একজন সুর কৃষ্ণ চাকমা এবং তাঁর স্বপ্নভঙ্গের বেদনা
সতেজ চাকমা: একজন সুর কৃষ্ণ চাকমা। পড়ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের মাষ্টার্সে।এই পরিচয় ছাড়াও তাঁর রয়েছে আরেকটি বড় পরিচয়। তিনি একজন পেশাদার বক্সার। উঁচু নিচু পাহাড়ের সবুজ পৃষ্ঠ থেকে তিনি উঠেছেন জাতীয় ও বিশ্ব বক্সিং এর নানা মঞ্চে।পেয়েছেন নানা মাত্রার সফলতাও। রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার জুরাছড়ি উপজেলার কৃতি এ সন্তান ছোটকাল থেকেই খেলাধুলার প্রতি ছিলেন প্রবল মনোযোগী। বলা চলে পাহাড়ের প্রত্যন্তে পুরো শৈশবটাই কেটেছে ফুটবল মাঠের চৌহদ্দির মধ্যে। পড়াশুনা করেছেন রাঙ্গামাটি সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে। খেলাধুলায় সীমাহীন ঝোঁক থাকার কারণে রাঙ্গামাটি সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় খেলার মাঠ তথা রাঙ্গামাটি শহরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ক্রিড়া সংস্থার আয়োজিত ফুটবল ও বিভিন্ন অ্যাটলেটিক্সে অংশগ্রহনকারী তৎসময়ের প্রতিযোগীদের মধ্যে অপ্রতিরোধ্য এক নাম হয়ে ওঠেন এই সুরকৃষ্ণ চাকমা।অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী এই মানুষটির সাথে কথা হয় আইপিনিউজ এর এই প্রতিবেদকের।
তিনি জানান, ঘটনাক্রমে একদিন বাংলাদেশ ক্রিড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (বিকেএসপি) ক্রিড়া প্রতিভা অন্বেষণের জন্য রাঙ্গামাটিতে আয়োজন করে ক্রিড়া প্রতিভা অন্বেষণ প্রতিযোগীতার। এই অন্বেষণ প্রতিযোগীতায় অংশগ্রহনই আমার স্বপ্নের দুয়ার খুলে দেয়।
জানা য়ায়, এই আয়োজনে সুর কৃষ্ণ চাকমাই সঠিক সময়ে বিকেএসপির জালে ধরা পড়ে। অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী এই মানুষটির স্বপ্ন ছিল ফুটবলার হওয়ার কিন্তু নানা সীমাবদ্ধতার কারণে ফুটবলের ডিসিপ্লিনে তাঁর সুযোগ হয়নি। তবে আয়োজকদের পরামর্শক্রমে ট্রায়াল দেন বক্সিংয়ে। এই ট্রায়ালে বক্সিং কোচ সুরকৃষ্ণ চাকমা’কে চিনে নিতে ভুল করেননি। প্রত্যাশা ছিল ফুটবল নিয়েই স্বপ্ন গড়বেন কিন্তু সুযোগ হল বক্সিং এর স্টেজে নিজেকে বিকশিত করার। ২০০৭ সাল থেকে নানা প্র্যাকটিসের মধ্যে বক্সিং এর প্রতি তাঁর ভালোবাসা জন্মে যায়। কঠোর অনুশীলন আর সাহসের সহিত বক্সিং নিয়ে এগোনোর পথে তিনি হয়ে ওঠেন বক্সার সুর কৃষ্ণ চাকমা।
এই বক্সারের সাথে কথা বলে জানা যায়, ২০১৩ সালে তাঁর ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে বাংলাদেশ অলিম্পিক খ্যাত ‘বাংলাদেশ গেমস’ এ অংশগ্রহন করেন। এই আয়োজনে একে একে এসএ গেমস এ সোনা জেতা মো: আব্দুর রহিম, তৎকালীন বক্সিং চ্যাম্পিয়ন মো: আরিফ হোসেনকে হারিয়ে তিনি জাতীয় পর্যায়ে সোনা জিতে নেন।
তিনি আরো জানান, ২০১৪ সালে জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হিসেবে কমনওয়েল্ট গেমসে বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে স্কটল্যান্ডে যাওয়ার সুযোগ ঘটে। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করে ১৯-২০ ব্যবধানে হেরে গেলেও কর্তৃপক্ষের সুনজরের কারণে রিও অলিম্পিকে অংশগ্রহনের জন্য বৃত্তি লাভ করেন সুরকৃষ্ণ চাকমা।
এত লড়াইয়ের মধ্যেও তিনি জানান স্পনসরশিপের সংকটের হতাশার কথা।তিনি জানান, ২০১৫ সালে কিকবক্সিংয়ের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত লন্ডন প্রবাসী আলী জ্যাকোর একান্ত সহযোগীতায় লন্ডনের পিকক জিমে বিশ্বমানের কোচের সান্নিধ্যে ট্রেনিং এর সুযোগ পান যা তার প্রতিভাকে এক নতুন মাত্রায় নিতে সক্ষম হয়।
২০১৮ সালে ইন্ডিয়ার হরিয়ানা রাজ্যে আবারো ৫ মাস ট্রেনিং এর সুযোগ পেয়ে হরিয়ানা রাজ্যের স্টেট চ্যাম্পিয়নকে প্রথম ম্যাচেই হারানো এই প্রতিভাবান বক্সার বিগত বছরে নেপালে অনুষ্ঠিত সাউট এশিয়ান গেমস এ বক্সিং এ ৬০ কেজি ওজনের ক্যাটাগরিতে অর্জন করেন বাংলাদেশের পক্ষে ব্রোঞ্জ পদক।
ভবিষ্যত ভাবনা নিয়ে কথা বলাতেই ইতস্তত ও হতাশার সুরে জানালেন তাঁর আশাভঙ্গের কথা। তিনি জানান, বক্সিং এ টিকে থাকার জন্য উঁচু মানের ট্রেনিং দরকার যা দেশে সম্ভব নয়। উন্নত কোনো ট্রেনিং পেলে বক্সিং নিয়ে বাংলাদেশকে আরো বড় কিছু উপহার দেওয়ার কথা জানালেও এই ট্রেনিং এর জন্য কে করবেন সহায়তা-এটাই তাঁর কাছে প্রধান প্রতিবন্ধকতা। কৈশোর বয়সে ব্যাংকার বাবাকে হারানো এই বক্সারের কাছে জীবনের ঘানি টানার জন্য এখন ঝুঁকতে হচ্ছে চাকরির বাজারের সম্পূর্ণ নতুন এক প্রতিযোগীতার মঞ্চে। যার ফলে এত অনুশীলন ও পরিশ্রমের মাধ্যমে তাঁর অর্জিত বক্সিং এর যত কলাকৌশল যেন মুখ লুকিয়ে কাঁদবে যদিনা কোনো ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠান এই প্রতিভাবান খেলোয়ারকে তাঁর স্বপ্নের কাছে পৌছে দিতে এগিয়ে না আসে।