অন্যান্যসাক্ষাৎকার

‘পার্বত্য চট্টগ্রামের চুক্তি নিয়ে আদিবাসীদের সাথে বড় ধরনের প্রতারণা করা হয়েছে’-খুশি কবির

আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উপলক্ষ্যে আইপিনিউজের পক্ষ থেকে নিজেরা করি’র সমন্বয়ক খুশি কবিরের বিশেষ সাক্ষাতকার নিয়েছেন শ্যাম সাগর মানকিন। সহায়তা করেছেন সতেজ চাকমা ও সুমেধ চাকমা।

আইপিনিউজ: আদিবাসী দিবসের শুভেচ্ছা। কেমন আছেন আপনি?
খুশি কবির: এমনি ভালোই আছি এখন। কোভিড হয়েছিল তো এটার আফটার এফেক্টগুলোর কারনে একটু টায়ার্ড লাগে। তাছাড়া ঠিকই আছি।

আইপিনিউজ:
আদিবাসী/উপজাতি/ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী নানান পরিচয় নানান বিতর্ক, সাম্প্রতিক আদিবাসী শব্দটি গণমাধ্যমকে ব্যবহার না করার জন্য চিঠি দেয়া হয়েছে এ নিয়ে আপনার মত কি?
খুশি কবির : সবাইকে আদিবাসী দিবসের শুভেচ্ছা। প্রথমত আমার মনে হয় আদিবাসী শব্দটা অনেকের কাছেই স্পষ্ট না। স্পষ্ট না হওয়াটা বিতর্কের একটা কারণ। আর দ্বিতীয়তকারন হচ্ছে এটা রাজনৈতিক । ব্যাপারটা হল যে অনেক মানুষ আছে যারা খুব একটা সচেতন নন, তাদেরকাছে হয়তো আদিবাসী শব্দটাই স্পষ্ট না। তাদেরকে যেভাবে বোঝানো হয়েছে বা বলা হয়েছে সেভাবেই তারা বোঝেন। আমি রাষ্ট্র বলবো না, কিন্তু সরকারের একটি মহল থেকে যে চিঠিটা দেয়া হয়েছে বিভিন্ন মিডিয়াতে বিশেষ করে টিভি চ্যানেলদেরকে বলা হয়েছে যেন আদিবাসী শব্দটা ব্যবহার করা না হয়। এটা তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো হয়েছে, একটা বিশেষ সংস্থা থেকে তাদেরকে বলা হয়েছে। এটা কিন্তু কোন ক্যাবিনেটে কোন আলোচনা করে এই সিদ্ধান্তটা নেয়া হয়নি। তো এই কারণে আমি বলব যে এটা উদ্দেশ্যমূলকভাবে করা হয়েছে। এই যে আদিবাসী শব্দ ব্যবহার করা যাবে না বলা হল, আমরা যারা এদেশের নাগরিক আমরা এটাকে গ্রহণ করছি না এবং আমরা প্রতিবাদও জানাচ্ছি। আমার মনে হয় সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে আমাদের বাংলাদেশে যে রাষ্ট্র এটার পরিচয়, লড়াই,মূল্যবোধ বিষয়ে যদি পরিষ্কার ধারনা থাকে সবার মধ্যে তাহলে কিন্তু আদিবাসী শব্দ নিয়ে আসলে জনগণের সমস্যা হওয়ার কথা না।

আইপিনিউজ: আপনি বিশেষ সংস্থার কথা বলেছেন, সরকারের কোন বিশেষ সংস্থা এটা যদি আপনি একটু স্পষ্ট করতেন….
খুশি কবির: ঠিক কোন সংস্থা সেটা আমি জানিনা। আমি যতটুকু জানি, অনেক গোয়েন্দা সংস্থা আছে, সেখান থেকে কোন একটা। আমি যেটা বলছিলাম যে আদিবাসী শব্দটা বর্তমান যারা সরকারে আছেন তারাও কিন্তু ব্যবহার করেছে। তারা এবং তাদের প্রতিনিধিরাও আদিবাসী দিবসে অংশগ্রহণও করেছে নানা ভাবে। আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীও ২০০৯ এ ও আদিবাসীদের বাণী দিয়েছেন। ২০০৮ এর নির্বাচনী ইশতেহারেও কিন্তু আদিবাসীদের ব্যাপারে বেশ স্পষ্ট বিষয় ছিল এবং আদিবাসী শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। একটা বড় রাজনৈতিক দল যেটা আমাদের দেশের বলতে পারি প্রায় সবচেয়ে পুরনো একটি রাজনৈতিক দল যে দল আমাদের নেতৃত্ব দিয়েছিল স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়, তো এই দল যখন ইশতেহার দিয়েছিল তারা যে না বুঝে বিষয়গুলো দিয়েছিল এমনতো না । ক্ষমতায় আসার কিছু সময় পর বলা হচ্ছে যে আদিবাসী শব্দ ব্যবহার করা যাবে না। উপজাতি ব্যবহার করবে কিনা, নাকি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সেগুলো নিয়ে আলোচনা হয় তখন, যেটা একটা খুবই অদ্ভুত ব্যাপার।

তো আমি যেটা প্রথমে বলছিলাম যে জনগণের কাছে এটা স্পষ্ট না আসলে। আর বাংলাদেশের জন্ম এটা কোন আদর্শ নীতি আর কোন বৈশিষ্ট্যের উপর জন্মেছে এটা যদি স্পষ্ট হয় তাহলে অনেক কিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে। বাংলাদেশের জন্ম তো আমরা সবাই জানি যে একটা স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে। যারা অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করেছে শুধু তারাই যে দেশ স্বাধীন করেছে এমন নয়, এইটা এমন একটা যুদ্ধ যেখানে সকল সাধারণ নাগরিক গ্রামে শহরে নগরে বন্দরে, যে কোন জাতি, যেকোনো ধর্ম, যে কোন পেশা, যে কোন শ্রেণী, লিঙ্গ সবাই কিন্তু অংশগ্রহণ করেছে এবং এই পুরো সহযোগিতাটা যদি না থাকতো এত দ্রুত এই দেশ স্বাধীন হতো না, আরো অনেক বছর লাগত। গ্রামে গঞ্জে যখন মুক্তিযোদ্ধারা যেত আশ্রয় দেওয়া, খাবার দেওয়া, তারপরে পাকিস্তানী আর্মিদের তথ্য দেওয়া সহ নানান ভাবেই সহযোগিতা করতো। অনেককে এজন্য ভুগতেও হয়েছে, অনেকগুলো গ্রাম পুড়িয়েও ফেলা হয়েছে। আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি, আমরা যে পাকিস্তান শাসনের অধীনে ছিলাম, পাকিস্তান আমাদের সংস্কৃতি সেটাকে গ্রহণ করছিল না। তারমানে আমার সাংস্কৃতিক পরিচয়, আমার অবস্থান আমার পরিচয় ভাষা-সংস্কৃতি এগুলোর ব্যাপার। তারমানে শুধুমাত্র বাঙালি সংস্কৃতি নয় এই ভূখন্ডে যারা আছে তাদের সংস্কৃতি, তার মানে বহুত্ববাদ আমাদের দেশের জন্মেরই একটা অংশ। গণতন্ত্র ধর্মনিরপেক্ষতা এগুলো সব আমাদের বিষয়।

অনেকেই বলে যে বাংলাদেশে তো আগে বাঙালিরাই আগে আসছে বাঙালিরাই নাকি আদিবাসী । আসলে বাঙ্গালী একটা মিশ্র জাতি। বিভিন্ন জায়গা থেকে যারা এখানে আসছে এবং যারা ছিল সব মিলেমিশে বাঙালি। কিন্তু আদিবাসী যারা তাদের নিজেদের গোত্র নিজেদের নিজেদের জাতি নিজেদের ভাষা নিজেদের সংস্কৃতি এটা কিন্তু আলাদা রেখে দিয়েছে। আদিবাসীদের মধ্যেও অনেক ধরনের পার্থক্য আছে নিশ্চয়।

আইপিনিউজ: আদিবাসী নারী আন্দোলন আর মূলধারার নারী আন্দোলনের সম্পর্ক, সমস্যা, সম্ভবনা সম্পর্কে আপনার ভাবনা বা মতামত কি?
খুশি কবির: নারী আন্দোলনে নারীরা নিজেদের অধিকারের জন্য লড়াই করে। গত ২০ বছর ধরে নারীবাদী চিন্তা ধারায় নতুন একটা ধারণা চলে আসছে। সেটা হল ইন্টারসেকশনালিটি।এটার ইংরেজি বলছি, যুতসই বাংলা খুঁজে পাচ্ছিনা। তবে এটা হচ্ছে যে একজন নারীর অনেকগুলো পরিচয় আছে। আমি একজন নারী, আমি একজন সমাজকর্মী, আমি একজন আন্দোলনকারী, আমি একজন চাকরিজীবী,আমি মা ইত্যাদি।

সকল নারীকে যদি বলা হয় যে সকল নারী বৈষম্যের শিকার এটা ঠিক, কিন্তু সকল নারী একই বৈষম্যের শিকার এমনটা নয়। এটা শ্রেণী-জাতি সবকিছুর উপর নির্ভর করে হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারনে বিশেষ করে ধর্মীয় অথবা জাতিগতভাবে অন্যদের উপর চাপিয়ে দেয়ার প্রবণতা রয়েছে। আমরা যদি দেখি যে, ভারতে যেমন মুসলমানদের উপর নানান কিছু চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে, তেমনি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেখি যে এখানে অমুসলিমদের উপর অনেককিছু চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। এটা হল যে মেজরিটিদের আধিপত্য। এখন সেটা যদি আদিবাসী নারীর বিষয় হয়, সেতো সংখ্যালঘুর মধ্যেও আরো সংখ্যালঘু। আমাদের দেশে যখন রাষ্ট্র আদিবাসীদেরকে স্বীকৃতি দিচ্ছেনা, তো সেখানে আদিবাসী হিসেবে তো ‘মূলধারার’ বাঙালির চেয়েও তাদের আলাদা একটা বৈষম্যমূলক অবস্থায় থাকতে হয়। তার মধ্যে নারী হিসেবে আদিবাসী নারীদের কথা ভাবুন।আদিবাসী নারী হিসেবেও সে তার জাতির মধ্যেও কিন্তু বৈষম্যের শিকার হয়। আমি জানি যে আমাদের দেশে আদিবাসীদের মধ্যে দুটো জাতি আছে তারা মাতৃসুত্রীয়। সেখানে মাতৃসুত্রীয় বলে সে জমির অধিকারটা পায়, উত্তরাধিকারটা পায়, কিন্তু সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার কিন্তু তার নেই। এটা কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে। সে তার নিজের গোত্রের ভিতরেও কিন্তু অনেক ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়। আরেকটা যে ব্যাপারটা হলো আমাদের যে সামাজিক ব্যবস্থা,মেজোরেটারিয়ান বা সংখ্যাগুরুর সংস্কৃতি, এর প্রভাব আমাদের আদিবাসীদের উপরেও পরে যাচ্ছে। এবং তারাও একই ধরনের ব্যবহার নারীদের সাথে করে।

আমি একটা উদাহরণ দিই, আমরা রংপুরের বেশ কয়েকটি উপজেলায় কাজ করেছি। তার মধ্যে একটা উপজেলার একটা গ্রামে সাঁওতাল নারীরা কৃষি মজুর হিসেবে কাজ করে। তো এখানে মজুরির হারে পুরুষ যা পায় নারীরা তার চেয়ে কম পায়। তো ওরা বলছিল যে আমরা পুরুষের চেয়ে বেশী খাটতে পারি, আমরা আরো বেশি দক্ষ, তো আমাদের মজুরি কম কেন হবে? এটা নিয়ে তারা যখন বার্গেইনিং করছিল, স্বাভাবিকভাবে বাঙ্গালী যে জমির মালিক, সে এটাকে মানছিলো না। আমাদের ওখানে কিছু সংগঠনের কাজ আছে। তখন আমাদের সাথে তারা বসলো, বসে আমাদের যে সমিতিগুলো আছে ভূমিহীন নারী এবং পুরুষদের, সবাই ঠিক করল যে ওদের দাবিটা খুবই ন্যায্য। তারা ঠিক করল কেউ ধান কাটার সময় ছিল সেখানে ধান কাটতে যাবে না। মালিকরা অন্যদের নিয়ে আসতেও পারলো না। বাঙালি পুরুষরাও এই প্রতিবাদের সাথে যুক্ত ছিলো। তারা তাদেরকে সাপোর্টাটা দিয়েছে যে আমরা কোন বাঙালি পুরুষকেও যেতে দেবো না। এটা সাকসেসফুল হয়েছিল।এটা বেশ ৩-৪ বছর আগের ঘটনা। ঐ গ্রামের ওই নারীরা এখনো সমান মজুরি পাচ্ছে।

আদিবাসীদেরকে সবাই গ্রহণ করে আবার কেউ কেউ আদিবাসীদের বাড়িতে পানিও খাবেন না, এটাতো আছেই, আবার কিছু আদিবাসী গোষ্ঠী আছে যাদেরকে অন্য আদিবাসীরাও সে ভাবে গ্রহণ করেননা। তো এই যে পার্থক্যগুলো, এইটাকে কিন্তু সেকশনালিটি বলে।

আমরা যারা নারীবাদী আন্দোলন করি আমরা এখানে প্রচন্ড রকম বিশ্লেষণ করছি এবং এটাকে বুঝতে চেষ্টা করছি। আদিবাসী নারীরা নিজেদের আন্দোলন নিজেদের অবস্থানের জন্য করবে। পাশাপাশি আমি যে উদাহরণটা দিলাম মজুরি নিয়ে, এটা হল যে আমাদের একটা সার্বিক আন্দোলনও দরকার। আমার বন্ধু দরকার যারা আমাকে সাপোর্ট করবে, আমাদের আন্দোলনের ক্ষেত্রেও সেটা খুবই প্রয়োাজন। তো সর্ম্পক যেমনটা হওয়ার এখনো পুরোপুরি হয়নি।

একটা জিনিস ভালো যে পার্বত্য চট্টগ্রামে কিন্তু আদিবাসী নারীদের আন্দোলন বেশ অনেকটাই শুরু হয়ে গেছে, সবগুলো গোষ্ঠীর মধ্যে সমানভাবে না হলেও যারা একটু পড়াশোনা করেছে বা যারা একটু এগিয়ে এসেছে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হচ্ছে। এটাকে বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা হয়েছে এবং নিজেদের আন্দোলন করছে। কিন্তু সমতলের আদিবাসীদের মধ্যে ঐ ধরনের আলাদা একটা নারীবাদী আন্দোলন যেটা আমি পার্বত্য চট্টগ্রামে দেখেছি, সেটা কিন্তু সমতল আদিবাসীদের মধ্যে দেখিনি। সেখানে ব্যাপারটা হলো আমার আদিবাসী পরিচয় এটাকে আগে ঠিক করি, নারীর আন্দোলনটা আমরা পরে করি। পার্বত্য চট্টগ্রামে ওটা এখন অতিক্রম করে বেশ কয়েকটা নারী সংগঠন হয়েছে যারা হলো দুটোই বলছে, আমরা আদিবাসী এবং আমরা নারী।

সার্বিকভাবে এই বিষয়টাকে বিশ্লেষণ করার জন্য আমাদের আরও সময় প্রয়োাজন। এটা শুরু হয়েছে। আরেকটা বিষয় হল যে কিছু আদিবাসী নারী আমাদের সাথে যুক্ত হয়েছেন তাদের নিজেদের সত্তা বজায় রেখেই। আমাদের আরো খানিক সময়ের প্রয়োজন রয়েছে।

আইপিনিউজ: সারা পৃথিবীতেই বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ভাষা বিপন্নপ্রায়, কীভাবে এই ভাষাগুলো জীবন্ত থাকতে পারে এই বিষয়ে আপনার মতামত জানতে চাই?
খুশি কবির: বাংলাদেশে এখন তো অনেক আদিবাসী গোষ্ঠীর, অনেক ছেলেরা মেয়েরা কিন্তু শিক্ষিত হয়েছে এবং সেখানে আমার মনে হয় তাদের একটা ভূমিকা থাকা দরকার। কিছু কিছু আদিবাসী ভাষা আছে, যাদের কোন বর্ণ বা লেটার নাই। এইটা বড় কোন বিষয় না।

আমি যদি পাঞ্জাবি ভাষাটা দেখি, পাঞ্জাবি ভাষা কিন্তু তিনটা স্ক্রিপ্টে লেখা হয়। একটা স্ক্রিপ্ট হলো হিন্দি বা দেবাংগিরি স্ক্রিপ্ট আরেকটা হল গুর্মুখি যেটা হলো শিখদের আর আরেকটা হল উর্দু। তো একই ভাষা কিন্তু তিনটা স্ক্রিপ্ট কিন্তু পাঞ্জাবি কে তো কেউ বলবে না যে অধীনস্থ বা এরা নির্যাতিত। বরং পাঞ্জাবীরা তো যথেষ্ট বলিষ্ঠ পুরো ভারতবর্ষে বা পাকিস্তানেও। আমার স্ক্রিপ্ট না থাকা এটাকে আমি নেগেটিভলি বা খাটো করে দেখব না কিন্তু স্ক্রিপ্ট থাকলে যেটা হয়তো অনেক সুবিধা হয়।

নিজের ভাষাটাকে রক্ষা করা খুবই প্রয়োজন। মৌখিকভাবে তো এটা পরম্পরায় আসতেই থাকবে। আমাদের পড়াশোনা করতে গেলে বাংলা বা ইংরেজী বিশেষ করে বাংলা শিখতে হচ্ছে তখন আমি কিন্তু আমার নিজস্ব ভাষাটা ভুলে যাচ্ছি। আমাদের যেমন-অনেক বাঙালিরা যখন বিদেশে থাকে বা ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে তো বিদেশে থাকলে কিন্তু বাংলার চর্চা তেমন হয়না। স্বাভাবিকভাবে তো ইংরেজি স্কুলে বা কলেজে রাস্তাাঘাটে কারো সাথে বাংলা কথা বলবে তা হয়না।

এখন একই জিনিস যদি ঘটে আমার নিজ দেশে আমার নিজ ভূমিতে এটা দুঃখজনক। যদিও সরকার বলেছে যে নিজ ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ হবে। কিন্তু এই ভাষা শেখানোরও তো ব্যবস্থা নাই আসলে। আমি মনে করি যে প্রত্যেকটা গোষ্ঠী তার নিজের ভাষা বা সংস্কৃতি চর্চা করার জন্য নিজেদেরকেই উদ্যোগ নিয়ে এটাকে ধরে রাখতে হবে। তারমানে নতুনত্ব কিছু আসবে না এমন না। কিন্তু আদিবাসী মানেই তো আমার নিজের সংস্কৃতি নিজের অস্তিত্ব নিজের ঐতিহ্য, নিজের কৃষ্টি, সবকিছুকে ধরে রাখা, অটুট রাখা, মিশে গেলে আমি তো আর আদিবাসী থাকছি না। আমার সংস্কৃতিকে আমার শেকড়টাকে ধরে রাখছি কি না এটা একটা বড় মুভমেন্ট আদিবাসীদের জন্য আমি মনে করি। আদিবাসী দিবসে আমি বক্তব্যটা দিতে চাই যে নিজের শেকড়টাকে আরো শক্তিশালী করে এটাকে আরো শক্তভাবে ধরে রাখা এবং এটা যেন বিলীন না হয়ে যায় সেটা খুব প্রয়োজন।

আইপিনিউজ: আপা আমি একটা সম্পূরক প্রশ্ন জুড়ে দিই, সেটা হচ্ছে যে আদিবাসীদেরকে নিজেদের ভাষা রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে তা ঠিক। কিন্তু সরকার আসলে তার জায়গা থেকে কি করছেন, তাদের কেমন দেখছেন?
খুশি কবির : একদমই দেখি না। তারা কিছু ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার, উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট, একাডেমি করেছে। ওইটাতে শুধু একটু নাচ গান হয়। একটা জাতির পরিচয় শুধু যদি নাচ-গান পোশাকের মধ্যে থাকে তবে এটা খুবই দুঃখজনক।

আইপিনিউজ:
জাতিসংঘ ২০২২-২০৩২ সময়কালকে ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী ভাষা দশক’ পালনের ঘোষণা দিয়েছে। আমাদের দেশে প্রাক-প্রাথমিক স্তরে পাঁচটি ভাষায় শিক্ষাদানের কার্যক্রম হাতে নিলেও তেমন অগ্রগতির খবর পাওয়া যায়নি, আমরা কি ঠিক পথে এগুচ্ছি বলে মনে করেন?
খুশি কবির : আমরা অনেক নীতি নিয়ম করি, কিন্তু আমার সদিচ্ছা না থাকলে, আমার আগ্রহ না থাকলে আমি এটা বাস্তবায়ন করবো না, এমনটাই হচ্ছে।

আইপিনিউজ: তাহলে আমরা ঠিক পথে আগাচ্ছি না…
খুশি কবির : না, আমরা শুধু এটাকে লেখার জন্য লিখেছি, বলার জন্য বলেছি। আন্তর্জাাতিকভাবে যেন আমরা বলতে পারি আমরা স্বীকৃতি দিচ্ছি, নিজের ভাষায় পড়ার সুযোগ স্বীকৃতি দিয়েছি প্রভৃতি।

আইপিনিউজ: আমরা প্রায়শই দেখি পর্যটনের শিল্পের কারনে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষকে উচ্ছেদ হতে হয়, এই যে পর্যটন দর্শন এই বিষয়ে আপনার ভাবনা কি?
খুশি কবির : আমি তো সম্পূর্ণভাবে এটার বিরোধীতা করি। কারণ হলো যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জায়গাটাকে আমরা বাণিজ্যে করছি। উন্নয়নের অনেকগুলো সংজ্ঞা আছে। আমার কাছে উন্নয়নের সংজ্ঞা হলো সকল মানুষ পাঁচটি মৌলিক অধিকার পাবে। সাথে তার যে নিজের অধিকার তার যে নিজের চর্চা, চিন্তা, মতপ্রকাশ এইগুলোর সব স্বাধীনতা থাকতে হবে এবং মানবাধিকার রক্ষা করতে হবে, এগুলো হচ্ছে আমার কাছে উন্নয়ন। এটা না থাকলে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে হবে। আমরা যতই ইনফোস্ট্রাকচারালি ডেভেলপ হই, সত্যিকারের উন্নয়ন হচ্ছে না। যাদের জায়গা সবকিছু দখল করে উচ্ছেদ করছে এটাতো আমার কাছে একটা ক্রিমিনাল অফেন্স। আবার প্রতিবাদ করতে গেলেই বলবে যে তারা আমাদের দেশের উন্নয়নকে ক্ষতি করতে চায়।

আইপিনিউজ: যখন তারা উচ্ছেদ করে তখন তারা প্রায়শই একথা বলেন যে এটা খাস জমি…
খুশি কবির : এইটা একটা বিষয়। যেহেতু আমি ভূমি নিয়ে কাজ করি, অধিকাংশ আদিবাসীদের ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি নাই আসলে। এটা হলো সমষ্টিগত ব্যাপার। গোষ্ঠীর প্রধান থাকে তারা হয়তো এটার ফয়সালা করে কাউকে চাষাবাদ করতে দেয়। মালিকানা বাঙ্গালীদের মধ্যেও ছিল না । মালিকানা নিয়ে আসা হয়েছে বৃটিশদের আমলে । এটা ব্রিটিশরা করেছে তখন জমিদারি সিস্টেম করেছে যেন টেক্সগুলো নিতে পারে । কিন্তু আদিবাসীদের ওপর আরোপ করেনি। এটা কিন্তু ব্রিটিশরা বলে দিয়েছে আদিবাসীরা নিজস্ব নিয়মে চলবে। তো এখন সরকার বলছে যে আমার খাতায় যেহেতু তোমার নামে লিখিত না অতএব এটা খাস কিন্তু এটা আসলে খাস না এটা হল সামাজিক প্রপার্টি।

আইপিনিউজ:
পার্বত্য চট্টগ্রামের চুক্তি নিয়ে পার্বত্য আদিবাসী এবং বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের অনেক আশা ছিলো। কিন্তু, এখন আমরা চারদিকে কেবল আশাভঙ্গের কথা শুনি, আপনার কী মনে হয় চুক্তি বাস্তবায়ন হচ্ছেনা তার কারন কী?
খুশি কবির : পার্বত্য চট্টগ্রামের চুক্তি নিয়ে আদিবাসীদের সাথে বড় ধরনের প্রতারণা করা হয়েছে। চুক্তির বাস্তবায়ন হচ্ছে না এটা একটা প্রতারণা, পুরো প্রতারণা। আমাদের আশা ছিল, আদিবাসী যারা বিশেষ করে যারা শান্তি বাহিনীতে ছিল উনাদের একটি বড় অংশ, যদিও একটা ছোট গোষ্ঠী ছিল যারা এটাকে গ্রহণ করেনি, মনে করেছিল যে এই চুক্তির মাধ্যমে অধিকার পাব। কিন্তু চুক্তির মূল কোনটাই বাস্তবায়ন হয়নি এবং হওয়াতো তো দূরের কথা আমি প্রতি বছর দেখেছি যে এটা আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

আমি পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশনের একজন সদস্য হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামে গেলে আমাদেরকে নিয়ে খুব হইচই করা হয়। আমাদের ওপর হামলাও করা হয়েছে। আমি একবার নিজে গেছিলাম সেটা ছিল কল্পনা চাকমা অপহরণ কেইসের ব্যাপারে। একজন এসপি ছিলেন তিনি একটা রিপোর্ট দিয়েছিলো যে রিপোর্টটা খুবই হাস্যকর। যে কল্পনা চাকমাকে পাওয়া যায়নি যেহেতু, তার সাক্ষ্য পাওয়া যায়নি তাই আমরা এটা বলতে পারি না যে সে অপহৃত বা তাকে অপহরণ করা হয়েছে, মানে একটা বোকার মত রিপোর্ট। তো কল্পনা চাকমার ভাই যখন এটা নারাজি করার জন্য কোর্টে যাচ্ছে তখন কোর্ট গ্রহণ করছিল না। তখন আমরা ঠিক করেছিলাম যে কয়েকজন যাবো। আমি কোন প্রকার আয়োজন না করে কাউকে না জানিয়ে চলে গিয়েছিলাম। পরে কোর্টে কিন্ত নারাজি আবেদন গ্রহন করা হয়েছিলো। তারপরে সেখানকার অনেককেই নাকি গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন জিজ্ঞেস করেছিলেন আমি কেমনে গিয়েছি। অবস্থা এমন।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি নিয়ে আমরা তো বারবার কথা বলছি। সরকার বলছে আমরা এতগুলো বাস্তবায়ন করেছি, ছোটখাটো কিছু নামকাওয়াস্তে বাস্তবায়ন করেছে। পাহাড়ে শান্তি নিয়ে আসা, আমি ক্যাম্প উইথড্র, তারপরে ভূমি সমস্যার সমাধান এগুলোর কোনটাই বাস্তবায়ন হয়নি।

আইপিনিউজ: আমরা অনেকেই বৈচিত্র্য, বৈচিত্র্যের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করে থাকি, আমাদের একটু বলবেন, সমাজে-দেশে বৈচিত্র্য থাকার প্রয়োজনীয়তা কিংবা গুরুত্ব কি?
খুশি কবির: সমাজ না শুধু, পৃথিবীর জন্য বৈচিত্র্যের প্রয়োজন। পৃথিবীতে যদি বাঁচতে তাহলে এই বৈচিত্র্যতা রাখতে হবে এবং বাইরে থেকে জিনিস এনে, যেরকম অর্কিড আমি এখন ফলাচ্ছি আমি এখন ড্রাগণ ফল ফলাচ্ছি এটা জীববৈচিত্র্য না। এটা হল বাণিজ্যিক, কারন আমি বাইরে থেকে আমদানি করে নিয়ে আসছি। আসলে জীববৈচিত্র্য প্রত্যেক ভূখন্ডের একটা নিজস্ব থাকে, প্রাকৃতিক পরিবেশ সবকিছু, এই জিনিসটা যদি আমরা না বুঝি তবে আমরা পৃথিবীকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিবো।

আইপিনিউজ: আদিবাসী দিবসের এইবার এর মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে ‘ঐতিহ্যগত বিদ্যা সংরক্ষন ও বিকাশে আদিবাসী নারী সমাজের ভূমিকা’ এ নিয়ে আপনার মতামত যদি দিতেন….
খুশি কবির: সাধারণত এই ঐতিহ্যগত বিদ্যা যেটা আছে এটার ধারক-বাহক কিন্তু নারীরাই। আমি বলছি যে নারীদের ভূমিকা তো আছেই, কিন্তু শুধু নারীদের এত ভূমিকা থাকা উচিত না, এটা পুরো সমাজকে, পুরো জাতিগোষ্ঠীকে দায়িত্ব নিতে হবে। উভয় মিলেই এটাতে ভূমিকা রাখতে হবে। এটা ঠিক যে আদিবাসী নারীদের মধ্যে বেশি আছে যেমন তাঁত বোনা, ঝুড়ি তৈরি করা, চাষাবাদ করা, রান্না করা অধিকাংশ আদিবাসী নারীরাই করছে তো সে জিনিসটা থাকুক, কিন্তু এটা শুধু নারীদের একক দায়িত্ব না, বরং গোটা সমাজের।

আইপিনিউজ: আবারো আদিবাসী দিবসের শুভেচ্ছা, আপনার মূল্যবান সময়ের জন্য ধন্যবাদ
খুশি কবির: ধন্যবাদ আপনাদেরকেও। সবাইকে আদিবাসী দিবসের শুভেচ্ছা।

Back to top button