পাহাড়ে আবারও জাতিগত আক্রমণ ও সাম্প্রদায়িকতার জিগির
বিশেষ প্রতিবেদনঃ
বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের উৎসবের রেশ কাটতে না কাটতেই পাহাড়ী জনপদে আবারও জাতিগত আক্রমণ ও সাম্প্রদায়িকতার জিগির তোলা হচ্ছে। বিজু, বিহু, সাংগ্রাইং, বিষু, বৈসুক-এর উৎসবে মাতোয়ারা ছিল পাহাড়ী জনপদ। এখনও ঘরে ঘরে এই উৎসবের রেশ রয়ে গেছে। পাজনের সৌরভ, গড়িয়া নৃত্যের ছন্দ আর জলকেলির পানির ফোটাগুলো এখনও হারিয়ে যায়নি। কিন্তু পাহাড়ে এর মধ্যে শুরু হয়েছে চির পরিচিত সেই আতংকের জীবন। বান্দরবান জেলার আলীকদম – থানছি সড়ক থেকে ১৫ এপ্রিল শুক্রবার তিন গরু ব্যবসায়ি নিখোঁজ হয়ে যান। ৩ দিন পর ১৮ এপ্রিল সোমবার তাদের মরদেহ আলীকদম-থানছি সড়কের ২৯কিঃমিঃ চিহ্নিত পার্শ্ববর্তী জঙ্গলাকীর্ণ এলাকায় পাওয়া যায়।
এই ঘটনার জের ধরে পার্বত্য জনপদে আবারও জাতিগত আক্রমণ ও সাম্প্রদায়িক হামলার মতো ন্যাক্কারজনক কর্মকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি লক্ষ করা যাচ্ছে। মরদেহ উদ্ধাদের পর পরই ১৮ এপ্রিল সোমবার আলীকদম বাস স্ট্যান্ড এলাকায় কথিত উত্তেজিত জনতার লেবাসধারী দুর্বত্তরা নিরীহ পথচারী জোনাক ত্রিপুরা ও তার স্ত্রীর উপর আক্রমণ চালায়। এই হামলায় দুইজন গুরুতর আহত হন। বর্তমানে তারা চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এর পর দুর্বত্তরা আলীকদম বাজার এলাকায় পাহাড়ী বিদ্বেষী নানান উস্কানীমূলক সাম্প্রদায়িক শ্লোগান দিতে থাকে। এতে করে পুরো আলীকদম বাজারে অবস্থানরত পাহাড়ী জনগেণের মধ্যে আতংক ছড়িয়ে পরে। বাজারে আগত পাহাড়ী জনগণ দ্রুত বাজার ত্যাগ করে বাড়ী ফিরে যেতে থাকেন। উপজেলা সদরে অবস্থিত পাহাড়ী অধ্যুষিত এলাকার জনগণ আতংকিত অবস্থায় নিজ নিজ গৃহে সতর্কতার সাথে অবস্থান নেন। এহেন পরিস্থিতিতে এলাকায় সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়। অন্যান্য আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি সেনা টহল জোরদার করা হয়।
কিন্তু আইন শৃংখলা রক্ষাকারীর বাহিনী ও কড়া সেনা নজড়দারীর মধ্যেও ১৯ এপ্রিল মঙ্গলবার বিকাল ৫টায় কথিত উত্তেজিত জনতা লেবাসধারী বাঙালি দুর্বত্তরা আলীকদমের মাষ্টার পাড়া নামক ত্রিপুরা পল্লীতে হামলা চালায় ও বসত বাড়ীতে অগ্নিসংযোগ করে। উল্লেখ্য নিহত ৩ বাঙালি গরু ব্যবসায়ীর বাড়ী আলীকদমের হাকিম পাড়ায়। ১৯ এপ্রিল মঙ্গলবার নিহত ৩ জনের জানাজা শেষে দুর্বৃত্তরা সংঘবদ্ধ হয়ে সদর থেকে প্রায় ১ কিঃমিঃ দূরের মাষ্টার পাড়া নামক ত্রিপুরা গ্রামে অগ্নিসংযোগ ও লুঠপাট করে। দুর্বৃত্তদের লাগানো আগুনে আমতলী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মতিরাং ত্রিপুরার বসতবাড়ীসহ ৫টিরও অধিক বাড়ী ভস্মীভূত হয়ে যায়। এইছাড়া অপরাপর কয়েকটি বাড়ীতে ভাংচুর ও লুঠপাট করা হয়। আক্রান্ত মাষ্টার পাড়ার গ্রামবাসী অভিযোগ করেন এই সময় আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা কিংবা কোন সেনা টহল ছিলনা। অথচ দুর্বত্তরা জানাজা শেষ করে সংঘবদ্ধভাবে অনেক পথ অতিক্রম করে মাষ্টার পাড়া আক্রমণ করে। এই অগ্নিকাণ্ডের বিষয়ে প্রশাসন এবং আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোন তৎপরতা পরিলক্ষিত না হওয়ায় পার্শ্ববর্তী পাহাড়ী পল্লীর মানুষেরাও চরম আতংকের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন।
উল্লেখ্য এই ৩ গরু ব্যাবসায়ীর মরদেহ উদ্ধাদের পর থানছি বাজারের একদল বাঙালি ব্যবসায়ী হঠাৎ লাঠি-সোটা নিয়ে রাস্তায় নেমে আসেন। এতে করে বাজারে অবস্থানরত নিরীহ বাঙালি ও পাহাড়ী জনগণ আতংকিত হয়ে পড়েন। পরে এলাকাবাসী সংগঠিত হলে এই দুর্বত্তরা তেমন আতংক তৈরি করতে পারেনি। ৩ গরু ব্যবসায়ীর মরদেহ উদ্ধার হওয়ার পর ১৯ এপ্রিল থানছি উপজেলার বাঙালি ব্যবসায়ীরা হরতাল পালন করে। এই অবস্থার মধ্যে বান্দরবানের আলীকদম, লামা, থানছি ও বান্দরবান সদর উপজেলার পাহাড়ী আদিবাসী জনগণ নিরাপত্তাহীনতায় চরম উদ্বিগ্নতার মধ্যে দিনযাপন করছে। স্থানীয় পাহাড়ী ও বাঙালিরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন ৩ গরু ব্যবসায়ী নিহত হওয়ার বিষয়টি আইন শৃংখলা-রক্ষাকারী বাহিনী দেখবেন। অপরাধী এবং হত্যকারীদের খুঁজে বের করার দায়িত্ব তাদের। কিন্তু এই বিষয়টি নিয়ে জল ঘোলা করে জাতিগত বিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িকতার জিগির তুলে পাহাড়ে অশান্তি সৃষ্টি করতে একটি বিশেষ গোষ্ঠী বহুকাল ধরে ক্রিয়াশীল। বান্দরবান জেলার সচেতন মানুষ মনে করে হত্যাকারীদের গ্রেফতারের পাশাপাশি এই জাতিগত আক্রমণ পরিচালনাকারী সাম্প্রদায়িক মহলটির দুর্বত্তদের বিরুদ্ধেও আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি হয়ে পড়েছে।