মতামত ও বিশ্লেষণ

পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি সমস্যা এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশনের কার্যক্রম ও আশু করণীয়: মঙ্গল কুমার চাকমা

এক. পটভূমি
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে অবস্থিত পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট আয়তন ৫,০৯৩ বর্গমাইল (১৩,৩১৮ বর্গকিলোমিটার)। যদিও পার্বত্য চট্টগ্রামের আয়তন সমগ্র বাংলাদেশের এক-দশমাংশ কিন্তু নিবিড় চাষাবাদযোগ্য জমির পরিমাণ অত্যন্ত কম। ১৯৬৪-৬৬ সনে কানাডার ফরেস্টাল ফরেস্ট্রি এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্টারন্যাশন্যাল লিমিটেড এর ভূমি জরিপ রিপোর্ট অনুযায়ীপার্বত্য চট্টগ্রামের চাষযোগ্য ধান্য জমির (‘এ’ শ্রেণিভুক্ত) পরিমাণ পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট জমির মাত্র ৩.০৭% অর্থাৎ ৭৬,৪৬৬ একর। এছাড়া ‘বি’ শ্রেণিভুক্ত ঢালু জমিগুলো রয়েছে মোট জমির ২.৭২% অর্থাৎ ৬৭,৮৭১ একর যেগুলো সোপান কৃষিকাজের জন্য ব্যবহার করা যায়। আর ‘সি’ শ্রেণিভুক্ত জমি রয়েছে পার্বত্যাঞ্চলের মোট জমির ১৪.৭১% (৩,৬৬,৬২২ একর) যেগুলো মূলত উদ্যান চাষের জন্য ব্যবহার করা যায়। পার্বত্য চট্টগ্রামে সবচেয়ে বেশী রয়েছে ‘ডি’ শ্রেণিভুক্ত জমি যা পার্বত্যাঞ্চলের মোট জমির ৭২.৯১% অর্থাৎ ১৮,১৬,৯৯৩ একর। ‘ডি’ শ্রেণিভুক্ত জমিগুলো কেবল বন ও বনায়নের জন্য উপযোগী। আরো রয়েছে সি-ডি শ্রেণিভুক্ত ৩২,০২৪ একর (১.২৮%) জমি। এছাড়া ৬৫৩ একর বসতভিটা (০.০৩%) এবং ১,৩১,৬৩৭ একর জলাশয় ভূমি (৫.২৮%) রয়েছে। সুতরাং পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট ভূমির পরিমাণ ২৪,৯২,২৬৬ একর। তবে মনে রাখতে হবে যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের জমি দেশের সমতল জমির মতো উর্বর ও বহু ফসলী নয়।
পার্বত্য চট্টগ্রামে দু’টি প্রধান ভূমি প্রশাসন ব্যবস্থা রয়েছে। একটি হচ্ছে রিজার্ভ ফরেস্টের জন্য এবং অন্যটি হচ্ছে বাদবাকি এলাকার জন্য। রিজার্ভ ফরেস্ট যা পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট অঞ্চলের এক-চুতর্থাংশের সামান্য কম তা পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়াধীন বন বিভাগের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। বাদবাকি এলাকাগুলো নিয়ন্ত্রিত হয় বিশেষ শাসনব্যবস্থার অধীনে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান, প্রথাগত প্রতিষ্ঠান ও সরকারি প্রশাসন কর্তৃপক্ষের সংমিশ্রণে ব্যবস্থাপনার দ্বারা, যার মধ্যে রয়েছে রাজা, হেডম্যান এবং কার্বারীর মতো প্রথাগত প্রতিষ্ঠান, জেলা পর্যায়ে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ ও অঞ্চল পর্যায়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ। তবে ভূমি ব্যবস্থাপনা এখনো জেলা প্রশাসনও যুক্ত রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ অঞ্চল পর্যায়ে সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান হিসাবে জাতীয় পর্যায়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কাছে দায়বদ্ধ থাকে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি মোতাবেক ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনার বিষয়টি পার্বত্য জেলা পরিষদের হস্তান্তরিত বিষয় হলেও এখনো তিন পার্বত্য জেলার জেলা প্রশাসকরা এই ক্ষমতা প্রয়োগ করে চলেছেন।

দুই. পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি সমস্যা
পার্বত্য চট্টগ্রামে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ এমনিতেই অত্যন্ত কম। অধিকন্তু ১৯৬০ সালে কাপ্তাই বাঁধ নির্মিত হওয়ার ফলে প্রথম শ্রেণী আবাদী জমির ৪০ শতাংশ (৫৪ হাজার একর জমি) এই বাঁধের পানিতে তলিয়ে যায়। আবাদী জমির স্বল্পতার কারণে পুনর্বাসন করা সম্ভব হয়নি ১৯৬০ সালে কাপ্তাই বাঁধে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারসমূহকে। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিরাজ করছে শত শত ভূমিহীন পরিবার। কিন্তু সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রচুর আবাদযোগ্য জমি রয়েছে এই প্রতারণামূলক প্রচারণা চালিয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ১৯৭৯ সাল থেকে দেশের সমতল জেলাগুলো হতে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়ে আসে চার লক্ষাধিক বহিরাগত লোক এবং তাদেরকে বসতি দেয়া হয় জুম্মদের ভোগ দখলীয় ও রেকর্ডীয় জমির উপর। নানা ষড়যন্ত্রমূলক তৎপরতার মাধ্যমে জুম্মদেরকে উচ্ছেদ করে তাদের জমিগুলো বেদখল করে নেয়া হয় প্রচলিত আইন ও প্রথা লঙ্ঘন করে। তাই পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় একটি জলন্ত অগ্নিকুন্ড।
রাবার প্লান্টেশন, বন বাগান, ফলবাগানসহ হর্টিকালচারের নামে পার্বত্য জেলার স্থায়ী বাসিন্দা নয় এমন ব্যক্তির নিকট আদিবাসী জুমচাষীদের প্রথাগত জুমভূমি, জুম্মদের রেকর্ডীয় ও ভোগদলীয় ভূমি দীর্ঘমেয়াদী লীজ দেওয়া হয়েছে। কেবলমাত্র বান্দরবান জেলায় ১৬০৫টি রাবার প্লট ও হর্টিকালচার প্লট-এর বিপরীতে প্লটপ্রতি পঁচিশ একর করে ৪০,০৭৭ একর জমি ইজারা দেওয়া হয়েছে বলে জানা যায়। এছাড়া সশস্ত্র বাহিনীর ক্যাম্প স্থাপন ও সমপ্রসারণ এবং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনের নামে হাজার হাজার একর জমি পদ্ধতি বহির্ভূতভাবে অধিগ্রহণ করা হয়েছে কিংবা অধিগ্রহণের উদ্যেগে নেয়া হয়েছে। কেবলমাত্র বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলায় এ ধরনের সামরিক উদ্দেশ্যে ৭১,৮৭৭.৪৫ একর অধিগ্রহণ বা বেদখল করা হয়েছে। অধিকন্তু রিজার্ভ ফরেস্ট ও সংরক্ষিত বনাঞ্চল গঠনের কার্যক্রমের অংশ হিসেবে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় ২৫ জুন ১৯৯০ থেকে ৩১ মে ১৯৯৮ তারিখের জারিকৃত বিভিন্ন গেজেট প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ২,১৮,০০০ (দুই লক্ষ আটার হাজার) একর জমি অধিগ্রহণের উদ্যোগ গ্রহণ করে। তিন পার্বত্য জেলায় পর্যটন কেন্দ্র স্থাপনের নামে শত শত একর জায়গা-জমি অধিগ্রহণ ও জবরদখল করা হচ্ছে। এছাড়া জুম্মদের আইনের অজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে, জালিয়াতির মাধ্যমে, দাদনের ফাঁদে ফেলে, সামরিক ও ভূমি প্রশাসনের প্রভাব খাটিয়ে, বান্দরবানে কথিত ‘আর’ কবুলিয়তের মাধ্যমে ইত্যাদি নানা অসৎ উপায়ে জুম্মদের জায়গা-জমি হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে।
ভূমি হারানোর ফলে হাজার হাজার পার্বত্য অধিবাসী, বিশেষ করে জুম্ম অধিবাসী নিজ বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদ হয়ে পড়েছে এবং তাদের চিরায়ত জুম ভূমি হারিয়ে তাদের জীবন-জীবিকা বিপন্ন হয়ে পড়েছে। জুম্মদের পাশাপাশি তিন পার্বত্য জেলার অনেক স্থায়ী বাঙালি অধিবাসীও তাদের স্ব স্ব জায়গা-জমি হারিয়েছে এবং ভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে পড়েছে।

তিন. পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ও ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির বিধান
পার্বত্য চট্টগ্রামের এই মৌলিক সমস্যাকে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতি অনুসারে সমাধানের লক্ষ্যে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে একটি ভূমি কমিশন গঠন করার বিধান করা হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ‘ঘ’ খন্ডের ৪নং ধারায় উল্লেখ আছে যে, “জায়গা-জমি বিষয়ক বিরোধ নিষ্পত্তিকল্পে একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে একটি কমিশন (ল্যান্ড কমিশন) গঠিত হইবে। পুনর্বাসিত শরণার্থীদের জমি-জমা বিষয়ক বিরোধ দ্রুত নিষ্পত্তি করা ছাড়াও এযাবৎ যেইসব জায়গা-জমি ও পাহাড় অবৈধভাবে বন্দোবস্ত ও বেদখল হইয়াছে সেই সমস্ত জমি ও পাহাড়ের মালিকানা স্বত্ব বাতিলকরণের পূর্ণ ক্ষমতা এই কমিশনের থাকিবে। এই কমিশনের রায়ের বিরুদ্ধে কোন আপিল চলিবে না এবং এই কমিশনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলিয়া বিবেচিত হইবে। ফ্রীঞ্জল্যান্ড (জলেভাসা জমি) এর ক্ষেত্রে ইহা প্রযোজ্য হইবে।”
চুক্তির ৫নং ধারায় সংশ্লিষ্ট সার্কেল চীফ বা তাঁর প্রতিনিধি, আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান বা তাঁর প্রতিনিধি, সংশ্লিষ্ট পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং বিভাগীয় কমিশনার বা তাঁর প্রতিনিধির সমন্বয়ে কমিশন গঠনের বিধান রয়েছে। কমিশনের মেয়াদ তিন বছর হবে। তবে আঞ্চলিক পরিষদের সাথে পরামর্শ করে কমিশনের মেয়াদ বৃদ্ধি করা যাবে বলে উল্লেখ রয়েছে। ভূমি কমিশন “পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতি অনুয়ায়ী বিরোধ নিষ্পত্তি করিবেন” বলে চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

চার. পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি অনুসারে ১৯৯৯ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশন গঠিত হয়। এই ধারা অনুযায়ী এ যাবৎ নিম্নোক্ত ব্যক্তিদের কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে-
(১) ৩ জুন ১৯৯৯ অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি জনাব আনোয়ারুল হক চৌধুরীকে ল্যান্ড কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি কার্যভার গ্রহণের আগে ৬ ডিসেম্বর ১৯৯৯ মৃত্যুবরণ করেন।
(২) ৫ এপ্রিল ২০০০ অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি জনাব আব্দুল করিমকে চেয়ারম্যান পদে নিযুক্তি দেওয়া হয়। তিনি ১২ জুন ২০০০ কার্যভার গ্রহণ করেন। কার্যভার গ্রহণের পর তিনি একবার মাত্র খাগড়াছড়ি জেলায় সফর করেন। তারপর তিনিও শারীরিক অসুস্থতার কারণে চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এরপর প্রায় দেড় বছর ধরে চেয়ারম্যান পদ শূণ্য থাকে।
(৩) বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ২৯ নভেম্বর ২০০১ অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মাহমুদুর রহমানকে কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ প্রদান করা হয়। তিনিও ২০০৭ সালের নভেম্বরে মারা যান। এরপর ড. ফখরুদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যান নিয়োগ করেনি।
(৪) আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ১৯ জুলাই ২০০৯ অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি খাদেমুল ইসলাম চৌধুরীকে ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৮ জুলাই ২০১২ তাঁর মেয়াদ শেষ হওয়ার পর দুই বছরের অধিক কমিশনের চেয়ারম্যান পদ শূণ্য থাকে।
(৫) দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর গঠিত নতুন সরকার কর্তৃক গত ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ তারিখে কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আনোয়ার-উল হককে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
বিগত ১৭ বছরে পাঁচজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০০১ এর বিরোধাত্মক ধারাগুলো সংশোধন না হওয়ার কারণে কমিশনের কাজ এতদিন শুরু করা যায়নি।
উল্লেখ্য যে, তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রাক্কালে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সাথে কোনরূপ আলোচনা না করে তড়িঘড়ি করে ২০০১ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন পাশ করেছিল। ফলে উক্ত আইনে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির সাথে অনেক বিরোধাত্মক বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়। তারপর থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও নাগরিক সমাজ ভূমি কমিশন আইনের এই বিরোধাত্মক ধারাগুলো সংশোধনের জন্য একদিকে সভা-সমিতির মাধ্যমে সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছে, অন্যদিকে সরকারের সাথে একের পর এক বৈঠক অনুষ্ঠিত করে আসছে। বর্তমান সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত ধারাবাহিক অনেক বৈঠকের পর ২০১১ এবং ২০১৫ সালে দুইবার সরকার ও আঞ্চলিক পরিষদের মধ্যে ১৩-দফা সংশোধনী প্রস্তাবাবলী সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও তদনুসারে উক্ত ভূমি কমিশন আইন সংশোধনের প্রক্রিয়া এক রহস্যজনকভাবে দীর্ঘদিন ধরে ঝুলিয়ে থাকে।
অবশেষে গত ১ আগস্ট ২০১৬ তারিখ পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০০১ এর বিরোধাত্মক ধারা সংশোধনকল্পে মন্ত্রীসভার নিয়মিত বৈঠকে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন (সংশোধন) আইন ২০১৬ ভেটিং সাপেক্ষে চূড়ান্ত অনুমোদন করা হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় মহামান্য রাষ্ট্রপতির সম্মতি সাপেক্ষে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক ৯ আগস্ট “পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০১৬” নামে উক্ত সংশোধনী আইনের প্রজ্ঞাপন জারী করা হয়েছে। এর ফলে ভূমি কমিশনের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির কাজ শুরু করার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে।

পাঁচ. ভূমি কমিশনের কার্যাবলী
পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০০১ (২০১৬ সংশোধিত) এর ৬ ধারায় ভূমি কমিশনের কার্যাবলী ও ক্ষমতা সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে। উক্ত ৬ ধারায় বলা হয়েছে যে-
“(১) কমিশনের কার্যাবলী নিম্নরূপ হইবে, যথা:-
(ক) পুনর্বাসিত শরণার্থীদের ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ এবং অবৈধ বন্দোবস্ত ও বেদখল হওয়া ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতি অনুযায়ী নিষ্পত্তি করা;
(খ) আবেদনে উল্লেখিত ভূমিতে আবেদনকারী, বা ক্ষেত্রমত সংশ্লিষ্ট প্রতিপক্ষের, স্বত্ব বা অন্যবিধ অধিকার পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতি অনুযায়ী নির্ধারণ এবং দখল পুনর্বহাল;
(গ) পাবর্ত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতি বহির্ভূতভাবে জলেভাসা ভূমিসহ (Fringe Land) কোন ভূমি বন্দোবস্ত প্রদান বা বেদখল করা হইয়া থাকিলে উহা বাতিলকরণ এবং বন্দোবস্তজনিত বা বেদখলজনিত কারণে কোন বৈধ মালিক ভূমি হইতে বেদখল হইয়া থাকিলে তাহার দখল পুনর্বহাল:
তবে শর্ত থাকে যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতি অনুযায়ী অধিগ্রহণকৃত ভূমি এবং বসতবাড়ীসহ জলেভাসা জমি, টিলা ও পাহাড় ব্যতীত কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প এলাকা ও বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ এলাকার ক্ষেত্রে এই উপ-ধারা প্রযোজ্য হইবে না।
(২) উপ-ধারা (১)-এ বর্ণিত কার্যাবলী পার্বত্য চট্টগ্রামে সীমিত থাকিবে।
(৩) উক্ত কার্যাবলী সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের নিমিত্ত কমিশন যে কোন সরকারী বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থার কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় তথ্য, উপাত্ত বা কাগজপত্র সরবরাহের এবং প্রয়োজনে উক্ত কর্তৃপক্ষের যে কোন কর্মকর্তাকে স্থানীয় তদন্ত, পরিদর্শন বা জরিপের ভিত্তিতে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিতে পারিবে এবং উক্ত কর্তৃপক্ষ বা কর্মকর্তা উহা পালনে বাধ্য থাকিবেন।
(৪) কমিশন বা চেয়ারম্যান বা কমিশন কর্তৃক ক্ষমতাপ্রদত্ত কোন সদস্য যে কোন বিরোধীয় ভূমি সরজমিনে পরিদর্শন করিতে পারিবেন।”
পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০০১ এর ৭ ধারার (৪) উপধারায় উল্লেখ রয়েছে যে, “কোন বৈঠকে বিবেচিত বিষয় অনিষ্পন্ন থাকিলে উহা পরবর্তী যে কোন বৈঠকে বিবেচনা ও নিষ্পত্তি করা যাইবে এবং সংশ্লিষ্ট পূর্ববর্তী বৈঠকে উপস্থিত সদস্যগণের কাহারও অনুপস্থিতির কারণে বিষয়টির নিষ্পত্তি বন্ধ থাকিবে না বা নিষ্পত্তি সংক্রান্ত কার্যক্রম অবৈধ হইবে না। তবে শর্ত থাকে যে, উক্তরূপ বিবেচনা ও নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে কমিশনের সকল সদস্যকে বৈঠকের পূর্বে নোটিশ প্রদান করিতে হইবে।”
উক্ত ৭ ধারার (৫) উপধারায় বর্ণিত রয়েছে যে, “চেয়ারম্যান উপস্থিত অন্যান্য সদস্যদের সহিত আলোচনার ভিত্তিতে ধারা ৬(১)-এ বর্ণিত বিষয়টিসহ উহার এখতিয়ারভুক্ত অন্যান্য বিষয়ে সর্বসম্মতির ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিবে, তবে সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব না হইলে চেয়ারম্যানসহ উপস্থিত সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের গৃহীত সিদ্ধান্তই কমিশনের সিদ্ধান্ত বলিয়া গণ্য হইবে।”
আইনের ১৬ ধারায় ‘কমিশনের সিদ্ধান্তের আইনগত প্রকৃতি এবং চূড়ান্ততা’ সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, “কোন বিষয়ে দাখিলকৃত আবেদনের উপর কমিশন প্রদত্ত সিদ্ধান্ত দেওয়ানী আদালতের ডিক্রী বলিয়া গণ্য হইবে, তবে উক্ত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোন আদালত বা অন্য কোন কর্তৃপক্ষের নিকট আপিল বা রিভিশন দায়ের বা উহার বৈধতা বা যথার্থতা সম্পর্কে কোন প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না।”
আইনের ১৭(১) ধারায় ‘কমিশনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন’ সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, “অন্য কোন আইনে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, কমিশনের সিদ্ধান্ত দেওয়ানী আদালতের ডিক্রী, বা ক্ষেত্রমত, আদেশের ন্যায় কমিশন উহার কর্মকর্তা ও কর্মচারীর মাধ্যমে বা প্রয়োজনবোধে সরকারী কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করিতে বা করাইতে পারিবে।”

ছয়. পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতি
এ অঞ্চলের সাধারণ প্রশাসনিক ব্যবস্থার মতো পার্বত্যাঞ্চলের ভূমি ব্যবস্থাপনাও দেশের অন্যান্য অঞ্চলের ভূমি ব্যবস্থাপনা থেকে সম্পূর্ণ পৃথক ও আলাদা। বিশেষত: ব্রিটিশ শাসনামল হতে পার্বত্য চট্টগ্রামের শাসনব্যবস্থা ও ভূমি ব্যবস্থাপনা পরিচালিত হয়ে এসেছে বিশেষ আইনের আওতায়। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির আলোকে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশেষ শাসন কাঠামো এবং আলাদা ভূমি ব্যবস্থাপনা স্থাপিত হয়েছে। এ শাসনব্যবস্থায় জাতীয় পর্যায়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়, অঞ্চল পর্যায়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও জেলা পর্যায়ে তিনটি পার্বত্য জেলা পরিষদ গঠিত হয়েছে। পার্বত্য জেলা পরিষদের উপর ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা কার্যাবলী অর্পণ করা হয়েছে। আঞ্চলিক পরিষদ তা তত্বাবধান ও সমন্বয় সাধন করতে পারে এবং সরকার পক্ষ হতে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় তা সম্পাদন করতে পারে।
পার্বত্যাঞ্চলের শাসন ব্যবস্থা বরাবরই দেশের অপরাপর সমতল অঞ্চলের শাসনব্যবস্থা হতে পৃথক। অনুরূপভাবে এ অঞ্চলের ভূমি ব্যবস্থাপনাও সমতল জেলাগুলো থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। পার্বত্য চট্টগ্রামে মূলত: তিন ধরনের ভূমি রয়েছে। প্রথমত: বন্দোবস্তকৃত ব্যক্তিগত মালিকানাধীন ভূমি যা বেশীর ভাগই ধান্য জমি। দ্বিতীয়ত: ভোগদখলীয় জমি যা বেশীর ভাগই বাস্তুভিটা, বাগানবাগিচা ইত্যাদির ভূমি। তৃতীয়ত: রেকর্ডীয় বা ভোগদখলীয় কোনটাই নয় এমন ভূমি যা জুমভূমি নামে খ্যাত ও প্রথাগতভাবে সংশ্লিষ্ট মৌজা অধিবাসীদের সমষ্টিগত মালিকানাধীন। অর্থাৎ মৌজা এলাকায় অবস্থিত ভূমির মধ্যে ব্যক্তি নামে বন্দোবস্তকৃত বা ভোগদখলীয় ভূমি ব্যতীত অন্য সকল ভূমিই মৌজাবাসীর। রাজা-হেডম্যান-কার্বারী নিয়ে গঠিত প্রথাগত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এসব ভূমি ব্যবস্থাপনা পরিচালিত হয়ে থাকে। তাই মৌজার অধিবাসী যে কোন ব্যক্তি হেডম্যানের অনুমতি নিয়ে মৌজাস্থিত সমষ্টিগত মালিকানাধীন জমিতে জুম চাষ, গো-চারণ, গৃহস্থালী কাজে ব্যবহার্য বনজ দ্রব্যাদি সংগ্রহ ইত্যাদির অধিকার রয়েছে। এজন্য জুমচাষীরা পরিবার ভিত্তিক জুম খাজনাও দিয়ে থাকে। জুমভূমি সমষ্টিগত মালিকানাধীন বিধায় জুম খাজনা জমি ভিত্তিক না হয়ে, মূলত: মাথাপিছু ভিত্তিক ক্যাপিটাশন ট্যাক্স হিসেবে ধার্য হয়ে থাকে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধির ৪১ ও ৪২ নং বিধিতে জুমচাষ সম্পর্কে এবং ৪৩ নং বিধিতে সার্কেল চীফ ও মৌজার হেডম্যানের জমির খাজনা আদায় ও মওকুফের বিধান বিবৃত হয়েছে। এসব বিধি বলে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীনে বন্দোবস্তকৃত বা অধিগ্রহণকৃত ভূমি ব্যতীত অন্য সকল ভূমির উপর মৌজার অধিবাসীদের ঐতিহ্যগত মালিকানা স্বত্ব বহাল থাকে। স্বাভাবিকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে কোন ভূমি ব্যক্তি মালিকানাধীনে বন্দোবস্তকৃত না হয়ে থাকলেও মৌজায় স্থায়ীভাবে বসবাসরত কোন ব্যক্তি কর্তৃক দখল বা চাষাবাদ করা হয়ে থাকলে তাকে দখলকার বা চাষাবাদকারী হিসাবে প্রচলিত রীতিতে উক্ত ভূমির মালিক হিসাবে গণ্য করা হয়ে থাকে।
কোনো মৌজার অন্তর্ভুক্ত প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারের পূর্বে সংশ্লিষ্ট হেডম্যানের পরামর্শ নেওয়ার বিধানটি উক্ত মৌজার প্রাকৃতিক সম্পদের উপর আদিবাসী জনগণের অধিকারেরই স্বীকৃতি। প্রত্যন্ত এলাকায় অধিবাসী, বিশেষ করে মৌজার হেডম্যান এবং কার্বারীর নেতৃত্বে এ ধরনের প্রথা ও রীতি চর্চা করে আসছে। এসব প্রথা বা রীতি অলিখিত বা মৌখিকভাবে জাতিগোষ্ঠী ভেদে ভিন্ন নিয়মে প্রচলিত হয়ে আসছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রথাগত আইনগলো লিখিত আইন বা নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে স্বীকৃত হয়েছে অথবা লিখিত আইনে পরিণত হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০০১ এর ২ ধারার (ছ) দফায় বলা হয়েছে যে, “প্রচলিত আইন” বলিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে এই আইন বলবৎ হইবার পূর্বে যে সমস্ত আইন, ঐতিহ্য, বিধি, প্রজ্ঞাপন প্রচলিত ছিল কেবলমাত্র সেইগুলিকে বুঝাইবে।” ভূমি সংক্রান্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইনগুলো হচ্ছে-
ক পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি ১৯০০ (১৯০০ সনের ১নং আইন)
খ পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন, ১৯৯৮
গ রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন, ১৯৮৯ (১৯৯৮ সালে সংশোধনীসহ)
ঘ খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন, ১৯৮৯ (১৯৯৮ সালে সংশোধনীসহ)
ঙ বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন, ১৯৮৯ (১৯৯৮ সালে সংশোধনীসহ)।
পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি বন্দোবস্তী, হস্তান্তর ইত্যাদির ক্ষেত্রে এক বিশেষ পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয়। এই পদ্ধতি পার্বত্য চট্টগ্রামের আইন ও প্রথার উপর প্রতিষ্ঠিত। পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি ১৯০০ এর ৩৪ ধারা অনুসারে সার্কেলের আওতাধীন ভূমি বন্দোবস্তের ক্ষেত্রে মৌজা প্রধানের সুপারিশ ও মতামত গ্রহণের বিধান রাখা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের আইন ও রীতি মোতাবেক মৌজা প্রধানের সুপারিশ ও মতামত ব্যতীত মৌজাধীন কোন জায়গা জমি বন্দোবস্ত হতে পারে না।

সাত. আবেদনপত্র দাখিলের পদ্ধতি
পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০০১ এর ৯ ধারায় কমিশনের কাছে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির আবেদন দাখিল সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য সংশ্লিষ্ট আবেদনকারী তাঁর দস্তখত বা টিপসইযুক্ত দরখাস্ত সাদা কাগজে বাংলা ভাষায় লিখে কমিশনের কাছে দাখিল করবেন। আইনে আরো বলা হয়েছে যে, কমিশন কর্তৃক উক্ত আবেদন নিষ্পত্তির পূর্বে যে কোন সময় ন্যায় বিচারের স্বার্থে, কমিশনের অনুমতি সাপেক্ষে, আবেদনকারী তাঁর আবেদন সংশোধন করতে পারবেন।
ভূমি কমিশন আইনের ১০(১)(২) ধারায় আবেদনের প্রতিপক্ষ সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, দায়েরকৃত প্রতিটি আবেদনে প্রতিপক্ষ হিসেবে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক, অবৈধ বন্দোবস্ত গ্রহীতা এবং ক্ষেত্রমত আবেদনকারীর জানামতে দাবীকৃত ভূমির বর্তমান দখলকার-এর নাম ও ঠিকানা উল্লেখ করতে হবে। উক্ত আবেদনের প্রতিপক্ষ হিসেবে উল্লেখিত সকল ব্যক্তির উপর কমিশন নোটিশ জারী করবে এবং নোটিশের সাথে আবেদনপত্রের একটি কপিও সংযুক্ত করবে।
উল্লেখ্য যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের চেয়ারম্যানের বরাবরে আবেদনপত্র লেখতে হবে। এরপর বিষয় উল্লেখ পূর্বক আবেদনকারী বা বাদীর নাম, পিতার নাম ও ঠিকানা উল্লেখ করতে হবে। তার নীচে প্রতিপক্ষ বা বিবাদীর নাম, পিতার নাম ও ঠিকানা, সংশ্লিষ্ট জেলার জেলা প্রশাসক এবং ক্ষেত্রমতে জমি দখলদারের নাম ও ঠিকানা উল্লেখ করা আবশ্যক। এরপর কিভাবে জমি বেদখল হয়েছে, বেদখলের ক্ষেত্রে কে বা কারা জড়িত ছিলেন, কখন বা কোন সময়ে বেদখল করা হয়েছে, ভূমির পরিমাণ ও চৌহদ্দি, কোন প্রকার বা শ্রেণির ভূমি, সংশ্লিষ্ট ভূমির খতিয়ান নম্বর, হোল্ডিং ও দাগ নম্বর (যদি থাকে) ইত্যাদি উল্লেখ পূর্বক প্রতিকার চেয়ে বা ভূমি ফেরত পাওয়ার আর্জি জানিয়ে আবেদনপত্র সমাপ্ত করতে হবে। আবেদনপত্রের সাথে প্রয়োজনীয় সহায়ক দলিলাদি (যদি থাকে) যেমন- জমাবন্দী বা বন্দোবস্তীর কবলা, খাজনা দাখিলা, ডকেট নম্বর সম্বলিত দলিল (আবেদন) ইত্যাদি সংযুক্ত করা অত্যাবশ্যক।
আইনের ১০(৩) ধারায় আরো উল্লেখ রয়েছে যে, প্রতিপক্ষ হিসেবে উল্লেখ করা হয়নি এমন কোন ব্যক্তিও সংশ্লিষ্ট কারণ উল্লেখ পূর্বক প্রতিপক্ষ হওয়ার আবেদন করতে পারবেন এবং কমিশন উক্ত আবেদন বিবেচনাক্রমে উক্ত ব্যক্তিকে প্রতিপক্ষভুক্ত করতে পারবে।
ভূমি কমিশন আইনের ১১ ধারায় কমিশন কর্তৃক সাক্ষ্য গ্রহণ সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, কার্যাবলী সম্পাদনের নিমিত্ত কমিশনের কোন কার্যক্রমে সাক্ষ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট পরিসি’তি অনুসারে কমিশন যেইরূপ যথাযথ বিবেচনা করে সেইরূপ সাক্ষ্য গ্রহণ ও লিপিবদ্ধ করতে পারবে। কোন বিষয়ে সাক্ষ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে কোন ব্যক্তি বাংলা ব্যতীত অন্য কোন ভাষায় সাক্ষ্য প্রদান করলে কমিশন একজন অনুবাদকের সহায়তা গ্রহণ করতে এবং অনুবাদকের অনুবাদ অনুসারে উক্ত সাক্ষ্য বাংলায় লিপিবদ্ধ করবে। আরো বলা হয়েছে যে, কমিশন লিখিত নোটিশ দ্বারা যে কোন ব্যক্তিকে উহার সম্মুখে উপস্থিত হয়ে সাক্ষ্য প্রদান এবং সকল প্রকার তথ্য ও দলিল-পত্রাদি দাখিলের নির্দেশ দিতে পারবে। কমিশন কর্তৃক কোন ব্যক্তির মৌখিক সাক্ষ্য হুবহু লিপিবদ্ধ করা বাধ্যতামূলক নয়, বরং উহার সারাংশ লিপিবদ্ধ করলেই চলবে বলে আইনে উল্লেখ রয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের কার্যালয় থেকে ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ইস্যুকৃত গণবিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি বিরোধ সংক্রান্তে কোন অভিযোগ থাকলে এই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের ৪৫ পঁয়তাল্লিশ) দিনের মধ্যে সংক্ষুব্ধ যে কোন ব্যক্তি ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন, ২০০১ এর ৯ ধারার বিধান মোতাবেক আবেদনকারী তাঁর দখস্তখত বা টিপসহিযুক্ত দরখাস্ত সাদা কাগজে সরাসরি অথবা প্রতিনিধির মাধ্যমে অথবা ডাকযোগে কমিশনের কাছে আবেদন দাখিল করতে পারবেন।

আট. আশু করণীয়
পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি-বাঙালি স্থায়ী অধিবাসীরা সাধারণত আইন সম্পর্কে তেমন একটা ওয়াকিবহাল নন। মামলা-মোকদ্দমা, আইন-আদালত, বিচার প্রক্রিয়া সম্পর্কে তাদের তেমন কোন যথাযথ ধারণা নেই। ফলে অনেকে কিভাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের কাছে বিরোধ নিষ্পত্তির আবেদন দাখিল করবেন সে সম্পর্কে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব-এর মধ্যে রয়েছেন। এছাড়া কিভাবে আবেদনপত্র লেখবেন, আবেদনপত্রে কী কী বিষয় উল্লেখ করা আবশ্যক, আবেদনপত্রের সাথে কোন সহায়ক দলিল সংযুক্ত করতে হবে কিনা বা করতে হলে কী কী দলিল সংযুক্ত করা বাঞ্ছনীয়, কাকে বা কাদেরকে প্রতিপক্ষ বা বিবাদী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে, কোন প্রকার ভূমি বিরোধ আবেদনযোগ্য বা আবেদনযোগ্য নয় ইত্যাদি বিষয়ে অনেকে জানতে চান। এমনকি ভূমি কমিশনের ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬ তারিখের গণবিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখিত ৪৫ দিনের মধ্যে আবেদন দাখিল করতে না পারলে পরবর্তী আবেদন করার সুযোগ পাওয়া যাবে কিনা সে বিষয়ে মানুষের জানার আগ্রহ রয়েছে। এমতাবস্থায় পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন এবং কমিশনের কার্যাবলী সম্পর্কে জনসচেতনতা গড়ে তোলা ও সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সহায়তা করা অত্যন্ত জরুরী বলে বিবেচনা করা যায়। তাই ভূমি কমিশনের কার্যক্রমকে যথাযথভাবে এগিয়ে নেয়া তথা পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি সমস্যার যথাযথ সমাধানের লক্ষ্যে আশু করণীয় হলো-
ক পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন সম্পর্কে জনগণকে যথাযথ ধারণা প্রদান করা;
খ ভূমি বিরোধের নিষ্পত্তি চেয়ে আবেদনপত্র লেখা ও দাখিল করার ক্ষেত্রে সহায়তা প্রদান করা;
গ পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতি সম্পর্কে প্রথাগত প্রতিষ্ঠান, জনপ্রতিনিধি ও সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিদেরকে সচেতন করা;
ঘ সংক্ষুব্ধ, ক্ষতিগ্রস্ত ও ভুক্তভোগী ব্যক্তিদের আইনী, কারিগরী ও লজিষ্টিক সহায়তা প্রদান করা;
ঙ ভূমি কমিশনের কার্যাবলী সম্পর্কে কায়েমী স্বার্থান্বেষী মহলের নানা অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্র সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করা।
……………………………..
তারিখ: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬।
মঙ্গল কুমার চাকমা; তথ্য ও প্রচার সম্পাদক, জনসংহতি সমিতি

Back to top button