সাক্ষাৎকার

‘আমি প্রত্যাশা করি, বাংলাদেশ সরকার আদিবাসীদের স্বীকৃতি দিয়ে আমাদের সাথে আদিবাসী দিবস পালন করবে’ -অজয় এ মৃ

আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উপলক্ষ্যে মধুপুরের প্রবীণ নেতা ও সাবেক জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের সাবেক সভাপতি অজয় এ মৃ’র সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শ্যাম সাগর মানকিন।

আইপিনিউজ : আদিবাসী দিবসের শুভেচ্ছা, কেমন আছেন?
অজয় এ মৃ : হ্যা, ভালই আছি।

আইপিনিউজ : মধুপুরের আদিবাসীরা সার্বিক দিক দিয়ে কেমন আছেন?
অজয় এ মৃ : সার্বিক দিক দিয়ে যদি চিন্তা করি, তবে খুব বেশি ভাল নেই মধুপুরের আদিবাসীরা। আমরা নানান সমস্যায় জর্জরিত, উচ্ছেদ আতংকে আতংকিত। ভূমি সমস্যা নিয়ে সবসময় আমরা আতংকিত। জীবন জীবিকা যেভাবে স্বাচ্ছন্দ্য হওয়ার কথা ছিল সেভাবে হচ্ছেনা। সার্বিক দিক দিয়ে যদি দেখি তাহলে বলা যায় আমাদের মধুপুর অঞ্চলের আদিবাসীরা ভাল নেই।

আইপিনিউজঃ ভূমি সমস্যার কথা বললেন, ভূমির সমস্যা কেমন, বিস্তারিত বলবেন… সাম্প্রতিক কোন ঘটনা..
অজয় এ মৃ : ভূমির সমস্যা আমরা যদি বলি, প্রথমত ৬২ সাল থেকে যদি দেখি তাহলে দেখবো ন্যাশনাল পার্ক করার নামে আমাদের নামে উচ্ছেদ নোটিশ করা হয়েছিলো। ৬৮- ৬৯ সালে এবং পরবর্তীতে ৭১ এর যুদ্ধের পরে আমরা মনে করলাম; যেখানে বঙ্গবন্ধু বলে গেলেন “আমি তোমাদেরকে উচ্ছেদ করবোনা, বরং ন্যাশনাল পার্কের আকার ছোট করবো। কিন্তু পরবর্তীতে উনি তা করতে পারেননাই, ন্যাশনাল পার্ক ছোট করেছেন, কিন্তু আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকা ঘিরেই ন্যাশনাল পার্ক করা হয়েছে। সুতরাং সমস্যাটা এখানে রয়েই গেল। আর আমরা রিপিটিশন করার পরে মনে করলাম যে, ন্যাশনাল পার্ক শব্দটা থাকবেনা কিন্তু পরবর্তীতে দেখা গেল, ন্যাশনাল পার্ক রয়েই গেল এবং এইটার নামে নানা প্রকল্প আসতে থাকলো। সুতরাং সমস্যাটা রয়েই গেল।

দ্বিতীয়তত হল, ১৯৮৪ সালে চূড়ান্ত রিজার্ভ ফরেস্ট ঘোষণা করা জন্য যে নোটিশ দেয়া হয়েছিলো সেসময় আদিবাসীরা দাবি জানিয়েছিল যে, এই সমস্ত জায়গায়, যেখানে দখলীস্বত্ব আছে, বাপ দাদা চৌদ্দ পুরুষ থেকে দখল করে আসছে, রাইট অফ অকোপেশন যেখানে আছে সেটা রিজার্ভ ফরেস্ট ঘোষণার যোগ্য নহে। তিনটা ক্যাটাগরিতে এখানে অকোপেশন করা হয়েছে, একটা হল দখলী সত্ব আছে, আরেকটি হলো সনামি পত্তন নেওয়া হয়েছে তৃতীয়টি হলো, কেজার্স সার্ভের সময় সার্ভেতে আমাদের নাম যুক্ত হয়েছে। সুতরাং, চূড়ান্ত রিজার্ভ ফরেস্ট ঘোষণার যোগ্য নহে। কিন্তু সরকার বাহাদুর সেটা আমলে নেন নাই এবং সেটার সমাধান বের করেন নাই। বিধায় এ সমস্যাটা এখনো রয়ে গেছে।

তৃতীয়ত হলো, এই যে এখন বিভিন্ন প্রকল্পের নামে যে সমস্ত সমস্যাগুলো আসতেছে, যেমন নিসর্গ, আইপ্যাক, পরবর্তীতে রিহেবিটালাইজেশন রিভিজিটাইজেশন , এখানে আমরা বলেছি আদিবাসীরাতো আপনাদের কাছে পূণর্বাসন চায় নাই, আদিবাসীরা চেয়েছে সরকারে কাছে স্থায়ী বন্দোবস্ত। আদিবাসীরা নিজেদের জমিতে পূণর্বাসন কখনো চায় নাই। আমরা চেয়েছি বনবিভাগ তার জায়গা রিমার্কেশন করে নিক, আদিবাসীদের স্বত্বদখলীয় জমিগুলো রিমার্কেশন করে স্থায়ী বন্দোবস্ত করে দিক। কিন্তু অদ্যাবধি সরকার সেটা করেনাই।

আইপিনিউজ : লেক ইস্যুতে আদিবাসীদের অবস্থান কি?
অজয় এ মৃ : প্রথম দিকে যখন আমাদের মন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক ভোলার সাথে আলোচনা করা হয়, তখন তিনি বলেছিলেন , ‘কে বলেছে এখানে লেক হবে? এখানে লেক হবেনা।’ পরবর্তীতে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে তিনি বলা শুরু করলেন এখানে লেক হবে, আপনাদের আদিবাসীদের ভাল হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। এবং আদিবাসীরা এই লেকের ব্যাপারে পরিষ্কারভাবে কিছুই জানতোনা। পরবর্তীতে আদিবাসীরা আতংকিত হয়ে পড়েছে। যেখানে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন এক ইঞ্চি কৃষি জমিও যেন পতিত না থাকে, সেখানে আদিবাসীদের কৃষি জমি দখল করে লেক করা হবে সেটা আদিবাসীরা কোনভাবেই মেনে নেবেনা। এছাড়া আমাদের স্বত্বদখলীয় জায়গা এবং সালোমি পত্তন আছে। ১৯৮০-৯২ সাল পর্যন্ত খাজনা দেওয়া হয়েছে , সুতরাং আমাদের দখলীয়স্বত্ব জমির রাইট অফ অকুপেশন আছে। একারণে আদিবাসীরা এই বিষয়টিকে মেনে নিতে পারছেনা।

আইপিনিউজ : তারমানে আপনারা এই লেক যেন না হয় তার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন…
অজয় এ মৃ : আমরা সরকারের কাছে আশা করবো, বন বিভাগ সুফল প্রকল্পের মাধ্যমে যে চিন্তা করেছে সেটি আদিবাসীরা মেনে নিতে পারছেনা।
ভূমি সমস্যার প্রধান কারন আমরা যে দেশে আদিবাসীরা আছি, সরকার সেটি কখনো আমলে নেন নাই। এখানে যে টেরিটরি আছে ট্যারেন্স আছে এইটা কখনো আমলে নেন নাই। আবার নানা প্রকল্প নিয়ে আদিবাসীদের বন ধ্বংস করা হয়েছে এবং এখন আদিবাসীদের দোষারোপ করা হচ্ছে যে আদিবাসীরা বন ধ্বংস করছে।
১৯৭৭-৭৮ সালে ফায়ারিং রেঞ্জের নামে যে জায়গাম দখল ও বন ধ্বংস করা হয়েছে , যেখানে বন ও পরিবেশের কথা বলা হয়েছে। সেখানে বন্য প্রাণী অভয়ারণ্যের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সেখানে যখন ফায়ার রেঞ্জ করা হয় যা কন্ট্রাডিকটরি।
দ্বিতীয়ত হলো, ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য ১৯৮৬-৮৭ সালে এরশাদ আমলে রাবার প্লান্টেশন করা হয়েছে। অবসরপ্রাপ্ত আর্মি সদস্যরা বিভিন্ন প্রকল্প এনে গভীর বন কেটে কেটে এই রাবার প্লান্টেশন করেছে। সেটি আরেকটি বড় বিষয়।

আইপিনিউজ : কাগজপত্র না থাকা কি বড় কোন সমস্যা?
অজয় এ মৃ : ….পরবর্তীতে সামাজিক বনায়নের নামে বন ধ্বংস করা হয়েছে। দেশ ভাগ হওয়ার আগে জমিদারের কাছে আদিবাসীরা রানী ভবানী ও জগন্নাথ রায় বাহাদুরের কাছে খাজনা দিত। পরবর্তীতে দেশ ভাগের পরে সরকার সেটি চিহ্নিত করেনাই। এরপরেও আমি দেখেছি ১৯৮০ সাল পর্যন্ত সেই খাজনার কাগজ দিয়ে ব্যাংক লোন নেওয়া যেত। তখন পর্যন্ত যদি বৈধতা থাকে তাহলে এখন কেন বৈধতাকে স্বীকার করে নিচ্ছেনা। সেটি আমাদের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ।
সুতরাং কাগজপত্র যতটুকু আছে ততটকু যদি সরকার বাহাদুর আমাদের ঠিক করে দিত, তাহলে বনবিভাগের সাথে যে বিরোধ সেটির নিষ্পত্তি হতো।
আমরা শুনেছিলাম এইটা নিয়ে রিভিনিউ অফিসে কথা চলছে। আমরা অপেক্ষা করলাম নিশ্চয়ই এঁর একটা সমাধান হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা দেখলাম ১৯৮৩ সালের আটিয়া অধ্যাদেশের নামে আমাদের খাজনা বন্ধ করে দেওয়া হলো। আটিয়া অধ্যাদেশতো শুধু সখিপুর অঞ্চলের জন্য ছিল, মধুপুরের খুব কম অংশ সেখানে পড়েছে।

আইপিনিউজ : জমিদারী প্রথার পড় সরকার খাজনা দেওয়াকে চিহ্নিত করেনাই, কেন বলে মনে করেন?
অজয় এ মৃ : এইটা সরকারেরও স্বদিচ্ছার অভাব এবং একই সাথে আমাদের আদিবাসীরাও এ বিষয়ে সচেতন ছিলনা। আইন বিশেষজ্ঞ না থাকলে যা হয়, এখনকার আদিবাসীরা যেভাবে বিভিন্ন বিষয়ে জানতে পারছে আগেতো এই অবস্থা ছিলনা। সবচেয়ে বড় কথা হলো, সরকার আমাদের আদিবাসীদেরকে সেভাবে গুরুত্ব দেয়নাই।

আইপিনিউজ : এখানে পর্যটন হলে আদিবাসীরা লাভবান হবে বলা হচ্ছে, আদিবাসীরা কি পর্যটনের বিরোধী কিনা?
অজয় এ মৃ : আদিবাসীরা পর্যটনের বিরোধী না, বা বন রক্ষারও বিরোধী না। বন ও পরিবেশ রক্ষায় আদিবাসীরা সবসময়ই সচেতন। বরঞ্চ সামাজিক বনায়নের নামে যখন প্রাকৃতিক বন কাটা হয় তখন আদিবাসীরা প্রতিবাদ করেছিল। প্রাকৃতিক বন ধ্বংস হওয়ার কারণ হলো বিভিন্ন প্রকল্প এনে প্রাকৃতিক বন কেটে সামাজিক বনায়নের মতন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা।
শুরুর দিকে আদিবাসীদের বলা হয়েছিল এ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হলে আদিবাসীরা সম্পৃক্ত হতে পারবে এবং আদিবাসীদের জীবনমান উন্নত হবে, কিন্তু আমি দেখেছি তাদের জীনব জীবিকার মান তো উন্নয়ন হয়ই নাই বরং দিন দিন বন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, আমাদের জীববৈচিত্র্য নষ্ট হচ্ছে। আদিবাসীদের কৃষ্টি-সংস্কৃতিতে আঘাত হানছে। মধুপুরে লেক খনন হলে, বনের পরিবেশ এবং আদিবাসীদের সংস্কৃতিকে আঘাত করবে।
পর্যটনের নামে যদি আদিবাসীদের কৃষ্টি সংস্কৃতি রক্ষা না হয় তাহলেতো আদিবাসীরা সেই পর্যটনকে সমর্থন করবেনা। আদিবাসীদের সাথে সুষ্ঠু আলোচনার মাধ্যমে পর্যটন গড়ে উঠলে সেটি বন পরিবেশ ও আদিবাসীদের জন্য মঙ্গল হয়।

আইপিনিউজ : জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদ বর্তমান সময়ে জনগণের আস্থার প্রতীক হয়ে উঠতে পারছে কিনা?
অজয় এ মৃ : জয়েনশাহী ১৯৬২ সাল থেকে মধুপুরে বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। যারা এখানে নেতৃত্ব দেন, তারা যদি পরিচালনা করতে না পারে তাহলে সংকটের তৈরি হয়। নেতৃত্বকে নিরপেক্ষ থাকতে হবে, যদি ব্যাক্তিস্বার্থকে দেখা হয় তাহলে যেকোন সংগঠনই সংকটের মুখে পড়বে এবং যুবরাও বিভ্রান্ত হয়ে যাবে।

আইপিনিউজ : তার মানে কি এখন বর্তমান পরিস্থিতে জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদ আস্থার প্রতীক হয়ে উঠতে পারছেনা?
অজয় এ মৃ : আমি পরিষ্কার করে বলছি, যারা নেতৃত্ব দেন তাদের নিরপেক্ষ থাকতে হবে এবং সুস্পষ্ট জানতে হবে যে আমার জনগণ ও সংগঠনের মূল লক্ষ্য, আদিবাসীদের স্বার্থবিরোধী কিনা, আমাদের আদিবাসীদের ভূমি অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে কিনা সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। সুতরাং যুব নেতৃত্ব থেকে শুরু করে সকলকে সম্পৃক্ত করে কাজ করলে জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদ সুদৃঢ়ভাবে নেতৃত্ব দিতে পারবে।

আইপিনিউজ : আপনি দীর্ঘদিন জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের নেতৃত্ব দিয়েছেন। নেতা হিসেবে মধুপুর এই অঞ্চলে কোন চ্যালেঞ্জকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন?
অজয় এ মৃ : যখন যে সরকার আসে তখন সে সরকার আদিবাসীদেরকে চিহ্নিত করে আমাদের সাথে আলোচনা করে শুধু বক্তব্য দেয়ার জন্য দিয়ে যান, কিন্তু পরবর্তীতে আর বাস্তবায়ন করেননা।
যেমন বর্তমান সরকার যখন ২০০৪ সালের ৩রা জানুয়ারি পিরেন স্নাল হত্যার ঘটনার পর তার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম, তখন তিনি বিরোধী দলের নেত্রী ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আমি ক্ষমতায় গেলে প্রথমেই, মধুপুরের সমস্যা সমাধান করবো। সাক্ষাতের পরদিন জাতীয় গণমাধ্যমগুলোতে সেই খবর ছাপা হয়েছিল।
বর্তমান কৃষিমন্ত্রী ২০১০ সালের ১০ই ডিসেম্বর আমাদের ওয়ানগালায় এসেছিলেন। সেখানে আমেরিকা এম্ব্যাসেডর ডেন মজিনোও ছিলেন। উনি ওয়াদা করে বলেছিলেন, ‘আমরা চেয়েছিলাম সিএইচটি টু প্লেন ল্যান্ড মিলে একটা ভূমি কমিশন গঠন করবো। যেহেতু সিএইচটিরা রাজি হচ্ছেনা সেহেতু আমরা আপনাদের সমতলের আদিবাসীদের জন্য আলাদা ভূমি কমিশন গঠন করবো।’ অদ্যাবধি সেই ভূমি কমিশন গঠন করা হয়নাই।
আরেকটি বিষয় হলো, তারা তখন আদিবাসী শব্দ ব্যবহার ও আমাদের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে কথা বলেছে যখন তারা বিরোধী দলীয় ছিল। কিন্তু বর্তমানে তারা আদিবাসী শব্দকে প্রত্যাখান করেছে এবং এটি ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। সেটি অত্যন্ত দুঃখজনক। সরকারের কাছে আমরা এখন আশা করি, আমরা মনে করি বর্তমান সরকার আদিবাসী বান্ধব সরকার, আমরা তার কাছে আমাদের কথাগুলো পৌঁছে দেওয়ার জন্য চেষ্টা করছি। যেন তিনি আদিবাসীদের সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারনা পেতে পারেন এবং আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেন।

আইপিনিউজ : তারমানে আপনি বলছেন, সরকারি নেতৃবৃন্দ যেসব ওয়াদাগুলো আদিবাসীদের জন্য করেন সেগুলো বাস্তবায়ন করেননা, এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এছাড়া আর কি কোন গুরত্বপূর্ণ বিষয় আছে?
অজয় এ মৃ : আমাদের ভূমির যে কাগজপত্র সেটি বিবেচনা করে বনবিভাগের সাথে আমাদের যে বিরোধ সেটি নিষ্পত্তি করা না হলে এই সমস্যা চলতেই থাকবে। শুধু মধুপুর না শেরপুর গজনী এসমস্ত অঞ্চলে প্রকল্পের নামে আমাদের যে জায়গাগুলো দখল করা হচ্ছে, যেমন ঝিনাইগাতি গজনী এলাকায় আদিবাসীদের জায়গা দখল করে হাতির অভয়ারণ্য করা হচ্ছে। সেটা আমাদের আদিবাসীদের জন্য শঙ্কার কারন। আদিবাসী এলাকায় বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে কিন্তু আদিবাসীদের কোন উন্নয়ন হচ্ছেনা সেটি আমাদের জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ।

আইপিনিউজ : সারাদেশে আদিবাসীরা লড়াই করে যাচ্ছে আমরা জানি, আদিবাসীদের লড়াই ঠিক পথে আছে কিনা এবং আগামী দিনের আন্দোলন কেমন হওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?
অজয় এ মৃ : এখানে আন্তর্জাতিক বিষয়গুলো দেখতে হবে, আইএলও কনভেনশন ১০৭ বর্তমান সরকার অনুসাক্ষর করেছে,। ১৬৯ এখনো করেন নাই। এই বিষয়টা দেখতে হবে।
আরেকটি বিষয় হলো, সরকারি নানা উন্নয়ন প্রকল্প, বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা এবং স্থানীয় প্রভাবশালীদের দ্বারা আদিবাসীদের ভূমি বেদখল হচ্ছে।
আদিবাসীদের আদিবাসী হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছেনা। আর শিক্ষার ক্ষেত্রে আদিবাসী ভাষার শিক্ষা ব্যাবস্থা চালু হলেও আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে আদিবাসীদের কৃষ্টি ও সংস্কৃতি রক্ষার জন্য কোন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছেনা। এবং শিক্ষক নিয়োগ ঠিকমত হচ্ছেনা।

আইপিনিউজ : আদিবাসীদের লড়াই ঠিক মত এগোচ্ছে কিনা?
অজয় এ মৃ : আমাদের বর্তমান যুব সমাজ যেভাবে অগ্রসর হচ্ছে সেটি সঠিক আছে। এবং আগামী দিনে দুটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে, একটা হচ্ছে আইনি এবং বিভিন্ন মিনিস্ট্রির সাথে কথা বলা এবং আদিবাসী বিষয়ে তাদের জানান দেওয়া। এটি আমাদের করতে হবে। সেক্ষেত্রে আমি দেখি আমাদের লড়াই ঠিক পথেই আছে। স্থানীয় সংগ্রাম চলমান আছে এবং সরকারের সাথে নেগোসিয়েশন চালিয়ে যেতে হবে। স্থানীয় সংগ্রাম চলমান না থাকলে সরকার মনে করবে আমরা সমস্ত কিছু মেনে নিচ্ছি। আবার সরকারের সাথে আমাদের আলোচনাও চলমান রাখতে হবে।

আইপিনিউজ : বর্তমান সরকারের নানা উন্নয়ন কর্মকান্ডে আদিবাসীদের অংশগ্রহণটা কেমন?
অজয় এ মৃ : এটা কাগজে কলমে আছে, কিন্তু বাস্তবে আদিবাসীরা সেখানে নাই। এখানে আমলাতান্ত্রিক একটা বিষয় আছে। স্থানীয় কর্মকর্তাদের একটি বিষয় আছে এবং রাজনৈতিক একটা বিষয়ও আছে। স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলের প্রভাব বিস্তার করার জন্যই আদিবাসীরা সুফল ভোগ করতে পারছেনা।

আইপিনিউজ : তার মানে উন্নয়ন কর্মকান্ডে কাগজে কলমে বলা হলেও আদিবাসীরা সেখানে অংশগ্রহন করতে পারছেনা?
অজয় এ মৃ : দেখেন এখানে সাইনবোর্ড টানানো আছে যে স্থানীয় এবং নৃতাত্তি¡ক জনগোষ্ঠীর সহায়তায়, কিন্তু আমরা যে তাদের সহায়তা করছি এরকমতো কিছু হচ্ছেনা। আমাদের সাথে কোন আলোচনা করে কাজগুলো হচ্ছেনা। তাদেরকে শুধুমাত্র শ্রমিক হিসেবে নেওয়া হয়েছে, তার মানে এই নয় যে আদিবাসীরা উন্নয়নে অংশগ্রহণ করতে পারছে।

আইপিনিউজ : আদিবাসী দিবসের এইবার এর মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে ‘ঐতিহ্যগত বিদ্যা সংরক্ষন ও বিকাশে আদিবাসী নারী সমাজের ভূমিকা’ এ নিয়ে আপনার মতামত যদি দিতেন….
অজয় এ মৃ : বর্তমান আদিবাসী নারীরা যারা শিক্ষিত হচ্ছে এবং তাদের সাথে পুরুষরাও কৃষ্টি এবং সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে। তবে এখানে সরকারের সুদৃষ্টি দরকার। সরকার যদি আদিবাসীদের শিক্ষা কার্যক্রমে আদিবাসীদের ভাষা সংরক্ষণ করার জন্য, বা আদিবাসীদের ভাষা, কৃষ্টি সংস্কৃতি চর্চার জন্য একাডেমী করে না দেয়, সুযোগ সৃষ্টি না করে এয় তাহলে সমস্ত কিছু বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
আমি যদি বলি এই যে লেক, এটি যদি বাস্তবায়ন করে তাহলে আদিবাসীদের ব্যবহার করে তাদের নাচ গান দেখানো হবে। কিন্তু আদিবাসীদের কৃষ্টি সংস্কৃতি এতে ব্যহতই হবে। আমাদের শো করা হবে কিন্তু সংস্কৃতি চর্চা রক্ষা করা সম্ভব হবেনা।

আইপিনিউজ : আদিবাসী দিবসে আপনার প্রত্যাশা কী?
অজয় এ মৃ : আমরা প্রত্যাশা করি, আদিবাসী দিবসকে সরকার স্বীকৃতি দিবে যেটা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। সেই ঘোষণা হিসেবে কয়েক দশক ধরে আমরা আদিবাসী দিবস পালন করে আসছি। বর্তমান সরকার আগে আমাদের সাথে আদিবাসী হিসেবে গলা মেলালেও এখন বর্তমান ক্ষমতসীন সরকার আর সেটি ব্যবহার করছেনা। আমি প্রত্যাশা করি, বাংলাদেশ সরকার আদিবাসীদের স্বীকৃতি দিয়ে আমাদের সাথে আদিবাসী দিবস পালন করবে।

আইপিনিউজ : আপনার মূল্যবান সময় দেয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। এবং আদিবাসী দিবসের শুভেচ্ছা।
অজয় এ মৃ : ধন্যবাদ, আপনাদেরকেও, অসংখ্য ধন্যবাদ।

Back to top button