অন্যান্যআঞ্চলিক সংবাদ

কুকি-চিন কর্তৃক ৩ ত্রিপুরা গ্রামবাসীকে হত্যা ও ২ শিশুকে আহত করার ঘটনায় টিকেএস ও টিএসএফ’এর প্রতিবাদ ও প্রধানমন্ত্রীর নিকট স্মারকলিপি

কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) এর সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের কর্তৃক রাঙ্গামাটির বিলাইছড়ি উপজেলার বড়থলি ইউনিয়নের সাইজাম পাড়া গ্রামে এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে ৩ ত্রিপুরা নিরীহ গ্রামবাসীকে নৃশংসভাবে হত্যা এবং ২ শিশুকে গুরুতর আহত করার প্রতিবাদে বাংলাদেশ ত্রিপুরা কল্যাণ সংসদ (টিকেএস) ও ত্রিপুরা স্টুডেন্টস ফোরাম (টিএসএফ), কেন্দ্রীয় কমিটির উদ্যোগে খাগড়াছড়ি প্রেস ক্লাবের সামনে এক প্রতিবাদ সমাবেশ ও মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়া মানববন্ধন শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বরাবরে ৬ দফা দাবি সম্বলিত একটি স্মারকলিপিও প্রেরণ করা হয়েছে।

আজ (২৭ জুন ২০২২) সকালে ত্রিপুরা কল্যাণ সংসদের সভাপতি সুশীল জীবন ত্রিপুরার সভাপতিত্বে এবং ত্রিপুরা স্টুডেন্ট্স ফোরামের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক অঞ্জুলাল ত্রিপুরার সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত সমাবেশে বক্তব্য রাখেন পেরাছড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তপন বিকাশ ত্রিপুরা, গোলাবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান উল্লাস ত্রিপুরা, ত্রিপুরা কল্যাণ সংসদের সহ সভাপতি হিরণ জয় ত্রিপুরা, সহ সভাপতি বিভিৎসু ত্রিপুরা, সাংগঠনিক সম্পাদক তাপস কুমার ত্রিপুরা, ত্রিপুরা কল্যাণ সংসদ, সদর থানার সাধারণ সম্পাদক মিহির কান্তি ত্রিপুরা, খাগড়াছড়ি প্রেসক্লাবের সদস্য নুরুল আজম, টিএসএফ’এর সাবেক কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নক্ষত্র ত্রিপুরা ও টিএসএফ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি নয়ন ত্রিপুরা। স্বাগত বক্তব্য রাখেন টিএসএফের কেন্দ্রীয় সহ সভাপতি খঞ্জন ত্রিপুরা।

এই ঘটনার নিন্দা জানিয়ে সংহতি বক্তব্যে ত্রিপুরা কল্যাণ সংসদের সাংগঠনকি সম্পাদক তাপস কুমার ত্রিপুরা বলেন, ‘বিলাইছড়িতে তিনজন ত্রিপুরাকে গুলি ও গলা কেটে হত্যা করার ৭ দিন পার হলেও লাশ উদ্ধারে প্রশাসনের কোন তৎপরতা দেখি না। উল্টো প্রত্যন্ত এলাকা বলে অজুহাত দেখিয়ে হাত গুটিয়ে বসে আছে। তার কারণ ও রহস্য কী আমরা সুস্পষ্টভাবে জানতে চাই?

তিনি আরও বলেন, শুধু বিলাইছড়ি ঘটনা নয়, আজকে বান্দরবানে যেখানে ঘটনা ঘটাচ্ছে তাদেরকে আইন শৃঙ্খলাবাহিনীও সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে যা দু:খজনক ও নিন্দনীয়।’ অবিলম্বে হত্যাকারীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসাসহ ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ প্রদান করার জন্য জোর দাবি জানান এই আদিবাসী নেতা।

খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের সদস্য ও ত্রিপুরা কল্যাণ সংসদের সহ সভাপতি হিরণ জয় ত্রিপুরা বলেন, ‘সন্ত্রাসীর কোনো জাত নেই, কোনো ধর্ম নেই। সন্ত্রাসী সন্ত্রাসীই।’ তিনি সন্ত্রাসীদের সংঘবদ্ধভাবে মোকাবেলার আহবান জানান এবং বিলাইছড়ি ঘটনায় জড়িত কুকি চিন পার্টি যাতে কোনোভাবে আর নিরীহ জনসাধারণের উপর হামলা করতে না পারে তাদের দ্রুত বিচারের দাবি জানান। না হলে আজকে একটা ত্রিপুরা পাড়ায় হামলা করেছে, আগামীতে তারা আরেকটা পাড়ায় হামলা চালাবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

টিএসএফ’এর সাবেক কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নক্ষত্র ত্রিপুরা বলেন, ‘হত্যাকান্ড ঘটার পর ন্যায়বিচারের দাবি জানানো হলেও কোনো ন্যায়বিচার পাওয়া যায় নি। লাশগুলোও উদ্ধার করা হয়নি। তার ব্যর্থতার দায়ভার প্রশাসন ও সরকারকে নিতে হবে।’
প্রেসক্লাবের সদস্য নুরুল আজম বলেন, ‘নারকীয় হত্যাকান্ডের দায় কুকি চিন পার্টি এড়াতে পারে না।’ তাদের সন্ত্রাসী কার্যকলাপ বন্ধে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়ার জন্য তিনি সরকার ও প্রশাসনের নিকট দাবি জানান।

টিএসএফ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি নয়ন ত্রিপুরা বলেন, ‘সন্ত্রাসী সংগঠন কুকি চিন পার্টি নিরীহ ত্রিপুরাদের হত্যার কথা তাদের ফেসবুক পেজে প্রচার করেছে, বলেছে তারা জেএসএস কর্মী মেরেছে। জেএসএস কর্মী তকমা দিয়ে ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার অপচেষ্টা চলছে। এদের ফেসবুক পেজে আমাদের হুমকি-ধামকি দিয়ে যাচ্ছে যা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। এই সন্ত্রাসী সংগঠন কুকি চিনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে রুখে দাঁড়াতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘সরকার-প্রশাসন যদি নিরীহ তিন ত্রিপুরা গ্রামবাসীকে হত্যকান্ডের ঘটনায় কুকি চিনদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ না করেন তাহলে ত্রিপুরা ছাত্র সমাজ বসে থাকবে না। আমরা কঠোর কর্মসূচি দিতে বাধ্য হব।’

সভাপতির বক্তব্যে সুশীল জীবন ত্রিপুরা বলেন, ‘আমরা সশস্ত্র সন্ত্রাসী কুকি চিন কর্তৃক নিরীহ তিন ত্রিপুরাকে হত্যা করার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিষয়টি উত্থাপন করেছি। কিন্তু আজ অবধি তার কোন সুরাহা পাওয়া যায়নি। আমরা জানি না, কার সহযোগিতায় কীভাবে তারা এগুলো করে?

তিনি আরও বলেন, ‘তিন নিরীহ গ্রামবাসীকে মারার পর তাদেরকে জেএসএসের সন্ত্রাসী বানিয়ে কেএনএফর ফেসবুকে প্রচার করে। কিন্তু ভুক্তভোগী যারা এখনো বেঁচে আছে তাদের বক্তব্য সম্পূর্ণ বিপরীত। একের এক ঘটনা কুকি চিন ঘটাচ্ছে এতকিছু জানার পরও প্রশাসন কেন চুপ করে থাকে?’

তিনি মিডিয়া ও গোয়েন্দা সংস্থাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বিলাইছড়ির ঘটনাটি সর্বাত্মকভাবে প্রচারের জন্য আহবান জানিয়ে বলেন, ‘আপনারা যদি ঘটনা প্রচার না করেন তাহলে আমাদের মনে অবশ্যই প্রশ্ন থেকে যাবে।’

মানববন্ধন শেষে বাংলাদেশ ত্রিপুরা কল্যাণ সংসদ ও ত্রিপুরা স্টুডেন্ট্স ফোরামের নেতৃবৃন্দ খাগড়াছড়ি ডিসির মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর বরাবরে একটি স্মারকলিপি প্রদান করেন।

স্মারকলিপিতে নিম্নোক্ত ছয়টি দাবি জানানো হয়-
১) নৃশংস হত্যাকান্ডের ঘটনায় জড়িত দুষ্কৃতিকারীদের আইনের আওতায় এনে সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে সঠিক ন্যায়বিচার ও সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদান করতে হবে।
২) নিহত ও আহত ব্যক্তিদের পরিবারগুলোকে যথোপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদার করতে হবে।
৩) আহতদের সুচিকিৎসার জন্য পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হবে।
৪) নিহত ও আহত পরিবার এবং হামলায় আক্রান্ত গ্রামবাসীদের জানমালের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
৫) কুকি -চীন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)-এর সংগঠনের সশস্ত্র কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে।
৬) ভবিষ্যতে এই ধরনের ঘটনা যাতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

উল্লেখ্য, গত ২১ জুন ২০২২ সন্ধ্যা আনুমানিক ৬:০০ টার দিকে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) এর সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা সাইজাম পাড়া গ্রামে এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে একই পরিবারের ৩ জন নিরীহ ত্রিপুরা গ্রামবাসীকে হত্যা এবং ২ শিশুকে গুরুতর আহত করে।
হামলায় নিহত গ্রামবাসীরা হলেন- ১। বিচাই চন্দ্র ত্রিপুরা (৫২), পীং-বাদলা ত্রিপুরা; ২। সুভাষ চন্দ্র ত্রিপুরা (২৩), পীং-বিচাই চন্দ্র ত্রিপুরা ও ৩। ধনরাম ত্রিপুরা (১৬), পীং-সিতারাম ত্রিপুরা। সন্ত্রাসীরা গুলি করে মারার পরও বিচাই চন্দ্র ত্রিপুরার মাথা কেটে দিয়েছে বলে গ্রামবাসীর সূত্রে জানা গেছে।

অপরদিকে আহত শিশুরা হল- অনন্ত ত্রিপুরা (৪), পীং-নিহত সুভাষ চন্দ্র ত্রিপুরা ও সুমনা ত্রিপুরা (১ বছর ৬ মাস), পীং-সুভাষ চন্দ্র ত্রিপুরা।

পরে আহত শিশুদের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় এবং বর্তমানে সেখানে চিকিৎসাধীন রয়েছে বলে জানা গেছে।

Back to top button