জাতীয়

মধুপুরে ঐতিহ্যগত জ্ঞান সংরক্ষণে আদিবাসী নারীদের ভূমিকা

চেলসি রেমাঃ ৯ই আগস্ট। বিশ্বব্যাপী আদিবাসীদের অধিকার রক্ষার জন্য প্রতিবছর এদিনে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস পালন করা হয়। এবছর ‘ঐতিহ্যগত বিদ্যা সংরক্ষণ ও বিকাশে আদিবাসী নারী সমাজের ভূমিকা’-র উপর আন্তর্জাতিকভাবে দৃষ্টিপাতের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বর্তমান যুগে নারীরা কীভাবে অতীত থেকে বহমান ঐতিহ্য ধরে রেখেছে তার অগণিত উদাহরণ এখনো বিদ্যমান।

বিভিন্ন ঐতিহ্যগত ও সচেতনতামূলক বিষয় নিয়ে কাজ করতে অটল থাকাটা আদিবাসীদের জন্য ক্রমেই জটিল হচ্ছে । ক্রমবর্ধমান সভ্যতা এবং অরণ্য উজাড়ের সাথে সাথে, মানুষও সহজ জীবনযাপনের জন্য শহরকেন্দ্রিক হয়ে উঠছে। এর মাঝেও নারীরা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে অনেক ঐতিহ্যবাহী জ্ঞান সযত্নে সংরক্ষণ করে আসছে। এ ব্যাপারে টাঙ্গাইল জেলার মধুপুরের কিছু আদিবাসী গারো নারী, নিজ অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন।

নির্মলা হাদিমা, আনুমানিক বয়স ৮০। মধুপুরের তেলকিতে বাস। ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিভিন্ন ঔষধি গাছ রোপণ করে আসছেন। এর মধ্যে বেশ কিছু হারানো ভেষজ আছে যা বিভিন্নভাবে নিরাময়ে সাহায্য করে থাকে। গ্রামের মানুষের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণও বটে। কারণ হিসেবে বলা যায়, গ্রামের হাসপাতালটি কিছুটা দূরে এবং পরিবহন ব্যবস্থাও বেশ দূর্বল।

নির্মলা হাদিমা
নির্মলা হাদিমা বলেন, বন-জঙ্গলে প্রচুর চিকিৎসার উপযোগী ভেষজ থেকে থাকে যা মানুষ ইচ্ছা অনুযায়ী বিনা অর্থে ব্যবহার করতে পারে। এর উপকারীতা শারিরীক ও মানসিক সুস্থ জীবনের জন্য অতুলনীয়। বৈজ্ঞানিকভাবেও দেখা যায়, কৃত্রিমভাবে তৈরীকৃত ঔষধ শরীরে যখন প্রবেশ করে পেছনে ফেরার কোনো উপায় থাকে না। ডাক্তারের কাছ থেকে চিকিৎসা গ্রহণ করাটা বাঞ্ছনীয় হয়ে উঠে। অন্যদিকে, প্রাকৃতিক ভেষজ অসুস্থতাকে শরীর থেকে দূরে রাখে। যা আমাদের বছরের পর বছর ধরে পূর্বপুরুষদের সুস্থ থাকার বিশেষ কৌশল হিসেবে পরিচিত। সবকিছুর মূলে হলো বিশ্বাস, বিশ্বাস না থাকলে রোগমুক্তি সম্ভব না।

জাসিন্তা নকরেক, আনুমানিক বয়স ৬০ বছর। মধুপুরের তেলকির বাসিন্দা। একজন আদিবাসী নেত্রী এবং পূর্ণকালীন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। ইন্টারনেট বা খবরাখবরে খুব একটা বিখ্যাত না হলেও নিজ গ্রামে তিনি একজন শ্রদ্ধার পাত্র। আদিবাসীদের অধিকার নিয়ে বিভিন্ন আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে প্রতিবাদ করে আসছেন এবং নিজ গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গারো শিশুদের নিজ মাতৃভাষায় পড়ালেখা শেখান।

জাসিন্তা নকরেক
জাসিন্তা নকরেকের বিশ্বাস, প্রাথমিকভাবে শিশুদের সাথে নিজ ভাষায় কথা বলা, লেখা পড়া শেখানো উচিত। পাশাপাশি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ভাষা শিশু ধীরে ধীরে একসময় আয়ত্ব করে নেবেই। সেটা বেড়ে ওঠার প্রাক্কালে হোক বা বিদ্যালয়ে অথবা জীবনের কোনো না কোনো ক্ষেত্রে যেয়ে হোক। এতে করে নিজ শিকড়কে তারা জানতে পারবে।

তিনি বলেন, ‘মানুষ শহরকেন্দ্রিক হচ্ছে। গ্রাম এখন আর আগের মতো নেই। অভিভাবকেরা নিজস্ব মাতৃভাষার চেয়ে বাংলায় কথা বলার দিকে বেশি ঝুকে যাচ্ছে, যাতে শিশুরা সংখ্যাগরিষ্ঠের মধ্যে টিকে থাকতে পারে। এতে করে আমরা আমাদের সন্তানদের নিজ সংস্কৃতি থেকে বঞ্চিত করছি। নিজস্ব ভাষা, ঐতিহ্য, খাবার ও পোশাক-পরিচ্ছদ নিয়ে একটি সমৃদ্ধ সংস্কৃতির মালিক আমরা। আগামী প্রজন্ম যদি বেচে থাকার প্রতিযোগীতায় নিজ পরিচয় ভুলে যায় তাহলে আমাদের সংস্কৃতিও বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

নিঝুম নকরেক, মধুপুরের বেদুরিয়ায় থাকে। তিনি গারো ঐতিহ্যবাহী তাঁতের পোশাক যেমন খুতুপ, উত্তরিও, গান্না-বারা এবং অন্যান্য পোষাক তৈরি এবং ডিজাইন করে থাকেন। এই পোশাকগুলি সাধারণত বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সময় গারো সম্প্রদায় পরিধান করে থাকে। গান্না-বাড়া সাধারণত বিয়ের ক্ষেত্রে গারো কনেদের পছন্দের সারিতে প্রথমেই থাকে।

নিঝুমের মতে, ‘এই ধরনের ঐতিহ্যবাহী পোশাক সবসময় গারো কনেদের প্রথম পছন্দ। যেহেতু এটি বহু বছরের ঐতিহ্য এবং নিজ আদিবাসীয় পরিচয়কে প্রতিনিধিত্ব করে।’

নিঝুম নকরেক
তবে এই উদ্যোগের পেছনে তার সংগ্রামের পথটাও ভিন্ন। দেখা যায় বিভিন্ন জায়গা থেকে একাধিক অর্ডার পেলেও, সম্পূর্ণ বুনার কাজ তাকে একাই করতে হয়। যদিও ঢাকা থেকে বড় বোন মুনমুন নকরেকের সাহায্যে তার হাতের কাজের চাহিদা ব্যপক বৃদ্ধি পেয়েছে। তবু কাজের বোঝা কমানোর মত যথেষ্ট হাত আশেপাশে নেই। তিনি উল্লেখ করেছেন, কোভিডের সময় কিছু কর্মচারী তার সাথে কাজ করতো বটে, কিন্তু লকডাউন তুলে নেয়ার পর, কর্মীরা হাতের কাজ ছেড়ে শহরে চাকরি করতে চলে যায়। তবে হতাশ হওয়ার পরিবর্তে আরও কঠোর এবং আরও আত্মবিশ্বাসের সাথে কাজ করে চলেছে এই তরুণী। তিনি আরও বলেন, সামনে প্রশিক্ষণ নিয়ে কাজটি চালিয়ে যেতে চান এবং বড় করতে চান।

মধুপুরের বেদুরিয়া গ্রামের আরেকজন মহিলার নাম ফ্রান্সিলা নকরেক, মধ্যবয়সী নারী। তিনি গামছা ও দকসাড়ি ব্যবসা করেন এবং একটি তাঁত কারখানার মালিক। দকসারি একটি গারোদের ঐতিহ্যবাহী আরামদায়ক পোশাক। গারো নারীরা ভ্রমণ, বাড়িতে বা কাজের সময় দকসাড়ি পরিধান করে থাকে। তার সাফল্য, শুধুমাত্র গারো সম্প্রদায়ের মধ্যে নয় বরং বাঙালি সম্প্রদায়ের মধ্যেও তৈরীকৃত ব্যবসার পণ্য ছড়িয়ে দিয়েছেন।

ফ্রান্সিলা নকরেকের কারখানায় কর্মরত গারো নারী

আদিবাসী নারী নেত্রী সুলেখা ম্রং বলেন, ব্যাবহারিক জীবনে নারীরা এখনো সামাজিক নানা নিয়ম চর্চা করেন। পোশাক কিংবা গহনা নারীরাই টিকিয়ে রেখেছে, পুরুষদের এ পোষাকে তুলনামূলক কম দেখা যায়। আদিবাসীদের অনেক কিছু হারিয়ে গেলেও পোষাকসহ অনেক আদি বিশ্বাস রয়ে গেছে। যার মধ্যে অনেক বিশ্বাসেরই পরিবর্তন ঘটছে। এজন্য আদি কৃষিভিত্তিক জুম চাষে অভ্যস্থ গারোদের জুমচাষ নিষিদ্ধ করা ও ভূমির অধিকার হারানো দায়ী।

তিনি মনে করেন, বিভিন্ন খ্রিস্টান ধর্মীয় চার্চের নীতি ও হস্তক্ষেপও এজন্য অনেকাংশে দায়ী এবং তিনি আরও বলেন, গারোদের সমাজ ব্যবস্থা ও বিশ্বাস আদি কৃষি ও পারিবারিক ধর্ম অনুসারে ছিল, যা একটি অতি প্রাচীন বিশ্বাস। সেই বিশ্বাসে নেতিবাচক পরিবর্তন আসছে।

প্রবীণ নেতা অজয় এ মৃ জানান, এখনো গারো নারীরাই সমাজের সামাজিক রীতিনীতি পালনে তৎপর আছে। বাড়ীতে শিশুর মুখে ভাষা শেখানো থেকে শুরু করে সামাজিক রীতিনীতি ও মূল্যবোধ গড়ে তোলার কাজটা নারীরাই করে। এমনকি আদিবাসীদের নিজস্ব চিকিৎসা পদ্ধতিও অনেক প্রবীণ নারীরাই এখনো চর্চা করেন।

তিনি আরও জানান, ভূমির অধিকার হারানোর পর কৃষি এবং খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন ঘটেছে। যা বনবাসী গারোদের জীবনযাপণে আমূল পরিবর্তন এনেছে। ভূমির অধিকার নিশ্চিত না হলে আদিবাসীদের প্রথাগত সকল বিদ্যা হারিয়ে যাবে।

Back to top button