হাতীবান্ধা শালবনের আহাজারি-পাভেল পার্থ
হাতীবান্ধা শালবন দেশের এক প্রাচীন অরণ্যের নাম। যদিও মূলধারার অরণ্য-আলাপে আমরা কখনোই এই বনের নাম শুনিনি। এমনকি আজ আর এই বনের পুরোটা টিকেও নেই। লালমনিরহাটের হাতীবান্ধার উপজেলার নওদাবাস ইউনিয়নে বর্তমানে টিকে আছে এই অরণ্যের এক ক্ষয়িষ্ণু অংশ। দৈখাওয়া সীমান্ত ফাঁড়ি পূর্বনওদাবাস গ্রামের কাছাকাছি এই বনের আয়তন মাত্র ৮১.৬০ একর। গোতামারী মৌজায় ১.১০ একর এবং পূর্ব নওদাবাস মৌজায় ৮০.৫০ একর। হাতীবান্ধা বনবীটের অধীন এই বনে কাজ করছে লালমনিরহাট ‘সোশাল ফরেষ্ট্রি নার্সারী ট্রেনিং সেন্টার’। হাতীবান্ধা নামে পরিচিত হলেও অনেকে একে নওদাবাস শালবাগান কিংবা গোতামারি শালবন হিসেবে চেনেন। চৈত্রমাসে আয়োজিত নওদাবাস গ্রামের বৈদ্যনাথের মেলা বহুপ্রাচীন। আগের দিনে যারা এই মেলায় আসতেন হাতীবান্ধা ছিল তাদের কাছে এক দুর্গম অরণ্য। দেশের সকল শালবন অঞ্চলে জনপ্রতিবেশগত সমীক্ষার ভেতর দিয়ে একটি বিষয় বুঝতে পেরেছি তা হলো সকল শালবনের একটি স্থানীয় বৈশিষ্ট্য আছে, বিশেষ বাস্তুতন্ত্র। মধুপুর, ভাওয়াল, সিংড়া, ঠুমনিয়া, ধর্মপুর-কুকড়ি, শারশা শালবন কিংবা হাতীবান্ধা শালবন। ক্ষয়ে যেতে যেতে কিছু জায়গায় কিছু প্রাচীন শালবৃক্ষ দাঁড়িয়ে থাকলেও হাতীবান্ধার বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য আছে যা অনন্য। হাতীবান্ধা শালবনের শালবৃক্ষে প্রচুর শৈবাল, লাইকেন, ফার্ণ ও মসের বিস্তৃতি আছে। ২০১০ সনের এক সফরে প্রায় ছয় রকমের ফার্ণ দেখতে পাই। হাতীবান্দা শালবনের চারধারে ছিল বর্মণ, ক্ষত্রিয়, কোচ, রাজবংশী গ্রাম। কিন্তু দেশ স্বাধীনের আগ থেকেই এই জনমিতি পাল্টাতে থাকে। এলাকায় বহিরাগত মানুষের ঘনত্ব বাড়তে থাকে। বিশেষ করে আসাম থেকে প্রত্যাগত বাঙালিসহ দেশের টাঙ্গাইলের ধনবাড়ি ও মধুপুর অঞ্চলের বাঙালিরা এলাকায় নতুন আবাস গড়ে তুলেন। মানুষের বসতির কারণেই মাত্র পঞ্চাশ/ষাট বছরে হাতীবান্ধা শালবন নিশ্চিহ্ন হতে থাকে। নতুন বসতি কেবল জায়গা নয়; জ্বালানি ও গৃহস্থালী কাজের জন্য শালবনের সীমিত সম্পদের ওপর হামলে পড়ে। আজ এই ছোট্ট একরত্তি বনটি খুব ভাল নেই। এখন কিছু মানুষ পিকনিকের জন্য এই বনে আসে, মাটি খুঁড়ে বিশালসব হাঁড়িতে রান্না চাপায়, মাইক বাজায় আর পুরো বনটি প্লাস্টিকে বিষিয়ে দিয়ে চলে যায়। ২১ মার্চ বিশ্বব্যাপি বিশ্ব বন দিবস পালিত হয়। বিশ্ব বনদিবসে আড়ালে থাকা দেশের এক ছোট্ট বনের আহাজারি তুলতে চাইছে চলতি আলাপ।
হাতীবান্ধা শালবন
হাতীবান্ধা-দৈখ্ওায়া সড়কের পাশে বর্তমানে টিকে আছে একটুখানি শালবন। বনের পূব-পশ্চিমে নওদাবাস, উত্তরে গোতামারী। আগে এই শালবনে এক জলপ্রবাহ ছিল, এখন নেই। বনের চারদিকে চ্যাংমারিদোলা (চাষের জমি)। তিস্তা নদী বন থেকে প্রায় ১০ কি.মি দূরে। শাল এই বনের নির্দেশক প্রজাতি। স্থানীয় ক্ষত্রিয়-বর্মণেরা বলেন ‘শালটি’ গাছ। এছাড়াও এই বনে শিমূল, ক্ষুদিজাম, আম, কাঁঠাল, টিকি, কাউয়াঠুকি, ফুলকুড়ি, উড্ডা, হাটুভাঙা, পানিমুচুরি, বাঘাচড়া, চাত্তা, ভাটি, কড়িয়াফুল, কাউয়ারফুটকী ও চুনাতি গাছ আছে। বনে এখনো কিছু বুনো আলু পাওয়া যায়। তবে বৈচিত্র্য ও সংখ্যায় কম। ক্ষত্রিয়-বর্মণ নারীরা কার্তিক মাসে বনের আলু তুলতে বনে যায়। চিকনী আলু, মাজ আলু, গাজ আলু, ব্যাং আলু, জংলি আলু কিছু পাওয়া যায়। এই বুনো আলুই আগের দিকে কার্তিকের মংগায় হাতীবান্ধা শালবনের ধারের বর্মণ-ক্ষত্রিয়দের বাঁচিয়েছে। বর্ষাকালে বনের মাটিতে ও কিছু গাছের গুঁড়িতে বুনো মাশরুম দেখা যায়। একসময় বনটি ডালকুকুরের জন্য বিখ্যাত ছিল। স্থানীয়রা বলে ডালগন্দা। শিয়াল, বনবিড়াল (বড়বিলি/বারবিলাই), বেজি (বিজি), খরগোশ, চিতাবিড়াল, শূকর এসব প্রাণিদের হঠাৎ দেখা যায়। দাঁড়াশ ও গুমা সাপ কিছু দেখা যায়। বনটি সবচে বেশি হারিয়েছে পাখি। এখন কেবল টিয়া, শালিক, ঘুঘু, ময়না আর ঝুরি সার পাখি কিছু দেখা যায়। বনে মাখলা ও বড় বাঁশের কিছু ঝাড় আছে।
বিলুপ্ত এক শালবনের অবদান ও গুরুত্ব বোঝার জন্য নওদাবাস গ্রামের ক্ষত্রিয়-বর্মণ নারীদের সাথে ২০১০ সনে এক অতি খুদে জনউদ্ভিদ আলাপ করেছিলাম। হাতীবান্ধা এলাকার সামগ্রিক বাস্তুতন্ত্র সুরক্ষা কেবল নয়, তিস্তা অববাহিকার বিন্যাস ও বিকাশে এই বনের প্রাকৃতিক ও সাংষ্কৃতিক গুরুত্ব অপরিসীম। ক্ষুদিজাম, কাউয়াঠুকি ও রাখালনাড়– গাছের ফল মানুষ খেতে পারে। বনের কড়িয়াফুল ও বেলপাতা ক্ষত্রিয়-বর্মণদের পূজায় কাজে লাগে। বর্মণ নারীরা বড় বাঁশের নতুন কন্দ শাখা মাটির পাতিল দিয়ে ঢেকে রাখেন, কিছুদিন পর পাতিল সরালে বাঁধাকপির মতো ‘নুখা’ দেখা যায়। এই নুখা রান্না করে খাওয়া যায়। বনের ভেতর রাজবংশীদের সন্যাস পূজার থান আছে। প্রাচীন এক শালগাছের নিচে। মাঘ মাসে গ্রামের সবাই মিলে বনে যাতে কারো বিপদআপদ না হয় গ্রামের মঙ্গলের জন্য সামাজিক পরব পালন করা হয়। ক্ষত্রিয়-বর্মণেরা জিগা গাছের নিচে বাস্তুনারায়ণ পূজা করেন বলে এই গাছ তাদের কাছে পবিত্র বৃক্ষ হিসেবে মান্য করা হয়। ক্ষত্রিয়-বর্মণ ও রাজবংশী নারীরা কার্তিক মাসে শালগাছের কষ/আঠা সংগ্রহ করেন। এই আঠা জমিয়ে শুকিয়ে গুঁড়ো করে ‘ধূনা’ তৈরি করা হয়। এই ধূনা মশা তাড়াতে ও পূজায় কাজে লাগে। বন থেকে ঢেঁকি শাক, কচু পাতা ও জোংয়ের ডেরা সংগ্রহ করেন নারীরা। গবাদিপশুর খাদ্য হিসেবে বন থেকে আলকলতা সংগ্রহ করা হয়। নওদাবাসের বিখ্যাত কবিরাজ ছিলেন জগতমোহন বর্মণ। তার পুত্র দৈত্যনাথ বর্মণও কিছু কবিরাজি করেছেন। দৈত্যনাথের পুত্র যতীন্দ্র বর্মণের (৮০) সাথে সাক্ষাত হয়েছিল ২০১০ সনে। যতীন্দ্র বর্মণও গ্রামে কবিরাজি করতেন। নইজ্জ্যরশি, ঘুলটি আর বড়রসুন গাছের কন্দ দিয়ে গরুর চিকিৎসায় তারা একটি ভেষজ ওষুধ ব্যবহার করেন। এটি তাদের পারিবারিক উত্তরাধিকার, বংশগত আবিষ্কার। কেবলমাত্র হাতীবান্ধা শালবন থেকেই এই ভেষজগুলো সংগ্রহ করতে হয়।
হাতীবান্ধা শালবনের সংকট
হাতীবান্ধা শালবনের সংকট কী? প্রথমত হাতীবান্ধার মতো বিরুপ্তপ্রায় বনভূমিগুলোকে আমরা কখনোই আমাদের অরণ্য-আলাপচারিতায় রাখিনা। আমাদের বনভূমিবিষয়ক আলাপ খুব বেশি সুন্দরবনকেন্দ্রিক বা বড়জোর তা লাউয়াছড়া অবধি গড়ায়। এমনকি খাদিম, ঠুমনিয়া, কুকড়ি বা লক্ষীবাওর জলাবনের কথাও আড়ালেই থেকে যায়। হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ের লক্ষীবাওর জলাবন আয়তনে প্রায় তিন কিলোমিটার এবং রাতারগুল থেকেও বড়। কিন্তু পর্যটনের কারণে রাতারগুলই আমাদের কাছে পরিচিত। তো, চলতি আলাপের হাতীবান্ধা শালবন কীভাবে নি:শেষ হতে চলেছে? দেশের সকল অরণ্য ও প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র মূলত ক্ষতিগ্রস্থ ও নি:স্ব হয়েছে বাইরে থেকে আসা মানুষের আবাসনের কারণে। হবিগঞ্জের রেমা-কালেঙ্গা অভয়ারণ্যে নেয়াখালী থেকে অভিবাসিত এক সুবিশাল বাঙালি বসতি আছে। টাঙ্গাইলের মধুপুর শালবনের চারধারে বাইরে থেকে আসা মানুষের বসতি আজ প্রাচীন এই অরণ্যকে বনসাই বানিয়ে রেখেছে। মধুপুর শালবনে ফারমপাড়া নামে এক বাঙালি বসতি আছে, যারা আবার উচ্ছেদ হয়ে এখানে আসেন আরেক উন্নয়ন কর্মসূচির জন্যই। স্বাধীনতার আগে থেকে হাতীবান্ধা শালবনের চারধারে বাড়তে থাকে বহিরাগত সেটেলার বাঙালিদের অভিবাসন। তারা বন কেটে চাষের জমি বের করে। স্থানীয় প্রভাব ও রাজনৈতিক বলয়ে প্রবেশ করে বনের জমিতে চাষাবাদ শুরু করে। বনের পাশে পূর্বনওদাবাস গ্রামে এখন বাঙালিদের সংখ্যা প্রায় পনের হাজার। এদের অধিকাংশই আসাম ফেরত এবং টাঙ্গাইলের মধুপুর ও ধনবাড়ি থেকে এসেছেন। নওদাবাস গ্রামের প্রবীণ কৃষক আবদুর রশীদ জানান, …এইটা ক্ষত্রিয় হিন্দুগো দেশ, এইখানে আগে শাল আর বেত বাগান ছাড়া কিছুই আছিল না। বহু দলিল স্বাক্ষ্য দেয়, এখানকার বর্মণ-ক্ষত্রিয় বসতিগুলি সুপ্রাচীন এবং এখানকার আদিবসতি। এমনকি এই বনের ওপর নির্ভর করেই কালীচরণ সাধু, জটিয়া কবিরাজ, যতীন সাধু বিখ্যাত কবিরাজ হয়েছিলেন। হাতীবান্ধা বনের চারধারে যত বেশি সেটেলার বাঙালি বসতি বাড়তে থাকে ততই দিনে দিনে কমতে থাকে বনের আয়তন ও বৈচিত্র্য। হাতীবান্ধা শালবনে এখন প্রাকৃতিক জলাধারের কোনো অস্তিত্ব নেই। এমনকি বনে পর্যাপ্ত উঁইঢিবি বা লতানো গুল্ম নেই। তাই এখানকার মাটিতে শালবনের বিজ্ঞান অনুযায়ী প্রাকৃতিক পানির প্রবাহ রুদ্ধ হয়েছে। এটি ঝরাপাতার বনের বিকাশে একটি অন্তরায়। বনে মৌমাছি ও পতঙ্গবৈচিত্র্য নেই বললেই চলে, প্রাকৃতিক পরাগায়ণও এখানে বাঁধাগ্রস্থ হচ্ছে। বহিরাগতদের কাছে এই বনভূমি কেবলমাত্র একটুখানি সরকারি জায়গা ও শালবাগান। এখানে কাঠ, জ্বালানি ও বিনোদনের স্থান পাওয়া যায়। কিন্তু এই বনের আশেপাশের আদিবাসিন্দা বর্মণ-ক্ষত্রিয়দের সাথে কথা বলে জানতে পারি তাদের জীবনে এই বনভূমি প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে মিশে আছে। এমনকি এই বনে তাদের কিছু পবিত্র ধর্মস্থল রয়েছে, যেখানকার সকল প্রাণ-প্রজাতি সুরক্ষা করতে হয়। চলতি আলাপে বিবৃত দেশের এক ক্ষয়িষ্ণু ও আড়ালে থাকা শালবনের নমুনা থেকে বোঝা যায় অরণ্য সুরক্ষায় আমাদের করণীয় কেমন হতে পারে।
বিশ্ব বন দিবস ও প্রতিজ্ঞা
প্রতি বছর ২১ মার্চ বিশ্ব বন দিবস পালিত হয়। এ বছরের প্রতিপাদ্য হলো, টেকসই উৎপাদন ও ব্যবহার করতে বনের ভূমিকা। আর বনভূমির এই অবদানকে যথাযথ মূল্যায়ণ ও স্বীকৃতির মাঝেই আছে ভবিষ্যতের সুরক্ষিত অনুপ্রেরণা। কিন্তু আমরা আমাদের বনভূমির প্রতি কতোটা আন্তরিক? বাংলাদেশের প্রাকৃতিক ও সামাজিক বিকাশ ও সুরক্ষায় আমরা কখনোই আমাদের বনভূমির অবদানের খতিয়ান পাবলিক করে তুলিনি। বনভূমি এবং বনভূমি বাস্তুতন্ত্রের প্রকল্প গুলো কতোটা স্থায়িত্বশীল এবং প্রতিবেশবান্ধব? এই প্রশ্ন দেশের যেকোনো বনভূমির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আসুন বিশ্ব বনদিবসে প্রতিজ্ঞা করি, হাতীবান্ধাসহ দেশের আলোচিত কী আড়ালের সকল অরণ্য ও প্রাকৃতিক বাস্তুসংস্থান সুরক্ষায় আমরা আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যকে স্পষ্ট ও প্রসারিত রাখবো।
গবেষক, প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ। ই-মেইল: [email protected]