প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে রাণী ইয়েন ইয়েনের কর্মসূচি স্থগিত
পার্বত্য অঞ্চলে ভূমি ধসে ব্যাপক প্রাণহানীতে ১৬জুনে রাঙামাটির প্রতিবাদ সমাবেশ বাতিল করে দুর্গত মানুষের পাশে দাড়ানোর আহবান জানিয়েছেন শোকাহত চাকমা রাণী ইয়েন ইয়েন। বর্তমান অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতিতে শোকাহত চাকমা রাণী তাঁর সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুক ট্যাটাসে লিখেছেন,-
“গত দুইদিন ধরে রাঙামাটিতে বিদ্যুৎ নেইI এই কয়েকদিন আমার ইন্টারনেটের তিনটি সার্ভারের কোনোটিই কাজ করছেনাI মোবাইলের নেট কয়েক সেকেন্ডের জন্য থাকে, চলে যায়I গতকাল হাজার কিলোমিটার দূরে থাকা আমার এক গুরুজন আমার অনুরোধে আমার FB একাউন্টে ঢুকে আমার পোস্টটি লিখে দিয়েছেনI বিদ্যুৎ না থাকায় আমার ফোনের চার্জও শেষI প্রতিবেশী দিদির ফোন নম্বরে কল দিয়ে তিনি আমাকে আপনাদের ১৫০টি কমেন্টও কষ্ট করে পড়ে শুনিয়েছেনI তাকে অশেষ ধন্যবাদ জানাইI এই পোস্টটিও তিনি আমার পাঠানো এসএমএস গুলোকে একত্র করে লিখে দিচ্ছেনI
যেহেতু সারা রাঙামাটি ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন, ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সকলের মন্তব্য পড়ে আমি সিদ্ধান্ত নিতে পারছিনাI গতকালের ও আজকের দেড়শোর অধিক মতামতের ওপর ভিত্তি করে আমার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিI
অনেকে বলেছেন আমাদের সমাবেশের নির্ধারিত দিন পরিবর্তন করলে আমরা কাপুরুষ বলে গণ্য হবোI আসলেই কি? আপনাদের ভার্চুয়াল জগতের কণ্ঠ শুনেই যে প্রশাসন তড়িঘড়ি করে নিষেধাজ্ঞা জারি করার মতো সিদ্ধান্ত নেয়, তখন কে সাহসী আর কে কাপুরুষ সেটি অন্তত আমার কাছে পরিষ্কারI
অনেকে আমাকে বিনীত ভাবে সতর্ক করেছেন, দিন পরিবর্তন করলে আমার গ্রহণযোগ্যতা কমে যাবেI আমিও অত্যন্ত বিনীত ভাবে বলতে চাই, গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে আমি চিন্তিত বা বিচলিত হতাম যদি আমি সক্রিয় ভাবে রাজনীতি চর্চা করতাম, যদি রাজনীতির চিরন্তন ধারা অনুসারে নিজের জনপ্রিয়তা কাজে লাগিয়ে কোনো উদ্দেশ্য (জনহিতকর বা অন্য) হাসিল করার মতো মনমানসিকতা আমার থাকতোI আমার জীবনে অনেক লক্ষ্য আছে, অনেক উচ্চাকাংক্ষাও আছে, তার মধ্যে এটি একটি নয়; কখনই ছিলোনা, আর কখনোই হবেনা বলে নিজের উপর বিশ্বাস আছেI
আমি বাংলাদেশের মূলধারার রাজনীতির কূটকৌশলে বিজ্ঞ নই, কিন্তু এই সম্পর্কে আমার জ্ঞান আছেI সেই জ্ঞানের সূত্র ধরে চরম বিতৃষ্ণাও আছেI রাজনীতি মানেই পাওয়ার-প্লেI আর বাংলাদেশের মূলধারার রাজনীতি মানে ‘কেবলই পাওয়ার-প্লে’, মানুষ সেখানে গৌণ, মানবিকতা সেখানে মুখ্য কিছু নয়, তবে মানুষ ও মানবিকতার কার্ড বা ঘুটি খেলার অন্যতম সম্পদI আমি এইধরণের রাজনীতির সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে চাইনাI
এইধরণের কূটরাজনীতির বিপক্ষে আমার স্পষ্ট অবস্থানের কারণেই আমি নিজের মতো করে সাধারণ একজন নাগরিক হিসেবে রাস্তায় নামতে চেয়েছিI আমার প্রতিবাদের চেতনা ক্ষণিক আবেগসর্বস্ব নয় যে দিনবদলের সাথে প্রতিবাদের স্পৃহাও কমে যাবেI
আপনারা যাঁরা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে একসাথে রাস্তায় দাঁড়াতে চেয়েছিলেন এবং তাঁদের মধ্যে যাঁরা ভাবছেন নির্ধারিত দিন পিছানো হলে স্বতঃস্ফূর্ততার জোয়ারে ভাঁটা পরবে, আপনারাই বলুন, যে চেতনা জোয়ারভাঁটার মতো ওঠানামা করে সে চেতনার মূল্য কতখানি আপনার কাছে? যে আদর্শিক চেতনা ক্ষণস্থায়ী তা আপনার কাছে কতটুকু গ্রহণযোগ্য? আর যে শাসকগোষ্ঠীকে আপনি নাড়িয়ে দিতে চেয়েছেন তারাইবা ক্ষণিক আবেগসর্বস্ব চেতনাকে কতটুকু গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করবে বলে আপনি মনে করেন ?
আপনারা অনেকে হয়তো ধারণা করতে পারবেন, অনেকে হয়তো বা পারবেন না, কীভবে কতোদিক থেকে ১৬ তারিখের সমাবেশ না ঘটার জন্য কত প্রকারের চেষ্টা করা হয়েছে I আমার পরিবারের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজনরা থেকে শুরু করে আমার শ্রদ্ধেয়ভাজন অনেকেই আমাকে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়েছেন I আমি তাঁদের ইচ্ছানুরূপ সিদ্ধান্ত নিইনি, আমি তাঁদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী I আদর্শের প্রশ্নে আমি ভয়ঙ্কর একরোখাI এই প্রতিবাদ সমাবেশ নিয়ে আদর্শিক সংঘাতের কারণে আমার অত্যন্ত প্রিয়জন প্রাণের এক মানুষের সাথে অনেক অভিমান নিয়ে সেদিন সম্পর্কছিন্ন করতে হলোI আমি জানি তিনিও এই পোস্ট পড়বেন, পড়ছেনI এই বিষয়ে আমি নিজের কাছেই নিজে নিরুপায়I
রাঙামাটিতে স্মরণাতীত কালের এই ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটার পর আমার নতুন করে চিন্তা করতে হচ্ছেI এতে আমার আদর্শের স্খলন হচ্ছে বলে যাঁরা মনে করছেন বা বিশ্বাস করতে চান, তাঁদের সাথে আমি দ্বিমত পোষণ করছিI
অন্যায়ের বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ মানবিক বিপর্যয়ের কাল-সময়-প্রেক্ষিত বিবেচনা করেনা, আমি সে প্রতিবাদ প্রত্যাখ্যান করিI
আপনাদের যদি মনে হয় আমি ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবং যেকোনো মূল্যে সমাবেশ এ মাসের ১৬ তারিখেই হতে হবে, সেটি আপনাদের সিদ্ধান্তI রাঙামাটির রাস্তা আমার একার নয়I তবে একান্ত অনুরোধ থাকবে, সমাবেশ স্থগিত করে অন্যদিনে করার কথাটি বিবেচনা করারI
একজন মানুষ হিসেবে, একজন নাগরিক হিসেবে এবং সর্বোপরি চাকমা সার্কলের রানী হিসেবে বিপর্যস্ত ও শোকাহত মানুষের পাশে দাঁড়ানো আমার নৈতিক দায়িত্বI মৃত ব্যক্তিদের সাপ্তাহিক ক্রিয়া সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত আমার পক্ষে প্রতিবাদ সমাবেশে অংশগ্রহণ করা সম্ভব হবেনাI
কেউ একজন মন্তব্য করেছেন, আপনাদের কল্যাণে ১৬তারিখ যেহেতু একটি প্রতীকী তারিখ হয়ে গেছে, জুলাই এর ১৬তারিখে সমাবেশটি নিয়ে যাওয়ারI আপনারা ভেবে দেখতে পারেনI
আর এই ১৬ তারিখ সন্ধ্যা ৬টায় আমরা ভেদভেদী রাঙাপানি সড়কের যে যে জায়গায় প্রাণহানি ঘটেছে সড়কের ওপর দু’পাশে সেসব স্থানে মৃতব্যক্তিদের উদ্দেশ্যে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ এবং তাঁদের স্মরণে প্রদীপ জ্বালাবোI
মানবিকতা জাগ্রত হোক I
প্রতিবাদের স্পৃহা অটুট থাকুক I
সংহতি ”