নিপীড়িতের লারমার সর্বজনীন ভাবনা- সতেজ চাকমা
মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা নামটি এখন আর কারোর অজানা থাকার কথা নয়। যারা মানবাধিকারের কথা বলেন, সুন্দর, মানবিক, মর্যাদাপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা বলেন, অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ গড়ার কথা বলেন, এমনকি পুরো পৃথিবীটাকে বদলিয়ে একটি সাম্যের সমাজ বানানোর প্রয়াসে যারা এখনো স্বপ্ন দেখেন এবং ভাবনা ভাবেন, চিন্তায় মনস্তত্তে¡ মেলাতে চান প্রাণে প্রাণ তাদের কাছে এই লারমা নামটি অত্যন্ত শ্রদ্বেয় এবং সুপরিচিত। তাদের মধ্যে আমিও ক্ষুদ্র একজন। সমাজের মধ্যে নারীতে-পুরুষে, মানুষে-মানুষে যে পাহাড়সম ভেদাভেদ, সেই ভেদাভেদ ভাঙতেই যারা স্বপ্ন দেখেন, কাজ করেন তাদেরই নগণ্য একজন। যার জন্যই এই লারমার প্রতি ভালোবাসা। এই লারমাকে পাঠ করার প্রয়াস।
যদিও এই লারমাকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। কেবল জানা আছে মাওরুম নামে কোনো এক গ্রামে তাঁর জন্ম ১৯৩৯ সালে। এই মাওরুমের অস্তিত্ব এখন কাপ্তাই-এর কৃত্রিম হ্রদের পানির তলানিতে। নিজ জন্মভূমি থেকে উচ্ছেদ হওয়ার যন্ত্রণায় এখনো কাতর পুরো পাহাড়ি জনমানুষ। সেই বঞ্চিত সমীকরণ মিলিয়ে জীবনের ঘানি টানা দুর্ভাগাদের মধ্যে লারমা একজন। ১৯৬০-এর যে কাপ্তাই বাঁধ প্রকল্পের কথা আমরা জানি, সেই প্রকল্পের বিরুদ্ধেই তো লারমার দ্রোহী হয়ে ওঠার সূচনা। যার জন্যই লারমার লারমা হয়ে ওঠা, দ্রোহী হয়ে ওঠা। সেই মাওরুম গ্রামের নিজ বাড়ির উঠানের একমুঠো মাটি নিজ বড়বোন জ্যোতিপ্রভা লারমাকে দিয়ে সেই মাটি সংরক্ষণের প্রয়াসই লারমাকে পরিচয় করিয়ে দেয় একেবারেই ‘মাটির মানুষ’ হিসেবে। এই মাটির মানুষটির প্রস্থান ১৯৮৩-তে। তাঁর চলে যাওয়াটা স্বাভাবিক নিয়মে নয়। নিজ সহকর্মী কিন্তু বিভেদপন্থী সেই কুচক্রীদের বুলেটে বিদ্ধ হয়েই তিনি বিদায় নিয়েছেন পৃথিবী থেকে। কিন্তু এই বিভেদপন্থীদের জন্যও লারমার মানবিক হৃদয়ের অবাধ আধারে জায়গা ছিল। দেশী-বিদেশী চক্রান্তের শিকার হয়ে গিরি-প্রকাশ-দেবেন-পলাশদের জন্য তিনিই নির্ধারণ করেছেন ‘ক্ষমা করে ভুলে যাওয়া’ নীতি। কিন্তু এই ক্ষমার অসাধারণ গুণই তাঁকে বিদ্ধ করেছে ষড়যন্ত্রের বুলেটে। তাই তো এই লারমার চলে যাওয়ার দিন ১০ নভেম্বর পাহাড়ে আসে শোকের বারতা, অশ্রæর অজ¯্র ধারা বেয়ে। কিন্তু এই মানবিক লারমার কাছ থেকে যে দ্রোহী হয়ে ওঠার শিক্ষা পাহাড়ের সরল-সাধারণ মানুষ নিয়েছে, সেই দ্রোহী আবেগই তো লারমাকে স্মরণ করে নতুন ভোরের প্রত্যাশায়। এই শোকাতুর দিনেই লারমার স্মরণে সন্ধ্যার অবাধ আকাশে ওঠে ফানুস, ওড়ে আগুনের ফুলকি আর পাহাড়ের নিপীড়িত মানুষ নেয় জীবনের শপথ। তাই লারমা এক দ্রোহী নাম, মানবিকতার স্মারক।
এই মানবিক লারমাকে কলমের নিবের কল্যাণে আমার অদক্ষ হাতে অঙ্কন করাটা বেশ কঠিন এবং তা রীতিমতো দুরুহ। তারপরেও নিপীড়িতের লারমার সর্বজনীন চরিত্রগুলোর প্রতি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। এই দৃষ্টি ক্যাসিনোজীবী খালেদ কিংবা শামীমদের জীবনের দিকে নয়, সালমান এফ. রহমানের মত মুনাফাজীবীদের দিকেও নয়। এই দৃষ্টি মোমের আলোর নিচে পড়ে থাকা অন্ধকারের দিকে। যেই পৃষ্ঠে মানুষের চোখ যায় না, যারা সাধারণের চেয়েও অনন্যসাধারণ হয়ে আহারে-অনাহারে, উপোসী জীবনযাপন করে সেই মুটে, মজুর, শ্রমিক, মেহনতী, আদিবাসী প্রান্তিক মানুষ, তাঁদের দিকেই এই দৃষ্টি। যার কথা বলে গিয়েছিলেন লারমা। যার জন্যই লারমাকে ‘নিপীড়িতের’ বলে অভিধা দেওয়ার প্রয়াস এবং যে ভাবনা সমাজের সকল মানুষকে ধারণ করে সে ভাবনাই ভাবতেন লারমা।
১৩ জুলাই ১৯৭৪, শনিবার। বাংলাদেশের তৎকালীন জাতীয় সংসদে প্রশ্ন-উত্তর পর্ব চলছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত সাংসদ মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা সংসদে প্রশ্ন করছেন-
‘মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়, দয়া করে বলবেন কি বাংলাদেশে ভবঘুরের সংখ্যা কত?’
এই উত্তরে তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী আব্দুল মান্নান উত্তর দিচ্ছেন, ‘মাননীয় ডেপুটি স্পিকার, ভবঘুরের সংখ্যা কত এই ধরনের কোনো সংখ্যা নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি।’
লারমা আবার পালটা প্রশ্ন ছুড়ছেন- ‘মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়, দয়া করে বলবেন কি বাংলাদেশের ভবঘুরের সংখ্যা নির্ণয় করার জন্য সরকার কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করবে কি না?’ উত্তরে তৎকালীন মন্ত্রী মহোদয় বলেছিলেন, ‘এখন পর্যন্ত করা হয়নি, ভবিষ্যতে করা হবে কি না বিবেচনা করা হবে।’ এই বিবেচনা এখনো করা হয়নি। লারমার এই আহ্বান বিবেচনায় নিলে অন্যরকম বাংলাদেশ আমরা পেতাম হয়ত। শাসকীয় চেয়ারে যারা বসে আছেন বা ক্ষমতাজীবী মানুষরা বলতে পারেন এটি এক অবান্তর প্রশ্ন। কিন্তু আমি বলব সংবিধানসম্মত এবং অত্যন্ত উঁচুমানের এবং মানবিক হৃদয়ের প্রশ্ন। আগেই বলেছিলাম, লারমার ভাবনা আলোর নিচে পড়ে থাকা অন্ধকার পৃষ্ঠে যারা দিনাতিপাত করে তাদের জন্য। সদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশের একজন সাংসদ শাসকদের জাত্যাভিমানী দৃষ্টিতে যিনি নগণ্য ও ক্ষুদ্র জাতির মানুষ, সেই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মাথায় ভর করা এই ভাবনাই লারমাকে সর্বজনীনতা দান করে। পাঠক বন্ধু ভাবতে পারেন, সদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশের ওই সময়ে ‘ভবঘুরে’দের সংখ্যা নির্ধারণের তাগাদা কেমন মানুষের মাথায় আসতে পারে! কেমন সমাজব্যবস্থা চেয়েছিলেন লারমা তা অত্যন্ত স্পষ্ট। কিন্তু সেই ভবঘুরেদের সংখ্যাটা আসলেই কত তা কি স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরও এই রাষ্ট্র তার হালখাতার হিসেবে রেখেছে? এই উত্তর খুঁজে পাওয়া যাবে রাজধানীর রাস্তায় রাস্তায়, রেলস্টেশনের জংশনে জংশনে। রাষ্ট্র যদি এদের হিসেবটা রাখত কিংবা লারমাকে অনুধাবন করত তাহলে কি এত বছর পরও রেলস্টেশন কিংবা পথের ধারে অবাধে এত মানুষকে পড়ে থাকতে হতো? আমি জানি না।
শহিদমিনারের পাদদেশটা শহিদের রক্তস্নাত। সেই রক্তস্নাত আঙিনায় তো রাতের আবছা আঁধারে ঘুমিয়ে পড়ে কত ভবঘুরের দল। মাঝে মাঝে জগন্নাথ হলের দক্ষিণ গেইট দিয়ে মেডিকেলের দিকে চা খাওয়ার খায়েশে বন্ধু, অগ্রজ, অনুজ নিয়ে বের হলেই এই চিত্র বেশ স্বাভাবিকভাবে চোখে পড়ে। এত মানুষের হাহকার, দৈন্যদশার পরেও বিটিবির পর্দায় বাতাবি লেবুর বাম্পার ফলন দেখে ভাবনাগুলো আরো জমাট বাঁধে। আর উন্নয়নের মরা জোয়ারে ভেসে যাওয়া দেশে এইসব মানুষের উন্নয়ন কি আসলেই হচ্ছে। সংবিধান কি আসলেই কাগুজে দলিল!
সংবিধানের পবিত্র দলিলের দ্বিতীয় ভাগে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির ১৫ নম্বর অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে মুদ্রিত রয়েছে- ‘It shall be a fundamental responsibility of the state to attain, through planned economic growth, a constant increase of productive forces and a steady improvement in the material and cultural standard of living of the people.’ অর্থাৎ, রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হবে পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বিকাশের মাধ্যমে উৎপাদন শক্তির ক্রমবৃদ্ধিসাধন এবং জনগণের জীবনযাত্রার বস্তুগত ও সংস্কৃতিগত মানের উন্নতি সাধন। এই যে জনগণের কথা বলা হয়েছে, এদের মধ্যে কি ভবঘুরেরা নেই! আদিবাসী প্রান্তিক মানুষ কি নেই! এটাই লারমার প্রশ্ন। কেবল তারা নয় লারমার প্রশ্ন ছিল হাওর-বাওর আর নদীর পানিতে নৌকা নিয়ে ভাসমান ‘বেদে’দের নিয়েও। প্রশ্ন ছিল পতিতালয় নিয়ে। এক সংসদীয় বিতর্কে ১৯৭৩ সালের ২৭ জুন লারমা সমাজকল্যাণ মন্ত্রীকে প্রশ্ন করেছিলেন পতিতালয় নিয়ে।
লারমার উক্ত কথাগুলো ছিল এরকম- ‘সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী অনুগ্রহ করিয়া বলিবেন কি, বাংলাদেশের যে যে শহরে পৌর কর্তৃপক্ষের অনুমতিপ্রাপ্ত পতিতালয় চালু আছে সেসব শহরের প্রত্যেকটিতে অনুমোদিত বারবণিতার সংখ্যা কত?’ এমনকি এইসব পতিতালয়ের পতিতা নারীদের পুনর্বাসনের জন্য কোনো ব্যবস্থা গ্রহণে সরকার ইচ্ছা রাখেন কি না জানতে চাওয়া হলে তৎকালীন সমাজকল্যাণমন্ত্রী চট্টগ্রামের এমপি জহুর আহমদ চৌধুরী জবাবে বলেছিলেন, ‘তথ্যগুলো সংগ্রহ করা হচ্ছে।’ এভাবে পাশ কাটিয়ে উপেক্ষা করা হয়েছিল লারমাকে। যিনি উপেক্ষিত মানুষের, বঞ্চিত মানুষের জীবনের কথা বলেন, তিনিও উপেক্ষার শিকার। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার সংসদে রাখা সেই বক্তব্য ‘জনাব স্পিকার সাহেব, নিষিদ্ধপল্লিতে যারা পড়ে আছে, তাদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। পণ্যদ্রব্যের মতো অসহায় অবস্থায় তারা নিজের জীবনকে তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে।’ তিনি আরো অনুরোধ করেছিলেন, যাতে আইন করে একটি পরিকল্পনার মাধ্যমে এই অসহায় নারীদের সমাজে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়, যাতে তারা খেয়ে-পরে বেঁচে থাকতে পারে এবং প্রকৃত মানুষের মতো সমাজে বাস করতে পারে। কিন্তু তাঁর এই আকুতিতে রাষ্ট্রের তৎকালীন শাসকদের মন ভরেনি। যার ফলে এখন অনেক পতিতালয়ে অনেক নারীর অসহায় দুর্বিষহ জীবন পড়ে আছে নির্মমভাবে। পাহাড়ে নারীদের অবাধ পদচারণা ছিল। স্বাধীন সত্তায় হেসে-খেলে যাপন করা পাহাড়ি আদিবাসী নারীর সেই দিনযাপনের চিত্র এখন ভিন্ন। পাহাড়ের বর্ণাঢ্য সব রিসোর্টের আড়ালে কত নারীর কান্না যে হাহাকার করছে, তার খবর কি এ রাষ্ট্র রাখে! সাজেক, নীলগিরি কিংবা নীলাচলের পর্যটনেও অনেকের হাহাকারের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি শুনি। এই রাষ্ট্রব্যবস্থা এমনভাবে পরিচালিত হচ্ছে যেখানে এই হাহাকারপূর্ণ জীবনকে জাতে তোলার প্রয়াসের চেয়ে এই দিকে ধাবিত করার প্রক্রিয়াটাই বেশি। সিস্টেমটাই এই পতিতাদের নিষিদ্ধপল্লিতে আবদ্ধ করে দুর্বিষহ জীবনে সামিল করেছে। অথচ মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা অনেক আগেই এই বঞ্চিতদের কথা বলে গিয়েছিলেন।
এই সমাজব্যবস্থা নারীদের যথাযথ সম্মান করতে জানে না। লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার হয়ে অনেক নারী নিজেদের অধিকার থেকে বঞ্চিত। তাদের অধিকারের প্রশ্নে সংসদে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা বলেছিলেন, ‘সমাজে একজন পুরুষ যে অধিকার ভোগ করে একজন নারীও সেই অধিকার ভোগ করবে।’ এ ধরনের মানবতাবাদী ও সাম্যবাদী দর্শনই ধারণ করতেন এই মানুষটি।
৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। এই সংখ্যাগরিষ্ঠদের নিয়েই স্বাধীনতার পর গঠিত হয় গণপরিষদ। লারমা ছিলেন এই সংখ্যাগরিষ্ঠের বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকা একজন সংখ্যালঘু। মাত্র দু-তিন জন সদস্যের তিনি একজন, যারা কিনা আওয়ামী ঘরানার বাইরে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য নিয়ে গণপরিষদে বসেছিলেন বিশাল সংখ্যার পাশে। কাজেই আজকের সংসদ দেখলেই বোঝা যেতে পারে কী একচ্ছত্র প্রতাপের মধ্যে লারমা তাঁর বক্তব্য রেখেছিলেন অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো আপন গতিতে। নানা বাধা ও উপেক্ষা সত্তে¡ও সংবিধান বিতর্কের সময় তিনি পাহাড়ের বঞ্চিত মানুষের পাশাপাশি যাদের কথা তুলে ধরেছিলেন তা তাঁকে যারা পাঠ করেছেন, আত্মস্থ করার চেষ্টা করেছেন তাঁর জীবন, তারাই কেবল জানবে। পাহাড় তথা সমতলের আদিবাসী মানুষের পরিচয়ের স্বীকৃতি তথা অধিকারের গ্যারান্টি চাওয়া এই মানুষটি ১৯৭২-এর ২৫ অক্টোবর গণপরিষদ বিতর্কে সংবিধান বিলের উপর তাঁর সাধারণ আলোচনার শেষে বলেছিলেন, ‘এই সংবিধানে মানুষের মনের কথা লেখা হয়নি। কৃষক, শ্রমিক, মেথর, কামার, কুমার, মাঝি-মাল্লার জন্য কোনো অধিকার রাখা হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় (আদিবাসী) জনগণের অধিকারের কথাও সংবিধানে লেখা হয়নি।’
আওয়ামী টিকেটে এমপি হওয়া সেই বৃহৎ নৃগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী অনেকের প্রবল বাধা ও বিরোধিতার মুখে দাঁড়িয়েও লারমা তাঁর মনের কথাগুলো সাবলীলভাবে বলেছেন সর্বজনীন ভাবনা দিয়ে।
তাঁর সংসদীয় বিতর্কের কথাগুলোর মধ্যে আমাকে আশ্চর্যান্বিত করেছে জেলখানার কয়েদিদের নিয়ে রাখা তাঁর বক্তব্যকে ঘিরে। কারাগারে তৃতীয় শ্রেণির বন্দিদের অসহায়, দুর্বিষহ জীবনের কথা তিনি সংসদে তুলে ধরেছিলেন। নিজের অভিজ্ঞতার বয়ানে তিনি বলেছিলেন, ‘একখানা থালা আর দুইখানা কম্বল, এই হল জেলখানার সম্বল’। এ বিষয়ে একটা সাম্প্রতিক (অপেক্ষাকৃত) উদাহরণ উল্লেখ করা যেতে পারে। দুর্নীতির অভিযোগে খালেদা জিয়াকে যখন সাজা দিয়ে কারাগারে প্রেরণ করা হলো, তখন তাঁকে যে কারাগৃহে অন্তরীণ করে রাখা হয় সেটা নিয়ে বিএনপির সিনিয়র নেতাদের অনেক আপত্তি আর অভিযোগ আমরা মিডিয়ার কল্যাণে শুনতে পেয়েছি। খালেদা জিয়ার ডিভিশন পাওয়া না পাওয়া নিয়ে পক্ষ-প্রতিপক্ষের নানা বক্তব্য গণমাধ্যমে এসেছে। কারাগৃহটির অবস্থা এবং একজন ভিআইপি বন্দির জন্য প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধাদি খালেদার স্তুতিকারী নেতাদের মনোপুত হয়নি। হবে না সেটাই স্বাভাবিক। নেত্রী বলে কথা। আমার কথা সেটা নয়। আমার কথা ওবায়দুল কাদের সাহেবের বক্তব্য বিষয়ে। তাঁর বক্তব্য হলো, ‘কারাগার তো কোনো আরাম আয়েসের জায়গা নয়।’ হ্যাঁ, জেলখানা আরাম আয়েসের জায়গা নয়। কিন্তু লারমার ভাবনাটা অন্যরকম। তাঁর মতে জেলখানা হলো, কোনো অপরাধে বন্দি মানুষকে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে আসার সুন্দর ব্যবস্থা। তাঁর অভিযোগ জেলে যেসব আসামি থাকে, তাদের জন্য এমন কোনো ব্যবস্থা নেই যে, তারা জেল থেকে ফিরে এসে সৎ জীবনযাপন করতে পারে। ১২ বৎসরের যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদÐপ্রাপ্ত আসামি বৃদ্ধ বয়সে জেল জীবন কাটিয়ে এসে আর কোনো আলোর মুখ দেখে না বলেও লারমার ভাবনা। জেল বিষয়ে তাঁর তুলে ধরা এই ভাবনাচিত্র বর্তমানেও বদলায়নি। এই সমাজব্যবস্থায় আমরা দেখতে পাই অনেক সময় প্রকৃত অপরাধীর সাজা হয় না। অনেক মানুষের সাজা হয় তাকে শোধরানোর জন্য নয়, বরং তা হয় রাজনৈতিক প্রতিশোধ নেয়ার জন্য। যার জন্য আমরা দেখি জেল থেকে ফিরে আসা আসামিদের সমাজে পুনর্বাসনের কোনো সুব্যবস্থা এই সমাজে নেই। আর এতেই আমরা দেখি অপরাধী বারবার অপরাধ করে যাচ্ছে, আর সমাজ হয়ে যাচ্ছে বিশৃঙ্খলদের রাজ্য।
লারমা কেবল মানুষের কল্যাণের কথা ভাবেননি। ভেবেছেন প্রাণী, পরিবেশ তথা প্রতিবেশের কথাও। তাঁর সাথে জীবন বদলানোর লড়াইয়ে সামিল হওয়া সাবেক গেরিলা ¯স্নেহ কুমার চাকমার আত্মজীবনী ‘জীবনালেখ্য’ থেকে জানা যায়, সহকর্মী গেরিলা যাঁরা ছিলেন তাঁদেরকে নিয়ে বনের ভেতর যে ছড়াগুলো থাকত সেগুলোতে মাছ আর চিংড়ি শিকারে যেতেন লারমা। ছড়া হচ্ছে পাহাড়ের কোনো প্রান্ত থেকে সৃষ্ট পানির ছোট বা মাঝারি প্রবাহ। এই পানির প্রবাহই পাহাড়ি মানুষের সুপেয় পানির অন্যতম উৎস ছিল। পাশাপাশি সেখান থেকে ছড়ার মাছ, কাঁকড়া, চিংড়ি, শামুককের সংস্থান করত পাহাড়ি মানুষ। কালের পরিক্রমায় এ উৎসগুলো কমে গেলেও এখনো সেসব ঝিরি-ঝরনা, ছড়ার পানির প্রবাহে অনেকেই মাছ ধরতে যায়। তো বিশেষ বাস্তবতায় মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে বন-পাহাড়ে যে গেরিলা জীবন নিয়ে হাজারো জুম্ম যুবক যাপন করেছিলেন ত্যাগময় কঠিন জীবন, সে জীবনের কিছু স্মৃতি পড়েছিলাম ‘জীবনালেখ্য’ গ্রন্থে। তিনি বলছিলেন এরকমভাবে, একদা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা বনের ভেতর প্রবহমান ছড়ায় মাছ, চিংড়ি ধরতে গিয়েছিলেন অনেক সহকর্মীকে সাথে নিয়ে। ছড়ার স্রোতের প্রবাহে বাঁধ দিয়ে সেই বাঁধের ভেতর পানি সিঞ্জন করে মাছ আর চিংড়ি ধরছিলেন। এক পর্যায়ে মাছ-চিংড়ির নির্ধারিত ঝুড়িটিতে চোখ বুলালেন লারমা। আর জিজ্ঞেস করলেন খাওয়ার মানুষের সংখ্যা কত! প্রশ্নের জবাব পাওয়া সংখ্যার সাথে সংগৃহীত মাছ-চিংড়ির পরিমাণের পর্যাপ্ততা দেখে লারমা বললেন বাঁধ ভেঙে দিয়ে মাছ-চিংড়ি ধরা বন্ধ করতে। যদিও বাঁধ দেওয়া নির্ধারিত পরিধির মধ্যে আরো যথেষ্ট মাছ ও চিংড়ি ছিল। এই বাস্তবতা দেখে হতবাক হলেন অন্য সহকর্মীরা। অন্য এক সময় ব্যারাকে থাকা রাঁধুনি গোলা, মারিচা (এক ধরনের বেত)-এর কচি আগাগুলি কুচি কুচি করে কেটে রান্না করেছিলেন উপস্থিত সবার জন্য। এ ধরনের ব্যাঞ্জন পাহাড়ি মানুষের কাছে খুবই প্রিয় ও মুখরোচক। স্বভাবতই সবাই খেতে চায়। কিন্তু বনের মধ্যে এসব খুবই বিরল। তাই লারমার সোজাসাপ্টা বিরুদ্ধাচরণ। বনজ সম্পদের মধ্যে এগুলো দুষ্প্রাপ্য ও মূল্যবান এবং এসব পরিপক্ক হতে বেশ সময় লাগে। ফলে বৃদ্ধি কম হয় এবং উজাড় হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি থাকে। অন্যদিকে কারুশিল্পে এইসব বেতের চাহিদা অত্যধিক বলে এগুলোর সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্বারোপ করে পরিবেশবাদী এই লারমা গুরুতর আপত্তি জানান, এসব যেন পরবর্তী সময়ে রান্নার উনুনে না ওঠে।
লারমার অন্য এক সহকর্মীর লেখা থেকে জানতে পারি লারমার এ পরিবেশবাদিতার কথা। লারমার সহকর্মী গেরিলারা নাইট মাচিং-এ বের হলে নাকি ছড়া থেকে কাঁকড়া ধরে দাঁড় (হাত)গুলো ভেঙে নিয়ে আসতেন। আর স্বভাবজাত প্রক্রিয়ায় একজন পাহাড়ি হিসেবে আগুনে পুড়িয়ে খেতেন। এসব দেখে লারমার ঘোরতর আপত্তি। তিনি সহকর্মীদের বলতেন, ‘তোমাদের হাতগুলো কেটে নিলে তোমরা কীভাবে আহার করবে?’ এই ছিল মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার অন্য প্রাণীর প্রতি অগাধ প্রেম এবং অন্যের জীবনের সংগ্রামকে নিজের করে অনুভব করার প্রবণতা। গেরিলা জীবনে নানা ত্যাগ আর তিতিক্ষার মধ্যে গেরিলারা নিজেদের আহার সংস্থানের জন্য বনের নানা কিছু শিকার করে টিকে থাকার লড়াইয়ে রত ছিলেন। এ বাস্তবতায় তাঁরা হরিণও শিকার করে খেতেন। কিন্তু এক ব্যর্থ শিকারের কথা একই লেখায় জানতে পারি এভাবে। সেটা হলো, একদা জুমে এক হরিণ ধরা পড়েছিল। কিন্তু লারমা সেই হরিণ ছেড়ে দিতে বলেছিলেন। কেননা, সেই হরিণটি ছিল মাদী হরিণ। এ ধরনের অসংখ্য জীবন্ত উদাহরণ আমরা লারমাকে পাঠ করে জানতে পারি। কাজেই জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের প্রতি লারমার কী পরিমাণ সচেতনতা এবং মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল তা উক্ত ঘটনাপ্রবাহগুলো বিশ্লেষণ করলে নিশ্চিত হতে পারি এবং পরিমাপ করতে পারি মানবিক হৃদয়ের মানুষ হিসেবে লারমার উচ্চতাকে। এছাড়া, তিনি নাকি অপ্রয়োজনীয় গাছ এবং বাঁশ কাটতেও নিষেধ করতেন। তিনি বলতেন, বন হচ্ছে পশুপাখির আবাসভূমি। আমরা আমাদের জাতীয় অস্তিত্ব ও আবাসভূমির অস্তিত্বের লড়াই করতে পশুপাখিদের আবাসভূমিতে আশ্রয় নিয়েছি। কাজেই পশুপাখিদের নিধন করা যাবে না। তাদেরকে সাথে নিয়েই একসাথে সহাবস্থানের কথা বলতেন এই পরিবেশবাদী, প্রকৃপ্রেমী ও মানবিক লারমা।
এমনি এক মানবিক হৃদয়ের মানুষকে জাত্যাভিমানী শাসকরা নিজেদের স্বার্থে বিচ্ছিন্নতাবাদী, উগ্রপন্থী, সন্ত্রাসীসহ নানা তকমায় অভিষিক্ত করলেও তাঁর এই লড়াই যে বিশ্বের সকল নিপীড়িত মানুষের তা আজ প্রমাণিত। লারমাকে যারা আত্মস্থ করার চেষ্টা করেন এবং তাঁকে অনুশীলন করার চেষ্টা করেন কেবল তাঁরাই উপলব্ধি করবে এই মানবিক হৃদয়ের মানুষটির সর্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গি। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা স্পষ্টভাবে বলতেন যে, বাংলাদেশের বাঙালি জনগণ পাহাড়ি মানুষের শত্রু নয়। যারা পাহাড়ের নিপীড়িত মানুষের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে না এবং পাহাড়ি মানুষকে অধিকার দিতে চায় না এবং প্রতিক্রিয়াশীল কার্যকলাপে জড়িত হয় সে জুম্ম হোক বা অজুম্ম হোক এরাই পাহাড়ি জুম্ম জনমানুষের শত্রু। তাঁর এই বক্তব্যটি আরো স্পষ্ট, তিনি বলতেন ‘বাঙালিদের মধ্যেও আমাদের (জুম্মদের) বন্ধু আছে আর জুম্মদের মধ্যে আমাদের (জুম্মদের) শত্রু আছে।’
কাজেই এই লারমা যেমন পাহাড়ের তথা সমতলের সকল অধিকারবঞ্চিত আদিবাসী মানুষের, তেমনি এ লারমা বাংলাদেশের নিপীড়িত বাঙালি মাঝি-মাল্লা, রিক্সাচালক, মেথর, পতিতা, বেদে, জেলের কয়েদি এবং রেলস্টেশনের জংশনে জংশনে বা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে জীবন পার করা ভবঘুরে থেকে শুরু করে বিশ্বের সকল নিপীড়িতের এবং অধিকারবঞ্চিত জনতার। সেই সাথে সুইডিশ কিশোরী গ্রেটা থুনবার্গের প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষা করে জলবায়ুর হুমকি রোধের যে করণীয়ের কথা সাম্প্রতিক সময়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে, সে প্রসঙ্গটিতেও লারমা বেশ প্রাসঙ্গিক। সকলের জন্য সুন্দর একটি অসাম্প্রদায়িক, সাম্যবাদী আদর্শের মানবিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা তো বটেই, পুরো পৃথিবীটাকে বদলিয়ে সুন্দর ও সকলের আবাসযোগ্য একটি গ্রহে পরিণত করার লড়াইয়ে চিরবিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার সর্বজনীন ভাবনা এবং মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি একটি অগ্রণী মশাল। অথচ লারমার এ দৃষ্টিভঙ্গির সাথে ‘আধুনিক’ এ রাষ্ট্রের কত ফারাক, কত দূরত্ব তা আজ সমাজ তথা রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রত্যেকটি পরতে পরতে চোখে পড়ে। কাজেই মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার লড়াই ও সংগ্রাম বৃথা যেতে পারে না এবং ১০ নভেম্বরও হারিয়ে যেতে পারে না। দেদীপ্যমান এ লারমা সকলের, এ লারমা মানবিক পৃথিবীর।
সতেজ চাকমাঃ শিক্ষার্থী; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়