ঢাবি’তে ভাষা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য উৎসব অনুষ্ঠিত
সতেজ চাকমা: পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত জুম্ম শিক্ষার্থীদের সাংস্কৃতিক সংগঠন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জুম লিটারেচার এন্ড কালচারাল সোসাইটি’র উদ্যোগে ঢাবিতে ভাষা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য উৎসব আয়োজিত হয়েছে। বাংলাদেশের আদিবাসীদের মানবাধিকার সংগঠন কাপেং ফাউন্ডেশন ও আইএলও এর সহযোগীতায় উক্ত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম। এছাড়া উক্ত অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট আদিবাসী গবেষক ও লেখক পাভেল পার্থ, কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা, বাংলাদেশ আদিবাসী কালচারাল ফোরামের সাধারন সম্পাদক চন্দ্রা ত্রিপুরা এবং ডাকসুর কেন্দ্রীয় সদস্য চিবল সাংমা প্রমুখ। জুম লিটারেচার এন্ড কালচারাল সোসাইটি’র সহ-সভাপতি থোয়াই নু অং চাক (কেনি) এর সভাপতিত্বে সাধারন সম্পাদক জশোয়া দেওয়ান এর পরিচালনায় উক্ত উৎসবের আলোচনা সভায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন সংগঠনটির সাংগঠনিক সম্পাদক রাতুল তঞ্চঙ্গ্যা।
স্বাগত বক্তব্যে রাতুল তঞ্চঙ্গগ্যা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের শিল্প,সাহিত্য ও বর্ণাঢ্য সংস্কৃতিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে তুলে ধরার জন্যই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জুম লিটারেচার এন্ড কালচারাল সোসাইটি’র এই আয়োজন। তাছাড়া আদিবাসীদের বর্ণাঢ্য এ সংস্কৃতির সাথে মূল ¯্রােতধারার বাঙালি শিক্ষার্থীদের সংস্কৃতির মধ্যে সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন ঘটানো এবং সৌহার্দ তৈরীর উদ্দেশ্যেই বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজনের এ প্রয়াস। এইসব প্রয়াসের মধ্যে ভাষা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য উৎসব একটি বলেও জানান তিনি।
অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ আদিবাসী কালচারাল ফোরামের সাধারন সম্পাদক চন্দ্রা ত্রিপুরা বলেন, আমাদের যুব সমাজকে আরো পুঙ্খানুপুুঙ্খ ভাবে চিন্তা করে আদিবাসীদের বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক লড়াইকে এগিয়ে নিতে হবে।
তিনি আরো বলেন, আমরা যদি অন্যদেরকে দোষারোপ করে থাকি তবে আমরা আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে রক্ষা করতে পারব না। কেননা, আমরা যদি সচেতন না হই তবে কেউই আমাদের সংস্কৃতিকে রক্ষা করে দিবে না।
ভাষা ও সংস্কৃতির অধিকার রাস্তা থেকেই শুরু হওয়া প্রয়োজন উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, রাস্তাই বের হলে আদিবাসীরা তাঁদের চেহারা ও ভাষার কারণে বিভিন্ন আপত্তিজনক শব্দের শিকার হয়। সেইসব আপত্তিকর শব্দে উত্তেজিত না হয়ে বরং তাঁদেরকে বুঝিয়ে আদিবাসীদের কথাগুলো বলারও আহ্বান জানান তরুণ শিক্ষার্থীদের ।
ডাকসুর কেন্দ্রীয় সদস্য চিবল সাংমা বলেন, ফেব্রুয়ারীর চেতনা কেবল মাত্র একটি ভাষার জন্য নয়, এ চেতনা’র বিস্তৃতি বিশাল। তিনি সবাইকে নিজ নিজ মাতৃভাষাকে চর্চার আহ্বান জানান
অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান প্রেক্ষাপট তুলে ধরে তিনি আরো বলেন, আমরা এখনও আদিবাসী ভাষাগুলোকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলে ধরতে পারিনি। টিএসসিতে ২৩ টি’র মত সংগঠন রয়েছে কিন্তু আমাদেরকে ভালোভাবে প্রতিনিধিত্বকারী কোনো সংগঠন এখনও গড়ে ওঠেনি। আমরা সেভাবে আমাদেরকে তুলে ধরতে পারিনি বলেও আক্ষেপ করেন তিনি।
টিএসসিতে একটি আদিবাসীদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন প্রতিষ্ঠা জরুরী বলে তিনি দাবী করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জুম লিটারেচার এন্ড কালচারাল সোসাইটির এ কার্যক্রমগুলো চালিয়ে নেওয়ার জন্য আহ্বানও জানান ডাকসুর এই নেতা ।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে পল্লব চাকমা বলেন, আদিবাসীদের বিভিন্ন বিষয়কে নিজের বিষয় হিসেবে ভাবেন সেরকম (বাঙালি) বন্ধু আরো বাড়াতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা চান্স পায় তারা আমাদের সমাজের সবচেয়ে অগ্রগামী চিন্তার অধিকারী বলে মনে করি। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আদিবাসী শিক্ষার্থীদেরকেই আদিবাসীদের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সচেতন হতে হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
পাহাড় থেকে ঢাকায় পড়ুয়া প্রত্যেক শিক্ষার্থী পাহাড়ের আদিবাসীদের এক একজন ‘অ্যাম্বাস্যাডর’ দাবী করে তিনি আরো বলেন, আদিবাসীদের জীবন ও সংস্কৃতির ‘পজিটিভ’ বিষয়গুলো বন্ধুদের তুলে ধরবেন। কেননা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে সেইসব বন্ধুরাই তো সরকারী বেসরকারী বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিয়োজিত হবে। কাজেই সেইসব বন্ধুরা যদি পজিটিভ ‘মাইন্ডসেট’ নিয়ে বেড়ে ওঠে তবে তারা বিভিন্ন জায়গায় আদিবাসীদের নিয়ে ইতিবাচক চিন্তার প্রতিফলন ঘটাবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আগে চাকমা,মারমা ও ত্রিপুরা শিক্ষার্থীদের সংখ্যাধিক্য ছিল। কিন্তু এখন ম্রো, চাক, খুমি শিক্ষার্থীরাও পথ চলছে এই ক্যাম্পাসে, এটা আমাদের জন্য আনন্দের। এই বৈচিত্র্যের শক্তিতেই বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বিশিষ্ট গবেষক ও লেখক পাভেল পার্থ বলেন, নিজেদের বাদ্যযন্ত্র ও সংস্কৃতির অনেক কিছু বাজানো বা ব্যবহার ভুলে যাচ্ছে আদিবাসী তরুণরা।এই ভুলিয়ে দেওয়া যতটা না তাদের সমাজ করছে তার চাইতেও এই রাষ্ট্র ব্যবস্থা সেগুলোকে ভুলিয়ে দিচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, দু:খজনক হলেও সত্যি যে এই ঢাকা শহরে অনেকগুলো আদিবাসী অঞ্চল রয়েছে।একটি হচ্ছে মগ বাজার যেখানে রাখাইন আদিবাসীরা তাঁদের রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছে, একটি হচ্ছে মনিপুরি পাড়া যেখানে জাতীয় সংসদ ভবন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, একটি হচ্ছে তেজতুড়ি পাড়া, তুড়ি আদিবাসীদের অঞ্চল যাদেরকে উচ্ছেদ করে বাংলাদেশের প্রথম বিমান বন্দর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, একটি হচ্ছে জাতীয় প্রেস ক্লাব যেখানে রবিদাস আদিবাসীদের পাড়া ছিল, যাদেরকে উচ্ছেদ করেই এটি তৈরী করা হয়েছিল।
তিনি আরো বলেন, মজার বিষয় হচ্ছে যে, বাংলাদেশে সকল আদিবাসীদের নাম বদলে দেয়া হয়। সকল আদিবাসী অঞ্চলের নাম বদলে একটা বাঙালি নাম দেয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ এ গবেষকের।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম বলেন, এমন একটি সময় চলছে যখন পৃথিবীতে সব ধরণের বৈষম্যই আমরা দেখতে পাচ্ছি। এই বৈষম্য নিয়ে যখন আমরা কথা বলছি তখন কিছুটা কৌশলগত ভাবেই আমরা এটাই বলতে চাই আমরা ইতিবাচক দিকগুলোকে বিবেচনা করেই এ বৈষম্য নিরসনে এগিয়ে যেতে পারি।
করোনা ভাইরাসের পাশাপাশি যে বিষয়টি বিষাক্ত করে তুলছে সেটি হলো ধর্মীয় বিষয়কে পুঁজি করে সংঘাতের সৃষ্টি করা হচ্ছে বলে মত ব্যক্ত করে তিনি আরো বলেন, এ ধরণের বৈষম্য আসলে কারো কাছে কাম্য নয়। তারপরও আমরা দেখছি হিন্দু মুসলিম একসাথে হয়েই তাদের মহল্লা পাহাড়া দিচ্ছে। এটাই শিক্ষণীয় বলেও মত দেন এই সমাজ বিজ্ঞানী।
তিনি আরো বলেন, আমার জীবনের বড় একটি জায়গা ছিল আদিবাসী বন্ধুদের নিয়ে গবেষনা। এই গবেষনা শেষ পর্যন্ত আর গবেষণার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। এই গবেষণার মধ্য দিয়েই আমি আদিবাসীদের বন্ধু হয়ে গেছি। তাঁর উপর আদিবাসীদের বিশ্বাস এবং নির্ভরতার জায়গা কিছুটা হলেও তৈরী হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। এটা তাঁর দীর্ঘ পরিশ্রম ও সম্পৃক্ততার ফসল বলেও দাবী করেন তিনি। আদিবাসী শিক্ষার্থীদের মধ্যেকার সংহতি আরো বৃদ্ধির পরামর্শও দেন ঢাবির সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন।
আলোচনা সভার সভাপতি থোয়াই নু অং চাক (কেনি) এর সমাপনি বক্তব্যের মধ্য দিয়েই শেষ হয় আলোচনা সভা। এছাড়া আলোচনা সভার আগে অর্ধবেলা ব্যাপী আয়োজিত এ উৎসবে প্রথমে ‘এক টুকরো পার্বত্য চট্টগ্রাম’ র্শীর্ষক ছবি প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের জীবন ও কর্মের বিভিন্ন দিক নিয়ে এইসব ছবি প্রদর্শনীতে তুলে ধরা হয়। এরপর ‘সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে হারিয়ে যাচ্ছে আদিবাসীদের ভাষা ও সংস্কৃতি’ প্রতিপাদ্যকে সামনে নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের জুম্ম শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতর্ক প্রতিযোগীতা অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া বিভিন্ন ভাষায় আদিবাসী শিক্ষার্থীরা মাতৃভাষায় নিজেদের অনুভূতি ব্যক্ত করেন।
আলোচনা সভার পরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জুম লিটারেচার এন্ড কালচারাল সোসাইটি’র শিল্পীদের পরিবেশনায় পরিবেশিত হয় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এরপর রাতুল তঞ্চঙ্গ্যাকে সভাপতি, নুথোয়াই মারমাকে সাধারন সম্পাদক এবং ঐতিহ্য চাকমা সাংগঠনিক সম্পাদক করে ৪৫ সদস্য বিশিষ্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জুম লিটারেচার এন্ড কালচারাল সোসাইটি’র নতুন কমিটি ঘোষনা করা হয়। এবারের ভাষা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য উৎসবের মূল স্লোগান ছিল- ’বৈচিত্র্যের শক্তিতেই ঘটুক সকল ভাষা-সংস্কৃতির মুক্তি।’