বড় বিপর্যয়ের মুখে রাঙামাটি
পাহাড় ধস আর ঢলে শতাধিক প্রাণহানি আর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পর তিন দিনেও যোগাযোগ চালু না হওয়ায় খাবার, পানি আর জ্বালানি সঙ্কটে বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে বাংলাদেশের পার্বত্য জেলা রাঙামাটি।
উদ্ধার অভিযানের তৃতীয় দিনে এক সেনাসদস্যসহ তিন জনের লাশ উদ্ধারের পর এ জেলায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০৮ জনে। সব মিলিয়ে পাহাড়ধসের এই বিপর্যয় পাঁচ জেলায় কেড়ে নিয়েছে ১৫৩ জনের প্রাণ।
রাঙামাটি ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক দিদারুল আলম জানান, সদর উপজেলার শিমুলতলি, ভেদভেদি, দক্ষিণ ও পশ্চিম মুসলিম পাড়া, মানিকছড়ি ও রাঙাপানি এলাকায় বৃহস্পতিবারও তাদের উদ্ধার অভিযান চলে।
কিন্তু চট্টগ্রামের সঙ্গে রাঙামাটির সড়ক যোগাযোগ তিন দিনেও স্বাভাবিক হয়নি। পাশের দুই পার্বত্য জেলা বান্দরবান ও খাগড়াছড়ির সঙ্গেও সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে বলে রাঙামাটির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. শহীদুল্লাহ জানিয়েছেন।
প্রধান সরবরাহ লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ৬ লাখ ২০ হাজার জনসংখ্যার এ শহর বিদ্যুৎহীন ছিল তিন দিন। বৃহস্পতিবার রাতে অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ আসা শুরু করলেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি এখনও। বিদ্যুত জটিলতায় শহর এলাকায় পানি সরবরাহও বন্ধ।
রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালে গত তিন দিন জেনারেটর দিয়ে কাজ চালানোর চেষ্টা হলেও রোগী ও স্বজনরা পড়েছেন ভোগান্তিতে ।
পাহাড় ধসের পর থেকে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ থাকায় জেলার বাইরে থেকে তেল বা গ্যাস সিলিন্ডার নিয়ে কোনো গাড়ি আসতে পারেনি। ফলে নতুন বিপদ হয়ে এসেছে জ্বালানি সঙ্কট।
চারটি পেট্রোল পাম্প এবং কয়েকজন খুচরা তেল বিক্রেতাই রাঙামাটি সদরে জ্বালানি প্রাপ্তির উৎস। এর মধ্যে বনরূপা ও রাজবাড়ির পাম্প দুটি বন্ধ থাকায় বাকি দুটি পাম্পে প্রচণ্ড ভিড়। বহু মানুষকে প্লাস্টিকের ক্যান হাতে লাইন দিয়ে তেলের অপেক্ষায় থাকতে দেখা গেছে পাম্পে।
সব মিলিয়ে কার্যত বিচ্ছিন্ন এ জনপদের মানুষকে দুর্বিষহ পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে বলে স্থানীয় বাসিন্দা ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
পাহাড়ে বিপর্যয়
>> সাগরে নিম্নচাপের প্রভাবে টানা বৃষ্টিতে সোমবার রাত থেকে বুধবার ভোর পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিভাগের পাঁচ জেলায় বিভিন্ন স্থানে পাহাড় ধসে ক্ষয়ক্ষতি হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে রাঙামাটি।
>> রাঙামাটি জেলায় প্রাণহানির ঘটেছে জেলা সদরের শিমুলতলি, যুব উন্নয়ন এলাকা, মানিকছড়ি, শালবন, নয়াপাড়া, সার্কিট হাউজ, মনতলা, ভেদভেদি, রাঙাপানি, দক্ষিণ মুসলিম পাড়া ও পশ্চিম মুসলিম পাড়া এবং জেলার কাউখালি, কাপ্তাই, জুরাছড়ি ও বিলাইছড়িতে ।
>> বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত জেলায় ১০৮ জনের মরদেহ উদ্ধারের কথা জানিয়েছে জেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ।
>> রাঙামাটি সদরের ১৩টি আশ্রয় কেন্দ্রে ক্ষতিগ্রস্ত এক হাজার নয়শ মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। এর বাইরে জেলায় আরও ২৩টি আশ্রয় কেন্দ্রে দুর্গতদের রাখার ব্যবস্থা হয়েছে।
>> রাঙামাটির মানিকছড়ি, শালবন ও ঘাগরা এলাকায় সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে শালবন এলাকায় পাহাড়ি ঢলে রাস্তা ধসে পড়েছে।
>> ফায়ার সার্ভিসের ১০৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে দুর্গত এলাকাগুলোতে উদ্ধার কাজ চালাচ্ছেন। এছাড়া ধসে পড়া সড়ক এলাকায় উদ্ধার কাজ পরিচালনা করছে সেনাবাহিনী, জেলা প্রশাসন, সড়ক ও জনপথ বিভাগ এবং বিদ্যুৎ বিভাগের বেশ কয়েকটি দল।
>> উপজেলাগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় ক্ষয়ক্ষতির বিস্তারিত তথ্য এখনো পায়নি জেলার ত্রাণ ও পুর্নবাসন দপ্তর।
সঙ্কট নানামুখী
জেলা সদরের তবলছড়ি এলাকার বাসিন্দা সৈকত রঞ্জন চৌধুরী সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, “পরিস্থিতি খুবই নাজুক। জানমালের ক্ষতি তো হয়েছেই। আমাদের সবাইকে এখন সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।”
তিনি জানান, শহরের ভেতরে ১০ টাকার গাড়ি ভাড়া ৩০ টাকায় উঠেছে। চাল-ডাল-তেল, এমনকি আলু-পটলের ব্যবসায়ীরাও দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। গ্যাস সিলিন্ডারসহ সড়ক পথে যেসব পণ্য বাইরে থেকে আসে, সেগুলোর সঙ্কট দেখা দিয়েছে।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শহীদুল্লাহ বলেন, “বিদ্যুৎ ছিল না তিন দিন। পাশাপাশি মোবাইল নেটওয়ার্ক দুর্বল হওয়ায় জনজীবন অনেকটা স্থবির হয়ে পড়েছে। শুধু কাপ্তাই থেকে রাঙামাটি সদরের সঙ্গে জলপথে বোট চলাচল করছে।”
স্থানীয় কর্মকর্তারা জানান, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর রাঙামাটির পাঁচ হাজার গ্রাহককে পানি সরবরাহ করে। কিন্তু সোমবার রাতে পাহাড় ধসের পর বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে মঙ্গলবার থেকে পানি সরবরাহও বন্ধ হয়ে যায়।
রাঙামাটি সদরে যাদের বাড়িতে নিজস্ব পাম্প আছে, কেবল তারাই নিজেদের উৎস থেকে পানি পাচ্ছেন।
রাঙামাটিতে অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী অনুপম দে বলেন, “বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে পানি সরবরাহও স্বাভাবিক করা সম্ভব হবে না।”
আর বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের রাঙামাটির তত্ত্বাবধায় প্রকৌশলী দুলাল হোসেন বলছেন, এ বিপর্যয়ে কি পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তাই এখনো নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি তাদের পক্ষে।
বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৮টার পর শহরের কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ সবরাহ শুরু হয়। রাত ১০টার দিকে শহরের ৭০ শতাংশ এলাকায় বিদ্যুৎ ফিরেছে জানিয়ে দুলাল হোসেন বলেন, ধীরে ধীরে সব জায়গাতেই চালু করা যাবে বলে তারা আশা করছেন।
বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক করার পাশাপাশি সড়ক যোগাযোগ সচল করার ওপর জোর দেন তিনি।
জেলার ত্রাণ ও পুর্নবাসন কর্মকর্তা বিশ্বনাথ মজুমদার বলেন, তাদের হাতে পর্যাপ্ত ত্রাণ আছে; বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৩০ লাখ ৯০ হাজার টাকা এবং ৫৫ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ করা হয়েছে। কিন্তু সড়ক যোগাযোগ বন্ধ থাকায় সবগুলো উপজেলায় ত্রাণ পাঠানো যায়নি।
যোগাযোগ বন্ধ থাকায় স্থানীয় বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে বৃহস্পতিবার বিকেলে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন জেলা প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
ওই বৈঠকের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা বিশ্বনাথ বলেন, “দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যবসায়ীদের নির্দেশনা দিয়েছেন জেলা প্রশাসক। কেউ পরিস্থিতির সুবিধা নেওয়ার জন্য দাম বাড়ালে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জরিমানা করা হবে। ইতোমধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালত কাজও শুরু করেছে।”
আশ্রয়কেন্দ্রে আসা মানুষের দেখাশোনার জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি কমিটিও করে দেওয়া হয়েছে।
এদিকে তেলা পাওয়া কঠিন হওয়ায় জেলা সদরের ভেতরেও যান চলাচল কমে গেছে। রাঙামাটি শহরে চলাচল করছে হাতেগোনা কয়েকটি ব্যক্তিগত যানবাহন ও অটোরিকশা। গণপরিবহনের ভাড়া বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্টেটরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছেন।
রাঙামাটি অটো রিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক শহিদুজ্জামান মহসিন রোমান বলেন, “দুর্যোগ মুহূর্তে আমরা ন্যায্য ভাড়া নিচ্ছি। কোনো চালক বেশি ভাড়া নিয়ে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”