জাতীয়

রাজধানীতে নানা আয়োজনে মানবেন্দ্র নারায়ন লারমার ৩৬ তম মৃত্যুবার্ষিকী পালন

সতেজ চাকমা: প্রতিবছরের ন্যায় এবছরও নানা আয়োজনে রাজধানীতে পালিত হল বিপ্লবী নেতা মানবেন্দ্র নারায়ন লারমার ৩৬ তম মৃত্যুবার্ষিকী। আয়োজনের মধ্যে ছিল শোক,শ্রদ্ধা,ভালোবাসা ও এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার বকুলতলায় বিকাল ৩.০০ ঘটিকার সময় শুরু হয় বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ন লারমার ৩৬ তম মৃত্যুবার্ষিকী পালন জাতীয় কমিটির নানা আয়োজন। মানবেন্দ্র নারায়ন লারমার স্মরণে আয়োজক কমিটি নির্মিত অস্থায়ী শহীদ বেদিতে বিভিন্ন সংগঠনের পুষ্পস্থবক দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদনের পাশাপাশি সমান্তরালে চলে মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা স্মরণে কেন্দ্রীয় খেলাঘরের শিশু শিল্পীদের চিত্রাংকন। আয়োজনে অংশ নেন রাজধানীর বিভিন্ন স্কুল এবং কলেজের শিল্পী শিক্ষার্থীরা। এসব আয়োজনের পাশাপাশি চলে মূল আলোচন সভা।

জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক ডাকসুর সাবেক জিএস ডা: মুশতাক হোসেনের সভাপতিত্বে সভা পরিচালনা করেন এ কমিটির সদস্য সচিব হিরণ মিত্র চাকমা। মানবেন্দ্র নারায়ন লারমাকে নিয়ে চাকমা ভাষায় লেখা একটি বিখ্যাত গান দিয়ে আলোচনা সভার প্রারম্ভিকতা ধ্বনিত করেন আদিবাসী নারীদের প্রথম ব্যান্ড এফ-মাইনর। পরে উক্ত আলোচন সভায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন আয়োজক কমিটির অন্যতম সদস্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. রোবায়েত ফেরদৌস। স্বাগত বক্তব্যে তিনি বলেন, মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা সংবিধানের ভেতর থেকেই আদিবাসীদের স্বীকৃতি চেয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় তাঁর এই আকুতিকে বুঝতে না পেরে শাসকরা বিভিন্ন নামে প দশ সংশোধনীর মাধ্যমে আদিবাসীদের পরিচয় দেওয়ার চেষ্টা করেছে। যা তাঁদের জন্য অপমানজনক। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ ক্রমশ সাম্প্রদায়িকতার মোহে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে বলেও অভিমত ব্যক্ত করেন বিশিষ্ট এই সাংবাদিক।

একুশে ফেব্রুয়ারী আন্তজার্তিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতির প্রসঙ্গ টেনে তিনি আরো বলেন, ২১ শে ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া মানে কেবল বাঙালির ভাষাকে মর্যাদা দেয়া নয়। বরং এই মাতৃভাষা রক্ষার বাঙালির যে সংগ্রাম সে সংগ্রামকে ধারণ করে পৃথিবীর তাবৎ মাতৃভাষাকে স্বীকৃতি দিয়ে সেগুলো রক্ষা করাই হচ্ছে এর মূল লক্ষ্য। কিন্তু বাংলাদেশের আদিবাসী ভাষাগুলো ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে বলে শঙ্কা ব্যক্ত করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক।

স্বাগত বক্তব্যের পর ১৯৮৩ সালে ১০ নভেম্বর পানছড়ির দুধুকছড়ার খেদারাছড়া থুমে শত্রুর বুলেটে নিহত হওয়া মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা সহ অন্য আট সহযোদ্ধার শাহদাৎ বরণকে কেন্দ্র করে শোক প্রস্তাব পাঠ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অন্য এক শিক্ষক ড. জোবাইদা নাসরীণ কণা। মানবেন্দ্র নারায়ন লারমার পাশাপাশি একই ঘটনায় শহীদ হওয়া অন্য আট সহকর্মীর নাম একং তাঁদের অবদানের কথা স্মরণ করে শোক প্রস্তাব শেষে উপস্থিত সকলেই দাঁড়িয়ে উক্ত ঘটনায় শহীদ সহ সকল গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল সংগ্রামে আত্মাহুতি দেয়া মানুষদের জন্য এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়।

আলোচনা সভায় সংহতি বক্তব্যে জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় স্টাফ সদস্য চঞ্চনা চাকমা বলেন, ঘুনে ধরা সমাজকে জাগরণে মানবেন্দ্র নারয়ান লারমা ছিলেন অগ্রণী। পাহাড়ের পরতে পরতে শিক্ষা বিস্তার করে অধিকার আদায়ের সংগ্রামে পাহাড়ী জনমানুষকে সম্পৃক্ত করেছিলেন। শিক্ষা বিস্তারের পাশাপাশি নারীদের অধিকার তথা শ্রমিক, মাঝি-মাল্লা, মেথর,পতিতা, বেদে সহ সকল শ্রমজীবি মানুষের জন্যও তিনি সংসদে কথা বলেছিলেন বলেও উল্লেখ করেন জনসংহতি সমিতির এই নেত্রী।

অন্যদিকে সংহতি বক্তব্যে বাসদের কেন্দ্রীয় নেতা রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, এম. এন লারমা জন্মেছিলেন আদিবাসী পাহাড়ী অঞ্চলে কিন্তু লড়াই করেচিলেন সমগ্র নিপীড়িত মানুষের জন্য।

মানবেন্দ্র নারায়ন লারমার অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, তিনি (এম. এন লারমা) তাঁর চোখ দিয়ে কেবল পাহাড়ী মানুষের কষ্ট দেখেননি। দেখেছেন সমতলের সকল নিপীড়িত বঞ্চিত মানুষের হাহাকার। এছাড়া সংবিধান প্রণয়নের সময় মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা সংবিধানের দুর্বলতাগুলোও উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যা অন্যরা পারেননি বলেও মত দেন বিশিষ্ট এই বাম নেতা।

বাংলাদেশের কমিউনিষ্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম তাঁর বক্তব্যে বলেন, মানবেন্দ্র নারায়ন লামাকে স্মরণ করলে মুক্তিযাদ্ধের কথা মনে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলাম দু’ ধরণের শোষণ থেকে মুক্তির জন্য। একটি জাতিগত অন্যটি শ্রেণীগত। কিন্তু দুর্ভাগ্যের হলেও সত্যি এই শোষণ এখনো বন্ধ হয়নি। বরং বেড়ে গেছে বলেও মত তাঁর।

কেবলমাত্র ‘বাঙালি কনভেনিয়েন্স’ এর জন্য আমরা মুক্তিযুদ্ধ করিনি। প্রত্যক জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম এবং বাঙালি কেবল মাত্র এক জাতির নয় বরং এটি একটি ‘মাল্টিন্যাশনাল স্টেট’ বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিষ্ট আবু সাঈদ খান বলেন, ১৯৭৩ সালে মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা তাঁর প্রজ্ঞা দিয়ে যা বুঝেছিলেন আমরা তা বুঝতে পারিনি। তা আমাদের অনেক সময় লেগেছে।

মানবেন্দ্র নারায়ন লারমার সংগ্রামে একটি পরিণতি পার্বত্য চুক্তিতে ঘটেছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, শান্তিচুক্তির মাধ্যমে মানবেন্দ্র নারায়ন লারমার স্বপ্নকে কিছুটা হলেও বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ নেয়া হয় কিন্তু তাঁর পুরোপুরি বাস্তবায়ন না হওয়ায় পার্বত্য সমস্যাকে জিইয়ে রাখা হয়েছে বলেও জানান তিনি। পার্বত্য চুক্তির পুরোপুরি বাস্তবায়ন দাবি করেন বিশিষ্ট এই সাংবাদিক।

আলোচনায় অংশ নিয়ে ওয়াকার্স পার্টির সভাপতি ও সাংসদ বলেন, ‘মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা কেবল জুম জনগণের নেতা নন। বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল সেখানে তাঁর রাষ্ট্র ভাবনা তুলে ধরে তিনি জাতীয় নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটান বলে জানান তিনি।
সংবিধানে অনেক অপূর্ণতা ছিল দাবী করে তিনি পঞ্চদশ সংশোধনীর কথা উল্লেখ করে বলেন, এই সংশোধনীতেও আদিবাসীদের সঠিকভাবে পরিচয়ের ব্যবস্থা করা হয়নি। জাতীয় সংসদে আমরা সংশোধনী প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিলাম বলে উল্লেখ করেন সাবেক এই মন্ত্রী।
আদিবাসী স্বীকৃতির প্রসঙ্গ টেনে তিনি আরো বলেন, জাতিসংঘ যখন আদিবাসী দিবস ও বর্ষ ঘোষণা করে তখন দেশের দুই মূল দলের নেত্রী উভয়েই আদিবাসী স্বীকৃতি বিষয়ে নানা বাণী পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু ক্ষমতায় এসে অদিবাসীদের এই দাবীকে ক্ষমতাসীনরা গোয়েন্দার চোখে দেখেছিলেন বলে অভিমত ব্যক্ত করেন তিনি।

এছাড়া উক্ত আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন আদিবাসী ফোরামের সাধারন সম্পাদক সঞ্জিব দ্রং, জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্র নাথ সরেন, বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি শরীফ নুরুল আম্বিয়া, আইইডির নির্বাহী পরিচালক নুমান আহমদ খান এবং সমাপনি বক্তব্য রাখেন বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ন লারমার ৩৬ তম মৃত্যুবার্ষিকী পালন জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক ডা: মুশতাক হোসেন।

মানবেন্দ্র নারায়ন লামার শহীদ বেদীতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ন লারমার ৩৬ তম মৃত্যুবার্ষিকী পালন জাতীয় কমিটি, কমিউনিষ্ট পার্টি বাংলাদেশ, জনসংহতি সমিতি, ওয়াকার্স পার্টি, জাতীয় আদিবাসী পরিষদ, আদিবাসী ফোরাম, বাসদ, বাংলাদেশ জাসদ, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন, জনউদ্যোগ, কাপেং ফাউন্ডেশন, আদিবাসী নারী নেটওয়ার্ক, বাগাছাস, আদিবাসী চাত্র সংগ্রাম পরিষদ, ছাত্র ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফন্ট, ছাত্র ফেডারেশন, পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, হিল উইমেন্স ফেডারেশন, ম্রো ছাত্র সংগঠন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জুম সাহিত্য ও সংস্কৃতি সংসদ, ঢাকাস্থ পাহাড়ী ছাত্রবাস, গানের দল মাদল ও আদিবাসী নারী ব্যান্ড দল এফ-মাইনর, কেন্দ্রীয় খেলাঘর, রক্তদাতা সংগঠন জুবদা, হেবাং রেষ্টুরেন্ট কর্তৃপক্ষ সহ বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক , রাজনৈতিক এবং ছাত্র ও যুব সংগঠন। পরে শহীদ বেদীতে ১০ নভেম্বরের শহীদদের স্মরণে প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করেন আপামর জনসাধারণ। এছাড়া উক্ত আয়োজনে চিত্রাংকনে অংশগ্রহন করা শিশু শিল্পীদেকে পুরষ্কার ও সার্টিফিকেট প্রদান করা হয় ।

সবশেষে আদিবাসী নারীদের প্রথম ব্যান্ড এফ-মাইনর, বিশিষ্ট শিল্পী কফিল আহমদ এর পরিবেশনার পরে আদিবাসীদের গানের দল মাদলের পরিবেশনার মধ্য দিয়ে শেষ হয় উক্ত আয়োজন এবং মাদলের কন্ঠে সুর মিলিয়ে উপস্থিত সবাই কন্ঠ মেলান- ‘তাই মিছিলে ধ্বনিত আজো মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা, জানায় তোমায় লাল সালাম, জানায় তোমায় লাল সালাম।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের প্রভাতফেরী ও আলোচনা সভা:

উক্ত দিবসটিকে কেন্দ্র করে ১০ নভেম্বর ২০১৯ পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়োজনে জগন্নাথ হলে সকাল বেলায় আয়োজিত হয় প্রভাতফেরী ও আলোচনা সভা। মহান নেতার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পুষ্পমাল্য অর্পন করা হয় এবং আলোচনা সবা অনুষ্ঠিত হয়। পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ ঢাবি শাখার সহ-সভাপতি লিটন চাকমা সভাপতিত্বে এবং সাধারন সম্পাদক জিনেট চাকমা সঞ্চালনায় আলোচনায় অংশ নেন প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী শান্তি জীবন তঞ্চঙ্গা, দনওয়াই ম্রো। এছাড়া আলোচনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জুম সাহিত্য ও সংস্কৃতি সংসদের প্রকাশনা বিষয়ক সম্পাদক ঐতিহ্য চাকমা, পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ ঢাবি শাখার সহ-সাধারন সম্পাদক হিতো চাকমা এবং সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক সতেজ চাকমা প্রমুখ। বক্তারা মানবেন্দ্র নারায়ন লারমার জীবন ও সংগ্রাম থেকে শিক্ষা নিয়ে আগামী দিনের লড়াইয়ে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন । সভার সভাপতি লিটন চাকমার সমাপনি বক্তব্যের মাধ্যমে উক্ত আয়োজন সমাপ্ত হয়।

Back to top button