পিসিপির উদ্যোগে ঢাকায় নবীন বরণ অনুষ্ঠিত
সতেজ চাকমাঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি মিলনায়তনে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ ঢাকা মহানগরের উদ্যোগে ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ ঢাকাস্থ বিভিন্ন পাবলিক এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের বরণ অনুষ্ঠান এবং মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক পরিবেশনা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
উক্ত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. নাসরীন আহমদ। এছাড়া সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. খায়রুল চৌধুরী এবং বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় স্টাফ সদস্য অনন্ত বিকাশ ধামাই, বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সাধারন সম্পাদক অলীক মৃ এবং পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় স্কুল ও পাঠাগার বিষয়ক সম্পাদক পলাশ চাকমা প্রমুখ।
পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের ঢাকা মহানগর শাখার সাধারন সম্পাদক রেঙ ইয়ং ম্রো এর পরিচালনায় এবং সভাপতি নিপন ত্রিপুরার সভাপতিত্বে উক্ত আয়োজনে শুরুতেই জাতীয় সংগীত ও সংগঠনের দলীয় সংগীত পরিবেশন করা হয়।এছাড়া নবীন শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে মানপত্র পাঠ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের মেধাবী শিক্ষার্থী রাতুল ত ঙ্গ্যা এবং নবীনদের পক্ষে মানপত্র গ্রহন করে স্বীয় অনুভূতি ব্যক্ত করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান প্রথম বর্ষের মেধাবী শিক্ষার্থী দনওয়াই ম্রো।
দনওয়াই ম্রো তাঁর সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বলেন, “আমি এমন এক প্রত্যন্ত পাহাড়ী জনপদ থেকে উঠে এসেছি যেখানে এতবড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করার স্বপ্ন দেখাটা খুবই অবান্তর ছিল। পরিবার থেকে দীর্ঘ ১২ বছর দূরে থেকে নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে এতদূর আসতে সক্ষম হয়েছি”। পাহাড়ের বাতিঘর খ্যাত ‘মৌনঘর’ থেকে শিক্ষা গ্রহন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন বান্দরবানের চিম্বুক পাহাড়ের এই মেধাবী শিক্ষার্থী।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় স্কুল ও পাঠাগার বিষয়ক সম্পাদক বলেন, পাহাড় আগের যেকোনো সময়ের চাইতে এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। এই ক্রান্তিকালীন সময় থেকে উত্তোরণের একমাত্র অবলম্বন নবীন তারুণ্যের দ্রোহী প্রতিরোধ। তিনি নবীন শিক্ষার্থীদেরকে পড়ালেখা শেষে বিবর্ণ পাহাড়ে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানান।
এছাড়া বিশেষ অতিথির বক্তব্যে আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সাধারন সম্পাদক অলীক মৃ বলেন, শাসক গোষ্ঠী পাঠ্য পুস্তকে আদিবাসীদের সহজ-সরল বলে তুলে ধরে। কিন্তু সবচেয়ে দমন পীড়ন জারী রাখে এই আদিবাসীদের উপর। তিনি আদিবাসী শিক্ষার্থীদের আগামী দিনের দেশ ও জাতির কান্ডারী হিসেবে গড়ে ওঠার আহ্বান জানান।
অন্যদিকে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় স্টাফ সদস্য অনন্ত বিকাশ ধামাই বলেন, দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে পড়াশুনা করা জুম্ম শিক্ষার্থীদের প্রধান লক্ষ্য কেন শুধু বিসিএস হবে। যেখানে অন্যান্য শিক্ষার্থীরা নাসা থেকে শুরু করে বিশ্বের বিভিন্ন প্লাটফর্মে নিজেদের মেধা এবং যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখছেন সেখানে পাহাড়ের জুম্ম শিক্ষার্থীরা কেন এই সীমাবদ্ধ গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ থাকবে। তিনি নবীন শিক্ষার্থীদেরকে পাহাড়ের সংকট উত্তোরণে ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান।
সম্মানিত অতিথির বক্তব্যে ঢাবির সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. খায়রুল চৌধুরী বলেন, ‘জাতিভেদ একটি ঐতিহাসিক বিকাশ। জাতিরাষ্ট্র গঠনের সাথে সাথে পৃথিবীর মানুষ দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। রাষ্ট্রভিত্তিক জাতি এবং রাষ্ট্রবিহীন জাতি। এই রাষ্ট্র বিহীন জাতির মানুষরাই হল আদিবাসীরা।’ এছাড়া তিনি বলেন, ১৮৬০ সালের আগে পাহাড়ে কোনো ‘রাষ্ট্র’ ছিল না।
তিনি সাম্প্রতিক জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে আরো বলেন, বিশ্বের আদিবাসীরা টিকে না থাকলে বিশ্ব যেমন টিকবে না তেমনি বাংলাদেশের আদিবাসীরা টিকে না থকলে বাংলাদেশও টিকে থাকতে পারবে না। আদিবাসীদের জীবনের লড়াইয়ে সমগ্র মানব জাতির টিকে থাকার লড়াই বলেও উল্লেখ করেন বিশিষ্ট এই আদিবাসী গবেষক।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যারয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) ড. নাসরীন আহমদ বলেন, পাহাড় থেকে উঠে এসে যারা এই শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠে পড়ে তাদের দায়টা একটু বেশী। কাজেই পাহাড়ী শিক্ষার্থীরা যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ঢাকাস্থ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পড়াশুনা করে তাদেরকে কেবল মাত্র বিসিএস-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে দেশের বিভিন্ ক্ষেত্রে নিজেদের মেধার স্বাক্ষর রাখতে হবে। স্বপ্ন দেখেই এতদূর আসতে পেরেছ বলে দাবী করে তিনি নবীন শিক্ষার্থীদেরকে স্বপ্ন হারিয়ে না ফেলার অনুরোধ জানান।
উক্ত অনুষ্ঠানের সভাপতি নিপন ত্রিপুরা’র সমাপনি বক্তব্যের পরপরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জুম সাহিত্য ও সাংস্কতিক সংসদ এবং ঢাকাস্থ বিভিন্ন উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জুম্ম শিক্ষার্থদের পরিবেশনায় অনুষ্ঠিত হয় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। ‘ঘুনধুম থেকে ধুধুকছড়ার বিবর্ণ পাহাড়ের ডাক, প্রতিরোধের মশাল হোক জুম নবীনের হাঁক’ এই স্লোগানে অনুষ্ঠিত হওয়া উক্ত আয়োজন সমাপ্ত হয় শতাধিক নবীন জুম্ম শিক্ষার্থীকে ফুল এবং ক্রেষ্ট বিতরণের মধ্য দিয়ে।