বাগান-বাগিচার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ উপজেলার লেবাপাড়া, চম্পাতলী, দেওয়ানপাড়া ও জুনুমাছড়া এলাকা, সন্দ্বীপ কলোনি, বেতছড়ি ও কচুখালীতে ব্যাপক ক্ষতি হয়। কাপ্তাই উপজেলা প্রশাসনের তালিকা অনুযায়ী কাপ্তাই, চিৎমরম, ওয়াগ্গা ও রাইখালী ইউনিয়নে ৬৭৭ পরিবার ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়। কাপ্তাই উপজেলার বরইছড়ি, চিৎমরম, ঢাকাইয়া কলোনী, ওয়াগ্গা, চন্দ্রঘোনা, রাইখালীসহ বিভিন্ন স্থানে দুই শতাধিক পরিবারের বসতি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। ওয়াগ্গা ইউনিয়নের দেবেতাছড়ি পাহাড়ের (মোন) বিরাট অংশ ধসে পড়ে।
জুরাছড়ি উপজেলা প্রশাসনের তথ্য মতে জুরাছড়ি, দুমদুম্যা ও মৈদুং ইউনিয়নে ৫৯৩ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জনসংহতি সমিতি সংগৃহিত তথ্য অনুসারে জুরাছড়ি ইউনিয়নে ৬৪টি, বনযোগীছড়া ইউনিয়নে ১২টি, মৈদুং ইউনিয়নে ১৫টি ও দুমদুম্যা ইউনিয়নে ২৩টি পরিবারের ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জুরাছড়ি ইউনিয়নের ঘিলাতলী গ্রাম পাহাড়ি ঢলে ভরাট হয়ে যায় এবং ৩৯টি পরিবারের ঘরবাড়ি কাদা মাটিতে তলিয়ে যায়। বিলাইছড়ি উপজেলায় বিলাইছড়ি, ফারুয়া ও কেংড়াছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের তালিকা অনুসারে ৩টি ইউনিয়নে ২,০৩৩ পরিবারের ঘরবাড়ি, বাগান-বাগিচা, ধান্যজমির ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশেষ করে ব্যাপক ভূমিধসে ফারুয়া ইউনিয়নে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে।
রাজস্থলী উপজেলায় গাইন্দা ও ঘিলাছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের তালিকা অনুসারে দুটি ইউনিয়নে ভূমিধস ও প্রবল বৃষ্টিতে ৪৫৩ পরিবারের ঘরবাড়ি ও সহায়-সম্পত্তির ক্ষতি হয়। উপজেলায় রাজস্থলী বাজারের সাথে যে সব এলাকার সহজে গ্রামীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়েছে সেগুলো পাহাড় ভেঙ্গে পড়ে রাস্তা ব্লক হয়ে যায়। রাজস্থলী সদরে খালের কিনারায় অবস্থিত টিএন্ডটি পাড়া, পুরানো থানার এলাকা, হেডম্যান পাড়া, খাগড়াছড়িপাড়া, কুটির শিল্পপাড়া, অনগ্রীনা পাড়াসহ অনেক বসতি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। নানিয়ারচর উপজেলার ৪টি ইউনিয়নের তথ্য অনুসারে ৮৮৯ পরিবারের ঘরবাড়ি, বাগান-বাগিচা, ধান্যজমির ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
২. বান্দরবান জেলার ক্ষয়ক্ষতি
১৩ জুনের পাহাড় ধস ও প্রবল বৃষ্টিতে বান্দরবান সদর ইউনিয়ন ও পৌরসভা এলাকায় ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। বান্দরবান শহরের লেমুঝিরি, কালাঘাটা, বড়ুয়ার টেক, পাইনসি ঘোনা, রাজার গোদা, গর্জনিয়া পাড়াসহ বিভিন্ন দুর্গম পাড়ার বসতিগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হয়েছে। বিভিন্ন সড়কের কিনারের খাড়া পাহাড়ে বসবাসকারী দুই শতাধিক পরিবারের বসতি মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। জেলায় পাহাড় ঘেঁষে বসবাস করা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ পরিবারের সংখ্যা ১৪৪টি। এ ছাড়া কম ঝুঁকিপূর্ণ আরও প্রায় একশ পরিবার সড়কের কিনারে বসবাস করছে। প্রবল বৃষ্টি ও ভূমিধসে সারাদেশের সঙ্গে বান্দরবান জেলার সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। লামা, আলীকদম ও নাইক্ষ্যংছড়ির বিদ্যুত বিতরণ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে।
৩. খাগড়াছড়ি জেলার ক্ষয়ক্ষতি
খাগড়াছড়ি জেলার লক্ষ্মীছড়ি ও রামগড়ে পাহাড়ধসে চারজনের মৃত্যু হয়েছে। ১৪ ও ১৮ জুন পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটে। জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, সদর উপজেলা ছাড়াও মানিকছড়ি, রামগড় ও মহালছড়িতে পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে লোকজন বসবাস করছে। খাগড়াছড়িতে টানা বর্ষণে নিম্না ল প্লাবিত হয়েছে। বন্যার পাশাপাশি টানা বর্ষণের ফলে জেলা সদরসহ বিভিন্ন উপজেলায় পাহাড়ধসের আশঙ্কা করা হচ্ছে। পাহাড়ধস এবং বন্যার ফলে দীঘিনালা উপজেলার অনেক গ্রাম বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। খাগড়াছড়ি শহরসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলায় পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারী প্রায় দুই হাজার পরিবারের বসতি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। পাহাড়ধস এবং বন্যার ফলে উপজেলার ৬টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় দুই শতাধিক পরিবার আশ্রয় নিয়েছে।
৪. সরকারি পদক্ষেপ ও সহায়তা
রাঙ্গামাটি শহরে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ১৯টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। তার মধ্যে ৬ নং ওয়ার্ডে জুম্মদের ৭টি আশ্রয় কেন্দ্র রয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে যে ত্রাণ ও আর্থিক সহায়তা এ পর্যন্ত পৌঁছানো হয়েছে তা একেবারে অপর্যাপ্ত। ঘরবাড়ি হারানো শত শত মানুষ পুনরায় নতুন করে কখন বসতবাড়ি পাবে বা নিজেরা করবে তা সম্পূর্ণ অনিশ্চিত।
১৪ জুন যোগাযোগ মন্ত্রী ও আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়েদুল কাদের ও ত্রাণ মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন মায়া ভূমিধসে বিধ্বস্ত রাঙ্গামাটি সফর করেন। এসে তিনি সার্কিট হাউজ থেকে সরাসরি মানিকছড়িতে মাটি চাপায় ৫ সেনাসদস্য নিহত স্থল পরিদর্শন করেন। সেখান থেকে সেটেলার অধ্যুষিত শিমূলতলী এলাকা পরিদর্শনের পর রাঙ্গামাটি হাসপাতালে যান। তারপর রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে মিটিং করে ঢাকায় চলে যান। এ সময় তিনি নিহত প্রতিজনকে ২০ হাজার টাকার ক্ষতিপূরণ প্রদানের ঘোষণা প্রদান করেন। শিমূলতলী এলাকা পরিদর্শনের পর জুম্ম অধ্যুষিত ভেদভেদী-মোনঘর এলাকা যেখানে ব্যাপক ভূমিধসে কমপক্ষে ২২ জন জুম্ম নিহত হয়েছে তা পরিদর্শনের জন্য রাঙ্গামাটি উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান রীতা চাকমা যোগাযোগ মন্ত্রী ওবায়েদুল কাদেরকে অনুরোধ করেন। ‘সময় নেই, সেনাবাহিনীকে বলে যাচ্ছেন দেখার জন্য’ এই বলে তিনি জুম্ম অধ্যুষিত ভেদভেদী-মোনঘর এলাকা পরিদর্শন না করে সরাসরি হাসপাতালে চলে যান।
রাঙ্গামাটি শহরের দুর্যোগ মোকাবেলায় কোন সমন্বয় নেই বলে পরিলক্ষিত হয়। ত্রাণ ও দুর্যোগ মোকাবেলা বিষয়টি সমন্বয় ও তত্ত্বাবধানের এখতিয়ার পার্বত্য চট্টগ্রাম আ লিক পরিষদের হলেও সরকারের রাঙ্গামাটি ভূমিধস দুর্যোগ মোকাবেলা ও ত্রাণ সহায়তায় আ লিক পরিষদকে সম্পৃক্ত করা হয়নি। এমনকি রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ ও রাঙ্গামাটি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানকে ভূমিধস সংক্রান্ত জেলা প্রশাসনের কোন সভায় ডাকা হয়নি। জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে গঠিত ‘ত্রাণ বিতরণ ও পুনর্বাসন এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি’ এবং তার অধীনে বিভিন্ন উপকমিটিগুলো মূলত ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের নিয়ে গঠিত হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এভাবে ব্যাপক দলীয়করণের ফলে ক্ষয়ক্ষতির তালিকা প্রণয়ন, ত্রাণ বিতরন, আশ্রয় কেন্দ্র পরিচালনা, ক্ষতিগ্রস্তদের নিরাপত্তা বিধানের কাজে ব্যাপক অনিয়ম ও সমন্বয়হীনতা লক্ষ্য করা যায়। সরকার জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে নিহতদের জন্য ২০,০০০ টাকা এবং আহতদের জন্য ৫,০০০ টাকা বিতরণ করেছে। অপরদিকে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদও নিহতদের জন্য জনপ্রতি ২০,০০০ টাকা ঘোষণা করলেও কেবল দলীয় সমর্থক ক্ষতিগ্রস্তদেরকে বেছে বেছে উক্ত টাকা বিতরণ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
৫. ভূমিধসের কারণ
গত ২০ জুন ২০১৭ সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত এক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায প্রলয়ঙ্করী প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও ভুমি ধসের কারণ খুঁজতে ২৭ সদস্যের নতুন কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটির আহ্বায়ক হলেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব। কমিটিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রতিনিধি থেকে শুরু করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়, ভূমি, স্থানীয় সরকার, ফায়ার সার্ভিস, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চটগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিসহ পাঁচটি জেলার জেলা প্রশাসককে রাখা হয়েছে। কমিটিকে পরবর্তী এক মাসের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। আশচর্যের বিষয় যে, উক্ত কমিটিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম আ লিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের কোন প্রতিনিধি রাখা হয়নি।
জানা যায় যে, ঝুঁকি রয়েছে এমন এলাকাগুলোর পূর্ণাঙ্গ তালিকা তিন পার্বত্য জেলার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে নেই। তাই পাহাড়ধসে প্রাণহানি ঠেকাতে প্রশাসনের সামগ্রিক প্রস্তুতিও ছিল না। শুধু বর্ষা মৌসুমের আগে প্রতি জেলায় পৃথকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করা হয়। এবার তিন পার্বত্য জেলার দুটিতে সেই তালিকাও করা হয়নি। প্রায় এক দশক ধরে পার্বত্য এলাকায় নিয়মিত ভূমিধস হচ্ছে। এ জন্য আশির দশক থেকে শুরু হওয়া যত্রতত্র বসতি স্থাপন ও বন উজাড়কে মূলত দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।
পার্বত্য এলাকায় এই নজিরবিহীন ভূমিধসের পেছনে নানা কারণের মধ্যে অন্যতম কারণ হিসেবে ভাবা হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপক বনজ সম্পদ উজার, প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে বনবিভাগ কর্তৃক সেগুন বাগান সৃষ্টি করা ও বহিরাগতদের নিকট ব্যাপক পাহাড়ভূমি লীজ দিয়ে নির্বিচারে রাবার বাগান গড়ে তোলা। দ্বিতীয়ত আরেকটি কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে আশি দশকে পার্বত্য চট্টগ্রামে চার লক্ষাধিক সেটেলার বাঙালি বসতি প্রদান করা এবং তাতে করে ভূমির উপর জনসংখ্যার চাপ পড়ে। তৃতীয়ত: সেটেলার বাঙালি কর্তৃক ভূমি বেদখল ও সাম্প্রদায়িক হামলার কারণে জুম্মদের তাদের চিরায়ত ভূমি থেকে উচ্ছেদ হওয়ার ফলে এবং সেই সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি মোতাবেক আভ্যন্তরীণ জুম্ম উদ্বাস্তুদের পুনর্বসান না হওয়ার কারণে রাঙ্গামাটি শহরে জুম্মদের বসতি স্থাপন ও ঝুঁকিপূর্ণ ঘরবাড়ি নির্মাণও অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। চুতর্থত: এর ফলে বিশেষ করে শহরা লে পাহাড় কেটে অপরিকল্পিত বাড়ি নির্মাণ ও রাঙ্গামাটি শহরে প্রশাসনের ইন্ধনে সেটেলার বাঙালিদের পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি গড়ে তোলা ইত্যাদি অন্যতম কারণ বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। প মত: আইন প্রয়োগের অভাব। প্রভাবশালী ব্যক্তি ও কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অবাধে পাহাড়া কাটা হলেও প্রশাসন দেখেও না দেখার ভান করে থাকে। তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় না। এভাবে নির্বিচারে পাহাড় কেটে প্রকৃতিকে ধ্বংস করা হচ্ছে।
ভূমিধসের পেছনে অন্যতম কারণ হিসেবে লাগাতার তীব্র বজ্রপাতকেও অনেকে দায়ী করছেন। ১৩ জুন ভূমিধসের প্রাক্কালে টানা তীব্র বজ্রপাত ও মেঘের গর্জন হয়েছিল। তীব্র বজ্রপাত ও গর্জনের সময় মাটি ক্ষেপে উঠতো। এই ঝাঁকুনীর ফলে প্রবল বৃষ্টিতে ভিজে থাকা পাহাড় আলগা হয়ে পড়ে বলে অনেকে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। যার ফলে এই প্রলয়ঙ্করী ভূমিধস ঘটে। তীব্র বজ্রপাত ও গর্জনের ফলে মাটি ক্ষেপে উঠা এবং তার ফলে ভিজে থাকা মাটি আলগা হওয়া- এ নিযে বৈজ্ঞানিক সত্যতা পাওয়া না গেলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনেও অন্যান্যের মধ্যে এটি একটি কারণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
উল্লেখ্য যে, ভূমিধসের পূর্বে ১১ জুন বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ৩৬৫ মিলিমিটার। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৮৩ সালে ৪ আগষ্ট রাঙ্গামাটিতে বৃষ্টিপাত হয়েছিল ৩৩৫ মিলিমিটার, ১৯৯৮ সালের ১৫ জুলাই বৃষ্টিপাত হয় ৩১৭ মিলিমিটার, ১৯৯৯ সালের ২৬ জুন বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৩০৭ মিলিমিটার, ২০০৪ সালের ১১ জুলাই বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ৩৩৭ মিলিমিটার, একই বছরে জুন মাসে ২১ তারিখে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ৩০৪ মিলিমিটার। আরো উল্লেখ্য যে, ভূমিধসে ২০০৭ সালের ১১ জুনে মারা যায় ১২৭ জন। ২০০৮ সালের ১৮ আগস্ট ভূমিধসে মারা যায় ১২ জন। ২০১১ সালে মারা যায় ১৭ জন। আর এই গত তিন বছর ভূমিধস হয়েছিল শুধু চট্টগ্রামে। আর ২০১২ সালে ২৬ ও ২৭ জুন চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান ও সিলেটে ভূমিধসে মারা যায় ৯৪ জন। ২০১৫ সালে শুধু কক্সবাজারে ভূমিধসে মারা যায় ১৯ জন। আর এবার পাঁচ জেলায় মারা গেল প্রায় ১৭০ জন।
৬. ভূমিধসের প্রভাব
ভূমিধসে ঘরবাড়িসহ কাপ্তাই হ্রদের জলেভাসা জমি, প্রত্যক্ষ অ লে ফসলী জমি ও ফলজ বাগানের যে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তার পরিমাণ অর্ধ শত কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। বিশেষ করে প্রত্যক্ষ অ লে শত শত একরের যে ফসলী জমি পাহাড়ি ঢলে কাদামাটি ভরাট হয়ে গেছে সেগুলো চাষোপযোগী করতে কয়েক বছর সময় লাগতে পারে। ব্যাপক ফসল ও ফল-ফলাদি নষ্ট হওয়ার ফলে কয়েক মাস পর থেকে রাঙ্গামাটি জেলার জলেভাসা এলাকা ও বিভিন্ন উপজেলার ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় খাদ্যাভাব ও অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিতে পারে বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন।
তথ্যসূত্রঃ জনসংহতি সমিতির প্রকাশিত প্রতিবেদন