মতামত ও বিশ্লেষণশিল্প ও সংস্কৃতি

বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা আন্দোলন – পাভেল পার্থ

২০০৫ সনে প্রথম জানতে পারি বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা আন্দোলনের কথা। ভাষা শহীদ সুদেষ্ণা সিনহার কথা। তখন এ সম্পর্কে দেশে কোনো লেখালেখি খুঁজে পাইনি। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী গ্রামগুলো ঘুরে ২০০৬ সনে পত্রিকায় লিখি ‘বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা আন্দোলন’। ২০০৭ সনে উত্তর-পূর্ব ভারতের আসাম রাজ্যের হাইলাকান্দি, করিমগঞ্জ ও শিলচর যাওয়া হয়। হাইলাকান্দি আশ্রমরোডের বাসায় বিস্তর আলাপ হয় শিক্ষক ও লেখক ব্রজেন্দ্র কুমার সিনহার সাথে। শিলচরের জ্যোর্তিময় সিনহা, হাইলাকান্দির মণিময় সিনহা, প্রতিশ্রুতি মহিলা কল্যাণ সমিতির সুখদা সিনহারাও আলাপে অংশ নেন। ঘুরে দেখি করিমগঞ্জের কলকলিঘাট রেলস্টেশন। এখানেই মাতৃভাষার দাবিতে ১৯৯৬ সনের ১৬ মার্চ শহীদ হন সুদেষ্ণা সিনহা। দেশে ফিরে ‘দুনিয়ার প্রথম আদিবাসী ভাষা শহীদ’, ‘দুনিয়ার প্রথম রক্তক্ষয়ী আদিবাসী ভাষা আন্দোলন’, ‘ভাষা শহীদ সুদেষ্ণা সিনহা’ এমন শিরোনামে বেশকিছু লেখা লিখি। এর আগে কেবল জানা ছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন আর বাংলা ভাষা শহীদদের কথা। ২৬ বছর পার হলেও বাংলাদেশে বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষা আন্দোলন নিয়ে খুব একটা পাবলিক আলাপ বা তৎপরতা দেখিনি। দেশে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের শিল্পসাহিত্য ভুবন বেশ সক্রিয়। মণিপুরী শাড়ি, মণিপুরী নৃত্য কিংবা রাসলীলার জন্য বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী সংষ্কৃতি বেশ পরিচিত হলেও বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষা আন্দোলন কী সুদেষ্ণা সিনহাকে এখনো বাংলাদেশে মাতৃভাষার আলাপের ময়দানে দেখা যায়নি। এমনকি আসামে বাংলাভাষার দাবিতে ১৯৬১ সনের ১৯ মে শহীদ ১১ ভাষাযোদ্ধার কথাও খুব একটা আলাপে আসেনা। আসেনা ১৯৬০ সনের ৪ জুলাই অসমীয়া ভাষা আন্দোলনে শহীদ রঞ্জিত বরপূজারীর কথাও। বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের গর্বিত সত্তর বছরে চলতি আলাপখানি বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা আন্দোলন ও ভাষা শহীদ সুদেষ্ণা সিনহাকে স্মরণ করছে।

বরাক-ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় মাতৃভাষার দাবি

ভারতের উত্তর পূবাঞ্চলীয় রাজ্য আসামের দুটি প্রধান উপত্যকা, একটি ব্রহ্মপুত্র অপরটি বরাক। এই রাজ্যেই বাংলা, অসমীয়া ও বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষার জন্য শহীদ হয়েছেন ভাষাবিপ্লবীরা। ১৯২৭ সালে আসাম প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য সিলেটের গোলাপগঞ্জ থানার রণকেলী গ্রামের আবদুর হামিদ চৌধুরী(সোনা মিয়া) বাংলা ভাষায় প্রশ্ন করেন। জবাবে পরিষদের জুডিশিয়াল মেম্বার বলেন, বাংলা ভাষায় প্রশ্ন করলে এর উত্তর দেয়ার বিধান আইনে নাই। তখন সিলেটের সব সদস্য রুখে দাঁড়ান। আসাম সরকার ১৯২৭ সালে বাংলা ভাষাকে পরিষদের ভাষা হিসেবে যুক্ত করেন। ১৯৫২ সনেই আসামে অসমীয়া ভাষার সরকারি স্বীকৃতির জন্য আসামে আন্দোলন শুরু হয়। বাংলাভাষার দাবিতে ১৯৬১ সনের ১৯ মে শহীদ আসামে কমলা ভট্টাচার্যসহ শহীদ হন ১১ জন।

বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা আন্দোলন ( ১৯৫৫-১৯৯৬)

১৯৫৫ সন থেকেই বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীরা মাতৃভাষার অধিকারের আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ হতে শুরু করেন। দাবি ছিল আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্যে বিষ্ণুপ্রিয়া শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষাদান। ভাষার দাবিতে গড়ে উঠে ‘সত্যাগ্রহ আন্দোলন’। ১৯৬১ সালের ২ জুলাই ভাষা পরিষদ ভাষা দাবি দিবস পালন করে। ভাষা পরিষদ ১৯৬৪ সালের ৭ জুলাই আসামের মূখ্যমন্ত্রীর কাছে একটি মেমোরান্ডাম পেশ করেন। ১৯৬৮ সালের মে মাস থেকেই স্কুল, কলেজসহ রাস্তা ঘাটে পিকেটিং, ধর্মঘট শুরু হয়। ১৯৬৯ সালের ১৫ অক্টোবর কাছাড়ের বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী শিক্ষার্থী ও যুবসমাজ রক্ত দিয়ে রক্তস্বাক্ষর কর্মসূচি পালন করে। ১৯৬৯ সালের ২২ অক্টোবর কাতিগড়া বন্ধ কর্মসূচি থেকে ৭ জন ভাষাবিদ্রোহীকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৭০ সাল থেকে ভাষা আন্দোলন অন্য মোড় নেয়। ১৯৭০ সালের ১৯-৩০ এপ্রিলের ভেতর কাছাড়, ত্রিপুরা ও শিলং-এ ২৪ ঘন্টার গণঅনশণ করেন বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষাবিদ্রোহীরা। ১৯৮২ সালের ২৫ জানুয়ারি আসামের শিল্প মন্ত্রণালয় ও ‘বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ছাত্র ইউনিয়নের’ ভেতর একটি বৈঠক হয়। ১৯৮৩ সালের ২৫ অক্টোবর আসামের রাজ্য সরকারের কেবিনেট মিটিং-এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, কাছাড় ও করিমগঞ্জ জেলার স্কুল গুলোতে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষাকে প্রাথমিক পর্যায়ে অন্তর্ভূক্ত করার। ১৪ নভেম্বর ১৯৮৩ তারিখে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা চালু বিষয়ক একটি নোটিফিকেশন হয়, কিন্তু দু:খজনকভাবে ৮ ডিসেম্বর ১৯৮৩ তারিখে তা স্থগিত করা হয়। ১৯৯২ সালের ২১ অক্টোবর বরাক উপত্যকার বারমুনি, কাটাখাল, কালানি, পাথাবরকান্দিতে ২৪ ঘন্টার জাতীয় সড়ক অবরোধ কর্মসূচি পালন করা হয়। ১৯৯২ সালের ৩ ডিসেম্বর আসামের মূখ্যমন্ত্রী হিতেশ্বর শইকিয়া দিসপুরে এক বৈঠক আহবান করেন। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে রাষ্ট্রের মূখ্যমন্ত্রী স্তরে এটিই ছিল কোনো প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠক। ১৯৯৩ সালের ২০ ডিসেম্বরও বরাক উপত্যকার অনেক সড়কে ৭২ ঘন্টার অবরোধ কর্মসূচি পালিত হয়। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৯৫ সালের ২৬ মে ত্রিপুরা রাজ্য সরকার ত্রিপুরা রাজ্যের প্রাথমিক স্কুল গুলোতে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষাকে অন্তর্ভূক্ত করে। ভাষাবিপ্লবীরা বরাক উপত্যকায় ১৯৯৬ সালের মার্চ মাসে ৫০১ ঘন্টার রেল অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ১৯৯৬ সালের ১৬ মার্চ ভাষা আসামের পাথারকান্দির কলকলিঘাট রেলস্টেশনে আন্দোলনকারীদের একটি মিছিলে রাষ্ট্রের পুলিশ গুলি করে আন্দোলনকারীদের উপর। এই ঘটনায় অনেক ভাষা বিদ্রোহী আহত হন এবং ব্যাপক ধড়পাকড় হয় এবং মাতৃভাষার অধিকার চাইতে গিয়ে শহীদ হন বিলবাড়ি গ্রামের সুদেষ্ণা সিনহা। আসাম রাজ্যের ইলিমেন্টারি এডুকেশন এর ডেপুটি ডিরেক্টর ২০০১ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি বরাক উপত্যকার বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী অধ্যূষিত গ্রামের ৫২টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিষ্ণপ্রিয়া মণিপুরী ভাষার প্রথম পাঠ্য পুস্তক ‘কনাক পাঠ’ তৃতীয় শ্রেণীতে চালু করার সিদ্ধান্ত নেন। ২০০১ সালের ১২ ফেব্র“য়ারি থেকে তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ২০০৬ সালের ৮ মার্চ ভারতের সুপ্রিমকোর্ট ‘বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী’ শব্দটি লেখার রাষ্ট্রীয় অনুমোদন দেয়।

ভাষা শহীদ সুদেষ্ণা সিংহ
জানামতে, দুনিয়ায় দু’জন নারী ভাষার লড়াইয়ে প্রাণ দিয়েছেন। দু’জনই ভারতের বরাক উপত্যকায়। কমলা ভট্টাচার্য আসামের বাংলাভাষা আন্দোলনে এবং সুদেষ্ণা সিনহা বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা আন্দোলনে শহীদ হন। সুদেষ্ণা শহীদ হয়েছিলেন করিমগঞ্জের কলকলিঘাট রেলস্টেশনে। কলকলিঘাটে গিয়ে জানতে পারি সুদেষ্ণা সিনহার পরিবার কোনো ক্ষতিপূরণ বা সহযোগিতা পাননি। তার মা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। সুদেষ্ণা তখন উচ্চমাধ্যমিকে অধ্যয়নরত ছিলেন। সুদেষ্ণা সম্পর্কে বলতে গিয়ে এক প্রবীণ নারী জানান, ‘চাকগ কংগালা’। মানে তার মনটা খুব নরম ছিল। স্কুল থেকেই সুদেষ্ণা নানা সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কর্মসূচিতে জড়িত ছিলেন। দরিদ্র পরিবারের মেয়ে হওয়াতে পড়াশোনা, সংসার এবং সামাজিক কর্মসূচি চালাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। কিন্তু সুদেষ্ণা নিজ জাতির আত্মপরিচয়ের নির্দেশনা হিসেবে মাতৃভাষার অধিকারের দাবিতে সোচ্চার ছিলেন। যা আমরা বায়ান্নতে একুশে ফেব্রæয়ারিতে দেখতে পাই বাংলাদেশে।

সকল ভাষার মর্যাদা

বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের ঠার ভাষার লাগি দীর্ঘদিনের যে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম সেই সংগ্রামের প্রতি আমাদেরও মনোযোগ রাখা জরুরী। ২০০০ সালে দুনিয়ার ১৮৮ টি দেশ ২১ ফ্রেুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বাংলাদেশে স্থাপিত হয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউট। এখনো দেশের সকল আদিবাসী জাতিসত্তার মাতৃভাষা সমান স্বীকৃতি ও মর্যাদা পায়নি। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউট পরিচালিত ২০১৮ সনে শেষে হওয়া ভাষাগত জরিপের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে আদিবাসীদের ৪০টি মাতৃভাষা আছে। এর ভেতর কন্দ, খাড়িয়া, কোডা, সৌরা, মুন্ডারি, কোল, মালতো, খুমি, পাংখোয়া, রেংমিটচা, চাক, খিয়াং, লুসাই ও লালেং এই ১৪টি আদিবাসী মাতৃভাষা বিপন্ন। আজ আন্তর্জাতিকভাবে মনোযোগ তৈরী হয়েছে দুনিয়ার সকলের মাতৃভাষাকে স্বীকৃতি ও গুরুত্ব দেয়ার। বলা হয়ে থাকে দুনিয়ায় চলতি সময়ে সাত হাজারেরও বেশী ভাষা আছে যার অর্ধেকেরও বেশী ভাষা বিলুপ্তির পথে। বাংলাদেশে প্রায় ত্রিশ লাখ আদিবাসী জাতিসত্তার মাতৃভাষা সুরক্ষা প্রশ্নে আমাদের কাঠামোগত তৎপরতা জরুরি। ভাষা শহীদ সালাম, বরকত, রফিক, শফিক, কমলা ভট্টাচার্য, রঞ্জিত বরপূজারী কিংবা সুদেষ্ণা সিনহারা জীবন দিয়ে মাতৃভাষার আওয়াজ প্রমাণ করে গেছেন। সকল মাতৃভাষার প্রতি সম মর্যাদা ও স্বীকৃতির সংস্কৃতি আমাদের প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ১৬ মার্চ, ১৯ মে কিংবা ৪ জুলাইয়ে তারিখগুলি পাবলিক পরিসরে আয়োজনের ভেতর দিয়ে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আমরা আরো বেশি আমাদের সকলের করে তুলতে পারি। সকল মাতৃভাষার সম্মান ও স্বীকৃতির এক বৈশ্বিক ময়দান।

পাভেল পার্থ, লেখক ও গবেষক। ই-মেইল: [email protected]

Back to top button